মেরি হ্যাসকেল: কাহলিল জিব্রানের সৃষ্টির অন্তরালের কবি

স্রষ্টা প্রথমে আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর খেয়াল করলেন, আদম যেন অপূর্ণ। কী যেন এক হাহাকার আদমকে যাতনা দিয়ে বেড়াচ্ছিলো। এরপর স্রষ্টা সৃষ্টি করলেন ইভকে। মানুষ একা থেকে অনেক কিছু সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকে। আরেকজনের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হলে সে নিজের ভেতরের অনেক রূপ নতুনভাবে আবিষ্কার করে। এভাবেই যুগে যুগে প্রেম ভালোবাসা মানুষকে ‘মানুষ’ করেছে। মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছে, এই রক্ত মাংসের দেহের বাইরেও কিছু একটা আছে। সেই কিছু একটাই মানুষকে অন্য মানুষে পরিণত করে। আর কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এদের জীবনে প্রেম আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কাহলিল জিব্রান সাহিত্যের ইতিহাসের এক স্বপ্নীল নাম। অসংখ্য মানুষ জিব্রানকে ভালোবাসেন। তার লেখা কবিতা, আঁকা ছবি থেকে পান করে অমৃত সুধা। কাহলিল জিব্রান নামটি বললেই যে আরেকটি নাম অবধারিতভাবে সবার মুখে আসবে, তা হলো তার লেখা বই ‘দ্য প্রফেট’। ‘দ্য প্রফেট’ এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইগুলোর একটি। কিন্তু যে আরেকটি নাম তার সব সৃষ্টির আড়ালে রুধির ধারার মতো বহমান, তা হলো মেরি হ্যাসকেল। জিব্রানের জীবনে তিনি ছিলেন খুঁটির মতো। জিব্রানকে দিয়ে গেছেন ভালোবাসা আর সাহস। মেরির এই ভালোবাসার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে জিব্রানের সব কালজয়ী সৃষ্টি।

মেরি ছিলেন জিব্রানের ভালোবাসার মানুষ, সবচেয়ে কাছের বন্ধু, যাকে আশ্রয় করে জিব্রান তার অন্ধকার দিনগুলোকে পার করেছেন। তাদের মধ্যে কখনও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। বিয়ের চেয়ে তারা সম্পর্কের গভীরতাকে মূল্য দিয়েছেন বেশি। সারাজীবন একজন আরেকজনের সাথে থেকেছেন ছায়ার মতো করে। তাদের ভালোবাসায় একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে চিঠি। আধুনিক যুগে আমরা চিঠির কথা ভুলে গেলেও একসময় চিঠিই ছিলো যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। জিব্রান আর মেরির চিঠিগুলো ছিলো ভালোবাসায় সিক্ত আর প্রাজ্ঞতার আলোয় উদ্ভাসিত।

জিব্রানের একাকী সময়ের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মেরির চিঠিগুলো। হ্যাসকেলকে লেখা এক চিঠিতে জিব্রান বলছেন,

“প্রিয় মেরি, আমার যখন মন খারাপ থাকে তখন তোমার চিঠিগুলো পড়ি। আমি ছোট বাক্সের ভেতর থেকে দুটি অথবা তিনটি চিঠি বের করি এবং এগুলো বারবার পড়ি। চিঠিগুলো আমার নিজের আসল রূপের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা আমাকে জীবনের অধঃপতিত আর কদর্য রূপকে এড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। মেরি, আমাদের প্রত্যেকেরই আশ্রয়ের জন্য জায়গা দরকার। আমার আত্মার আশ্রয়স্থল হলো এমন একটা কুঞ্জবন যেখানে আমি তোমার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।”

কাহলিল জিব্রানের তুলিতে নিজের আত্মপ্রতিকৃতি ও তার ভালোবাসার মানুষ মেরি হ্যাসকেল; Source: brainpickings.org

জিব্রানের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মেরির হাত ছিলো। মেরি জিব্রানকে প্যারিসে চিত্রকলা নিয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি জোগাড় করে দেন। জিব্রান এজন্যই বলেছিলেন,

“এমন একটা সময় আসবে যখন আমি বলতে পারবো, আমি মেরির মাধ্যমেই চিত্রশিল্পী হয়েছি।”

মেরি আর জিব্রানের মধ্যে বয়সের বেশ পার্থক্য ছিলো। তাদের যখন প্রথমবারের মতো দেখা হয়েছিলো তখন জিব্রানের বয়স ছিলো একুশ আর মেরির বয়স ছিলো প্রায় একত্রিশ। এই বয়সই তাদের সম্পর্কে হয়তো আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। মেরি তার ডায়েরিতে লিখছেন,

‘কাহলিল সন্ধ্যাটা এখানে কাটিয়েছে। সে বলেছে আমাকে ভালোবাসে। যদি সম্ভব হয় আমাকে বিয়ে করবে। আমি বলেছি আমার বয়সের কারণে এটা অসম্ভব।”

