তাবৎ দুনিয়ার সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে লিও তলস্তয় এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। নিজেও আয়েশী জমিদারি জীবন কাটিয়েছেন বহুদিন। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি ছিলো তার গভীর অনুরাগ। সেই অনুরাগেরই ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি ‘ওয়ার এন্ড পিস’ কিংবা ‘আনা কারেনিনা’র মতো কালজয়ী সাহিত্যকর্ম।
জন্মের দু’বছর পরেই তলস্তয়ের মা মারা যান। একটু বড় হওয়ার পর তলস্তয়কে তার ফুপু সম্বন্ধীয় এক আত্মীয়ার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই আত্মীয়া থাকতেন কাজানে। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার সুযোগ পান। বিশেষ করে দার্শনিক রুশোর লেখা বইগুলো তাকে ভীষণ রকমের আকৃষ্ট করেছিলো। মূলত কাজানে থাকাকালীন সময়েই সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কখনোই টানতো না তলস্তয়কে। বরং খামখেয়ালি, বিলাসী জীবনযাপন তাকে বেশি আকৃষ্ট করতো। বয়স ১৮ হওয়ার পর নিজের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ হিসেবে জন্মস্থান ইয়াসনা পলিয়ানার বিশাল জমিদারি এবং প্রায় ৩৫০ জন ভূমিদাসের মালিকানা পেলেন। কিন্তু ক্রমশ উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা তাকে অসুস্থ করে ফেললো। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে তার হাতে আসে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী, জানতে পারলেন বেঞ্জামিন দিনশেষে তার দোষগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। ভাবলেন নিজেও এই অভ্যাস গড়ে তুলবেন। তলস্তয়ের ডায়েরি থেকে জানা যায়, একদিকে তার মধ্যে একধরনের অনুশোচনাবোধ কাজ করতো, অন্যদিকে বিলাসী জীবনের জন্যও ছিলেন আকুল। ভালো আর খারাপের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সবসময় তলস্তয়ের অন্তরাত্মাকে অস্থির করে রাখতো।
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়বার সময় একদিন পত্রিকা পড়তে গিয়ে চোখে পড়ে চার্লস ডিকেন্সের ক্লাসিক ডেভিড কপারফিল্ড। তলস্তয়ের মনে হলো, এই রকম একটা উপন্যাস তো তিনিও লিখতে পারেন। জীবনকে যতখানি কাছ থেকে দেখেছেন তা নিয়ে তো লেখাই যায়। উপন্যাস লিখবেন বলে মনস্থির করলেও এরই মধ্যে বড় ভাই তাকে ভর্তি করিয়ে দেন সেনাবাহিনীতে।
সেনবাহিনীতে যোগ দেয়ার সুবাদে চলে গেলেন ককেশাসে। ককেশাসে অবস্থানরত সেনাবাহিনী স্থানীয় উপজাতিদের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দায়িত্বরত ছিলো। ককেশাসের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই পরে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত বড় গল্প ‘ককেশাসের বন্দী’।
সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়েই লিখে শেষ করলেন আত্মজীবনী মূলক উপন্যাসের প্রথম পর্ব ‘শৈশব’ (Childhood)। স্থানীয় এক পত্রিকায় ১৮৫২ সালে লেখাটি ছাপা হলো। পত্রিকার সম্পাদক আরেক বিখ্যাত রাশিয়ান কবি নিকোলাই নেক্রাসভ বেশ প্রশংসা করলেন লেখাটির। উৎসাহিত হয়ে উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব ‘বাল্যকাল’ও ১৮৫৪ সালের মধ্যে লিখে ফেললেন। মোটামুটিভাবে লেখায় মনোনিবেশ করতে না করতেই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলো। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা তলস্তয়কে এতটাই আহত করেছিলো যে তিনি যুদ্ধ শেষে সৈনিক পদ থেকে ইস্তফা দেন।
