ঘটনাটি একটি সস্তা দরের সরাইখানার। যেখানে মদ পানীয় ইত্যাদি আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যার পরে লোকেরা গিয়ে সেখানে জমায়েত হতো। আড্ডা হতো, সুরা পান হতো। দরিদ্র শ্রেণীর নাচিয়ে মেয়েরা নাচ গান করতো। বিভিন্ন ধরনের লোকজনের যাতায়াত ছিল সেখানে। গুণ্ডা শ্রেণীর লোকেরাও আসতো। তাদের সাথে অবশ্যই তাদের চরিত্রটিও আসতো। ফলে মাঝে মধ্যেই লেগে যেত মারপিট।
কবি পাবলো নেরুদার বয়স তখন কম। অল্প স্বল্প কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। তার ক্রেপুস্কুলারিও নামক কবিতার বইটি বের হয়েছে কিছুদিন আগে। একদিন কয়েকজন পরিচিত বন্ধুর সাথে বসে সেই সরাইখানায় সুরা পান করছিলেন। নাচ-গান শুরু হয়েছে। তখনই দুজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোকের মধ্যে বচসা বাঁধে। একজন বেশ গায়ে পড়েই অন্যজনকে আক্রমণ করে এবং হাতাহাতি শুরু করে দেয়। হাতাহাতির সাথে সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজও ছিল, তা বলা বাহুল্য।
মুহুর্তেই সরাইখানার পরিবেশ বাজে হয়ে উঠতে লাগলো। বন্ধুদের নিয়ে গল্পগুজব করতে সন্ধ্যার পরে যারা এসেছিলেন তারা ভীত ও বিব্রত হয়ে উঠলেন। কিন্তু কারো সাহস হলো না আগ্রাসী গুণ্ডাটিকে গিয়ে কিছু বলতে। কারণ সবার দেহেই প্রাণ একটি এবং ধড়ের উপর মাথাও একটি। নাচিয়ে মেয়েরা প্রাণভয়ে সরাইখানার পেছনে গিয়ে লুকালো। নেরুদা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রাসী গুন্ডা দুটির সামনে গিয়ে তাকে বললেন, হারামজাদারা, সরাইখানার পরিবেশ নষ্ট করছিস কেন? মানুষ এখানে এসেছে আনন্দ করতে, তোদের মারামারি দেখতে নয়।
দুটি লোকই তার দিকে বেশ অবাক হয়ে তাকালো। তারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ঘটনাটিকে। বেটে খাটো লোকটি এগিয়ে আসে। নেরুদা এতই রেগে ছিলেন যে এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন বক্সিং করা পেটানো শরীরের গুন্ডাটির মুখে। অগ্র পশ্চাত কিছুই ভাবলেন না। লোকটি পড়ে গেল মাটিতে। লোকটির প্রতিপক্ষ তখন তাকে বাগে পেয়ে কিছু কিল ঘুষি মেরে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অপর গুণ্ডাটি এবার এলো নেরুদার সাথে ভাব জমাতে। নেরুদা তাকেও কর্কশ ভাষায় তিরস্কার করলেন। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে-ও বেরিয়ে গেল।
উপস্থিত সবাই ভেবেছিল হয়তো লোকটি নেরুদাকে একহাত দেখে নেবে। কিন্তু ঘটনা হলো উল্টো এবং বিস্ময়কর। সবাই বেশ ধন্যবাদ জানালেন নেরুদাকে। আপ্যায়ন করতে চাইলেন। নেরুদা যখন বন্ধুদের সাথে গল্পগুজব করে তাদের সাথে নিয়েই বের হলেন সরাইখানা থেকে, তখন তারা দেখলেন অনতিদূরে এক গলির ধারে সেই দ্বিতীয় গুন্ডা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তাকে লাগছে আরো ভয়ংকর।
নেরুদার বন্ধুরা ভাবলেন এবার আর বাঁচার উপায় নেই। লোকটি হয়তো ভেতরে কোনো ঝামেলা করতে চায়নি। কিন্তু বাইরে তৈরী হয়ে বসে আছে। এবার আর নিস্তার নেই তার। নেরুদাকে দেখেই লোকটি এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে তাকে রাস্তার এক কোনে নিয়ে বলল, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। আসুন একটু আলাপ করি। ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন কবি। কিন্তু তিনি যেন সমস্ত সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার বন্ধুরাও ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। নেরুদা ভাবলেন ভয় প্রকাশ করা যাবে না, তাই লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলেন। কিন্তু রোগা কবির ধাক্কায় ওরকম শক্তিশালী লোক কি টলে?