গড়পড়তা অনেক সম্পর্কের মতো মেরিও বলেছিলেন যে, বিয়ে হলে হয়তো তাদের ভালো বন্ধুত্ব হয়তো নিছক এই প্রেমের কারণে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু পরদিন বিকেলে মেরি জিব্রানকে বিয়ের ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ বলে দেন।

তবে এই প্রেম তো আর দশটা সাধারণ প্রেম নয় যেখানে নিজের পাওয়াটাই হবে মূল কথা। মেরি নিজের স্বার্থের উর্ধ্বে জিব্রানের ভবিষ্যতের জন্য কোনটি ভালো হবে সেটাই চিন্তা করেছেন। মেরির মতো জিব্রানকে আর কেউ বুঝতে পারেনি। জিব্রানের প্রতিটি কাজের এক অনবদ্য সঙ্গী ছিলেন মেরি। জিব্রান লিখছেন,

“প্রিয় মেরি, তোমার কাছে কাউকে বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা আছে। তুমি জীবনদাত্রী। তুমি মহান আত্মার মতো যে কিনা শুধু কারও জীবন ভাগাভাগি করার জন্যই তার বন্ধু হয় না। বরং তার জীবনে কিছু যোগও করে। তোমার সাথে আমার পরিচয় হওয়াটাই আমার দিনরাত্রির কাছে একটা বিরাট কিছু। এটা প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরের এক অলৌকিক ঘটনা।”

জিব্রান আরও লিখছেন,

“তোমার আমাকে বুঝতে পারা আমার সবচেয়ে শান্তিময় স্বাধীনতা।”

জিব্রানের আত্মপ্রতিকৃতি; Source: brainpickings.org

মেরি জিব্রানকে বোঝেন বলেই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জিব্রানকে বিয়ের জন্য মানা করে দিলেন। তার মতে, জিব্রানের আসল বিবাহ হলো তার কাজ। তার ভয় ছিলো, তাদের মধ্যে বিয়ে হলে হয়তো তা জিব্রানকে তার আসল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করবে। তাই মেরি তার নিজের ভালোবাসাকে পরিণতি পেতে দেননি। আত্মোৎসর্গের এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। হৃদয়ের ভেতরকার সে কান্না থেকে মেরি তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন,

“আমি আমার মন ঠিক করে ফেলেছি। এটাই আমার কাছে ঈশ্বরের নির্দেশনা। যদিও প্রতিটি মুহূর্তে আমার অন্তর চক্ষু সিক্ত হয়েছে তবুও আমি জানি আমি যা করছি সেটাই সঠিক। এই কান্নার মানে ভবিষ্যতের জন্য আনন্দ, ভবিষ্যতের জন্য দুঃখ নয়। আমার জন্য কাহলিলের যে প্রেম রয়েছে তা থেকে অন্য এক ধরনের প্রেম তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে প্রেম স্বর্গীয়। এটাই হবে তার বিবাহ। তার সেরা কাজগুলো এখান থেকেই সৃষ্টি হবে। এটাই তার সেরা আনন্দ, তার পরিপূর্ণ জীবন এবং সেটা হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।”

মেরির সিদ্ধান্ত শুনে জিব্রান অনেক কাঁদলেন। খুব বেশি কিছু বলতে পারলেন না। কিন্তু জিব্রানও বুঝেছিলেন মেরি যা বলছেন সেটাই সঠিক। বিদায়ের সময় দরজায় দাঁড়িয়ে যখন মেরি কাঁদছিলেন তখন জিব্রান মেরির চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন,

“মেরি-মেরি-মেরি, তুমি আমাকে আজ রাতে এক নতুন হৃদয় দিলে।”

জিব্রানের আঁকা ছবি ‘দ্য স্পিরিট অফ লাইট’; Source: brainpickings.org

জিব্রান যাওয়ার পর মেরি এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলেন। সেই প্রশান্তিতে যেন জিব্রান ও মেরি এক হয়ে ছিলেন। মেরি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। মেরি তার ডায়েরিতে লিখছেন,

“এটা আমাদের আলাদা করেনি বরং আরও অনেক কাছে নিয়ে এসেছে।”

এভাবেই আত্মিকভাবে তাদের সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছিলো। বিয়ে না হয়েও যেন তারা আত্মার বিবাহে আবদ্ধ। জিব্রান লিখছেন,

“প্রিয় মেরি এখন আমি বিশ্রাম করতে যাচ্ছি। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে শুধু আমি তোমার কথা চিন্তা করবো।”

