কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে ভেসে বেড়াতেন তিনি। তবে তিনি তার কল্পনাকে শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজোড়া কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী পাঠকের কাছেও! হ্যাঁ, বলছি অপ্রতিদ্বন্দ্বী কল্পবিজ্ঞান লেখক জুল ভার্নের কথা।
আমরা সবাই জানি কল্পবিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়, মূলত কল্পকাহিনী। আর জুল ভার্নও কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না, তবু তার বিজ্ঞান নির্ভর কল্পনা বিজ্ঞানেরই সমতুল্য।
জুল গ্যাব্রিয়েল ভার্ন, আমাদের কাছে পরিচিত ‘জুল ভার্ন’। উনবিংশ শতাব্দীর এক ফরাসি লেখক, যিনি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞানের জগতে। তার জন্ম হয়েছিল ১৮২৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্সের পশ্চিমে বিস্কে উপসাগরে এক ব্যস্ত বন্দর নগর ‘নান্তেস’ এ। জাহাজের আসা-যাওয়ার দৃশ্য ছিলো জুল ভার্নের শৈশব-কৈশোরের নিত্যদিনের অংশ, হয়তো এ দৃশ্যই তার ভ্রমণ কল্পনাকে করেছিলো প্রসারিত।
১২ বছর বয়সে জাহাজে কেবিন বয়ের চাকরি নিয়ে পালিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়েন মায়ের হাতে। সে থেকে ভেবেই নিয়েছিলেন তার অভিযানগুলো হবে কল্পনাতে। অভিযানের রোমাঞ্চ সৃষ্টি হবে কলমে-কাগজে। আর তাই বোর্ডিং স্কুলে থাকাকালেই জুল ভার্ন শুরু করেন ছোট গল্প ও কবিতা লেখা।
জুল ভার্নের পিতা পিয়েরে ভার্ন ও মা সোফি এলো দে লা ফুয়ে। পিতা ছিলেন সেখানকার নামকরা আইনজীবী। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হবার কারণে আইনজীবী পিতার ইচ্ছাপূরণের ভার বর্তায় জুল ভার্নের ওপরেই এবং তাকেও আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে পাঠানো হয় প্যারিসে। কিন্তু প্যারিসে গিয়ে জুল ভার্নের সাহিত্যপ্রেমে যেন আরো দোলা লাগে! পড়াশুনার ফাঁকফোকরে জুল ভার্ন আসা-যাওয়া শুরু করেন প্যারিসের বিখ্যাত সাহিত্যপ্রাঙ্গনগুলোতে। সেখানে অনেক সাহিত্যিক-শিল্পীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। জুল ভার্নের সে সময়ের বন্ধু তালিকায় ছিলেন আলেক্সান্ডার দ্যুমা ও তার পুত্রও। সাহিত্যের এত কাছে আসার সু্যোগ পেয়ে জুল ভার্ন যেন খোঁজ পেয়ে গেলেন এতদিনের আকাঙ্খিত স্থানের। তাই ১৮৪৯ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করার পরও জুল ভার্ন পারলেন না প্যারিস ত্যাগ করতে, থেকে গেলেন সেখানেই, ভাবলেন আরো কিছুদিন শানিয়ে নেয়া যাক তার সাহিত্যচর্চাকে!
সাহিত্যাঙ্গনে জুল ভার্নের প্রবেশ ঘটে মঞ্চনাটক রচয়িতা হিসেবে, তার প্রথম নাটকটি ছিল একটি একাঙ্কিকা- ‘ব্রোকেন স্ট্রোস’। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আইনের পেশাও চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন জুল ভার্ন, কিন্তু ১৮৫২ সালে এসে আর পারলেন না নিজের সাথে মিথ্যাচার করতে! তাকে নিয়ে নান্তেসে আইনব্যবসা চালু করার যে স্বপ্ন তার পিতা দেখেছিলেন, তা বাদ দিয়ে জুল ভার্ন ‘থিয়েটার লিরিক’ এ সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন। এই পেশায় থাকাকালীন তিনি সৃষ্টি করেন ‘ব্লাইন্ড ম্যান’স ব্লাফ’ ও ‘দ্য কম্প্যানিয়নস অফ দ্য মার্জোলাইন’ এর মত নাটক।
১৮৫৬ সালে জুল ভার্ন তার হৃদয়ের গাঁটছড়া বাঁধেন অনরাইন দি ভিয়েনার সাথে। অনরাইন ছিলেন একজন বিধবা এবং তার দু’টি মেয়েও ছিল- সুজানে মরেল ও ভ্যালেন্টাইন। ১৮৫৭ সালে তারা দুজন বিয়ে করেন এবং দুই মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন জুল ভার্ন। বাড়তি পরিবারের জন্য প্রয়োজন পড়ে বাড়তি রোজগারেরও, স্টোকব্রোকার হিসেবে কাজ নেন জুল ভার্ন। তবে কখনোই তিনি তার সাহিত্যচর্চা ছেড়ে দেন নি। সে বছরই প্রকাশ পায় তার প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য ১৮৫৭ স্যালন’ ।
১৮৫৯ সালে জুল ভার্ন ও অনরাইন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে একটি জাহাজযাত্রায় শামিল হন এবং এটি তার লেখনীতে নতুন করে উৎসাহ জোগায়। ১৮৬১ সালে এই দম্পতির একমাত্র পুত্রসন্তান মাইকেল ভার্নের জন্ম হয়।
