সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: নীললোহিতের উপাখ্যান

“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো
কেউ কথা রাখেনি!”

বছরের পর বছর শেষে কথা না রাখার আর্তি নিয়ে পরিচিত এই কবিতাটি যার অবদান, তাকে নিয়েই আজ হয়ে যাক কিছু কথার মালা গাঁথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, একইসাথে যিনি সাফল্য পেয়েছেন কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবে। এছাড়াও তিনি ছিলেন প্রথিতযশা ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।  ১৯৩৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ভারতীয় বাঙালি এই সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফরিদপুরে, যা এখন বাংলাদেশেরই অন্তর্ভুক্ত।

কবিতায় কথা হতো নীরার সাথে; image source: bangla.kurigramblog.com

কবিতা ছিল তার প্রথম প্রেম, আর এই কবিতার হাত ধরেই পাঠক পেয়েছে সুনীলের নীরাকে। “এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ, এ হাতে আমি কি কোনো পাপ করতে পারি?” তার কাছে নীরা যেন নিজেই নীরার তুলনা, “নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো”।

নীরাকে পেতে গিয়েও পাওয়া হয় না সুনীলের, প্রবল আহ্বানে ডাকতে গিয়েও যেন কথা চাপা পড়ে যায় নিজের মধ্যেই,

“‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্‌টের দরজায়।”

ভারতীয় উপমহাদেশের সময়ের ইতিহাসকে বইয়ের পাতায় বন্দী করেছেন উপন্যাসচ্ছলে। তার বিখ্যাত ত্রয়ী প্রথম আলো, সেই সময় এবং পূর্ব-পশ্চিম। সেই রবি ঠাকুর থেকে বঙ্কিমের প্রথম লেখা খুঁজে পাওয়া, হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার উত্থান-পতনের সাথে জড়িয়ে থাকা হরিশ্চন্দ্রের মাতাল জীবন। অদেখা সময়কে পাঠক দেখতে পায় এই ত্রয়ীর মধ্য দিয়ে। ইতিহাস যাদের ভালো লাগে না, ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসগুলো একেবারে সঠিক ইতিহাস উপহার না দিতে পারলেও এর অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক আছে। এই উপন্যাসগুলো পাঠককে ইতিহাসের প্রতি উৎসাহী করে তুলতে সক্ষম হয়। এই ত্রয়ীর ভূমিকাও এক্ষেত্রে প্রশংসনীয়, আর সেই সাথে ত্রয়ীস্রষ্টারও। এর মধ্যে প্রথম আলো ও সেই সময় ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে অরুণা চক্রবর্তীর হাতে: যথাক্রমে First Light, Those Days নামে। প্রথম প্রকাশ পাবার দু’দশক পরেও বেস্ট সেলার হয়ে ছিল ‘সেই সময়’। ১৯৮৫ সালে এই বইটি সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারও লাভ করে।

তার বিখ্যাত ত্রয়ী উপন্যাসের একটি ‘পূর্ব-পশ্চিম’; image source: boi4u.com

‘নীল লোহিত’, ‘সনাতন পাঠক’ ও ‘নীল উপাধ্যায়’- এগুলো ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। যদিও এর মধ্যে তার ‘নীললোহিত’ নামটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রথমেই বলছিলাম নীরার কথা, নীরা ছাড়াও আরেকটি নাম খুব গুরুত্বপূর্ণ নাম রয়েছে তার কবিতায়, নিখিলেশ। কবিতা লিখতে হলে যেন কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখলে মনের ভাব আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, সুনীলের এমনই এক কবিতাপ্রাপক হলো নিখিলেশ। নিখিলেশের সাথে জীবনবদলের আক্ষেপে অথবা জীবনভোগের অতৃপ্তিতে সুনীল তার কবিতায় বলে ওঠেন,

আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
তোর সঙ্গে জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার।

এভাবেই প্রেরক-প্রাপকের সাথে তার কবিতা হয়ে উঠতো গদ্যময়। গদ্যের সাথে স্বচ্ছন্দ এই মানুষটি তার কবিতায়ও গদ্য নিয়েই ভালো থেকেছেন।

পাঠককূলে সকলক্ষেত্রেই সমাদৃত লেখক তিনি; image source: onosondhan.com

সুনীলের ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ কবিতাটি এখনও তরুণ-তরুণীদের অনুকম্পা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তার এই কবিতাটি যেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের অত্যন্ত আপন কিছু কথা হয়ে ওঠে,

“ধরো খুব অসুস্থ তুমি, জ্বরে কপাল পুড়ে যায়,
মুখে নেই রুচি, নেই কথা বলার অনুভূতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যদি বলি- ভালোবাসো?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?
নাকি তোমার গরম শ্বাস, আমার শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..”