পুনরায় নিজে জমিদারিতে ফিরে এসে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের শেষ অংশ ‘যৌবন’ (Youth) লেখা শুরু করলেন (সেটা শেষ হতে সময় লেগেছিলো ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত)। কিছুদিন পর বেরিয়ে পড়লেন দেশ ভ্রমণে। প্যারিসে দেখা হলো আরেক বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ইভান তুর্গেনেভ এর সাথে। তুর্গেনেভ বয়সে তলস্তয়ের চেয়ে বছর দশেকের বড় ছিলেন। তুর্গেনেভ তলস্তয়ের লেখার গুণগ্রাহী হলেও তলস্তয়ের আচার-আচরণ ও চলাফেরায় সন্তুষ্ট ছিলেন না।
এর কিছুদিন পর তলস্তয় পাড়ি জমালেন জেনেভায়। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছিলো। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘কসাক’লেখার কাজ শুরু করেছিলেন এখানেই। কিছুদিন পর ফিরে এলেন মস্কোতে। ‘কসাক’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে। ‘কসাক’ই প্রথম তাকে রাশিয়ার জনপ্রিয় লেখকদের একজন করে দেয়।পাঠকদের এই অভাবিত সাড়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা শুরু করলেন তার কালজয়ী উপন্যাস ‘ওয়ার এন্ড পিস’। ‘ওয়ার এন্ড পিস’ রচনায় তার সময় লেগেছিলো দীর্ঘ পাঁচ বছর। ধারণা করা হয়, উপন্যাসের ‘নাতাশা রস্তভ’ চরিত্রটি তার স্ত্রী সোফিয়ার ছোটবোন তাতিয়ানা বেহর্সের চরিত্রের আদলে লেখা হয়েছে। ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এর বিশালত্ব নিয়ে একটি মজার ধারণা প্রচলিত আছে। তলস্তয়ের হাতের লেখা নাকি একমাত্র তার স্ত্রী সোফিয়াই পড়তে পারতেন। তাই সোফিয়াকেই তলস্তয়ের পান্ডুলিপি থেকে লেখা উদ্ধার করতে হতো। ধারণা করা হয়, সোফিয়া উপন্যাসটির সাতটি খসড়া তৈরি করেছিলেন। আবার অনেক পরিচিতজনের অভিযোগ ছিলো যে, সোফিয়া নাকি উপন্যাসটির ২১টি খসড়া করেছিলেন!
মস্কোতে একদিন বন্ধুদের সাথে ভালুক শিকার করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ভালুকের সামনে। অল্পের জন্য বেঁচে যান। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার এই ঘটনাকে ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এ জীবন্ত ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন তলস্তয়। এই উপন্যাসকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম বিবেচনা করা হয়। উপন্যাসের মূল পটভূমি ছিলো নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়া আক্রমণের প্রভাব সহ ১৮০৫-১৩ সালের মধ্যকার সময়ে তৎকালীন রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা। এই উপন্যাসে তলস্তয় রাশিয়ার জার থেকে শুরু করে সৈনিক, গৃহবধু, সাধারণ কৃষক সবার চরিত্র তুলে এনেছিলেন। উপন্যাসের প্রথম অংশ দ্য রুশ হেরাল্ড নামের একটি রাশিয়ান পত্রিকায় ১৮৬৫ সালে সিরিয়াল আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালে এই উপন্যাসের সমগ্র অংশ প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়।
‘ওয়ার এন্ড পিস’ রচনা শেষে তলস্তয়ের মনে হচ্ছিলো তার সৃজনীশক্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য আবার মন দিলেন দর্শন সাহিত্য পড়ায়। দর্শন তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতো। সে সময় রাশিয়ার সামারা এলাকায় দুর্ভিক্ষ চলছিলো। তলস্তয় ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেখানকার মানুষের সেবায়। এ সময়ই একদিন জানতে পারলেন একটি মেয়ে রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনাকে উপজীব্য করেই লিখলেন তার আরেক সেরা উপন্যাস ‘আনা কারেনিনা’। ‘আনা কারেনিনা’কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্টিক উপন্যাসগুলোর একটি বলে মনে করা হয়। এই উপন্যাসে তলস্তয় ফুটিয়ে তুলেছিলেন প্রেমের এক ধ্বংসাত্মক দিক। এর মাধ্যমে তলস্তয় দেখাতে চেয়েছেন, মানুষের বিবেকই সবচেয়ে বড় বিচারক, পরিবেশ নয়। ১৮৭৭ সালে ‘আনা কারেনিনা’ প্রকাশিত হওয়ার পর তলস্তয় খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান।
