রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের এক দশক পরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন আরেক সৃষ্টিশীল মহাপুরুষ। সম্পর্কে তিনি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র। রবীন্দ্রনাথের ভাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সৌদামিনী দেবীর তৃতীয় সন্তান এই ছেলেটির নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কালক্রমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ শতকে ভারতে গড়ে উঠা শিল্পবিপ্লবের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দেশ বিদেশজুড়ে।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখতে উৎসাহিত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘অবন, তুমি লেখো-না,—যেমন ক’রে মুখে মুখে গল্প ক’রে শোনাও, তেমনি ক’রেই লেখো।’’ উৎসাহিত হয়ে প্রথমে লিখেছিলেন ‘শকুন্তলা’। এরপর ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর রূপকথাধর্মী গ্রন্থ ‘ক্ষীরের পুতুল’।
বাংলা শিশু সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন এটি। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর তার ডায়েরি থেকে এ গল্পের প্লট পেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর নিজের মত করে লিখেই তিনি এই রূপকথাধর্মী কাহিনিটির জন্ম দেন। পরবর্তীতে ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, হিন্দি, মারাঠি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় ‘ক্ষীরের পুতুল’।
এক রাজার দুই রানী, দুও আর সুও। রাজবাড়িতে সুওরানীর কত আদরযত্ন! সাতশো দাসী তার সেবা করে, পা ধোয়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। রাজার একেবারে প্রাণ সুওরানী। আর দুওরানী- বড়োরানী, তার বড়ো অনাদর, বড়াে অযত্ন। রাজা বিষ নয়নে দেখেন। একখানি ঘর দিয়েছেন- ভাঙাচোরা, এক দাসী দিয়েছেন- বোবা কালা। পরতে দিয়েছেন জীর্ণ শাড়ি, শুতে দিয়েছেন ছেঁড়া কাথা।
রাজা একদিন দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য জাহাজ সাজাতে রাজমন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন। বিদায় নেওয়ার আগে সুওরানী আর দুওরানীর সাথে দেখা করে রাজা জানতে চাইলেন কার কী প্রয়োজন। সুওরানী সাথে সাথে আট গাছা মানিকের চুড়ি, আগুন বরণ সোনার দশগাছা মল, পায়রার ডিমের মতো মুক্তোর হার, জলের মতো চিকন শাড়ি চেয়ে বসলেন। এদিকে দুয়োরানীর কাছে জানতে চাইলে, ‘রাজা ভালোয় ভালোয় ফিরুক’, সে শুধু এই কামনা করল। রাজা যখন জোর করে কিছু চাইতে বললেন, তখন সে একটা পোড়ামুখো বানর আনতে বলল। দীর্ঘ ছ’মাস দেশবিদেশ ঘুরে রাজা ফিরে এলেন। ছোটরানীকে তার জন্যে আনা সকল উপহার দিলেন। কিন্তু দিলে কি হবে কিছুই যে মনমতো হয়নি! রাগে-অভিমানে সুওরানী ঘরের দরজায় খিল দিলেন। আর বড়রানী দুওরানী পোড়ামুখো বানর সানন্দে গ্রহণ করলেন। লালন-পালন করতে লাগলেন তাকে। দুওরানীর পুত্র সে। সেই বানরটিই দুওরানীর দুঃখ দূর করে তাকে ফিরিয়ে দেয় আরাম-আয়েস-সম্মান। পোড়ামুখো বানর কীভাবে দূর করল দুওরানীর দুঃখ, তা নিয়েই অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘ক্ষীরের পুতুল’।
বলা হয়, ‘ছবি লেখেন অবন ঠাকুর’। অর্থাৎ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এতটাই সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল যে, পড়ার সময় তার লেখা ছবির মতো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ক্ষীরের পুতুলও অসম্ভব রকমের প্রাঞ্জল একটি রচনা। শিশুদেরকে কল্পনার রাজ্যে টুপ করে ডুব দিতে প্রচণ্ড সহায়ক এই রূপকথাটি তাই এত বছর পরেও আবেদন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
“সে এক নতুন দেশ, স্বপ্নের রাজ্য! সেখানে কেবল ছুটোছুটি, কেবল খেলাধুলাে; সেখানে পাঠশালা নেই, পাঠশালের গুরু নেই, গুরুর হাতে বেত নেই। সেখানে আছে দিঘির কালাে জল তার ধারে সর বন, তেপান্তর মাঠ তার পরে আমকাঠালের বাগান, গাছে গাছে ন্যাজঝােলা টিয়েপাখি, নদীর জলে, গােল-চোখ বােয়াল মাছ, কচু বনে মশার ঝাঁক। …সেখানে নীল ঘােড়া মাঠে মাঠে চরে বেড়াচ্ছে, গৌড় দেশের সােনার ময়ূর পথে ঘাটে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ছেলেরা সেই নীল ঘােড়া নিয়ে, সেই সােনার ময়ূর দিয়ে ঘােড়া সাজিয়ে, ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজিয়ে, ডুলি চাপিয়ে, কমলাপুলির দেশে পুটুরানীর বিয়ে দিতে যাচ্ছে।”
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন চমকপ্রদ বর্ণনা পড়ে কার না ইচ্ছে করে তেমন দেশে যেতে। ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি’, ‘শিবঠাকুরের বিয়ে এবং তিন কন্যে দান’, ‘ছেলেমেয়ের নাইতে নামা এবং রুই কাতলা ভেসে ওঠা’ ‘নায়ে ভরা টিয়ে’, ‘ভোঁদড় আর খোকনের নাচন’— কী নেই সেখানে!
