বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হয় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি সময়কালের ব্যাপ্তিকে বলে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ। এর পরবর্তী দেড়শ বছর, অর্থাৎ ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। এই বিশাল সময়কালের কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, সেই সময় মানুষ মুখে মুখে সাহিত্য রচনা করতো, একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে সেই সাহিত্যকর্মের পরিচলন হতো, মানুষের মস্তিষ্কেই তা স্থায়ী হতো। লেখার চল ছিল না বললেই চলে। আর সে কারণেই কোনো মানুষের বিস্মৃতি বা মৃত্যুর মাধ্যমে সাহিত্যরাও হারিয়ে যেতো। এই বিস্মৃতির আঁধার হাতড়ে ঐতিহাসিকরা কিছু খুঁজে পাননি। আর তাই এ যুগের নাম হয়েছে ‘অন্ধকার যুগ’।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরও একটি অন্ধকার যুগ রয়েছে। তবে এই অন্ধকারের ধরণ ও নামকরণের কারণ আলাদা। ১৩৫০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত হলো বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ। এই মধ্যযুগের শেষের দিকে নামে সেই দ্বিতীয় আঁধার। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ বণিকদের হাতে বাংলা হারায় স্বাধীনতা। ১৭৬০ সালে মৃত্যু হয় মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের। সেই ভারতচন্দ্র, যিনি অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছিলেন, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।” ব্রিটিশ বণিকরা যখন শাসকে রূপান্তরিত হয়, তখন সুদীর্ঘকাল ব্যাপী স্থিতিশীল সমাজের ভিত্তিটি নড়ে ওঠে। আগে যারা ছিল সমাজের মাথা, তারা যশ আর প্রতিপত্তি হারিয়ে পিছিয়ে পড়ে। পিছিয়ে থাকা নিম্নস্তরের মানুষগুলো ব্যবসার সুবিধা নিয়ে আর ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। সমাজে উদ্ভব হয় নতুন ধনিকশ্রেণির। কিন্তু রাতারাতি আর্থিক মানদণ্ডের পরিবর্তন হলেও রাতারাতি এই শ্রেণিটির রুচির পরিবর্তন হয়নি। এই নব্য ধনিক গোত্র চাইতো উন্মত্ত আনন্দ। আর সেই চাহিদা পূরণ করতে উদ্ভূত হয় কবিগান ও কবিয়ালদের। বিশেষ কোনো সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য না থাকায় কবিগানের সময়টিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিতীয় অন্ধকার যুগ বলা হয়।
কবিয়ালরা ছিলেন কবিদের থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা। তারা বিশেষ গাম্ভীর্যপূর্ণ কোনো কবিতা তৈরি করতেন না। ক্ষণিকের আনন্দ দানের উদ্দেশ্যেই হতো তাদের কাব্য সৃজনের প্রয়াস। তারা কবিতা লিখতেন না, বিপক্ষের ছোঁড়া কটাক্ষ বা প্রশ্নের জবাব হিসেবে তাৎক্ষণিক মুখে মুখে রচনা করতেন কয়েকটি পংক্তি। কবিগানের পালায় থাকতো দুটি করে দল। প্রতি দলে থাকতো একজন করে কবি। এছাড়া দুই দল মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাতজনের মতো দোহার ও তিন-চারজন বাদক থাকতো। দুই দলের দুই কবি মুখোমুখি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অবতীর্ণ হতেন কবিতাযুদ্ধে। এক কবি প্রথমে অপর দলের কবিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নাকারে কোনো পদ্য ছুঁড়ে দিতেন। অপর কবি সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক একটি ছন্দ বানিয়ে পাল্টা জবাব দিতেন। প্রথম দলের কথাকে বলা হতো ‘চাপান’, আর দ্বিতীয় দলের কথাকে বলা হতো ‘উতোর’। পাঁচালি, খেউড়,আখড়াই, হাফ-আখড়াই, বসা কবিগান, দাঁড়া কবিগান, ঢপ, টপ্পা, কীর্তন, তর্জা প্রভৃতি ছিল কবিগানের বিভিন্ন ধরন। এসব পদ্যে রুচির খুব একটা চিহ্ন থাকতো না। একে অপরকে কথার আক্রমণে পর্যুদস্ত করে ক্ষণিকের আনন্দ লাভই ছিল মূল লক্ষ্য।
