সাধারণের দৃষ্টিতে অন্ধকার জগৎ বলে পরিচিত অপরাধের কেন্দ্রস্থলই যখন গল্পের রূপ নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে ন্যায়ের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, তখন সর্বপ্রথম কোন চরিত্রটি মাথায় আসে? মুহূর্তক্ষণ সময়ও না নিয়ে যে নামটি মাথায় আসবে, তা হলো গডফাদার। একই বছর সেরা চলচ্চিত্র ও অভিনেতাসহ ছয়টি ক্যাটাগরিতে অস্কার পাওয়া কালজয়ী চলচ্চিত্র গডফাদারকে মানুষ যতটা চলচ্চিত্রায়নে চেনে, তার তুলনায় সামান্য কম চেনে না উপন্যাস হিসেবে। বলা যায়, চলচ্চিত্রের জয়জয়কার খানিকটা বাড়তি খ্যাতি যোগ করেছে ১৯৬৯ সালে রচিত মারিও পুজোর গডফাদার উপন্যাসে। সাহিত্যজগতের অমূল্য এক উপহার এই গডফাদার।
বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় মাফিয়া পরিবারের প্রধান ডন ভিটো কর্লিয়নি ও তার পরিবারকে ঘিরে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এক উপস্থাপনা তুলে ধরেছেন লেখক মারিও পুজো। দীর্ঘ উপন্যাসে ঘটনা পরম্পরার সহজ অথচ আগ্রহোদ্দীপক আবর্তনের সাথে সাথে চরিত্রসমূহের আকর্ষণীয় উপস্থাপন পাঠকমাত্রই আকৃষ্ট করতে বাধ্য।
চোখের সামনে পিতাকে খুন হতে দেখে নিজ জীবন বাঁচাতে আমেরিকায় পালিয়ে আসা সাধারণ জীবন-যাপন করা একজন মানুষের মাফিয়া হয়ে ওঠার গল্প গডফাদার। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ডন ভিটো কর্লিয়নি। নিউ ইয়র্ক সিটির লং বিচে বসবাসরত সিসিলিয়ান বংশোদ্ভূত ডনের কঠিন, সাহসী ও জটিল ব্যক্তিত্ব সকলকে আকর্ষণ করে। তিন ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী এবং ক্ষমতা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের নিয়ে ব্যস্ত ভিটো কর্লিয়নি যেন সিংহাসনে আরোহিত কোনো প্রাচীন সম্রাট। রাজ্যপাট পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত এ সম্রাটের ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বিনয় এবং ঠান্ডা মাথায় নেয়া সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত তার পদকে এনে দেয় পূর্ণতা। তার কাছে সাহায্যের জন্য এসে কেউ কখনো খালি হাতে ফেরে না। সবার দিকেই গডফাদার বাড়িয়ে দেয় বন্ধুত্বের হাত।
চরিত্রাঙ্কনের এ জায়গাতে মারিও পুজো তার সার্থকতা দেখিয়েছেন। শুধু গডফাদারই নয়, প্রতিটি চরিত্র এঁকেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। একই পরিবেশে বেড়ে উঠেও মানুষের মধ্যকার বিভেদ, প্রবৃত্তিগত দিক থেকে একজন ব্যক্তির মাঝেই ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বার উপস্থিতি এবং ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে এনে মূল বিন্দুতে ঘটনা পরম্পরার সংযোগে যে সাহিত্যিক কারসাজি তিনি দেখিয়েছেন, তা লেখকের দক্ষতারই পরিচায়ক।
উপন্যাসটিতে মানুষের লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা আর হিংস্রতার যতটা বাস্তবিক উপস্থাপন দেখা যায়, ঠিক ততটাই দেখা যায় ভালোবাসা আর স্নেহের এক অবিশ্বাস্য সমন্বয়। একই ব্যক্তির একাধিক ব্যক্তিত্বের সহজ উপস্থাপন লেখাটিকে এনে দিয়েছে অসাধারণত্ব। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গডফাদারের বড় ছেলে সনি কর্লিয়নি। শৈশবেই পিতার প্রথম খুনের একমাত্র সাক্ষী হয়ে ওঠা এ মানুষটি হিংস্রতায় হার মানাতে পারে না শুধুই লুকা ব্রাসিকে। অথচ নারী ও শিশুদের কখনো আঘাত করে না সে। নিজ জগতের সকলের জন্যে ত্রাস হয়ে ওঠা একজন হয়েও পরিবারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিত্ব তার। স্নেহপরায়ণ ভাই, পিতাভক্ত সন্তান আর ভালোবাসার প্রেমিক সনিকে দেখলে তার হিংস্রতাকে বিশ্বাস হতে চায় না।
একই কথা প্রযোজ্য ডনের সন্তান মাইকেল কর্লিয়নির ক্ষেত্রেও। দীর্ঘ সময় ধরে পিতার কাজকে এড়িয়ে একজন সৎ এবং আইন মান্যকারী মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠা মাইকেল ঘটনা পরম্পরায় জড়িয়ে পড়ে সেই অন্ধকার জগতের সাথেই। নিজের ভেতরের অজানা সত্ত্বাকে আবিষ্কার করে হয়ে ওঠে পিতার ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়ার যোগ্য উত্তরাধিকারী। লেখনীর জাদুতে মানুষের ভেতরের এ প্রবৃত্তিগুলোকেই অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক।
উপন্যাসের পরতে পরতে লেখক ইতালীয় ও আমেরিকানদের চারিত্রিক দিকসহ অন্যান্য যে বর্ণনা দিয়েছেন এবং যেভাবে দিয়েছেন তাতে পড়ার সময় বইয়ের পাতাতেই যেন ভেসে ওঠে সেই জীবন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে এতটা সূক্ষ্ম ও বাস্তব চিত্রায়ন সম্ভব হয়েছে যদি দাবী করা হয়, তবে পাঠক হিসেবে লেখকের বর্ণনা করার স্বভাবজাত ক্ষমতারও তারিফ না করলেই নয়। এছাড়াও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যৌনতা বা ধর্মকেন্দ্রিক গোঁড়ামিগুলোও উঠে এসেছে উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে।
উপন্যাসের প্লট, চরিত্র এবং বিশেষ করে সংলাপের দুর্বার আকর্ষণকে উপেক্ষা করা মনোযোগী পাঠকমাত্রই অসম্ভব। “I’m gonna make him an offer he can’t refuse” (আমি তাকে এমন প্রস্তাব দেবো যা সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না) কিংবা “Never hate your enemies. It affects your judgement” (তোমার শত্রুকে ঘৃণা করো না; এটা তোমার বিচারকে প্রভাবিত করবে) এর মতো শক্তিশালী সংলাপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা পূর্বের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। প্রেক্ষাপটের সাথে সংলাপগুলোর সামঞ্জস্য বইটিকে সাহিত্যিক মর্যাদায় আরো অনেক বেশি উঁচুস্তরে জায়গা করে দেয়।
এখানে অন্ধকার জগতের পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে জীবন নিয়ে ব্যক্তিবিশেষের দর্শন। আর তার অনেকটা কেন্দ্রেই অবস্থান করেছে পরিবার। বলা যায়, উপন্যাসটিতে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হয়েছে পরিবারকে। ডন ভিটো কর্লিয়নির সংলাপেই একাধিকবার উঠে এসেছে সে বক্তব্য।
“You spend time with your family?” (তুমি তোমার পরিবারের সাথে সময় কাটাও?)
