বিমল কর: এক মৃত্যুশিল্পী

বিমল করের সাথে আমার পরিচয় খানিকটা অদ্ভুতভাবেই। তাঁর পঞ্চাশটি গল্পের সংকলনটি হাতে আসবার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম, বইটি বিমল মিত্রের। হেমন্তের এক ব্যস্ত পূর্বাহ্নে বইটি যখন হাতে এলো, তখন অবাক হয়ে দেখলাম এ লেখক আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন, আনকোরা একজন। যার কোনো রচনা আমি পড়িনি, কোনো লেখার সাথে আমি পরিচিত নই। একজন নতুন লেখক আবিষ্কারের উত্তেজনায়, আবার উত্তরাধুনিক নিরীক্ষাধর্মী কোনো লেখার মুখোমুখি হবার ভয়ে ভীত আমি সেই বইটির পাতা খুললাম। তারপর দীর্ঘ চারটি মাস এই বইটি ছিল আমার পড়ার টেবিলের বাসিন্দা। তীব্র শীতের রাতে, নীরব মধ্য দুপুরে, ব্যস্ত সন্ধ্যায় আমি একে একে উল্টে গেছি বইটির পৃষ্ঠা, দেখেছি তার সৃষ্টির রূপ, পড়েছি নানা বর্ণিল আখ্যান।

বিমল কর; Image Source: Anandabazar

একটা সময় ছিল— পাঠজীবনের শুরুতে, প্রবল বর্ষণমুখর দিন এলেই মনে পড়ত, আজ একটা গোয়েন্দা উপন্যাস পড়া যাক। কোনো ভাতঘুমের দুপুরে সারাবাড়ি নিশ্চুপ, খুঁজে পেতে বের করতাম কোনো হাসির গল্পবই। আরেকটু বড় হয়ে পড়া হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের কথা মনে পড়েছে রাস্তায় ধীরগতিতে চলা কোনো রিকশা দেখে। এরকম হবার কারণ, সেসব রচনার সুখপাঠ্যতা। লেখার চাপে পাঠককে ব্যতিব্যাস্ত করে তোলা নয়, রচনার আবেশে জড়িয়ে নেয়া।

বিমল করের রচনার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য এই সুখপাঠ্যতা। নিতান্ত সাদামাটা ঘরোয়া সংলাপের ভেতর থেকে তিনি উপনীত হতে পারেন গভীর ভাবাবেগপূর্ণ কোনো তত্ত্বকথায়। সহজ নির্মল গদ্যে তিনি লিখে যেতে পারেন শিল্পিত, সুন্দর, ভাবগম্ভীর কোনো লেখা।

সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ যে প্রেম, তা বারবার এসেছে তার রচনায়। তবে সমুদ্রের ওপার হতে যৌনতার আঁশটে গন্ধ তিনি নিয়ে আসেননি, একটি গল্প ব্যতিক্রম ধরে নিয়ে। প্রেমের আশ্রয় কি শরীরে না আত্মায়, তার স্বরূপই বা কী, এ নিয়ে দ্বন্দ্বমুখর অপূর্ব একটি রচনা হলো ‘সুধাময়’। সে রচনায় নানা দিক থেকে আলো ফেলে তিনি স্বরূপ সন্ধান করেছেন প্রেমের। কিন্তু পেরেছেন কি? সম্ভবত না। কারণ এই সুধাময়ের মুখেই তিনি বলছেন-

“মালা বদলের রূপকথা কি প্রেম? না চোখে বান ডাকলেই প্রেম হয়? প্রেম কি তা তুমি জান না, বা সঠিকভাবে বোঝ না। তবু কেন লেখ?”

অবশ্য এ প্রশ্ন তুলে যে তিনি প্রেমের গল্প লেখা থামিয়ে দিয়েছেন, তা নয়। লিখেছেন ‘ওরা এরা’, ‘তুচ্ছ’, ‘উদ্ভিদ’ ও ‘সুখ’ এর মতো অসাধারণ সব প্রেমের গল্প। দক্ষ মিস্তিরির হাতে সেসব রচনায় তিনি দেখিয়েছেন প্রেমের রূপ-রস। আগেই বলেছি, এ প্রেম কেবলই আত্মিক, শারিরীকতার বাহুল্য—শারিরীকতা বাহুল্য কিনা, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই!—নেই। আছে কেবল আত্মার সাথে অন্তরের যোগাযোগ।

বাংলা সাহিত্যে সামাজিক চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের অবহেলিত শ্রেণির মানুষদের উপজীব্য করে লেখার একটা প্রবণতা আছে। অনেকটা কমিউনিজম দ্বারা প্রভাবিত সেসব রচনার আবেদনও সমালোচকদের কাছে অসামান্য। নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় সহ আরো অনেক লেখকের রচনাই এই দর্শন দ্বারা বিচার করার ফলে খানিকটা অবিচারের স্বীকার হয়েছে বৈকি। বিমল করের রচনার অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, সামাজিক চেতনার বদলে তার রচনায় বারবার জায়গা করে নিয়েছে মানুষের অন্তর্গত বোধ, ভাবনা ইত্যাদি। বোধকরি এ কারণে তার আলোচনাও তুলনামূলক কম। প্রেম, ভালোবাসা, জীবন ইত্যাদি নিয়েই তিনি বেশি লিখেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি রচেছেন তিনি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। মৃত্যুর নানামুখী রূপ, বিচিত্র ভঙ্গিমায় প্রকাশ, তার রচনাসমূহকে উজ্জ্বল করে রেখেছে।

