তেনালি রমন ও বিক্রমাদিত্য বলে কি আসলেই কেউ ছিল?

সাহিত্যের কিছু কিছু চরিত্র সম্পর্কে আমরা এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়ি যে চরিত্রগুলোকে অনেক সময় সত্যি বলে মনে হয়। ভাবতে থাকি, চরিত্রগুলো বাস্তব। নিশ্চয়ই তারা এই পৃথিবীতে ছিলেন। পৃথিবীর কোথাও, কোনো জনপদে তাদের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। চরিত্রগুলো এই পৃথিবীতে ছিল কি না তার সন্ধান করতে শুরু করে পাঠক থেকে গবেষক। 

সত্যিই কি লোকগল্প, ইতিহাস আর গল্পকথার চরিত্রগুলোর বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল? নাকি তারা সবাই কাল্পনিক? এ নিয়ে গবেষকরাও নানা বিচার-বিশ্লেষণ করতে লাগলেন। এমনই দুটি জনপ্রিয় চরিত্র তেনালি রমন ও বিক্রমাদিত্য। বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা অনুসন্ধানে আজকের এই আয়োজন।

তেনালি রমন

১৩৬৬ সালে হরিহর ও বুক্কা দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রায় তিনশো বছরের বেশি সময় ধরে চলে এই সাম্রাজ্য। ১৪৭১ সাল থেকে ১৫২৯ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণদেবার্য এই সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন। বিদ্বান, জ্ঞানী হিসেবে তার বেশ সুনামও ছিল। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বীর।

শোনা যায়, সেই রাজার রাজসভায় তেনালি রমন নামে নাকি এক বিদুষক ছিলেন। মোঘল সাম্রাজ্যে যেমন বীরবল, তেমনি রাজা কৃষ্ণদেবার্যের সভায় তেনালি রমন। সাহিত্যে তেনালি রমনকে নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে, যেখানে তেনালি রমনের উপস্থিত বুদ্ধি হারিয়ে দেয় সবাইকে, এমনকি স্বয়ং রাজাকেও।

এসব গল্পে তেনালি রমনের যে চরিত্র সম্পর্কে আমরা অবগত হই, তাতে দেখা যায়, তেনালি রমনের বুদ্ধি, কৌশলের কাছে রাজা থেকে মন্ত্রী, রাজ পুরোহিত সবাই কুপোকাত।

অন্ধ্র প্রদেশের গুন্টুর জেলার তেনালি নামক পৌর শহরে স্থাপিত তেনালি রমনের ভাস্কর্য; Image Source: Wikimedia commons

কিন্তু এমন বিশাল বিজয় নগর সাম্রাজ্য যারা এতদিন ধরে সুনামের সাথে পরিচালনা করেছেন, তাদের বিদ্যা, বুদ্ধি, বিদূষকের চেয়ে কি কম ছিল? তাদের কাজকর্ম, কথাবার্তায়, জ্ঞানের অভাব থাকবে, এমনটা ভাবা খুব একটা যুক্তিসঙ্গত হবে না তা বলাই যায়।  বরং গল্পের প্রয়োজনে রাজা, মন্ত্রী এবং অন্যান্য চরিত্রকে এমনভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে।

গবেষকরা ঠিক এমনটাই মনে করেন। তেনালি রমন দক্ষিণ ভারতে তো বটেই, কার্টুনের বদৌলতে সব জায়গায় ছোট-বড় সবার কাছে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগে, বিজয়নগর রাজ্য যদি থেকে থাকে, তাহলে সেই সাম্রাজ্যের রাজসভায় তেনালি রমন বলে কেউ কি ছিলেন?

কার্টুনের এক জনপ্রিয় চরিত্র তেনালি রমন; Image Source: topyaps.com 

এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যের গবেষকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে অধিকাংশের মতে, তেনালি রমন একজন কাল্পনিক চরিত্র। রাজা কৃষ্ণদেবার্যের রাজসভায় আটজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। অনেকে বলেন, আসলে তারা কবি নন, তারা ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী। এই আটজনকে একসাথে ‘অষ্ট দিগ্গজ’ বলা হতো। অনেকটা বিক্রমাদিত্যের সভার ‘নবরত্ন’ এর মতো।

তেনালি রমনের চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হয়েছে একাধিক নাটক; Image Source: scoopwhoop.com

