১৮৮৩ সালের শেষ দিকের ঘটনা। নরফোকের এক সুবিশাল বাড়িতে পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছেন এক ভদ্রলোক, তার চোখ বইয়ের পাতায়। বইটি পড়া শুরু করার পর থেকে শেষ শব্দটি পর্যন্ত চোখ অন্যদিকে ফেরাতে পারলেন না তিনি, যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক জগতে! জিম হকিন্স, ডক্টর লিভসি, স্কয়ার ট্রেলনি আর ক্যাপ্টেন স্মলেট তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সাগরের নীল আতঙ্কের মধ্যে। ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের অভিশপ্ত গুপ্তধনের ঘোরে তখনও যেন কানে বাজছিল লং জন সিলভারের কাঁধে বসে থাকা তোতাপখির “আট মোহর” চিৎকার! রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের “ট্রেজার আইল্যান্ড” যে তার মনের মধ্যে বিশাল এক ছাপ ফেলে গেছে তা বলাই বাহুল্য। দৌড়ে গেলেন তার অভিযাত্রী ভাইয়ের কাছে, বইয়ের পাতায় পাতায় যে উত্তেজনা রয়েছে তা সবাইকেই অনুভব করাতে চান।
ভাইয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন সদ্য দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত অভিযানপ্রিয় মানুষটি। এ জিনিস তার আগেই পড়া, ভাইয়ের উত্তেজনা তার কাছে আদিখ্যেতা বলে মনে হচ্ছে। অন্তত আফ্রিকার নির্জন প্রান্তরে ছুটে বেড়ানো লোককথাগুলো তার কাছে ঢের ভালো লেগেছে। কথাটা বলতেই তার প্রিয় ভাইটির মুখ দেখার মতো হলো! তার ভাই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসলেন, “এতই যদি পারো, তা লিখে দেখাও না কেন?” কিছুক্ষণ শান্ত চোখে চেয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, “বটে! তবে তাই হোক!”
ট্রেজার আইল্যান্ড-এর মতো পাতায় পাতায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা বেশ কঠিনই বলা যায়। জলদস্যু নিয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রচুর উপন্যাস লেখা হয়েছে, কিন্তু অন্ধকার আফ্রিকার হারানো সভ্যতা নিয়ে? একটাও না। সেই চ্যালেঞ্জটিই মাথায় নিয়ে লেখা শুরু করলেন নতুন এক উপন্যাস।
নিজ চোখে দেখা আফ্রিকার ধূসর মরুভূমি আর গহীন অরণ্যের সাথে মিশিয়ে দিলেন এক আফ্রিকান লোকগাঁথা! নিজেকে আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নগুলোকে গল্পে রূপ দিলেন অ্যালান কোয়াটারমেইনের মাধ্যমে, আফ্রিকার আলো বাতাসে পরিচিত হওয়া দুই বন্ধু ফ্রেডেরিক সাইলাস এবং রাসেল বার্নহ্যামকে রূপ দিলেন স্যার হেনরি কার্টিস আর ক্যাপ্টেন জন গুডের ভূমিকায়। হারানো আদিবাসী কুকুয়ানাদের বিশ্বাস, ইগনোসির বীরত্ব, গাগুলের অভিশাপ আর তিন অভিযাত্রীর ত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নিল উপন্যাস, “কিং সলোমন’স মাইন”!
