একুশের সেই ভাষার গানগুলো যা আজও আমাদের মাঝে অমলিন

ভাষার মাসে বাংলা ভাষার সাথে নিরবচ্ছিন্ন আলাপাচারিতায় নিজেকে কিছুটা বাঙালিয়ানা পোশাকে মোড়াতে বেশ ভালই লাগে। চারিদিকে বর্ণের ছটা। নগ্ন পায়ে, স্নিগ্ধ চিত্তে, হাতে ফুল, বুকে ভালবাসা নিয়ে উচ্চারিত হয় মধুর কিছু ধ্বনি, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”। সেই ভুলতে না পারার কাব্যে আরও কত শত গান রচিত হয়ে গেছে ভাষার আবেগে। সেই বিপুল ভান্ডার থেকে কিছু সুপরিচিত গানের স্মৃতি রোমন্থনেই আজকের এই প্রয়াস।

অমর একুশে, Image Source: trololoblogg.blogspot.com

“যে ভাষার জন্যে এমন হন্যে, এমন আকুল হলাম
সে ভাষায় আমার অধিকার
এ ভাষার বুকের কাছে মগ্ন আছে আমার অঙ্গীকার।

যে ভাষার জন্য সালাম বরকতেরা রক্ত দিলো
৫২’সালের লড়াই, আমার ‘আমি’ জন্ম নিলো
সে ভাষা আমার গানে তোমার পানে আমার অঙ্গীকার।”

সুমনের কথা ও সুরে বাংলাকে বারবার ফিরে পাওয়া; নতুন ছন্দে, নতুন কাব্যে, নতুন ভাবনায়। আজকাল বাংলা ভাষা ফেব্রুয়ারি মাসের ফ্যাশন বা শ্রদ্ধার নামে ফুল উপহারের উৎসব মাত্র। ভাষা ধারণ ও লালন করার ভাবনায় কেউ বিভোর নই মোটেই। ইংরেজি সংস্কৃতির বাংলা অনুকরণে সদা বিচ্ছুরিত আমাদের স্বপ্নকাতর চোখ। আঁকা সংস্কৃতির বাঁকা চিন্তাধারায় আমাদের কল্পনার রেখা সুদূর প্রসারিত। নিছক ছন্দের টানে বাংলাকে কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা আজ শুধু জন্মপ্রসূত অধিকার মাত্র। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই বাংলার তেমন অনুসরণ না থাকলেও কদাচিৎ উপচে পড়ে ভালবাসার রেশ দেশমাতার টান বোঝাতে সক্ষম। হিন্দি আর ইংরেজীর বাহুবলের কাছে বাংলা অনেকটাই হীনবল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মাতৃভাষার জন্য পিপাসার্ত কিছু মানুষের মুখে যখন শুনি বা পড়ি, শুধুমাত্র বাংলাদেশের কিছু দামাল ছেলের জন্য আজ বিশ্ব-সংসারে বাংলা ভাষার মর্যাদা আকাশচুম্বী, যে দেশটির জন্য ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো এমন সম্মানজনক স্বীকৃতি দিল; আমি সেই দেশের নাগরিক- এ তো আমার জীবনের চরম পাওয়া। পৃথিবীর অনেক মানুষই এই গর্বে গর্বিত হওয়া থেকে বঞ্চিত, এই ভাবনা নিজের মধ্যে এক ধরনের অহংকারের জন্ম দেয় তা আর বলতে মানা নেই।

Image Source: albd.org

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয় যখন দুই ভিন্ন সংস্কৃতিমনা দেশের মিলন সন্ধির চেষ্টা শুরু তখন থেকে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশের একাত্মতা ঘোষণা করা হলেও দুটি দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা তো ছিল স্বকীয়। আবেগের আকুতি খুব বেশিদিন দীর্ঘ হয়নি আমাদের।

১৯৪৮ থেকেই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণের মিনতি শুরু হয়ে যায়। ঐ বছর ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন- “যদি সত্যিই পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, তাহলে তার রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং উর্দুই হবে পকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

বাঙালির নাড়ির খবর তখনও পাকিস্তানিদের অজানা। ভাষার টান যে কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে তার দৃশ্যপট তখনও আঁকা হয়নি তাদের মনে। জিন্নার ঘোষণার পরপরই শুরু হয়ে গেল শহরজুড়ে ক্ষোভ আর হতাশা। বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ কখনও আপন করে নিতে পারেনি উর্দুকে। তাই রক্ত টগবগে হয়ে উঠে বাংলার দামাল ছেলেদের।  আর তারই টানে অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরি (১৯১৯-২০০৯) সেই রাতেই ভাষার জন্য প্রথম গানটি রচনা করে ফেলেন-

শোনেন হুজুর
বাঘের জাত এই বাঙালিরা
জান দিতে ডরায়না তারা
তাদের দাবি বাংলা ভাষা
আদায় করে নেবেই!

