পৃথিবীকে আমি গিলগামেশের কথা শোনাব। যিনি সব জানতেন, চিনতেন পৃথিবীর সব রাজ্য। জ্ঞানী ছিলেন তিনি। মুখোমুখি হয়েছিলেন রহস্যের, জানতেন অনেক গোপন কথা। মহাপ্লাবনের পূর্বের দিনগুলোর কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন। দীর্ঘ এক যাত্রায় বেরোন তিনি। পরিশ্রান্ত, অবসন্ন দেহে ফেরার পর বিশ্রাম করেন। তারপর পুরো গল্পটি লিখে রাখেন পাথরখণ্ডে।
—দ্য এপিক অব গিলগামেশ, ইংরেজি অনুবাদ: এন.কে. স্যান্ডার্স (পেঙ্গুইন বুকস, ১৯৭২); পৃষ্ঠা: ৬১
গিলগামেশ, পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য। ইলিয়াড ও ওডিসির প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে যা রচিত হয়েছিল। এই মহাকাব্য আবর্তিত হয়েছে প্রাচীন নগরী উরুকের রাজা, গিলগামেশ ও তার বন্ধু এনকিদুকে ঘিরে। দেবতা, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক ও অমরত্বের সন্ধান ইত্যাদি উঠে এলেও, এই মহাকাব্যের মূল কথা দুজন প্রায় দেবতা ও প্রায় বনমানবের মানুষ হয়ে ওঠা নিয়ে। বন্ধুত্বের জন্য মৃত্যুকে পরাজিত করার প্রচেষ্টা নিয়ে। কিন্তু মৃত্যুকে কি হারানো যায়? মানুষ কি পেতে পারে অমরত্ব?
মহাকাব্য-কথা
রামায়ণ-মহাভারতের নাম শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। ভারত উপমহাদেশেই রচিত হয়েছে এই দুটি মহাকাব্য। যদিও রামায়ণ-মহাভারতের কথা আসলে হিন্দু ধর্মের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু এই মহাকাব্য দুটি কেবলই একটি ধর্ম বা একজন লেখক এবং কিছু চরিত্রের সন্নিবেশ না।
মহাকাব্য মানেই, তাতে উঠে এসেছে একটি সভ্যতা ও সমাজের জীবনদর্শন, মানবিকতা, শুভ ও অশুভের ব্যবধান ইত্যাদি। মহাকাব্য কিছু চরিত্রের গল্প হলেও এর ক্যানভাস জীবনের চেয়ে বড়, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। কারণ, এর লেখক হয়তো একজন-যেমন, রামায়ণের লিপিকার বাল্মীকি-কিন্তু তিনি নিজেই এর রচয়িতা নন। যুগে যুগে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে পুরো সভ্যতার গল্প, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি মিলে-মিশে ধীরে ধীরে তৈরি করে মহাকাব্য।
একই কথা খাটে হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসির ক্ষেত্রেও। আমরা জানি, হোমার একজন কবি ছিলেন না। যুগে যুগে একাধিক কবি, সভ্যতা ও সময়ের হাতে হাত রেখে রচনা করেছেন এই মহাকাব্য দুটি।
গিলগামেশও তেমনি কোনো একজন মানুষের রচিত নয় বলেই মনে করা হয়। হায়াৎ মামুদ ‘গিলগামেশ’ নামে শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে এই মহাকাব্যটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ লিখেছেন। তার ভূমিকায় তিনি বলেছেন—
কে রচনা করেছিলেন এই উপাখ্যান, আমরা জানি না। জানা সম্ভবও নয়, কেননা কোনো একজন ব্যক্তি বা কবি তো এর রচয়িতা নন। লোকের মুখে মুখে বহু পুরুষ ধরে বংশপরম্পরায় যুগে যুগে গিলগামেশকে নিয়ে অজস্র কাহিনী প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো একসময়ে তা সর্বপ্রথম ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়। কোনো একজন লোক যে একা বসে বসে লিখেছিলেন, তা মনে হয় না। বহু সময় ধরে বহু ব্যক্তি ঐ কাজ সমাধা করেছিলেন হয়তো।
হায়াত মামুদ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের কথা লিখলেও এটি মূলত ১৩০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা।