মাত্র চার মাসে শেষ করা এই অসাধারণ উপন্যাস নিয়ে পথে ঘুরলেন মাসের পর মাস, কোনো প্রকাশকই এই রং চড়ানো অদ্ভুত গল্প প্রকাশ করতে রাজি হচ্ছেন না। শেষমেশ ৬ মাস পর যখন বইটি প্রকাশিত হলো, প্রিন্টিং মেশিন সারাদিন চালিয়েও পাঠকের চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল! ভাইয়ের সাথে ৫ শিলিং-এর বাজির ফলাফল বয়ে নিয়ে আসল বছরের সবচেয়ে বিক্রিত বইয়ের লেখকের সম্মান, আর? আর হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডও লেখক হিসেবে নতুন ক্যারিয়ার তৈরির চিন্তাভাবনা করা শুরু করলেন।
এই ঘটনার প্রায় ২৯ বছর আগে নরফোকের ব্র্যাডেনহ্যাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড। ব্যারিস্টার বাবা স্যার উইলিয়াম হ্যাগার্ড আর লেখক মা এলা ডাভটনসহ বারজনের বিশাল পরিবারের অষ্টম সন্তান ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তার প্রতি খুব একটা অনুরক্ত ছিলেন না তার বাবা, ফলে অন্যান্য বড় ভাইরা যেখানে ইংল্যান্ডের সব নামীদামী স্কুলে নিজেদের পড়াশোনার পাট চুকালেন, সেখানে হেনরির শিক্ষাদাতা হলেন এক বৃদ্ধ পাদ্রী, নাম রেভারেন্ড গ্রাহাম। এর ছাপ পড়েছিল হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের লেখাতেও, নিজেকে অ্যালান কোয়াটারমেইন হিসেবে কল্পনা করা লেখক নিজের বাবা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এক যাজককে!
আর্মি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করার পর হেনরির বাবা ছেলেকে পাঠিয়ে দেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে হেনরিকে পাড়ি দিতে হয় ইউরোপের এমাথা থেকে আফ্রিকার ওমাথা। নাটালের গভর্নরের কাছে কিছুদিন থাকার পর হেনরির পরবর্তী ঠিকানা হয় ট্রান্সভাল, স্যার থিওফাইলাস শেপস্টোনের স্টাফ হিসেবে। ওখানে থাকার সময়েই ভালোবেসে ফেলেন এক মেয়েকে, নাম মেরি এলিজাবেথ “লিলি” জ্যাকসন! অবশেষে ১৮৭৮ সালের দিকে যখন আয় করা শুরু করেন, বাবাকে চিঠি লিখে জানান ইংল্যান্ডে ফিরে মেরিকে নিয়ে সংসার পাতবেন। কিন্তু বাবা তাকে ইংল্যান্ডে ফিরতে নিষেধ করেন, আগে একটা ভালো ক্যারিয়ার, পরে সংসার।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু মাঝখানে বাগড়া বাঁধালেন মেরির বাবা। মেরিকে বিয়ে দিয়ে দিলেন এক উচ্চশিক্ষিত ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে। দুঃখ ভুলতে কঙ্গোতে গিয়ে সিংহ শিকার করলেন, ঘুরে বেড়ালেন আফ্রিকার নির্জন প্রান্তরে, জুলুসহ অন্যান্য উপজাতিদের সাথে ভাব জমালেন। অবশেষে ১৮৮০ সালে কিছুদিনের জন্য ইংল্যান্ডে ফিরে এসে গাঁটছড়া বাধলেন নিজের এক বন্ধুর বোনের সাথে, স্ত্রী মারিয়ানা লুইজার স্থান হলো উপন্যাসের “স্টেলা ফ্রেজেলিয়া” হিসেবে। তারপর স্ত্রীকে আফ্রিকার বন-বাদাড়ের স্বাদ উপহার দিয়ে ১৮৮৩ সালে থিতু হলেন ইংল্যান্ডের ডিচিংহ্যামে।
ডিচিংহ্যামের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে একের পর এক লিখে গেলেন, “কিং সলোমন’স মাইন (১৮৮৫)”, “মাইওয়ার প্রতিশোধ (১৮৮৬)”, “শী (১৮৮৬)”, “ক্লিওপেট্রা (১৮৮৭)”, “অ্যালান কোয়াটারমেইন (১৮৮৭)”, “অ্যালান’স ওয়াইফ (১৮৮৯)”- এর মতো জগদ্বিখ্যাত উপন্যাসগুলো। এর মধ্যে “শী” এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছিল এটি নিয়ে বানানো হয়েছিল একেবারে প্রথম যুগের নির্বাক চলচ্চিত্রসহ ৮টি সিনেমা, সাথে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইগুলোর ১২ নম্বর জায়গাটিও দখলে রেখেছে এই বই!