এই অষ্ট দিগ্গজের মধ্যে একজনের নাম ছিল তেনালি রামকৃষ্ণ। তার আসল নাম ছিল তেনালি রামলিঙ্গম। পরিবারের সবাই ছিলেন শিব ভক্ত। কিন্তু তেনালি পরে বিষ্ণুর উপাসক হয়ে ওঠেন এবং তেনালি রামলিঙ্গম নাম পরিবর্তন করে রাখেন তেনালি রামকৃষ্ণ।

ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে অন্ধ্র প্রদেশের গুন্টুর জেলার তেনালি নামক এক পৌর শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। ব্রাক্ষণ পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। আর তাই হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে তার গভীর পান্ডিত্য ছিল। সংস্কৃত এবং মাতৃভাষা তেলেগুর উপর তার পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। শুধু তা-ই নয়, বিদ্বান এই মানুষটি আদতে একজন কবি ছিলেন। তেলেগু ভাষায় আদি কবিদের মধ্যে তাকে অন্যতম বলে ধরা হয়। 

তেনালি রমনের চরিত্র নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও; Image Source: topyaps.com

গবেষকদের ধারণা, রাজা কৃষ্ণদেবার্যের পরামর্শদাতার ভূমিকাও তিনি কখনো কখনো পালন করে থাকতে পারেন। তার খুব ভালো উপস্থিত বুদ্ধি এবং রসবোধ ছিল। রাজসভায় এই কবির সাথে রাজার কথাবার্তা হয়তো বা লোকমুখে প্রচার পেয়ে গিয়েছিল। আর সেসবের আদলে পরবর্তীতে নিত্যনতুন মজার সব গল্প নিয়ে তেনালি রমন নামে এক বিদূষকের জন্ম হয়েছিল।  

গল্পকথায়, লোকমুখ থেকে শুনে শুনে যা বংশ পরম্পরায় নতুন নতুন রূপ পেয়েছে। এই তেনালি রামকৃষ্ণই যে রাজা কৃষ্ণদেবার্যের রাজসভার তেনালি রমন এর সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। আর তাই রাজা কৃষ্ণদেবার্যের রাজসভায় তেনালি রমন বলে কোনো বিদূষক ছিলেন, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের অনেকেই সেটা মনে করেন না। 

রাজা বিক্রমাদিত্য

শৈশবে বহুল পঠিত এক বই ‘বিক্রম আর বেতাল’। এই বইয়ের মাধ্যমেই রাজা বিক্রমাদিত্যের শৌয-বীর্যের কথা প্রথম জানা যায়। গল্পের পটভূমি অনেকটা এরকম। গল্পের প্রধান চরিত্র রাজা বিক্রমাদিত্য একজন পিশাচ বা বেতালকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যতবার তিনি বেতালকে ধরে নিয়ে আসছেন, ততবারই বেতাল রাজার কাঁধে করে চলতে চলতে একটি করে গল্প বলে যাচ্ছে।

ছোট-বড় সকলের বহুল পঠিত গল্প ‘বিক্রম আর বেতাল’; Image Source: devdutt.com

গল্পের শেষে বেতাল রাজাকে একটি করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতো। জানা থাকলেও রাজা বিক্রমাদিত্য তার উত্তর না দিলে বেতাল রাজার মাথা ফাটিয়ে দেবে। আর এ কারণে রাজা বেতালের প্রতিবার করা প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য থাকেন। যেই রাজা মুখ খুলেছেন, তখনই পালিয়ে যেত বেতাল। কারণ বেতালকে ধরার প্রধান শর্তই ছিল পথে রাজা কোনো কথা বলতে পারবেন না।

‘বিক্রম আর বেতাল’ এর এই গল্পের রচয়িতা এক কাশ্মীরি পন্ডিত মহাকবি সোমদেব ভট্ট। কাশ্মীরের রাজা অনন্তদেব এবং রানী সূর্যমতির বিনোদনের জন্যই ৩৫০টি গল্পের ১৮টি বই লিখেছিলেন সোমদেব, যা ‘কথাচরিত সাগর’ নামে পরিচিত। প্রায় ২,৫০০ বছর আগে তিনি এই গল্পগুলো রচনা করেন।

কমিক্সের বাইয়ের পাতায় উঠে আসা রাজা বিক্রমাদিত্যের বিজয় অভিযান; Image Source: swamirara.com