লোকটি নেরুদার দিকে একটু ঝুঁকে তাকালো আর তখনই কবি দেখতে পারলেন লোকটির মুখে কোনো হিংস্র ভাব নেই। সে নম্রভাবেই জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি পাবলো নেরুদা? নেরুদা বললেন, হ্যাঁ। লোকটি তখন মুখ কাচুমাচু করে বললো, কী অধম আমি! আপনাকে অপমান করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসি সে আপনার কবিতার খুব ভক্ত। আমরা দুজনে আপনার কবিতা পড়েই ভালোবাসতে শিখেছি। আপনার কবিতার জন্যই আমি সেই মেয়েটির ভালোবাসা পেয়েছি।
এরপর সে তার পকেট থেকে তার প্রেমিকার একটি ছবি বের করে বললো, আপনি এই ছবিটি একবার স্পর্শ করুন। তাহলে আমি তাকে বলতে পারবো পাবলো নেরুদার হাতের স্পর্শ আছে ছবিটিতে। ছবিটি যখন নেরুদা স্পর্শ করলেন তখন লোকটি নেরুদার লেখা কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলো। কবিতা আবৃত্তি শুনে নেরুদার বন্ধুরা এগিয়ে এলেন। দেখলেন অদ্ভুত দৃশ্য। নেরুদা যখন বন্ধুদের সাথে চলে যাচ্ছিলেন তখনও লোকটি কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছে।
এরকম একজন কবি ছিলেন পাবলো নেরুদা, যিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়াবেগকে স্পর্শ করতে পারতেন। তাদের সুখ, দুঃখ ও স্বপ্নকে নাড়া দিতে পারতেন। হাজার হাজার খনি শ্রমিকদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন কবিতা পড়তেন তখন নিঃশব্দে সেই শ্রমিকেরা কবিতা পাঠের তালে তালে তাদের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওঠানামা করতেন। ভাঙ্গাচোরা ঘরে, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে, হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে বসে সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষেরা নেরুদার মুখে তার কবিতা শুনতো তন্ময় হয়ে।
কবিতা শোনার পর অঝোরে কাঁদতেন অনেক শ্রোতা। দক্ষিণ চিলির পাররালে নামে এক গ্রামে ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই জন্ম নিয়েছিলেন এই কবি। সাধারণ এক রেল শ্রমিকের পরিবারে তার জন্ম। কবিতায় তিনি দুঃখী, নিপীড়িত ও নির্যাতীত মানুষের মুক্তির জন্য লিখেছেন। এ কাজে নিজের জীবনই উৎসর্গ করেছেন। কবিতায় বাস্তববাদ এড়িয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত মানসিকতা তার ছিল না।
নানা ঘটনায় ঘটনাবহুল তার জীবন। ১৯৪৮ সালে চিলির ব্যবস্থাপক সভায় তিনি নির্বাচিত হন। আবার সে বছরই তাকে বহিষ্কার করা হয় এবং জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কবি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন। ঘুরে বেড়ান ইউরোপ, সোভিয়েত ও চীন দেশ।
১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফেরার অনুমতি পান। এ বছরই তাকে স্তালিন বা পরবর্তীতে লেনিন নাম হওয়া পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭০ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি তাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে। কিছুদিন পরে তিনি তার বন্ধু সালবাদোর আয়েন্দের পক্ষে নির্বাচন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন। সারা দেশে তিনি আয়েন্দের পক্ষ হয়ে প্রচারণা চালান। ১৯৭১ সালে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলেন ফ্রান্সের প্যারিসে। সে বছরই তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে তিনি ফিরে আসেন চিলিতে, নিজ দেশে।
১১ ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। সামরিক বাহিনীর হাতে রাষ্ট্রপতি সালবাদোর আয়েন্দে খুন হন। এর প্রায় বারো দিন পরে অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে সান্তিয়াগোর এক হাসপাতালে অসুস্থ কবি পাবলো নেরুদা ইহধাম ত্যাগ করেন।
নেরুদার মৃত্যুর পরে ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনী তার দু’টি বাসগৃহ লুটপাট করে। তার অমূল্য সব সম্পদ, সংগৃহীত পুরনো বই, নথিপত্র, পাণ্ডুলিপি, পাবলো পিকাসোর দেয়া ছবি ইত্যাদি সব কিছু নষ্ট করে ফেলা হয়। এরপর বাড়িতে পানির সব কল খুলে রেখে সমস্ত কিছু জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। যাতে সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনীর সেই চেষ্টা সার্থক হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নেরুদাকে মোছা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র: অনুস্মৃতি, পাবলো নেরুদা, মর্মানুবাদ: ভবানীপ্রসাদ দত্ত, একুশে পাব্লিকেশন্স, ঢাকা।
ফিচার ইমেজ: multiculturalarts.com.au