সুনীল ও নীললোহিত

আগেই বলা হয়েছে ‘নীললোহিত’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অতি পরিচিত ছদ্মনাম। নীললোহিত তার একটি প্রিয় চরিত্রও বটে। নিজের সকল কথা যেন তিনি ক্রমাগত বলিয়ে নিয়েছেন নীললোহিতকে দিয়ে। নীললোহিতের বয়স সাতাশেই ঠেকে থাকে সবসময়। বেকার এই যুবকের পর্যবেক্ষণশক্তি সত্যিই অসাধারণ। নীললোহিত বড্ড বেশি চোখ-কান মেলে থাকে, তেমন খুব জড়ায় না কিছুতে, আর জড়াবার মতো তার নিজেরও তো নেই সেই আর্থিক সামর্থ্য! এটি সুনীলের ছদ্মনাম, কিন্তু তার এই লেখাগুলো পড়তে পাঠকের মনে হতেই পারে, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’-ই নয়তো নীললোহিতের ছদ্মনাম? কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে নীললোহিত ঘুরে বেড়ায়, দেখা হয় প্রতিদিন অজস্র মুখের সাথে। সেই মুখে লেগে থাকা প্রতারণা কিংবা শুদ্ধতাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে এই যুবক। সে জীবনের বাইরে থেকে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কোনোকিছুর বর্ণনা দেয় না, সে কাহিনীর কথক হলেও গল্পের মধ্যেরই চরিত্র। প্রতিটি মানুষের সাথে তার রয়েছে পৃথক সম্পর্ক।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা নীললোহিত; image source: times of india

আর তাই নীললোহিতের বর্ণনা ‘ইউটোপিয়া’ ঠেকে না, মনে হয় সে একেবারে ঐ চরিত্রগুলোর ভেতর থেকে কথা বলে যাচ্ছে। এই চরিত্রটি নিয়ে লেখকের মোট পাঁচটি সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। ঠিক গল্প বা উপন্যাসের কাতারে পড়ে না এই বইগুলো, কেমন যেন ডায়েরির মতো করে তরতরে লেখা, কখনো সংযোগ কখনো বিচ্ছিন্নতা! যখন যা দেখেছেন, যা ভেবে উঠতে পেরেছেন, যতটুকু মনে করতে পেরেছেন তাই যেন দর্পিত প্রতিবিম্বের মতো চলে এসেছে এই লেখায়। নীললোহিত স্বপ্নও দেখে, যাচ্ছেতাই ধরনের স্বপ্ন। তাইতো হীরেনদাকে বলে ওঠে তার চোখে দেখা ত্রিশ বছর পরের সমাজের কথা,

“নিশ্চয়ই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তখন সমাজে এরকম শোষণ থাকবে না, প্রত্যেকের সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। কেউ কারুর উপর জোর করে মতামত চাপাবে না।”

সে আশাবাদী, কারণ সে জেনে ফেলেছে যে ‘চিকিৎসার অতীত আশাবাদী’ না হলে বেঁচে থাকার কোনো ‘পয়েন্ট’ নেই! স্বপ্নগুলো ফাঁকি দিলে নীললোহিত চলে যায় তার একান্ত সেই ‘দিকশূন্যপুরে’!

বাংলা সাহিত্যের চাঁদ-সূর্য কিংবা নক্ষত্রদের পাশে নিজেকে নিতান্তই এক জোনাকি মনে করা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার এই ‘নীললোহিত’ নিয়ে লেখাকে সাহিত্য বলতেও লজ্জা পান। কিন্তু জীবনবোধের গভীরতা আর সহজ স্পষ্টতাই হয়তো সাহিত্য, আর তাইতো পাঠককূলে বিশেষভাবে আদৃত হয়েছেন ‘নীললোহিত’ এবং এর স্রষ্টা খোদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য ও তার রূপায়ণ

