“শীর্ষেন্দুর কোনো নতুন নভেলে,
হঠাৎ পড়তে বসা আবোল-তাবোলে…”
উপন্যাসের ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত শীর্ষেন্দুর জনপ্রিয়তার কথা বলার কিছুই নেই। তার উপন্যাসে পাঠক হারিয়ে যায় নিজের ভেতরেই যেন অন্য এক জগতে, কয়েক পাতা পড়ার সাথে সাথেই যেন চরিত্রগুলোকে দেখতে পাওয়া যায় এই তো সামনে হাঁটছে-কথা বলছে-খাচ্ছে দাচ্ছে, মান অভিমানের পালায় ভেসে যাচ্ছে। আবার এরাই দেখা যায় সময়ে সময়ে বিভিন্ন গূঢ় তত্ত্বের কথা নিয়ে দিন দুপুরেই ভাবতে বসেছে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে, লেখকের আধ্যাত্মবাদ যেন তাদের উপরও ভর করে! গল্প রচনায়ও তার পারদর্শিতা রয়েছে, তবে ঔপন্যাসিক হিসেবেই তার খ্যাতি বেশি।
সব লেখকেরই নিজের লেখা নিয়ে একান্ত নিজস্ব কিছু ভাবনা থাকে, যা অন্যের ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় না। শীর্ষেন্দুর লেখার ধরনটা তার মতে,
“হঠাৎ একটা লাইন এসে যায়। ওই যেমন তুলোর থেকে একটা একটা করে সুতো বেরিয়ে আসে, তেমনি ওই লাইন থেকে শব্দেরা ভিড় জমায়। ভাবনা শুরু হয়। চরিত্র আসে, ঘটনা আসে। আমি শব্দ দিয়ে ছবি দেখতে আরম্ভ করি”।
এত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন যে আজ নিজেই ভুলতে বসেছেন তাদের। তিনি ভুললে কী হবে, পাঠকসমাজের কাছে তার আবেদন বাড়ছে বৈ কমছে না। তরুণমনের আবেগঘন মুহূর্ত কিংবা বয়সের ভারে ন্যুব্জ কাঁধের শত নস্টালজিয়া, গল্প বোনার মাধ্যম হয়েছে সবকিছুই। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, তিনি খুব অযত্নে কোনো চরিত্র গড়েছেন, নেতিবাচকভাবে তাকে তুলে ধরেছেন, কিন্তু পাঠকমন তার প্রেমে পড়ে মুগ্ধতায় বহুবার আবিষ্ট হয়েছে।
‘দূরবীন’ এর ধ্রুবর কথাই ধরা যাক না কেন! বলিষ্ঠযুবা ধ্রুব প্রচণ্ড ধর্ষকামী ও হতাশ চরিত্রের। সে মানুষকে কষ্ট দিয়ে প্রচণ্ড তৃপ্তি পায়। এমনকি নিজেকে কষ্ট দিয়েও। এদিকে তার স্ত্রী রেমি যেন একেবারে পরিপূরক তার জন্য, মর্ষকাম তার মধ্যে কানায় কানায় ভরে আছে। ধ্রুবর দেওয়া সকল আঘাত সে যেন গণ্ডুষ ভরে পান করে। পাঠকের এজন্য ধ্রুবর উপর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক, অযথাই মেয়েটাকে মানসিকভাবে আহত করে দেবার জন্য! কিন্তু কেন যেন ধ্রুবকেই ভালোবেসে বসেন সবাই, বিশেষত নারীরা। ধ্রুব চরিত্রটির প্রচণ্ড আকর্ষণের গণ্ডি ছাড়াতে পারে না কেউই। কিন্তু লেখক কী ভাবেন ওর সম্পর্কে?