কিন্তু কীভাবে আবিষ্কৃত হলো এই মহাকাব্য? কীভাবে জানা গেল এর রচনাকাল? সেসব কথায় আমরা একটু পরে আসব। তার আগে চলুন, জেনে নেয়া যাক গিলগামেশ মহাকাব্য-দ্য এপিক অব গিলগামেশ-এর মূল গল্প।
দ্য এপিক অব গিলগামেশ
প্রাচীন দক্ষিণ মেসপটেমিয়া অঞ্চল। ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদী দুটির মধ্যবর্তী দোআব অঞ্চলের গড়ে উঠেছে উরুক রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা গিলগামেশ। প্রচণ্ড সাহসী, সুপুরুষ এবং বীরযোদ্ধা। দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা, এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। তার বাবা উরুকের ধর্মযাজক লুগালাবান্দা, মা দেবী নিনসাল। দেবীর দিক থেকেই তার দেহে দেবত্বের ধারাটি এসেছে। গিলগামেশ তাই মানুষ হয়েও অমর, অপ্রতিরোধ্য।
সব হাতের মুঠোয় পেলে যা হয়, গিলগামেশেরও তাই হলো। তিনি খেয়ালি ও অত্যাচারী হয়ে উঠলেন। প্রজারা তাকে রাজ্য রক্ষা ও সুনাম ধরে রাখার জন্য রাজা হিসেবে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার খামখেয়ালি ও অত্যাচারে তাদের জীবন বিষিয়ে উঠেছিল। এমনকি, কেউ বিয়ে করতে চাইলে নববধূকে আগে রাজার সঙ্গে কিছুদিন কাটাতে হতো, তার সেবা করতে হতো। রাজা সন্তুষ্ট হলেই কেবল বধূ ফিরে যেতে পারত নিজের নতুন সংসারে।
গিলগামেশ মহাকাব্য অনুযায়ী, দেবরাজার নাম আনু। তার মন্দির ছিল উরুকে। রাজ্যের প্রজারা সেখানে গিয়ে তার কাছে বিচার চাইল। তিনি দেবী আরুরুকে ডাকলেন।
এই আরুরুই মাটি ছেনে মানুষ তৈরি করেছেন। তাই তাকেই দায়িত্ব দিলেন আনু, তৈরি করতে হবে গিলগামেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। আরুরু ঠিক গিলগামেশের মতো করে তৈরি করলেন এক বনমানুষ। এনকিদু। পার্থক্য বলতে, এনকিদুর সারা শরীর পশুদের মতো লোমে ঢাকা। তাকে তিনি ছেড়ে দিলেন বনে। বিশাল অরণ্যে, প্রকৃতি ও পশুদের সঙ্গে, সবার চোখের আড়ালে বড় হতে লাগল এনকিদু।
এনকিদুকে প্রথম দেখতে পান এক শিকারী। এরকম অদ্ভুত প্রাণী দেখে ভয় পেয়ে যান তিনি। তবে বুঝতে পারেন, প্রাণীটি মানুষ। কিন্তু সে তার মানুষ-পরিচয় জানে না।
খবর পৌঁছে গিলগামেশের কাছে। রাজা কিন্তু এসব শুনে পাত্তা দিলেন না। ঠিক বিশ্বাসও করলেন না। তবু একটা উপায় বাতলে দিলেন— দারুণ সুন্দরী কাউকে পাঠাতে হবে বনে। এনকিদু তার ক্ষতি করতে পারবে না, অন্তত সৌন্দর্যের জন্য। আর, মানুষ হিসেবে সে সেই মেয়েটির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চাইবে। তখন দেখা যাবে, বনের প্রাণীরা আর তার সঙ্গ চাইছে না। ফলে মেয়েটা তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিয়ে আসতে পারবে শহরে।
ঠিক তা-ই হলো। এনকিদু চলে এল শহরে। জানতে পারল গিলগামেশের অত্যাচারের কথা। বিয়ে করতে চাচ্ছিল এক লোক। নববধূর ব্যাপারে তিনি জানালেন এনকিদুকে। বললেন, সেজন্যই তিনি বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন উরুকে, রাজার অনুমতি নিতে। সব শুনে এনকিদুও এলেন উরুকে। মুখোমুখি হলেন গিলগামেশের। প্রচণ্ড এক লড়াই বেঁধে গেল তাদের মধ্যে। একসময় তারা দুজনেই বুঝলেন, দেখতে তারা প্রায় একরকম। সাহস ও বীরত্বেও তাই। লড়াই থেমে গেল, হয়ে গেল বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্বের জন্য গিলগামেশ পাড়ি দেবেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, পেরিয়ে যাবেন মৃত্যুসায়র। জানতে পারবেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যটির কথা।