তবে কবিগানের শিল্পগুণও একেবারে অবহেলা করার মতো না। কবিগান একাধারে গান, কবিতা, বিতর্ক, সমালোচনা ও পর্যালোচনাও বটে। সাধারণ মানুষের নানা দ্বন্দ্ব, সমস্যা ও ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতেন কবিয়ালরা। শাস্ত্রীয় বহু প্রসঙ্গের মধ্যকার পরস্পরবিরোধী, অসামঞ্জস্যপূর্ণ উক্তি ও বক্তব্যগুলো দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে কবিয়ালরা বিষয়বস্তুর সত্যতার কাছে শ্রোতাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। আজও অধিকাংশ কবিয়ালদের মধ্যে ভাববাদের প্রাধান্য রয়েছে ও বিষয়বস্তুর মধ্যে আধ্যাত্মবাদ প্রধান স্থান দখল করে আছে। কবিগান আমাদের লোকসাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি লোকশিক্ষায় রেখেছে মূল্যবান অবদান। বাঙালির প্রাণের সামগ্রী, মানস সম্পদ, বাস্তব জীবানুভূতিসম্পন্ন লোকায়ত কবিগান গ্রামীন মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সামগ্রিক পরিমণ্ডল ব্যাপ্ত করে অবস্থান নিয়েছে। দেশপ্রেম আর মানবপ্রেম নিয়ে কবিগানে প্রচুর আলোচনা হয়। ভালো আর মন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মানুষের চিন্তাজগৎকে আলোড়িত করে এসব কবিগান। প্রকৃতি, পরিবেশ, নৈসর্গিকতা নিয়েও কবিগানে যথেষ্ট আলোচনা হয়। তবে সবার উপরে অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি কবিগানে বরাবর বহুলচর্চিত ও গীত হয়েছে। কবিগানের ধারাটি এখনও দুই বাংলায় গ্রামে ও শহরে প্রচলিত রয়েছে।
কবিগানের বিকাশ হয় ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে। এ পর্যন্ত একশ’রও বেশি কবিয়াল কবিগানের বিকাশে অবদান রেখেছেন। সবচেয়ে প্রাচীন যে কবিয়ালের নাম শোনা যায়, তিনি হলেন গোজলা গুঁই। এরপর নাম আসে রাম বসু, নৃসিংহ, রাসু, ভবানী, ভোলা ময়রা, হারু ঠাকুর, নিধুবাবু, কেষ্ট মুচি, হরিহরণ আচার্য, রামানন্দ নন্দী, রমেশ শীল, নকুল দত্ত, বিজয় সরকার, বিজয় নারায়ণ আচার্য, কালিদাস সরকার, রসিকলাল সরকার, নারায়ণ বালা, নিশিকান্ত সরকার, রাজেন্দ্র সরকার প্রমুখের নাম। একজন পর্তুগিজ বণিকও বাংলার নামজাদা কবি হয়েছিলেন। তিনি হলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।
কবিয়াল নিধুবাবুর পুরো নাম রামনিধি গুপ্ত। তার একটি বিখ্যাত গানের পংক্তি-
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা,
পুরে কি আশা?
রাম বসু ছিলেন হাওড়া জেলার মানুষ। তাকে প্রথম যুগের প্রতিনিধি বলা হয়। তার গুরু ছিলেন নিতাই বৈরাগী। রাম বসুর গানগুলো বেশ মানোত্তীর্ণ বলা চলে। যেমন-
যৌবন জনমের মতো যায়
আশাপথ নাহি চায়।
কী দিয়া গো সখী বাঁধিবো হিয়ায়।।
ঠাকুর সিংহ আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি একই মঞ্চে প্রতিযোগিতায় নামতেন। তাদের একটি লড়াইয়ের নমুনা এরূপ-
ঠাকুর সিংহ বলছেন-
বলো হে অ্যান্টনি, আমি একটি কথা জানতে চাই
এসে এদেশে তোমার গায়ে কেন কুর্তি টুপি নাই।।
আন্টনির জবাব-
এই বাংলায় বাঙালির বেশে আনন্দে আছি,
হয়ে ঠাকরে সিংহের বাপের জামাই কুর্তি টুপি ছেড়েছি।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির আরেকটি বিখ্যাত গানের পঙক্তি যা তিনি ভোলা ময়রার গানের জবাবে দিয়েছিলেন-
খ্রিস্ট আর কৃষ্ণ কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই
শুধু নামের ঘোরে মানুষ ফেরে, এও কোথা শুনি নাই।
আমার খোদা যে, হিন্দুর হরি সে
ঐ দেখ শ্যাম দাঁড়ায়ে রয়েছে…”
সেই আমলে এমন কথা সুনিশ্চিতভাবে অনেক বেশি গভীর আত্মোপলব্ধি ও অনুধাবনের পরিচায়ক।
কবিয়াল রাজেন্দ্র সরকার জন্মেছিলেন নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ে। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গোষ্ঠীর ঘৃণার শিকার ছিল এই সম্প্রদায়। বাংলার অন্যতম উৎপাদক শ্রেণি ছিল তারাই। তাদের ঘৃণা করার প্রতিবাদে রাজেন্দ্র সরকার তৈরি করেন এই গানটি-
কত মদের নেশায়, বদের দশায়, ব্রাহ্মণে খায় বেশ্যাদিগের ভাত,
বেশ্যারা কি ঠাকুর জগন্নাথ?