“যখন লিখেছিলাম, তখন তো ধ্রুবকে খলনায়ক করে লিখেছিলাম। পরে দেখি, ধ্রুব মেয়েদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিল। এটা এখনো রহস্য আমার কাছে। ধ্রুব চরিত্রটি মেয়েটির কাছে কেন এত জনপ্রিয়। আমাকে আবার বইটি পড়ে দেখতে হবে এটা বোঝার জন্য যে এর মধ্যে কী আছে, যা মেয়েদের অ্যাট্রাক্ট করে”।
তার কথাবার্তায় সাধারণত অনেক বিষয়েই হতাশার সুর স্পষ্ট। সাহিত্যে যারা নোবেল পাচ্ছেন তাদের সেই যোগ্যতা নেই বলেই মনে করেন এই লেখক। তার প্রিয় লেখকের স্থানে আছেন কাফকা ও কামু। তার লেখা থেকে বেশ কিছু চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘গয়নার বাক্স’, ‘কাগজের বউ’, ‘এবার শবর’, ‘দোসর’ সহ আরো কিছু সিনেমা। কিন্তু এর কোনোটিতেই সন্তুষ্ট নন তিনি। তিনি মনে করেন তার লেখা থেকে যেসব সিনেমা বানানো হয়েছে, তার কোনোটাই ভালো হয়নি। তারপরও শুধু টাকার খাতিরেই সিনেমা বানাতে দিচ্ছেন এবং তিনি এও মনে করেন যে সিনেমার সাথে সাথে তার লেখার মানের কোনো উত্থান-পতন ঘটে না।
তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে এমনটাই বোঝা যায় যে, আধ্যাত্মিকতাবাদের মধ্যে তিনি তার সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন, লেখার মধ্য দিয়ে জীবনের সত্যতা অনুসন্ধান করেন, আজো করে চলেছেন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজেকে বিষাদঘেরা বলে থাকেন, বিষাদের উৎসই সেই মহাজাগতিক অস্তিত্ব সম্পর্কে তার জিজ্ঞাসাই। ‘পার্থিব’ উপন্যাসের লেখক শীর্ষেন্দু নিজেকে বাঁধতে চান না কোনো পার্থিব সংজ্ঞায়, তবু প্রতিদিন নিয়ম করে বাজারে যান, সংসার করেন, বিদেশ বিভূঁইয়ে যান কোনো নতুন স্বীকৃতি আনতে। তবু কোথায় যেন একটা বিষাদ তাকে ঘিরে আছে, সে বিষাদের কূলকিনারা করতে পারছেন না। কলম চলছে, চলছে ভাবনার রথ।
তার মূল বাড়ি বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বাইনখানা গ্রামে। জন্ম হয়েছিলো ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর, ময়মনসিংহে, দাদুবাড়িতে। সেখানে তার জীবনের প্রথম ১১ বছর কাটে। দেশভাগের সময় তিনি ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়তেন। এরপর পরিবারের সাথে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি বাংলাদেশের জন্য বেশ অনুভব করেছিলেন বলেই জানা যায়। দেশভাগ তাকে প্রচণ্ড পীড়া দিয়েছে, হারিয়েছেনও অনেক আত্মীয়-শুভাকাঙ্ক্ষীকে। নিজেকে আজো উদ্বাস্তু বলে দাবি করেন তিনি। তার ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসে দেশভাগের বেশ কিছু ব্যাপার উঠে এসেছে, যা তার নিজের অভিজ্ঞতার আদলেই গড়া।
তার লেখায় নকশাল আন্দোলনের কথাও এসেছে কিছুটা। তিনি এই আন্দোলনকে আগাগোড়া ভুল বলেই মনে করেন। তার মতে গোটা পৃথিবীতেই মার্কসিজম পরিত্যক্ত।
সমসাময়িক শক্তি বা সুনীলের মতো বোহেমিয়ান ভাব নেই তার মধ্যে, বেশ ঘরমুখো বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন। মাকে খুব ভালোবাসেন, তবে মায়ের সাথে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারেননি বলে আজো আক্ষেপ করেন। বহুগামিতা সম্পর্কে তিনি ধারণা পোষণ করেন যে, যা করার তা যেন প্রকাশ্যে করা হয়। গোপন সম্পর্কের প্রতি তার অভিযোগ রয়েছে। তার ‘অসুখের পর’ উপন্যাসের নায়কের দুটো বিয়ে করাতে তাই তার কোনো আপত্তি নেই।
