[বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে] এটা এমন একটা বিশ্বাস যা বামপন্থী ও ডানপন্থী, মনোবিদ ও দার্শনিক, লেখক ও ইতিহাসবিদদের ঐক্যবদ্ধ করে। আমাদের চারপাশের সংবাদ শিরোনামগুলো আর আমাদের জীবনকে ছুঁয়ে থাকা আইনগুলো যার দ্বারা পরিচালিত হয়। ম্যাকিয়াভেলি থেকে হবস, ফ্রয়েড থেকে ডকিন্স: এই বিশ্বাসটির শেকড় পশ্চিমা চিন্তায় অনেক গভীরভাবে প্রোথিত। মানুষ, আমাদেরকে শেখানো হয়েছে, প্রবৃত্তিগতভাবেই স্বার্থপর আর স্বার্থ দ্বারা নির্দেশিত।
মানবজাতি একটি নতুন যুক্তি হাজির করেছে: মানুষ ভালো এটা অনুমান করে নেয়াটা বাস্তবসম্মত, একইসাথে বৈপ্লবিক। প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা করা, অবিশ্বাস করার বদলে আস্থা রাখার সহজাত আকাঙ্ক্ষার একটি বিবর্তনীয় ভিত্তি আছে; যার শুরু আমাদের প্রজাতির সূচনালগ্ন থেকে। অন্যদেরকে নিকৃষ্টতম বিবেচনা করাটা শুধু তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ককেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, আমাদের রাজনীতি আর অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গুরুত্বপূর্ণ এই বইয়ে, আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রীত গ্রন্থ-রচয়িতা রুটগার ব্রেগম্যান পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকটি গবেষণা ও ঘটনা বেছে নিয়ে তারপর সেগুলোকে পুনর্গঠন করেছেন, যা মানবেতিহাসের গত ২,০০,০০০ বছরের ব্যাপারে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। বাস্তব দুনিয়ার লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ থেকে ব্লিৎজের পর দৃশ্যমান সহযোগিতা পর্যন্ত, স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টের গোপন ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে কিটি জেনোভিজ হত্যাকাণ্ডের সত্যিকার গল্প পর্যন্ত, ব্রেগম্যান দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের দয়াশীলতা আর পরার্থপরতায় বিশ্বাস বদলে দিতে পারে আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়া– আর কাজ করতে পারে আমাদের সমাজে সত্যিকার পরিবর্তন আনার ভিত্তি হিসেবে।
মানবপ্রকৃতিকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার সময় এসেছে।
প্রস্তাবনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, ব্রিটিশ সেনা কমান্ড একটা অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ল। লন্ডনের জন্য ধেয়ে আসছিল মহাবিপদ। জনৈক উইনস্টন চার্চিলের মতে, শহরটা পরিণত হয়েছিল ‘দুনিয়ার এক নম্বর টার্গেটে, এক প্রকার বিশাল বপুর গাভীতে; একটা মূল্যবান মোটা গাভী, শিকারী পশুদেরকে আকর্ষণ করার জন্য যাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।’[1]
বলাই বাহুল্য, এই শিকারী পশুটা ছিল অ্যাডলফ হিটলার আর তার যুদ্ধ মেশিন। ব্রিটিশ জনসাধারণ যদি তার বোমারুদের আতঙ্কে ভেঙে পড়ে, সেটা জাতিটার ইতি টেনে দেবে। এক ব্রিটিশ জেনারেল আশঙ্কা করেছিলেন ‘যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে, গৃহহীনেরা চিৎকার করবে সাহায্যের জন্য, পুরো শহর জুড়ে দেখা দেবে হৈচৈ আর বিশৃঙ্খলা।’[2] লক্ষ লক্ষ নাগরিককে গ্রাস করে নেবে ক্লান্তি, আর সেনাবাহিনী লড়াই করতে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাতেই পারবে না, কারণ উন্মত্ত জনতাকে সামাল দিতেই তার সবটুকু শক্তি খরচ হয়ে যাবে। চার্চিল অনুমান করেছিলেন, অন্ততপক্ষে তিরিশ থেকে চল্লিশ লাখ লন্ডনবাসী শহরটা ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