কিন্তু বিশাল সময় পার করে এসে তলস্তয় নিজের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন অনুভব করেন। ততদিনে যশ, খ্যাতি আর অর্থ-সম্পদের মোহ তার চলে গিয়েছে। অনেকটা সাধু সন্নাসীদের মতো শান্ত, চুপচাপ আর অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময়েই তার বেশিরভাগ ছোটগল্পগুলো লেখা হয়েছিলো। তলস্তয়ের রচিত ছোটগল্পগুলো বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি গল্পের মাধ্যমেই তিনি মানুষকে কোনো না কোনো সত্যের বার্তা দিতে চেয়েছেন।
নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসার পর তলস্তয় ভাবলেন, সমস্ত অর্থ-সম্পদ দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেবেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন স্ত্রী। স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক ক্রমশই খারাপ হচ্ছিলো। এ পর্যায়ে তলস্তয় তার সমস্ত সম্পদ স্ত্রীর নামে উইল করে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। এখানকার সাধারণ মানুষদের জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করতেন। তাদের মতই কাজ করতেন। তার সাধারণ পোষাক দেখে অনেকেই তাকে কাজের লোক বলে ভুল করতো। আমিষ, ধূমপান ছেড়ে দিয়ে সন্যাসীদের মতোই জীবনযাপন শুরু করলেন। এই সময়টায় তিনি সাহিত্য থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিলেন।
দস্তয়ভস্কি, তুর্গেনেভ তখন পৃথিবী ছেড়েছেন, অন্যদিকে গোর্কি কিংবা চেকভ তখনো তেমনভাবে পরিচিতি পাননি। সেই সময়টায় সমগ্র রুশ সাহিত্যের তিনি একাই কাণ্ডারী। মানুষজন তার লেখা পড়তে চাইতো। তাই আবার মন দিলেন লেখায়। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস ‘ক্রয়োজার সোনাটা’। এই উপন্যাসের মূল গল্পে তিনি দেখালেন এক বৃদ্ধ ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণায় তার প্রতারক স্ত্রীকে খুন করে। এই উপন্যাস সে সময়ে ব্যাপক বিতর্কের ঝড় তোলে। সরকারের তরফ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। ধারণা করা হয়, স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষ থেকেই তিনি এই বই লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে তার স্ত্রী সোফিয়া বলেন, “আমি জানি, এই লেখা সম্পূর্ণই আমার বিরূদ্ধে। আমাকে এই লেখায় সম্পূর্ণভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীর চোখে আমাকে ছোট করা হয়েছে। আর এই লেখার সাথে সাথে আমাদের দুজনের মাঝে ভালোবাসার যে বন্ধনটুকু ছিলো সেটিও নিঃশেষ হয়ে গেছে।”
তার লেখা নাটকগুলোর মাঝে ‘দ্য পাওয়ার অব ডার্কনেস’ অন্যতম। এই নাটক পড়ে জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, “এক বুড়ো সেপাই আমাকে যতখানি মুগ্ধ করেছে, দুনিয়ার সমস্ত নাট্যসাহিত্যও আমাকে এতখানি মুগ্ধ করেনি।”
এছাড়াও জীবনের শেষ দিকে এসে লেখেন ‘হাজি মুরাদ’। এই উপন্যাসটি লেখার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন তার ককেশাসে থাকাকালীন সময়ে শোনা একটি ঘটনা থেকে। ‘হাজি মুরাদ’ তার মৃত্যুর পরে ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয়।
এছাড়াও তলস্তয়ের লেখা ‘রেজারেকশন’, ‘দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ’, ‘অ্যা কনফেশন’ সাহিত্যকর্মগুলো নিঃসন্দেহে বিশ্বসাহিত্যে বিশাল স্থান দখল করে আছে। সত্যি বলতে কী, এত অল্প পরিসরে তলস্তয়ের বিশাল সাহিত্যজীবনকে তুলে আনা কখনোই সম্ভব নয়। তবুও এখানে চেষ্টা করা হয়েছে তলস্তয়ের সাহিত্যজীবনের একটি ছায়া অংশ তুলে ধরার জন্য। রুশ সাহিত্য বা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলে তলস্তয় আপনাকে পড়তেই হবে। তলস্তয় বিহীন রুশ সাহিত্য তো বটেই, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যকেই কল্পনা করা যায় না।