“Good. Because a man who doesn’t spend time with his family can never be a real man” (ভালো। কারণ যে পুরুষ তার পরিবারের সাথে সময় কাটায় না সে কখনোই সত্যিকারের পুরুষ হতে পারে না)
উপন্যাসটিতে এক অসাধারণ জায়গা জুড়ে রয়েছে বন্ধুত্ব। অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষগুলোর শেষ ভরসা হয়ে ওঠা ডন কর্লিয়নি সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসায় কোনো প্রভুত্বের কিংবা দয়ার ভাব ফুটে ওঠে না। সাহায্যের বিনিময়ে তিনি যা চান তা হলো বন্ধুত্ব। বন্ধুকে যে সাহায্যে করেছেন, কখনো প্রয়োজনে সেটারই বিনিময় প্রত্যাশা করেন গডফাদার। তার মতে,
“Friendship is everything. Friendship is more than talent. It is more than the government. It is almost equal the family.” (বন্ধুত্বই সব। বন্ধুত্ব প্রতিভা ও প্রশাসনের চেয়েও বেশি। এটা প্রায় পরিবারের সমতুল্য)।
তবে উপন্যাসটিতে মাইকেলের স্ত্রী কে এডামস বাদে নারীদের উপস্থাপন অনেকটাই হতাশাজনক। পুরো উপন্যাসে পুরুষেরা যতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে নারীরা ছিল ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয়। স্বয়ং ডন ভিটো কর্লিয়নির স্ত্রীকেও দেখা যায় সাধারণ এক গৃহিণীর চরিত্রে, যার ভূমিকা স্বামীর মঙ্গলের জন্যে নিয়মিত গির্জায় যাওয়া এবং সন্তানের জন্য রান্না করাতেই সীমাবদ্ধ। এছাড়া রক্ষিতা, গণিকাবৃত্তি তথা যৌন বস্তু হিসেবেই নারীকে তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে তৎকালীন অবস্থায় নারীর সত্যিকার অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে বলে একটি যুক্তি উপস্থাপন করা গেলেও বাস্তবতা ভিন্ন একটি উপস্থাপন আশা করাটাও ভুল না, যা প্রত্যাশিত অবস্থাকে তুলে ধরতে পারতো।
বাবার মৃত্যুর পর আমেরিকায় পালিয়ে আসা ভিটো কর্লিয়নি পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, এখানে হয় তাকে পিষে মরতে হবে, নয়তো নিজেকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তুলে ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়ে নিজ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন ডন। শ্রমিক ইউনিয়ন, জুয়া ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যমণি হয়ে ওঠা ডনের মাঝেও ছিল নিজস্ব কিছু নৈতিকতা। ফলাফলস্বরূপ গণিকাবৃত্তি ও মাদক ব্যবসার সাথে নিজেকে জড়াননি কখনো। আর তারই প্রেক্ষাপটে অসাবধানতায় লাগা গুলিতে সম্পূর্ণ কর্লিয়ানি পরিবারের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়াকে উপজীব্য করে এগিয়ে যাওয়া গডফাদার বইটি নিঃসন্দেহে সাহিত্যজগতের জন্যে এক অমূল্য উপহার।
১৯৪৫-৫৫ এর প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাস কনসিলিওরি (উপদেষ্টা), ক্যাপোরেজিমি (সহকারী), ওমের্তা (নীরবতার নিয়ম) -এর মতো ইতালীয় মাফিয়া জগতের শব্দগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেয়। গত শতকের আশির দশকে সর্বপ্রথম শেখ আবদুল হাকিম বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন যা সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময় একাধিক প্রকাশনী থেকে একাধিক অনুবাদক বইটির অনুবাদ করেছেন। তন্মধ্যে ২০০৪ সালে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের অনুবাদটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতালিয়ান-আমেরিকান লেখক মারিও পুজোর মাফিয়া পরিবার ও তাদের শত্রুদের সাথে হানাহানি নিয়ে লেখা উপন্যাসটি এককথায় শ্রেষ্ঠ অপরাধমূলক উপন্যাস।