যাই হোক, বন্ধু এনকিদুকে নিয়ে গিলগামেশ বের হলেন অভিযানে। দৈত্য হুম্বাবাকে হত্যা করে তিনি নিজের কীর্তি রেখে যেতে চান। এই দৈত্যকে অরণ্য রক্ষায় নিয়োজিত করেছিলেন দেবতারা। গিলগামেশ সেসবের পরোয়া করলেন না। দেবী মায়ের সাহায্যে সূর্যদেবের আশীর্বাদ আদায় করে নিলেন। হত্যা করলেন হুম্বাবাকে।
এ সময় দেবী ইশরাত তাকে বিয়ের প্রস্তাব ও প্রলোভন দেখান। দেবীকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করেন গিলগামেশ। ক্ষুদ্ধ ইশরাত বাবা, দেবরাজ আনুর কাছে গিয়ে স্বর্গীয় ষাঁড় চাইলেন গিলগামেশকে শায়েস্তা করার জন্য। গিলগামেশ একা কতটা করতে পারতেন, তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু ষাঁড় যখন গিলগামেশকে আক্রমণ করছিল, সেই ফাঁকে বুদ্ধি করে এনকিদু ঠিকই হত্যা করল স্বর্গীয় ষাঁড়কে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত দেবতারা গিলগামেশকে শাস্তি দেয়ার জন্য তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষটিকে সরিয়ে নিতে চাইলেন। মারা গেল এনকিদু।
এনকিদুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রথম পর্ব শেষ। শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে প্রিয় বন্ধুকে পুনর্জীবিত করতে গিলগামেশ পথে নামলেন। তিনি শুনেছেন, পৃথিবীর শেষ প্রান্তে থাকেন উৎনাপিশতিম। জ্ঞানী এই বৃদ্ধ মহাপ্লাবনেও মারা যাননি। তিনি নাকি জানেন অমরত্বের রহস্য। যে করেই হোক, তার কাছ থেকে এই রহস্য জানতে হবে।
শুরু হলো গিলগামেশের যাত্রা। বিশাল অরণ্য, পাতাল থেকে শুরু করে আকাশ ছোঁয়া মাশুপর্বত পেরিয়ে তিনি পৌঁছালেন মৃত্যুসায়রের পাড়ে। উৎনাপিশতিমের নৌকার মাঝি উর্শানাবি ছাড়া আর কেউ পেরোতে পারে না এই নদী। উর্শানাবি বললেন, তিনি ওকে পার করাবেন না। ভেলা ও বৈঠা তৈরি করে নিজেকেই পেরোতে হবে। তবে যে বৈঠা একবার পানি স্পর্শ করবে, তা আর ওঠানো যাবে না। অসম্ভবকে সম্ভব করল গিলগামেশ। হাজির হলো উৎনাপিশতিমের কাছে।
জ্ঞানী বৃদ্ধ তাকে জানালেন, মৃত্যু থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। মহাপ্লাবনের সময় দেবতা এয়ার দয়ায় তিনি বেঁচে গেছেন। আর কিছু না। শোকে কাতর গিলগামেশকে দেখে মায়া হলো উৎনাপিশতিমের স্ত্রীর। স্বামীকে তিনি তিরস্কার করলেন। সেজন্যই, উৎনাপিশতিম সত্যিটা জানালেন গিলগামেশকে। মৃত্যুসায়রের তলায় গায়ে কাঁটাযুক্ত একধরনের লতা আছে, জীয়নলতা। এই লতাই পারে মানুষকে অমরত্ব দিতে।
গিলগামেশ উদ্ধার করলেন সেই জীয়নলতা। তারপর পা বাড়ালেন উরুকের পথে। বন্ধুকে তিনি পুনর্জীবিত করবেন, দেবেন অমরত্ব।
পথে, এক দীঘির পাড়ে জীয়নলতা রেখে গোসল করতে নামলেন গিলগামেশ। এতদিনের ক্লান্তি ধুয়ে গেল শীতল জলে। আর, সেই ফাঁকে এক সাপ এসে খেয়ে গেল জীয়নলতা। গিলগামেশ গোসল সেরে উঠে দেখেন, সাপের মৃত খোলস পড়ে আছে দীঘির পাড়ে। আর, জীয়নলতা খেয়ে নবযৌবন নিয়ে চলে গেছে সেই সাপ।
ক্লান্ত, পরাজিত, পরিশ্রান্ত গিলগামেশ উরুক ফেরেন। এক উরুকবাসীকে তিনি জিজ্ঞেস করেন এনকিদুর কথা। ‘কে সে?’ জবাব দেয় উরুকবাসী। গিলগামেশ বোঝেন, যে মারা গেছে, সে হারিয়ে গেছে ইতিহাসের বাঁকে। তাকে কেউ কেউ মনে রাখে না।
গিলগামেশ মহাকাব্য আবিষ্কারের গল্প
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই বিভিন্ন লেখকদের কলমে একটি প্রাচীন সভ্যতার পতনের কথা উঠে এসেছে। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য।