চলচ্চিত্রের আলোকদিশারী সত্যজিৎ রায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনী থেকে গ্রহণ করেছেন তার সিনেমার পটভূমি। সত্যজিত রায়ের কলকাতা ত্রয়ী সিনেমার একটি হচ্ছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং এটি সুনীলের একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এই সিনেমাটি তিনটি জাতীয় পুরষ্কার পাবার পর শিকাগো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও মনোনয়ন পেয়েছিলো। এছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্ট জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ চরিত্র ‘কাকাবাবু’র মোট চারটি সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হলো ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন?’, ‘এক টুকরো চাঁদ’, ‘মিশর রহস্য’। এর মধ্যে সর্বশেষটি মুক্তি পেয়েছে ২০১৩ সালে, পরিচালক সৃজিত মুখার্জী। কাকাবাবু চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যপ্রেমী শিশু-কিশোরদের কাছে অন্যতম প্রিয়। অনেক শিশুই পড়তে গিয়ে নিজেকে ‘জোজো’ অর্থাৎ কাকাবাবুর সঙ্গী ভাবতে ভুল করে না! শুধু বাংলাতেই নয়, মালায়লাম ও ইংরেজি ভাষায়ও তার উপন্যাসভিত্তিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। তার কবিতা পেয়েছে গানের রূপ, তার গল্পে এসেছে বড় পর্দার চেনা মুখ। এভাবেই বিভিন্ন মাধ্যমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনী রূপায়িত হয়েছে।

কাকাবাবু চরিত্রটি অ্যাডভেঞ্চার জাগায় কিশোরমনে; image source: quora.com

‘অর্ধেক জীবন’ নিয়ে কিছু শোরগোল

২০০২ সালে প্রকাশ পায় তার ‘অর্ধেক জীবন’। তিন দশক ধরে চলা আত্মজীবনীমূলক বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এতে। সুনীল গঙ্গোপাধায়ের নিজের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কলকাতার চল্লিশের দশক খুব সহজেই উঠে আসে এই বইয়ে। সময়কে তিনি কীভাবে ধরে রাখতে পারেন তা তো তার ত্রয়ী উপন্যাসেই টের পাওয়া যায়, ‘অর্ধেক জীবন’ যেন নিজের উপর করা এক্সপেরিমেন্ট! ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পায় এই বইটি, পাঠকরা নাকি অভিযোগ তোলেন এর নাম নিয়ে। তাদের কথা হলো, তিনি কেন এর নাম ‘অর্ধেক জীবন’ দিয়েছেন। তিনি তো নিজের আয়ুরেখা মেপে নেননি, এমনই অভিযোগের সুর ওঠে পাঠকসমাজে। এর উত্তরে লেখক বলেন যে, এর নামের সাথে তার আয়ুর কোনোই সম্পর্ক নেই। তিনি এর পরের খন্ডও লিখতে চাননি, এই অর্ধেকেই তিনি তৃপ্তির পূর্ণতা পেয়েছেন তাই একে অবিচ্ছিন্নতা দিয়ে আরেকটি গ্রন্থ শুরু করার কথাও তিনি ভাবেননি। এখানে তিনি তার জীবনের নির্দিষ্ট একটা সময়কে তুলে ধরতে চ্যেছেন, তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়টুকুকে। সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ভি এস নইপালের ‘হাফ অফ লাইফ’ বইয়ের সাথে কাকতালীয়ভাবে নাম মিলে যাওয়াতে খানিকটা অপ্রস্তুতও বোধ করেছিলেন লেখক, এমনটাই বলা হয়েছে বইটির প্রস্তাবনায়।

২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা যান। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন,

“গঙ্গোপাধ্যায় তার বৈচিত্র্যময় শৈলীতে বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। তার সমসাময়িকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম একজন বুদ্ধিজীবী। তার মৃত্যুতে সৃষ্টি হওয়া এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়।”

সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে কলকাতার ‘গণদর্পণ’-এর সাথে এর আনুষ্ঠানিক কাজ সারেন তিনি। কিন্তু মারা যাবার পর সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি তার, পুত্র সৌভিকের ইচ্ছানুসারে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সারা হয় ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেই।

তথ্যসূত্র

  1. অর্ধেক জীবন, লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
  2. নীল লোহিত সমগ্র, লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ফিচার ইমেজ- memoryinglobal.com

Related Articles

Exit mobile version