নটির হুক্কার তামাক খেয়ে, কুলিনকবলায় বাড়ি যেয়ে,
এইসব ব্রাহ্মণকে না প্রণাম দিয়ে-
নটির পদে কোটি দন্ডবৎ।”
উদ্ভবকালের কবিগান পরিবেশনার সাথে এখনকার পদ্ধতির বেশ কিছু ফারাক রয়েছে। ঢোল আর কাঁসি এখনকার কবিগানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। উদ্ভবকালে কবিগানের মূল অনুষঙ্গ ছিল খোল আর করতাল। আধুনিককালে কৌশলপূর্ণ কথা কাটাকাটির মধ্যে দিয়ে জিতে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আগেকার সময়ে গানেই সবকিছুর সমাধান হতো। ডাক, মালসি, সখীসংবাদ, কবি, টপ্পা, ধুয়া, প্যার ও পাঁচালি এই আটটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কবিগান পরিবেশিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কবিগানে অশ্লীলতা প্রবেশ করে। পূর্ববঙ্গের কবিগানের যুগস্রষ্টা নরসিংদীর হরিচরণ আচার্যের রচিত কবিগানের আংশিক সংকলন গ্রন্থ ‘কবির ঝংকার’ এর ভূমিকায় উল্লেখিত হয়েছে,
“কবিগানের গৌরবময় দিনের পর এক ঘোর অবনতির যুগ আসিল। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির রুচি পরিবর্তিত ও সংস্কৃত হইতে লাগি। বিলাতি ফ্যাশানের থিয়েটার প্রভৃতি আসিয়া শিক্ষিত ও ভদ্র সম্প্রদায়ের চিত্ত বিনোদনে ব্যাপৃত হইল। কবিগান তখন একমাত্র অশিক্ষিত সাধারণ সম্প্রদায়ের আমোদ যোগাতেই ব্যাপৃত রহিল ও সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীলতা দোষে এত জঘন্য হইয়া পড়িল যে ভদ্র গ্রামে পর্যন্ত তাহা গাওয়া অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। ভদ্রলোক তাহা শুনিতেনই না।”
এইকালে কবিগান গ্রামের ভেতরে না হয়ে ফাঁকা ভিটায়, বটতলায় বা শ্মশানঘাটে অনুষ্ঠিত হতো।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কবিগানকে ‘নতুন সামগ্রী, নষ্ট পরমায়ু’ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক ও প্রাবন্ধিক যতীন সরকার বলেন, “উদ্ভব থেকে পরিণতি পর্যন্ত সব সময়েই এ অঞ্চলের কবিগান ছিল আবহমান কালের লোকসংস্কৃতির মধ্যে দৃঢ়মূল।” তাই রবি ঠাকুরের উক্ত কথাটি তার ভাষ্যমতে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যায় না। কবিগানের পক্ষ ও বিপক্ষ নিয়ে গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই। অনেকের কাছে এ এক অনন্য সম্পদ, অনেকের কাছে রুচিহীনদের সময় কাটানোর অনুষঙ্গ। তবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে গেলে বলা যায়, কবিগানের সাগর মন্থন করে দু’চারটে মুক্তা নিশ্চয় পাওয়া যায়।