কমিকসের আবেদন চিরন্তন, জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। রঙিন মলাটের কমিকস বই কে না ভালবাসে বলুন তো? ছোট বেলায় বাচ্চাদের কার্টুন দেখার সাথে সাথে কমিকস পড়া যেন একটা নতুন পাওয়া খেলনার মতোই ছিল। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর-যৌবনেও এর নেশা কাটাতে পারে না অনেকেই। বয়সের সাথে সাথে কমিকস পড়ার আবেদন কমতে থাকলেও ছেলেবেলায় পড়া অ্যাসটেরিক্স, টিনটিন, অরণ্যদেব, টারজান, হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট কিংবা চাচা চৌধুরীর কমিক্সগুলো আজও হাতের কাছে পেলে বয়স্করাও কি একটু নস্টালজিক হয়ে পড়েন না!
‘কার্টুন’ কথাটি এসেছে ইতালির ‘কার্তোন’ শব্দ থেকে। যার অর্থ হলো পেস্ট বোর্ড। খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা প্যাপিরাসে আঁকা একটি ক্যারিকেচারকে প্রথম কার্টুন হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
সোয়াশ’ বছর আগে কমিকসের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু কমিকসের আদিরূপ কার্টুন তখন বেরিয়ে গেছে। ক্যারিকেচার-কার্টুন-কমিক স্ট্রিপ-কমিকস এই পর্ব পার হতে লেগেছে প্রায় ১০০ বছর।
কমিকস বই বা কমিকস ম্যাগাজিন প্রচলনের ইতিহাসটাও কিন্তু খুব বেশি দিন আগের নয়। একসময় শুধুমাত্র খবরের কাগজেই কোনো এক প্রাত্যহিক ঘটনা নিয়ে ব্যঙ্গচিত্রধর্মী কার্টুন পত্রিকার পাতায় শোভা পেত। ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার সম্পাদক যোসেফ পুলিৎজার সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসাবে কমিকসের তাৎপর্য ও ক্ষমতা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। আরো কিছুদিন পর পত্রিকায় পাঠকের চাহিদা দেখে বিদেশের বিভিন্ন নামী পত্রিকা থেকে সিরিজ হিসেবে প্রতিদিন কমিকস প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সেসব কমিকস ছিল মূলত সাদা-কালোয়।
এদিকে ১৮৯৫ সালে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিচার্ড আউটকোল্টের সম্পাদনায় ‘The Yellow Kid’ শীর্ষক রঙিন কমিক স্ট্রিপকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত প্রথম কমিকস এবং প্রথম রঙিন কমিক স্ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কমিকস বই সকলের হাতে পৌঁছে দেয়ার কথা কারও মনে তখনও আসেনি। কেউ ভাবতেই পারেনি কমিকসকে বই আকারেও প্রকাশ করা যেতে পারে।
কমিক স্ট্রিপগুলিকে একসাথে জড়ো করে বই আকারে প্রকাশ করার কথা প্রথম ভাবা হয় ১৯৩০ সালের দিকে। ১৯৩৩ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কমিক স্ট্রিপগুলো নিয়ে প্রথম কমিকস বই মুদ্রিত হয়, যার নাম ছিল ‘Famous Funnies’।
প্রথম দিকে এই বইগুলোতে খবরের কাগজে বের হওয়া কমিকসই ছাপানো হত। কিন্তু সে অবস্থা বেশি দিন থাকেনি। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে কমিকস প্রকাশনা সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব চিত্রকাহিনী ছাপতে শুরু করে।
১৯৩৮ সালে জেরি সিগেল আর জো শাস্টার একটি কাল্পনিক চরিত্র ‘সুপারম্যান’কে কমিকস বই আকারে প্রকাশ করেন। মাত্র ১৭ বছরের বালক সিগাল লিখেছিলেন ‘সুপারম্যান’ কমিকসটি। আর ছবি এঁকেছিলেন তারই বন্ধু শাস্টার।
একদিকে কল্পনার অতিমানব, আবার বাস্তবে একজন রক্তমাংসের সাংবাদিক- এই দ্বৈত স্বত্তার সংমিশ্রণই সাধারণ মানুষের কাছে সুপারম্যানকে হিরো করে তুলেছিলেন এই দুজন। এই বই প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে কমিকস দুনিয়ায় এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে। গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতার পাশাপাশি জন্ম নেয় এক নতুন সৃষ্টিশীল মাধ্যমের। অবিশ্বাস্যভাবে ছোট বাচ্চা থেকে আমজনতা সকলের নিকট এই কমিকস বই সাদরে গৃহীত হয়।