শৈশব এমন এক সময় যখন কৌতূহলের কমতি থাকে না, কল্পনার রাজ্যে পরিভ্রমণ করতে করতে মনে হয় পৃথিবীতে সব কিছুই সম্ভব। শিশুদের এই মনস্তত্ত্ব মাথায় রেখেই রচিত হয় রূপকথার গল্প। এ গল্পগুলো মূলত ইচ্ছাপূরণের। ঠিক যেমনভাবে শিশুমন চায়, সেভাবেই গল্পগুলোর সমাপ্তি ঘটে। হয়তো বা উপকরণে প্রভেদ ঘটে, তবে পুরো পৃথিবীজুড়েই রূপকথার মৌলিক কাঠামো একই রকম থেকে যায়। রূপকথার সেই চিরাচরিত নিয়ম মেনে ক্ষীরের পুতুলেরও তাই কোনো তুলনা চলে না।
তবে রানীদের মধ্যে হিংসা-দ্বেষ, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা বা বানরের অবিরাম মিথ্যা বলার যে চর্চা ‘ক্ষীরের পুতুলে’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন, তা শিশুমনে কেমন প্রভাব ফেলবে, সে নিয়ে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে।
সময় এবং সমাজের প্রচলিত ধারণাকে উত্তীর্ণ করার সক্ষমতা রূপকথায় খুব বেশি দেখা যায় না। ‘ক্ষীরের পুতুলে’ সময় ও সমাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাবল্যে। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র রূপকথাগুলোর মতো এখানেও রাজার স্ত্রীর সংখ্যা অধিক। পুরো গল্পটি জুড়ে দুওরানীর প্রতি রাজা চরম উদাসীনতা ও অবহেলা দেখিয়েছেন এবং তাকে রেখে দ্বিতীয়জন সুওরানীকে বিয়ে করেছেন। তবে রাজার এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ তো রচিত হয়ইনি, বরং এটাকে দেখানো হয়েছে খুব স্বাভাবিক রূপে, যেন এটাই নিয়ম।
কাজেই ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’র কাছে বশ্যতা স্বীকার করে এখানে যে দ্বন্দ্বটি সৃষ্টি হয়েছে তা হল ‘নারীর বিরুদ্ধে নারী’। সুওরানীর মাঝে দুওরানীর বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ এবং প্রতিশোধস্পৃহা প্রবল। তার এই খারাপ গুণগুলোর কাছে রাজা এবং দুওরানী- দু’জনকেই বেশ কাবু দেখা যায়। এমনকি দুওরানীর সন্তানধারণের সম্ভাবনার কথা জানতে পেরে সুওরানী তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করতে দ্বিধা করে না। কাজেই ‘নারীর বিরুদ্ধে নারী’র এমন হিংসাত্মক মনোভাবের বিবরণ শিশুদের মনে কতটুকু ইতিবাচকতা সৃষ্টি করবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
রানীদেরকে এখানে মূলত দেখানো হয়েছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে। সাজগোজ এবং বিলাসিতার পাশাপাশি তাদের একমাত্র কাজ রাজার জন্য উত্তরাধিকারের জন্ম দেওয়া। নারীদের মাঝে ‘আত্মসম্মানবোধে’র কোন ইঙ্গিতও এখানে পাওয়া যায় না। দেখা যায়, রাজা দুওরানীকে প্রচণ্ড রকমের অবহেলা করছেন, অথচ রাজার কাছ থেকে সামান্য অনুগ্রহ পেলেই দুওরানী নিজেকে ধন্য মনে করছেন এবং নির্দ্বিধায় সেসব অনুগ্রহ গ্রহণ করছেন। রাজার বিরুদ্ধে তার কোন প্রকার অভিযোগ অনুযোগ প্রকাশ পায় নি।
আবার কথা বলতে সক্ষম বুদ্ধিমান বানরটিকে দেখা যায় একের পর এক মিথ্যা বলে রাজার কাছ থেকে দুওরানীর জন্য নানারূপ সুবিধা আদায় করতে। নিঃশঙ্কচিত্তে এবং নির্দ্বিধায় অনবরত মিথ্যা বলার চর্চার এই বহিঃপ্রকাশ কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
‘ক্ষীরের পুতুল’ হয়তো বা সরল মনে শিশুরা পড়ে যাবে, কল্পনার রাজ্যে ঘোরার সময় ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হবে, তবে গল্পের মূলে যে বাণী প্রোথিত আছে, তা শিশুমনে কতটুকু ইতিবাচকতার জন্ম দেবে, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আবার হয়তো বা এমনও হতে পারে রূপকথাগুলো এভাবেই সত্যিকারের কঠিন পৃথিবীর জন্য শিশুদেরকে তৈরি করে নেবে।
ক্ষীরের পুতুল (দুও আর সুও রাণী গল্প) বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।