প্রখ্যাত গণসঙ্গীতশিল্পী শেখ লুতফর রহমান (১৯২১-১৯৯৪) গানটিতে সুরারোপ করেন। ভাষার তৃষ্ণায় কেটে গেল আরও চারটি বছর। এর মধ্যে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য গান ও কবিতা তৈরি হয়। সকলের মনে তখন ভাষার জন্য ডামাডোল চলছে। পাকিস্তানি সরকারও ছক গুছিয়ে নিচ্ছিল কী করে আরও সুগঠিত করতে পারে তাদের সিদ্ধান্তের চিরন্তন ব্যবস্থায়।

ভাষার জন্য প্রথম গান (আনিসুল হক চৌধুরী ও আরও অনেকে), Image Source: amadershomoy.com

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮), দিনটির কথা আর নতুন করে বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে বাংলা ভাষার স্তুতি হয়তো পাকিস্তানীদের বুকে সারা জীবনের পীড়া হয়ে গেঁথে থাকবে।  এই দিনটির শোকাবহ ছায়া মর্মাহত, ব্যথিত করে বাঙালিদের। গর্জে উঠে ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হকের (১৯২৯-২০০৯) লেখনি-

ভুলবো না ভুলবো না
ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি
ভুলবো না…
লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস
মিলিটারি আর মিলিটারি
ভুলবো না।।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
এই দাবিতে ধর্মঘট
বরকত সালামের
খুনে লাল ঢাকার রাজপথ।।

গাজীউল হকের ছোট ভাই নিজাম উল হক সাথে সাথে বসে গেলেন জ্বালাময়ী এই গীত-কবিতায় সুরারোপ করতে।  প্রতিবাদের শব্দ-বৃষ্টি যেন ঝড়ছিল গানটির চরণে চরণে। মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে ধরে যেন সংগ্রামী কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল প্রতিবাদের শব্দবৃষ্টি- “ভুলব না, ভুলব না।”

ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। Image Source: somewhereinblog.net

অমর একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাঁদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় গাজীউল হকের গানটিকে একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৫৩-৫৫ সালে এই গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো। গাজীউল হক পরবর্তীকালে আরও কিছু গান রচনা করেন যার পটভূমি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি।  তিনটি গানের কয়েকটি চরণ:

১) “বাংলার বুকের রক্তে রাঙানো আটই ফাল্গুন/ ভুলতে কি পারি শিমুলে পলাশে হেরি লালে লাল খুন”,
২) “বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা যখন একই নামের সুতোয় বাঁধা”।
৩) “শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে। তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।”

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল। Image Source: static.panoramio.com

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হন। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী। Image Source: ournewsbd.com

লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে সংকলনে’ও এটি প্রকাশিত হয়।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনা দেশের রক্ত রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।

এতে প্রথমে সুর দিয়েছিলেন গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী আবদুল লতিফ। পরবর্তী সময়ে এতে সুর-যোজনা করেন আরেক মহৎ সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। গানটির করুণ বিষণ্ণ সুর প্রতিটি হৃদয়কে স্পর্শ করে। শোক বিহ্বল করে তোলে শ্রোতার হৃদয়। কথা ও সুরের এমন শৈল্পিক সুষমা এ গানকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গানে উন্নীত করেছে। পরবর্তীতে  প্রভাতফেরির অনিবার্য গান হয়ে ওঠে এই গানটি।

সুরকার আলতাফ মাহমুদ। Image Source: daily-sun.com

আবদুল গাফফার চৌধুরী অমর একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর গান রচনা করেছেন। দুটি গানের কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করি:

১) ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/ আমি কি ভুলিতে পারি/ একুশে ফেব্রুয়ারি,’
২) ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/ দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।…/ এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’

একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনার পর গ্রামীণ গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদ রচনা করেছিলেন একটি মর্মস্পর্শী গান যেটি পল্লীগীতির সুরে সুরারোপিত হয়। গানটি শুনলে মনে হয় চোখের সামনেই যেন চাক্ষুষ দেখতে পারছি শহীদদের আত্মদান। তখন মনে হয় শহীদের এই বলিদান বৃথা যায়নি।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি
তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।
মা-ও কান্দে, বাপ-ও কান্দে, কান্দে জোড়ের ভাই
বন্ধু বান্ধব কাইন্দা কয়, হায়রে খেলার সাথী নাই
ও বাঙালি…

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং খ্যাতনামা গীতিকার এবং সুরকার, যিনি ছিলেন একুশের গানের প্রথম সুরকার, আব্দুল লতিফের (১৯২৭-২০০৫) লেখায় উঠে আসে মাতৃভাষার জন্য এক দীর্ঘ প্রাণবন্ত গান।

প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার আব্দুল লতিফ। Image Source: somewhereinblog.net

জারির সুরের খুব সহজ ভাষায় এই গান যেন হৃদয়ের কথা বলে। প্রত্যেকটা মানুষের মনে যেন এই গান বাজে। আব্দুল লতিফের এই জারিতে বাংলার নানা ঐতিহ্য, নিসর্গ, সংস্কৃতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ফলে এ জারি হয়ে উঠেছে গণমানুষের অভিব্যক্তি। ভাষা আন্দোলনের গানের এই সার্বজনীন রূপ উত্তরকালে ছড়িয়ে যায় সবার মাঝে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, বাঙালিকে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।।
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে।।
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।।

কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়।।
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়
কও দেহি ভাই…

তারপর একে একে লিখলেন –

১) ‘বুকের খুনে রাখলো যারা/ মুখের ভাষার মান/ ভোলা কি যায়রে তাদের দান?’,
২) ‘আমি কেমন কইরা ভুলি/ মুখের কথা কইতে গিয়া/ ভাই আমার খাইছে গুলি’,
৩) ‘রফিক-শফিক বরকত নামে/ বাংলা মায়ের দুরন্ত ক’টি ছেলে।/ স্বদেশের মাটি রঙিন করেছে/ আপন বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে’,
৪) ‘আবার এসেছে অমর একুশে/ পলাশ ফোটানো দিনে,/ এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে’।

উল্লিখিত সব ক’টি গানই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে। তখনো দেশটির নাম পাকিস্তান। পাকিস্তানিদের কড়া নজরের মধ্যে ভাষার আকুতিতে নিরন্তর গান বেঁধে যাওয়া আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেসব গেয়ে শোনানো মোটেও খুব সহজ কাজ ছিল না।

পরবর্তীতে ফজল-এ-খোদা রচনা করেন-

সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে।।

মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান
তাদের বিজয় মরণ…

শিল্পী আব্দুল জব্বারের কণ্ঠের এই গান আজ প্রায় চার দশক ধরে শ্রোতাদের হৃদয় সিক্ত করছে। শহীদ স্মরণে এ গানের আবেদন কখনো ম্লান হবার নয়।

আব্দুল জাব্বার। Image Source: banglasonglyrics.com

গানের কথার সঙ্গে সুরের আবেশ যুক্ত না হলে গানের পূর্ণ রূপ পরিস্ফুট হয় না। গান যেহেতু প্রায়োগিক শিল্প, কণ্ঠের গায়কী ভঙ্গি, বাদ্যযন্ত্রের তালের সমন্বয়ে তা পূর্ণতা লাভ করে। গানের স্পন্দমান কথা হৃদয়বীণায় এসে লাগে। কবি শামসুর রাহমানের লেখা একুশের একটি জনপ্রিয় গান-

ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে
ধুধু বালু চরে, পাখিদের নীড়ে
তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা।।
সকালে দুপুরে, গোধূলী বেলায়
শত পুষ্পের নিবিড় মেলায়
তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা।।

১৯৫৫ সালে রচিত কলিয়াল রমেশ শীলের ভাষার গান-

ভাষার জন্য জীবন হারালি বাঙালি ভাইরে
রমনার মাটি রক্তে ভাসালি
বাঙালিদের বাংলা ভাষা জীবনে মরণে
মুখের ভাষা না থাকিলে জীবন রাখি কেনে
কীট পতঙ্গ পশুপাক্ষী স্বীয় ভাষায় বুলি
তার থেকে কি অধম হলাম অভাগা বাঙালি।।