১৮৯১ সালে মেক্সিকো পাড়ি জমিয়েছিলেন হ্যাগার্ড, “মন্টেজুমার মেয়ে” উপন্যাসের জন্য গবেষণা করতে। সেই সময়ই খবর পান তার ছেলে জ্যাক বসন্ত রোগে মারা গিয়েছে। তা শুনেই বেশ কয়েক মাস অসুস্থতায় ভুগে ফিরে আসেন পিতৃভূমিতে। ছেলের মৃত্যুর ছাপ পড়েছিল তার লেখাতেও। “মন্টেজুমার মেয়ে”-উপন্যাসেই নায়ক টমাস উইংফিল্ড-এর ছেলেকে মেরে ফেলেন, এমনকি অ্যালান কোয়াটারমেইনের পরবর্তী উপন্যাসগুলোতেও উল্লেখ করেন ছেলের মৃত্যুর কথা।
আসলে কে বেশি জনপ্রিয়? হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড নাকি তার চরিত্র অ্যালান কোয়াটারমেইন? স্যার আর্থার কোনান ডয়েল শার্লক হোমসকে মেরে ফেলেছিলেন “দ্য ফাইনাল চ্যাপ্টার”-এ। হ্যাগার্ডও তাই করেছিলেন “অ্যালান কোয়াটারমেইন” উপন্যাসে। কিন্তু পাঠকদের চিঠির তোড়ে দুইজনকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় তাদের সৃষ্টি করা চরিত্রগুলোকে। হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড ইতিহাসের সাথে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে এমনভাবে মিশিয়ে ফেলেছিলেন যেন বাস্তবেও ঠিক তাই ঘটেছিল!
“দ্য ব্রেদরেন” উপন্যাসের ক্রুসেডের ঘটনা, “মন্টেজুমার মেয়ে” উপন্যাসের অ্যাজটেক যুদ্ধ বা “ভার্জিন অফ দ্য সান”-এর হেস্টিংসের যুদ্ধ; সবগুলো উপন্যাসেই রোমাঞ্চকর অভিযানের পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছেন মানবমনের গতিপ্রকৃতি। বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মত্যাগ, সংঘাতের মাঝখান থেকে জন্ম দিয়েছেন নিটোল প্রেমের, যার প্রেরণা পেয়েছিলেন লন্ডনের রাজপথে, ডিচিংহ্যামের বাগানে আর আফ্রিকার বুনো প্রান্তরে।
১৯১২ সালে নাইটহুড পাওয়ার পর হাত দেন “মেরি” উপন্যাসে, কারণ ততদিনে বাস্তবের মেরি মারা গিয়েছে। মেরির উচ্চশিক্ষিত স্বামী ফ্রাংক আর্চার ব্যাপক ধার-দেনা করে স্ত্রী লিলিকে ছেড়েই পালিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে, সাথে স্ত্রীকে বিনামূল্যে দিয়ে গেছে সিফিলিস রোগের জীবাণুগুলো। ততদিনে হ্যাগার্ড নামীদামী লেখকের পরিচয় পেয়ে গিয়েছেন। ছোটবেলার প্রেমিকাকে সাহায্য করেছেন দু’হাত ভরেই। ১৯০৯ সালে লিলি সিফিলিস রোগে মারা যাওয়ার পর ফ্রাংক আর্চার পরিচিতি পেলেন “হার্নান পেরেইরা” নামে, “মেরি” উপন্যাসের দুশ্চরিত্র ভিলেন হিসেবে।
“অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার” নাইটহুড পাওয়ার কয়েক বছর পর ১৯২৫ সালে স্যার হ্যাগার্ড মারা যান, ডিচিংহ্যামের গির্জায় পুঁতে রাখা হয় তার পোড়ানো মৃতদেহের ছাইয়ের অবশিষ্টাংশ। তার দেহ হয়তো নেই, কিন্তু তার লেখা উপন্যাসগুলো এখনো আমাদের নিয়ে যায় অ্যান্ডিজ পর্বতের চূড়ায়, অনুভব করায় আমস্লোপোগাসের কুড়ালের আঘাত কিংবা শোনায় “মাকুমাজান”-এর রাইফেল থেকে চলা গুলির শব্দ!