শোনা যায়, সুবিশাল সেই সাম্রাজ্যের শেষ রাজা সার্দানাপলাস বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও অনেক অনেক দাসী পরিবেষ্টিত অবস্থায় আত্মহত্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, সার্দানাপলাস না, সর্বশেষ সেই রাজার নাম আশুরবানিপাল। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্যমতে, স্বয়ং স্রষ্টার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে গেছে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য। কিংবদন্তী আর গুজব ঘুরে ফেরে। আগ্রহী অভিযাত্রী থেকে শুরু করে শখের প্রত্নতাত্ত্বিক, সবাই খুঁজে ফেরে সেই সভ্যতা। ঠিক যেন উইলবার স্মিথের লেখা গল্প!
কিন্তু ১৯ শতকের মধ্যভাগে উত্তর ইরাকের মসুল শহরের কাছাকাছি আবিষ্কৃত হয় হারিয়ে যাওয়া এক শহরের ধ্বংসাবশেষ। এই শহরের নাম নিনেভেহ (Nineveh)। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। কিংবদন্তী পরিণত হয় সত্যে!
১৮৪৯ সাল। স্থান: মসুলের নিকটবর্তী এলাকা (প্রাচীন নিনেভেহ শহর)। ব্রিটিশ মিউজিয়াম গত চার বছর ধরে এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করছে। প্রজেক্টের দায়িত্বে আছেন প্রত্নতাত্ত্বিক অস্টিন হেনরি লায়ার্ড (Austen Henry Layard)। কাজকর্ম ভালই আগাচ্ছে, বলা চলে। কিন্তু চার বছর পরে এসে লায়ার্ড এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করলেন। আবিষ্কার করে বসলেন রাজা আশুরবানিপালের হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন গ্রন্থাগার।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের তথ্যানুযায়ী, এই আবিষ্কারের ফলে ৩০,০০০ ট্যাবলেট (পাথরখণ্ড) উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এসব পাথরখণ্ডের ১২টি ট্যাবলেট মিলে লেখা হয়েছে গিলগামেশ মহাকাব্য। যার ১১তম খণ্ডে লেখা আছে মহাপ্লাবন (Great Flood)-এর কথা। ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মমতে যা নূহ (আঃ) এর সময় হয়েছিল। এই মহাপ্লাবনের সবচেয়ে প্রাচীন বর্ণনাসূত্র ছিল বাইবেলের বুক অব জেনেসিস। নতুন এই ট্যাবলেট এখন সবচেয়ে পুরাতন বর্ণনাসূত্রের জায়গা দখল করে নিল।
এছাড়াও সেই ট্যাবলেটগুলোতে লেখা আছে এনুমা এলিশ—ব্যাবিলনবাসিদের দৃষ্টিতে পৃথিবী, স্বর্গ ও নরক সৃষ্টির উপাখ্যান! (আশুরবানিপালের গ্রন্থাগার নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন এখানে।)
কিংবদন্তী বনাম বাস্তবে গিলগামেশ
গিলগামেশকে (রোমান উচ্চারণে বিলগামেশ) ঐতিহাসিকরা উরুকের ‘আধা-কিংবদন্তী’ ও ‘আধা-বাস্তব’ রাজা বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমরা একটু পরে দেখব। কিন্তু, শুধু গিলগামেশ মহাকাব্য থেকেই এই উত্তরের ব্যাপারে বেশ খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়।
মহাকাব্য মতে, গিলগামেশের বাবা ছিলেন মানুষ, কিন্তু মা দেবী। স্বাভাবিকভাবেই, তার মা যে দেবী- এটি ঐতিহাসিক ও যৌক্তিকভাবে সম্ভব না। আবার, দৈত্য হুম্বাবাকে হত্যা কিংবা এনকিদুর মৃত্যুর পরে পৃথিবীর শেষ মাথায় গিয়ে জীয়নলতার সন্ধান, উর্শানাবির পরামর্শে নৌকায় করে মৃত্যুসায়র পেরিয়ে উৎনাপিশতিমের দেখা পাওয়া। এসব কিছুর কোনোটারই ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। মহাপ্লাবনের কথা অবশ্য ধর্মগ্রন্থগুলোতে এসেছে। কিন্তু তাতে জীয়নলতা, মৃত্যুসায়র বা উৎনাপিশতিম কারো উল্লেখ নেই। স্বাভাবিক যুক্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এদেরকে তাই বাস্তব বলে মনে হয় না। এখান থেকে গিলগামেশের ‘কিংবদন্তী’ অংশটুকু স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, গিলগামেশ নামের কেউ কি আদৌ বাস্তবে ছিলেন?