১৯৩৯ এর শুরুর দিকে একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে নানা ব্যতিক্রমধর্মী সুপার হিরো ভিত্তিক কমিকস। ব্যাটম্যান, দ্যা হিউম্যান টর্চ, ক্যাপ্টেন আমেরিকা প্রমুখ অতি মানবিক সুপার হিরোরা চিত্র কাহিনীর পৃষ্ঠায় বেশ জাঁকিয়ে রাজত্ব করতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিকসের বইগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে ছোট-বড় সব বয়সীদের মধ্যে। এমনকি সৈনিকরাও তখন কমিকস পড়তে ভালোবাসতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, মার্কিন মহামন্দার তীব্র হতাশার মধ্যে এইসব অ্যাকশনধর্মী কমিকসে মানুষ আশার আলো খুঁজতে শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের পর থেকেই আবার কমিকসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। ভাটা পড়তে শুরু করে কমিকস বইয়ের বিক্রিতে। চিন্তা বাড়তে থাকে কমিকস প্রকাশনা সংস্থা সমূহের। বিক্রি বাড়ানোর জন্যে প্রকাশকরা তখন হিংস্রতা, আতঙ্ক ইত্যাদি বিষয় কমিকসে নিয়ে আসার দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। বলা বাহুল্য, এসব হিংস্রতা ও ভয়াবহ আতঙ্কের কাহিনী ছাপানোর জন্যে সাধারণ মানুষদের মধ্যে কমিকস নিয়ে এক ধরনের বিরূপ ভাব চলে আসে। অনেকেই প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেন। ১৯৫০ সাল অবধি এই বিরূপতা কাটেনি। পরবর্তীতে রীতিমতো সেন্সরশিপ জারি হয় এ ধরনের কমিকস বইয়ের উপর।
অবশেষে সেন্সরশিপের খাঁড়া এড়ানোর জন্যে সব কমিকস প্রকাশনা সংস্থা একত্রিত হয়ে গঠন করেন কমিকস কোড অথরিটি। এই সংস্থাই কমিকস শিল্পকে একদিকে যেমন ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে, তেমনি মাধ্যমটিকে ক্রমশ একঘেয়ে অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করেছে।
এইসব মার্কিন কমিকসের সর্বগ্রাসী প্রভাবের মধ্যেও জাপানি মাংগা সৃষ্টি করেছিল এক অনুপম চিত্রভাষা। ১৯৮৬ সালে এই শিল্পধারাটির একান্ত নিজস্বতা তৈরি হয়েছিল।
শুধুমাত্র বিনোদনই নয়, শিক্ষামূলক দিকও থাকে কমিকসে। বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্য, দুটোকেই এগিয়ে যেতে হলে নিত্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তেমনিভাবে কমিকসেও চলতে থাকল এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ‘ওয়াচম্যান’, ‘দ্য ডার্ক নাইট রিটার্নস’ এবং ‘মাউস’ এর মতো কালজয়ী চিত্র-উপন্যাস প্রকাশের মাধ্যমে কমিকস উন্নীত হল ‘নাইন্থ আর্ট’-এর মর্যাদায়।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কমিকস দুনিয়ায় আবার ঘটল সাফল্যের নতুন যাত্রা। মারভেল কমিকস নতুন ধরনের সুপার হিরোর কাহিনী ছাপাতে শুরু করল। ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’, ‘দ্যা ইনক্রেডিবল হাল্ক’ ও ‘ব্যাটম্যান’ এই নতুন ধরনের নায়ক।
একটা প্রজন্মে কিশোর বয়সীদের কাছে প্রচণ্ড সাড়া জাগিয়েছিল এই বইগুলি। তাদের তারুণ্য, সময় ও চিন্তা ধারার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল এগুলো। রবার্ট ক্রাম্ব, গিল বার্ট শেলটন, এক ক্লে উইলসন, আর্ট স্ফিগেল ম্যান, হার্জ প্রমুখ চিত্রকর কমিকস সৃষ্টিতে তাদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
বাংলা কমিকসের শুরুটাও কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। একসময় জনপ্রিয় ইংরেজি কমিকসগুলো বাংলায় অনুবাদ করে ছাপা হত। এর মধ্যে লি ফকের লেখা ‘ফ্যান্টম’ এর অনুবাদ ‘অরণ্যদেব’ বাঙালি পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ির আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা তখন যুগান্তরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। পরবর্তীতে ময়ুখ চৌধুরীর হাত ধরে বেশ কিছু বাংলা কমিকস প্রকাশিত হয়।
সার্থক বাংলা কমিকসের স্রষ্টা হিসেবে নারায়ণ দেবনাথের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সৃষ্ট ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘হাঁদা ভোঁদা’, ‘নন্টে ফন্টে’ সার্থক বাংলা কমিক চরিত্র হিসেব সকল বাঙালি পাঠকের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছে।
কমিকসের প্রতি সব বয়সী মানুষের ভালবাসা চিরকালীন। এটি এখন আর শুধু সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় আবদ্ধ নয়। সাহিত্যের অংশ হিসেবে কমিকস নিয়েও হয়েছে নতুন সব আন্দোলন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রঙ-বেরঙের কমিকস সারা পৃথিবীর মানুষকে বিনোদন দিয়ে চলছে এখনও।