পরিবারের সাথে বিমল কর; Image Source: Anandabazar

মৃত্যু তো মানবজীবনের অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি কিংবা উত্তরণ। এই অমোঘ নিয়তিকে সামনে নিয়েও মানুষের সতত চেষ্টা থাকে মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে রাখতে। শত ফন্দি আঁটে মানুষ জীবনের নদীতে মৃত্যুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলবার জন্য। এ যেন এক অদ্ভুত ধরা-ছোঁয়ার খেলা, যেখানে মানুষ জানে যে সে মৃত্যুর ঘেরাটোপে বন্দী, তবু মানুষ বাঁচতে চায়। আটকে পড়ার পরও ভাবে, কোনো আশ্চর্য উপায়ে যদি টপকে যাওয়া যেত ওপারে। এই চিরকালীন অসম লড়াইয়ের সার্থক প্রতিচ্ছবি যেন ‘নদীর জলে ধরা-ছোঁওয়ার খেলা’ গল্পটি।

মানুষ যে সর্বদাই মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে চায়, তা-ও নয়, বরং সংসারের বেদনা যাতনায় ক্লিষ্ট হয়ে কখনো হয়তো মৃত্যু কামনা করে অপারগ মানুষ। সারাদিনমান শীতের মাঠে মৃত্যুকে খুঁজে ফেরা নবেন্দু, কিংবা অপেক্ষার শিবতোষ যেন তাদেরই প্রতিনিধি।

মৃত্যু নিয়ে এতগুলো গল্প লেখার পরও হয়তো তার আক্ষেপ ছিল মৃত্যুকে ধরতে না পারার। অপেক্ষা গল্পে তাই মৃত্যু ও প্রেম সম্পর্কে তার মন্তব্য,

‘সুযোগ দেয়, ধরা দেয় না।’

মৃত্যুর অবধারিত উপসর্গ যে জীবনের প্রতি হতাশাবোধ, সেটি কোনো কোনো গল্পে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তার রচনা আশাবাদী। মানবজাতির স্মৃতিতে প্রায় ছ’হাজার বছর ধরে জমছে শতরকম পাপ। শত অন্যায় মনুষ্যজাত রেখে যাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে। এই হতাশা থেকেই হয়তো শূন্য গল্পে লিখলেন-

‘আমি যদি না জানতুম হিংসে কী, জানতুম কী করে ছােরা মারতে হয়, বন্দুক চালাতে হয়—যদি আমায় না শেখানাে হতো, জোচ্চুরি কর, মিথ্যে কথা বল, পরস্ত্রী সম্ভোগ কর, অন্যকে ঘৃণা কর—তবে, ভেবে দেখ আমি কেমন হতুম । মানুষ কেমন হতো—এ পৃথিবী কেমন হতো। পাপ আকাশ থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়েনি। এরও চাষ করতে হয়েছে। এখন আর কোনাে উপায় নেই। মানুষকে আর তুমি শুধরাতে পারবে না, সে আশা কম। এ হচ্ছে রক্তে গচ্ছিত রাখা পৈতৃক মূলধন।’

এই পৈতৃক সম্পত্তি কী করে আজ পুরো মানবসমাজকে ঘিরে ফেলছে, অসুস্থ করে তুলছে, সেটা উপজীব্য করে লিখেছেন ‘ওরা’ গল্পটি। মানবপুত্র গল্পে পাপের অপদেবতা বেলসেবুরের সাত অনুচরকে নিয়ে এসেছেন বাইবেলের পাতা থেকে। যে ‘অপদেবতা সূর্যের আলো মুছে দেয়, গাছের সবুজপাতা এক নিঃশ্বাসে ঝরিয়ে ফেলে, সমুদ্রের জল শুকিয়ে আগুনের ঝড় তোলে, ভীষণ ঝড়।’

বিমল করের বাছাই গল্প; Image Source: Boichoi.com

এতসব পাপের আয়োজনে তিনি হতাশ নন। তিনি আশায় বুক বেঁধে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে জানেন।

‘আফটার অল শূন্য থেকে আমরা শুরু করেছিলাম, এখন এক দুই করে নয় পর্যন্ত এসেছি। আমরা শূন্য আশা করব—পরের শূন্য আসুক— কিন্তু শুরুর শূন্য না, শেষের শূন্য৷’

This article is in Bangla. This is about a prolific writer of bangla literature- Bimal Kar. The style and content of his writing are discussed and briefly analysed in this article.

Featured Image: Anandabazar

 

Related Articles

Exit mobile version