১৮৬২ সালে প্রকাশক হ্যাটজেলের সাথে সাক্ষাৎ ছিল জুল ভার্নের জীবনের একটি অন্যরকম মোড়। হ্যাটজেল জুল ভার্নের লেখার সর্বোপরি পৃষ্ঠপোষকতা করেন ও তাকে আরো লিখতে উৎসাহ জোগান। জুল ভার্নের প্রথম লেখা উপন্যাস ‘ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন’ এর কাহিনী অবাস্তব বলে কোনো প্রকাশকই তা প্রকাশ করতে চান নি। ক্ষোভে দুঃখে একদিন সে পাণ্ডুলিপি আগুনে পুড়িয়ে ফেলতেও চেয়েছিলেন জুল ভার্ন, পরে তার স্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা রক্ষা পায়। হ্যাটজেলই একমাত্র প্রকাশক যিনি ১৮৬৩ সালে এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেন এবং তার জনপ্রিয়তা তো আজ কোনো কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীরই অজানা নয়! জানা থাকা ভালো যে, এই বইয়েরই সিক্যুয়েল হিসেবে আমরা পেয়েছি আরেক জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’, বিটিভিতে একসময় কিশোর-কিশোরীদের চোখ আটকে যাওয়া সিরিজও ছিল এটি। দেখা পাই ক্যাপ্টেন নিমো আর হার্ডিংয়ের, দেখা পাই সেই ডুবোজাহাজ নটিলাসের।
জুল ভার্নকে কল্পবিজ্ঞানের জনক বলেও অভিহিত করেন অনেকে। তার লেখায় কল্পনার পাশাপাশি ফুটে ওঠেছে সমসাময়িক ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা। জুল ভার্ন সবসময় ফরাসিতেই লিখতেন, তবে তার অধিকাংশ বই-ই অনুবাদ করা হয় ইংরেজী ভাষায়। আগাথা ক্রিস্টির পর জুল ভার্নই সেই লেখক যার লেখা সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। জুল ভার্নের ইংরেজীতে অনুদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো,
• প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি (১৮৬০)
• এ জার্নি টু দ্যা সেন্টার অফ আর্থ (১৮৬৪)
• ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন (১৮৬৫)
• টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী (১৮৬৯)
• দ্য পারসেজ অফ দ্য নর্থ পোল (১৮৮৮)
• দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড (১৮৭৫)
• মাইকেল স্ট্রগফ (১৮৭৫)
• দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি (১৮৭৭)
জুল ভার্নের লেখনীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তার ভবিষ্যৎ দর্শন। তিনি তার বইগুলোতে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বা আবিষ্কারের কথা কল্পনা করেছেন, যা আজকের দিনে বর্তমান ও বাস্তব। জুল ভার্ন বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন না কোনো ভূতত্ত্ববিদও। তিনি তার চিলেকোঠার ঘরটিতে বসে যে বইগুলো রচনা করেছেন তার মূল ইন্ধন জুগিয়েছে বিজ্ঞান ও ভূগোল সম্পর্কে তার অদম্য কৌতূহল আর তাতে রং ঢেলেছে তার ব্যতিক্রমী কল্পনাশক্তি। ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী’তে নটিলাস নামক যে ডুবোজাহাজের কল্পনা তিনি করেন, তার বাস্তব রূপ হিসেবে আমরা প্র্যরছি আজকের সাবমেরিন। উড়োজাহাজ তৈরী যখন কল্পনাতীত, তখন ‘ইন টু দ্য নাইজার ব্যান্ড’ বইয়ে দেখি ‘হেলিপ্ল্যান(হেলিকপ্টার+এরোপ্ল্যান)’ যন্ত্রকে উড়তে। মরুভূমিতে পানির দেখা পাওয়া যখন নিছক আকাশকুসুম চিন্তা, তখন ‘সিটি ইন দ্য সাহারা’তে জুল ভার্ন রীতিমতো একটি শহর গড়ে তোলেন! ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রাখেন, কিন্তু তার প্রায় ১০০ বছর আগেই জুল ভার্নের কল্পনা পৌঁছে গেছিলো তাতে। ‘জার্নি টু দ্য মুন’ বইয়ে তাই তো দেখি! জগদীশ চন্দ্র যখন বেতারের ধারণাও দেন নি, ‘কার্পেথিয়ান ক্যাসল’ বইয়ে জুল ভার্ন বেতারের আভাস দেন তার পাঠকদের। জুল ভার্নের কল্পনাপ্রবণ চিন্তার প্রবলতা সত্যি সেসময়ের পাঠক হলেই বোঝা যেতো ভাল করে, কারণ এখনতো এগুলো আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব!
বাংলাদেশের সেবা প্রকাশনী থেকে জুল ভার্নের বইয়ের অনেক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তার ‘টাইগার্স এন্ড ট্রেইটর্স’ উপন্যাসটি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ও নানা সাহেবের ইতিহাস আশ্রিত একটি উপন্যাস, এতে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে।
জুল ভার্নের পুরষ্কার তালিকার শোভাবর্ধন করেছে ফ্রান্স সাহিত্য একাডেমীর ‘অর্ডার অব মেরিট’ এবং ইংল্যান্ড রয়েল একাডেমীর সম্মানসূচক সদস্যপদও।
১৯০৫ সালের ২৪শে মার্চ ফ্রান্সের আমিয়েন্সে ডায়াবেটিসের কারণে জুল ভার্ন মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিলো ৭৭ বছর। আমিয়েন্সে জুল ভার্নের একটি স্মারকসৌধও আছে।