মেরিও ধীরে ধীরে আরও গভীরভাবে একাত্ম হচ্ছিলেন জিব্রানের সাথে। তাই মেরি লিখছেন,

“ঈশ্বর তোমাকে ভালোবাসার জন্য তার হৃদয় আমাকে ধার দিয়েছেন। আমি তখনই ঈশ্বরের কাছে তার হৃদয় চেয়েছি যখন আমি বুঝেছি আমার হৃদয় খুবই ছোট। ঈশ্বরের হৃদয়ই তোমাকে ধারণ করে এবং তোমাকে বেড়ে উঠতে সুযোগ করে দেয়।”

আমরা খুব কম মানুষের সাথে নীরবে সময় কাটাতে পারি। তার সাথেই নিরবে সময় কাটানো যায় যে আমাদের খুব কাছের। জিব্রান এক চিঠিতে মেরিকে লিখছেন,

“আমি তোমার সাথে নীরবে থাকতে ভালোবাসি।”

জিব্রানের সৃজনশীলতার অনুপ্রেরণা ছিলেন মেরি। জিব্রানের কালজয়ী ‘দ্য প্রফেট’ এর প্রচ্ছদ; Source: books.google.com

মেরি জিব্রানের সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন। জিব্রান অসুস্থ হয়ে পড়ায় যখন সৃজনশীল কাজ করতে পারছিলেন না তখন তার এই অবস্থার প্রেক্ষিতে মেরি লিখেন,

“তুমি চিত্রশিল্পী কিংবা কবি হবে এটা আমার বাসনা নয়। আমি চাই তুমি তাই হও যেটা তোমাকে অনুপ্রাণিত করে। তুমি যা-ই হও, কোনো কিছুই আমাকে আশাহত করতে পারবে না। তুমি কী হবে বা কী করবে এটা নিয়ে আমার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নেই। আমি তোমার ভবিষ্যতে দেখতে চাই না। আমি তোমাকে আবিষ্কার করতে চাই। তোমার কোনো কিছু আমাকে নিরাশ করতে পারে না।”

ভালোবাসার এমন উদারতা পেয়েছিলেন বলেই জিব্রান নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ভালোবাসার সেই আকাশে উড়ে বেরিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু সৃজনশীল মানুষ মাত্রই তাকে মানসিকভাবে যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে হবে। সৃষ্টির উল্লাস যেমন থাকবে, ধ্বংসের নাদও বাজবে অন্তরে। তাই যখন জিব্রান নিজের সৃষ্টি নিয়ে মানসিক যাতনায় ভুগছিলেন তখন মেরি জিব্রানকে লিখেছেন,

“তোমার কাজগুলো শুধু তোমার বই আর ছবি নয়। এগুলো তোমার কাজের অংশ। তোমার কাজ হলো তুমি নিজে। তোমার চেয়ে কমও নয়, তোমার অংশও নয়। এই দিনগুলোতে তুমি যখন কাজ করতে পারছো না এটাও তোমার কাজের অংশ। ঠিক যেমনই তুমি যখন কাজ কর। একে আলাদা করার কোনো উপায় নেই। তোমার জীবন হলো এর পুরোটাই। এর চেয়ে কম হলেই তা হলো তোমার জীবনের অংশ। তোমার নীরবতাই একসময় তোমার লেখার অংশ হবে। আর তোমার অন্ধকার হবে আলোর অংশ।”

এমনভাবেই মেরি আগলে রেখেছিলেন জিব্রানকে। ভালোবাসা যেন তথাকথিত সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে পেয়েছিলো এক অন্য মাত্রা। তাই তো জিব্রানের মতো করে কেউ হয়তো জীবন নিয়ে বলতে পারেন নি। জিব্রানের কাছে মেরির চিঠিগুলো ছিলো প্রাণসঞ্চারী। আর জিব্রানের ভাষায় মেরি তার কাছে ছিলেন জীবনদাত্রী। জিব্রান লিখছেন,

“প্রিয় মেরি, আমি যদি তোমাকে বলতে পারতাম তোমার চিঠিগুলো আমার কাছে কী! তারা আমার হৃদয়ে হৃদয় তৈরি করে। আমি এদের পড়ি এভাবে যেন জীবন আমার সাথে কথা বলছে। কীভাবে যেন চিঠিগুলো তখনই পাই যখন আমার এদের খুব দরকার। এই চিঠিগুলোর ফলেই আমরা আরও দিন, আরও রাত এবং আরও জীবন কামনা করি। যখন আমার হৃদয় শূন্য আর কম্পিত হয় তখন আমি চাই কেউ আমাকে বলুক সব শূন্য ও কম্পিত হৃদয়ের জন্য আগামীকাল এক নতুন আশা রয়েছে। মেরি, তুমি এই কাজটি সবসময় করো।”

জিব্রানের আঁকা চিত্র ‘ফোর ফেসেস’। যার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মেরি; Source: brainpickings.org

ফিচার ইমেজ: indiewire.com

Related Articles

Exit mobile version