শহরের শিক্ষিত শিল্পীদের বাইরে গ্রামগঞ্জের কবিয়াল, বাউল, গায়েনদের মনেও ভাষা আন্দোলনের শোকাবহ স্মৃতি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারা বাংলা ভাষার মানরক্ষায় শহীদদের আত্মদানের বিষয়টি নিয়ে কবিগান, জারি, গীতিকা রচনা করেছেন। পাঞ্জুসাহ, মহীন শাহ, সিলেটের শাহ আব্দুল করিম তাদের মধ্যে অন্যতম। শাহ আব্দুল করিমের গান-

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে
সালাম বরকতের বুকে
গুলি চালায় বেঈমানে।।

বাংলা ভাষার গর্ব। Image Source:http: golondaz.blogspot.com

একুশের গানের কবি ও গীতিকারদের মধ্যে রয়েছেন: সত্যেন সেন, গাজীউল হক, জসীমউদ্দীন, হাসান হাফিজুর রহমান, নাজিম মাহমুদ, আলিমুজ্জামান চৌধুরী, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর, সিরাজুল ইসলাম, কাজী লতিফা হক, নরেন বিশ্বাস, দিলওয়ার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, আবিদ আনোয়ার, বদরুল হাসান, জাহিদুল হক, নাসির আহমেদ, মতলুব আলী, শাফাত খৈয়াম, মুহাম্মদ মুজাক্কের, এস এম হেদায়েত, আজাদ রহমান, নজরুল ইসলাম বাবু, আবুবকর সিদ্দিক, সৈয়দ শামসুল হুদা, ফজল-এ-খোদা, হামিদুল ইসলাম, মুন্সী ওয়াদুদ, তোফাজ্জল হোসেন, ইন্দু সাহা, হাবীবুর রহমান, আসাদ চৌধুরী, জেব-উন্-নেসা জামাল, মাসুদ করিম, আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান আজিজ, কে জি মোস্তফা, আবদুল হাই আল হাদী, নুরুজ্জামান শেখ প্রমুখ।

একুশের গানে সুরারোপ করেছেন: আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, মোমিনুল হক, নিজাম উল হক, সমর দাস, সত্য সাহা, সাধন সরকার, আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, শেখ লুৎফর রহমান, খোন্দকার নূরুল আলম, অজিত রায়, লোকমান হোসেন ফকির, আবদুল জব্বার, খান আতাউর রহমান, প্রশান্ত ইন্দু, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবিয়াল ফণী বড়ুয়া, আবেদ হোসেন খান, দেবু ভট্টাচার্য, বশির আহমেদ, রাম গোপাল মোহান্ত, সুখেন্দু চক্রবর্তী, হরলাল রায় প্রমুখ। তবে কবি, গীতিকার ও সুরকারদের নামের তালিকা অনেক ব্যপ্ত, তা শুধুমাত্র লেখার আঙ্গিকে সমাপ্ত করা ত্রুটিমুক্ত নয়।

মোদের গরব মোদের আশা। Image Source: suprovatsydney.com

ভাষার প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ, আন্তরিকতা এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মায়ের ভাষার প্রতি আকুতির এক অপরূপ দৃষ্টান্ত আমাদের এই অমর একুশ। ভাষার জন্য অকুতোভায় বাঙালি কী করে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, তা আজ আর কারও অজানা নয়। ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের বদৌলতে এই দিনটি আমরা ভাগ করে নিয়েছি পুরো বিশ্বের সাথে।

আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকারে পৃথিবীর সকল দেশ আজ একীভূত। পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ ‘সিয়েরা লিওন’ তো বাংলা ভাষাকে সম্মানা-জ্ঞাপনে তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমাদের এই দেশটি খুব ছোট। কিন্তু আমাদের গর্জন অনেক ব্যপ্ত। সেই গর্জনের অনেক প্রাপ্তি যা আজও পৃথিবীকে অবাক করে দেয়। আর সে দেশের মধুর বোল আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার আমাদের বাংলা ভাষা। অতুল প্রসাদ সেনের মুখে-

মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।।
মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা।।
আ মরি বাংলা ভাষা।

মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।।
কি যাদু বাংলা গানে- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
গেয়ে গান নাচে বাউল- গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।।

This article is in Bangla language and it discusses about some famous songs on 21st February.

References:

1. bn.wikipedia.org/wiki/ekushergan

2. http://www.jaijaidinbd.com

3. http://www.prothom-alo.com

 

Featured Image: Pinterest

Related Articles

Exit mobile version