এহেন পরিস্থিতিতে খারাপ যা কিছু ঘটা সম্ভব, কেউ যদি তা পূর্বেই পড়ে ফেলতে চাইতেন, তার প্রয়োজন হতো স্রেফ একটা বই: সাইকোলজি দ্যস ফউলেস – ‘জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব’ – যার রচয়িতা ছিলেন সেকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী পণ্ডিতদের একজন, জাতিতে ফরাশি, গুস্তাভ ল্য বন। হিটলার বইটা আদ্যোপান্ত পড়েছিলেন। একইভাবে পড়েছিলেন মুশোলিনি, স্তালিন, চার্লিন, আর রুজভেল্টও।
লোকে কীভাবে সংকটে সাড়া দেয়, ল্য বনের বইটি তার একটা পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা পেশ করে। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে, লিখছেন তিনি, ‘মানুষ সভ্যতার মই বেয়ে কয়েকধাপ নিচে নেমে যায়।’[3] ছড়িয়ে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত আতঙ্ক আর সহিংসতা, আর আমরা মানুষেরা আমাদের আসল স্বভাবটা প্রকাশ করে ফেলি।
১৯৩৯-এর ১৯ অক্টোবরে, হিটলার তার সেনাপতিদেরকে জার্মান রণপরিকল্পনার ব্যাপারে ব্রিফ করলেন। তিনি বললেন, ‘ব্রিটিশ প্রতিরোধ ইচ্ছার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লুফটওয়াফের নির্মম অভিযান যথাসময়ে শুরু হতে পারে এবং শুরু হবে।’[4]
ব্রিটেনে, সবাই ঘড়ির টিকটিক ধবনি শুনতে পাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে লন্ডনের ভূতলে আশ্রয়কেন্দ্রের একটা নেটওয়ার্ক খোঁড়ার পরিকল্পনা বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু আখেরে পরিকল্পনাটা বাতিল করে দেওয়া হয়, কারণ আশঙ্কা ছিল, জনসাধারণ আতঙ্কে জমে গিয়ে আর কখনোই ভূতল থেকে উঠে আসবে না। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে, আক্রান্তদের প্রথম ঢেউটার শুশ্রুষা করার জন্য, শহরের বাইরে অল্প কয়েকটি সাইকায়াট্রিক ফিল্ড হাসপাতাল খোলা হয়।
তারপর আক্রমণ শুরু হলো।
১৯৪০-এর ৭ সেপ্টেম্বরে, ৩৪৮টা জার্মান বোমারু বিমান ইংলিশ চ্যানেল পার করল। সেদিন আবহাওয়াটা চমৎকার থাকায় বহু লন্ডনবাসী ঘরের বাইরে অবস্থান করছিলেন। তাই বেলা ৪টা ৪৩-এ যখন সাইরেন বেজে উঠলো, সবার আকাশের দিকে চোখ মেলে চাইলেন।
ইতিহাসে সেপ্টেম্বরের সেই দিনটা স্মরিত হবে কালো শনিবার নামে, আর এরপর যা ঘটল, তা ‘ব্লিৎজ’ নামে। পরবর্তী নয় মাস ধরে, এক লন্ডনেই ৮০,০০০-এরও বেশি বোমা ফেলা হবে। আস্ত মহল্লা উজাড় হয়ে যাবে। রাজধানীতে দশ লক্ষ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণরূপে ধবংস হবে, এবং দেশটির ৪০,০০০-এরও বেশি মানুষ তাদের প্রাণ হারাবেন।
তো, ব্রিটিশরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করল? দেশটিতে যখন মাসের পর মাস জুড়ে বিরামহীন বোমাবর্ষণ করা হলো, তখন কী ঘটল? মানুষ কি উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল? তারা কি পশুর মতো আচরণ করা শুরু করেছিল?
(চলবে…)
[1] Churchill said this in the House of Commons on 30 July 1934.
[2] J. F. C. Fuller, The Reformation of War (London, 1923), p. 150.
[3] Gustave Le Bon, The Crowd. A Study of the Popular Mind (Kitchener, 2001), p. 19. Originally published in 1896.
[4] Richard Overy, ‘Hitler and Air Strategy’, Journal of Contemporary History (July 1980), p. 410.
রুটগার ব্রেগম্যান, একজন ইতিহাসবিদ ও দ্য করেসপনডেন্টএ একজন লেখক, ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ চিন্তকদের একজন। তার ২০১৭ সালে প্রকাশিত বই, ইউটোপিয়া ফর রিয়েলিস্টস, একটি সানডে টাইমস ও নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার ছিল এবং বইটি বত্রিশটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তিনি নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী।
© rcbregman || rutgerbregman.com || Rutger Bregman