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ছিলেন। ২৯০০-২৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তিনি সুমেরীয় শহর উরুকে রাজত্ব করেছিলেন বলে মনে করা হয়। প্রাচীন প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্টেফানি ডেলি মনে করেন, সুনির্দিষ্ট কোনো সময়কাল বলা না গেলেও, ২৮০০ থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তিনি রাজত্ব করেছিলেন।
১৯৫৫ সালে টুমাল ইন্সক্রিপশন আবিষ্কৃত হয়। এই ইন্সক্রিপশনের ভাষ্যমতে, গিলগামেশ উরুকের চারপাশে একটি দেয়াল তুলেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গিলগামেশ মহাকাব্যে এই দেয়াল নির্মাণ ও এ সময় প্রজাদের প্রতি তার অত্যাচারের (অতিরিক্ত কাজ করানো, চাপ দেয়া ইত্যাদি) কথা এসেছে!
গিলগামেশের সমসাময়িক সময়কার কিশ-এর রাজা এন্মেবারাগেসিও (Enmebaragesi) গিলগামেশকে উরুকরাজ বলেছেন। এই কিশ হলো সুমেরের এক পার্বত্য রাজ্য। আবার, পাথরে খোদাই করা সুমেরিয়ান রাজাদের তালিকায়ও (Sumerian King List) পাওয়া যায় গিলগামেশের নাম। এই তালিকা বলে, গিলগামেশের রাজত্বকাল ছিল ১২৬ বছর। কিংবদন্তী অনুযায়ী, মৃত্যুর পর তার দেহ ইউফ্রেতিস নদীর তলদেশে কবরস্থ করা হয়।
শেষের আগে
রামায়ণে রাবণকে হারিয়ে রাম জিতে যান, এ কথা সবাই জানেন। ট্রয় নগরী যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গ্রিকদের ট্রোজানহর্সের কারিকুরিতে, সে কথাই জানেন সবাই। কিন্তু তাতে কি পুরো রামায়ণ বা ইলিয়াড পড়ার সাধ মেটে?
এই লেখাও তাই গিলগামেশ মহাকাব্যকে সত্যিকার অর্থে জানার জন্য যথেষ্ট না। আসলে, একটা মহাকাব্যকে বোঝার জন্য একটি নিবন্ধ যথেষ্ট না কোনোভাবেই। তাই আগ্রহী পাঠক চাইলে পড়ে ফেলতে পারেন গিলগামেশ মহাকাব্যের সংক্ষিপ্তরূপ, বাংলায়, হায়াৎ মামুদের লেখায়। আরেকটু বিস্তারিত পড়তে চাইলে মুহম্মদ আলমগীর তৈমূরের গিলগামেশ (প্রথিবীর প্রথম গল্প) বইটি পড়ে ফেলতে পারেন। আরো ভালভাবে জানতে চাইলে ইংরেজিতে পড়তে পারেন, দ্য এপিক অব গিলগামেশ।
পড়তে পড়তে আপনিও গিলগামেশের সঙ্গে নেমে পড়বেন অমরত্বের সন্ধানে। আবিষ্কার করবেন মৃত্যুসায়র, জীয়নলতা এবং বন্ধুত্ব। জানবেন, এক দেবীর সন্তানের মানুষ হয়ে ওঠার গল্প। সেই সঙ্গে বুঝতে পারবেন, মানুষ মরে যায়। কিন্তু গল্পেরা মরে না কখনো।
অনলাইনে কিনুন- গিলগামেশ মহাকাব্য