গল্পের শুরুতে রাজা বিক্রমাদিত্য নানা উপায়ে ২৫ বার বেতালকে ধরে আনতে সক্ষম হন এবং পঁচিশবারই বেতাল নানা গল্পের আশ্রয় নিয়ে রাজাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আর এভাবেই মহাকবি সোমদেবের ‘কথাচরিত সাগর’ রচনার একটি অংশ হলো পঁচিশটি গল্পের ‘বিক্রম আর বেতাল’। যে গল্প বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, যা আজও লোকমুখে সমান জনপ্রিয়।

বিক্রমাদিত্য কথার অর্থ হলো সূর্যের প্রতাপ। এখন এই বিক্রমাদিত্য কি আসলে কোনো রাজা? নাকি কাল্পনিক চরিত্র? এটা ঠিক যে, কোনো গল্পের চরিত্র তা তো কাল্পনিক হতেই পারে, বিক্রমাদিত্য বাস্তবে ছিলেন নাকি, তিনি কল্পনার রাজা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যেই রয়েছে নানা মতভেদ।

ভারতীয় ইতিহাসে তিনজন বিক্রমাদিত্যের কথা রয়েছে, যাদের কম-বেশি একটু পরিচিতি রয়েছে। অনেকে মনে করেন, সেই তিন বিক্রমাদিত্যের একজন হলেন বিক্রম-বেতালের বিক্রম।

এছাড়াও আরো অনেক বিক্রমাদিত্যের নাম ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- ‘ভবিষ্যৎ পুরাণে’ (মোট ১৮টি পুরাণের একটি) এক বিক্রমাদিত্যের নাম রয়েছে। অনেকে ভাবেন, তিনিই সোমদেবের গল্পের বিক্রমাদিত্য। বিক্রমাদিত্য নামটি সোমদেব কোনো নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রেখেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। কিন্তু অনেক গবেষকের মতে, সোমদেবের বিক্রমাদিত্য একদমই কাল্পনিক।

 রাজা বিক্রমাদিত্যকে নিয়ে রচিত প্রাচীন এক পুথি; Image Source: Wikimedia commons

কথাচরিত সাগরে যে বিক্রমাদিত্যের কথা বলা হয়েছে, তার বাবার নাম মহেন্দ্রদিত্য। আর পুরাণে বর্ণিত বিক্রমাদিত্যের বাবা হলেন গন্ধর্বসেনা। এই বিক্রমাদিত্য তার রাজসভায় নয়জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে নিয়ে নবরত্ন সভা গঠন করেছিলেন। 

সোমদেবের বইয়ের মারাঠা রাজপুত পারমারা বংশের শাসক ছিলেন মহেন্দ্রদিত্য, যার অন্যতম রাজা ছিলেন ভোজ। কিন্তু সেই বংশে যারা শাসক ছিলেন তাদের মধ্যে মহেন্দ্রদিত্য বা বিক্রমাদিত্য বলে কেউ ছিলেন কি না তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় যে তিন বিক্রমাদিত্যকে পাওয়া যায়, তাদের একজন ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় এক রাজা। খ্রিস্টপূর্ব শেষ হয়ে যখন শতাব্দীর শুরু হয়েছে, সেই সময়কালে তিনি উত্তর ভারতের শাসক ছিলেন। যিনি মধ্য এশিয়া থেকে আসা লুন্ঠনকারী শত্রুদের আক্রমণ রুখে দেন। যে ঘটনার পর নতুন দিনপঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন তিনি, যা ‘বিক্রম সম্বৎ’ নামে পরিচিত।

মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নী শহরে স্থাপিত রাজা বিক্রমাদিত্যের ভাস্কর্য; Image Source: Wikimedia commons

আরেকজন বিক্রমাদিত্য হলেন সমুদ্র গুপ্তর পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, যিনি হূণ আক্রমণ প্রতিহত করে ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। তৃতীয়জন হলেন দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে (১৫৫৬) আকবরের প্রতিপক্ষ হিমু, যিনি আফগান নেতা আদিল শাহ সুরির সেনাপতি ছিলেন। এই যুদ্ধের আগে পরাক্রমশালী মুঘল সেনাদের হারিয়ে দিয়ে বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন হেমচন্দ্র বা হিমু। কিন্তু এদের কেউই যে সোমদেবের ‘বিক্রম আর বেতাল’ গল্পের সেই বিক্রম, এ কথা ইতিহাসবিদরা এখনো স্বীকার করেননি।

ফিচার ইমেজ- shivsagarblog.wordpress.com 

Related Articles

Exit mobile version