পাঠকের মনোরঞ্জনের চাইতে নিজের তৃপ্তিকে তিনি লেখার ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেন, তার কাছে লেখাটা একটা ‘মিশনারি ওয়ার্ক’। লিখবার সময় নিজেকে ভুলে যান তিনি, তাই তার লেখায় তাকে ঠিক স্পষ্ট করে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই লেখকের মতে, তার জীবনটা অত ঘটনাবহুল নয় এবং এজন্য তিনি সচেতনভাবেই নিজেকে অনেকটা এড়িয়ে যান লিখবার সময়। কিন্তু তা-ও হয়তো সবসময় এড়ানো যায় না। কোথাও না কোথাও তিনি এসেই পড়েন। আত্মজীবনী লেখা হয়নি এখনও, তবে আগামীতে লিখবার সম্ভাবনা আছে। ‘উজান’ বইয়ে তার জীবনের শুরুর দিকের বেশ কিছু কথা উঠে এসেছে তবে পরিবারের লোকজন তাকে আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন এবং তারও ইচ্ছে আছে লেখার।
দেশ পত্রিকার সাথে শীর্ষেন্দুর সম্পর্ক বেশ পুরনো। তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ ১৯৫৯ সালে এই পত্রিকায় প্রকাশ পায়, এই পত্রিকাতে আরো সাত বছর পর প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। পরে তিনি দেশ পত্রিকার সাথে কর্মজীবনেও যুক্ত ছিলেন। তার ছোট উপন্যাসগুলোর চাইতে বিশাল পরিসরে লেখা উপন্যাসগুলো পাঠকের কাছে বেশি আবেদন রাখে, কারণ তিনি একটা বিস্তৃত সীমার মধ্যে চরিত্রগুলোকে বেশি বাঙ্ময় করে তোলেন। পার্থিব, মানবজমি, চক্র, দূরবীন তার এমনই কয়েকটি উপন্যাস। একইসাথে বেশ কিছু পরিবার অথবা বৃত্তের ক্রমান্বয়ে বর্ণন চলে তার উপন্যাসগুলোতে। একেকটি পরিচ্ছেদ তিনি এমন জায়গায়ই শেষ করেন যখন পাঠক খুব বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে ‘এরপর কী হবে’ এ বিষয়ে। তারপর চলে আসে আরেকটি বৃত্তের গল্প, এবং তাদের সাথে পরিচ্ছেদের শেষে মিল ঘটে পূর্বের ঘটনার। এভাবেই সংযোগে, সাযুজ্যে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেন শীর্ষেন্দু।
কখনো কখনো তো অতীত ও বর্তমানের মধ্যেও এমন ধারাবাহিক পরিচ্ছেদের ব্যাপারটি ধরে রাখেন তিনি, দূরবীনের ধ্রুব ও কৃষ্ণকান্তের কাহিনী এভাবেই রচিত হয়েছিল। একদিকে আজকের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ কৃষ্ণকান্ত, অপরদিকে কিশোর থেকে তরুণ হয়ে ওঠা সম্ভাবনাময় বিপ্লবী কৃষ্ণকান্ত। কাকে পাঠক বেশি ভালোবাসে, অতীত না বর্তমানকে? আর কৃষ্ণকান্তের ছেলে ধ্রুব তো উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি অংশ। এভাবেই প্রতি কোণে একেকটি আকর্ষণ রেখে দেন লেখক। পাঠক যেদিকেই যায়, আকর্ষণের গণ্ডি এড়াতে পারে না তার শক্তিশালী লেখনীর।
পার্শ্বচরিত্রগুলোও যেন নিজস্ব আলোয় ভাস্বর হয়ে রয়, সবগুলো চরিত্রের একেকটি দৃঢ় জীবনদর্শন থাকে। থাকে তাদের অস্তিত্বের নিজস্ব ব্যাখ্যা। লেখক তার সৃষ্টি করা একেকটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করেন, চেষ্টা করেন ধাঁধার সমাধান বের করার। বর্তমানের সাথে অতীতের সহাবস্থানটা শীর্ষেন্দু খুব ভালো করে দেখাতে পারেন। আমাদের সকল অতিবাহিত সময়ই যে আমাদের বর্তমানকে তিল তিল করে গড়ে দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে- সে ভাবটি তার কাহিনীগুলোয় স্পষ্ট করে বোঝা যায়। তিনি নিজে যেমন গৃহের প্রতি টান অনুভব করেন, তেমনি একটা শেকড়ের প্রতি টান বোঝানোর প্রচ্ছন্ন চেষ্টা থাকে তার সাহিত্যেও। জীবনদর্শনকে তিনি কখনোই সাহিত্যের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেন না ঠিকই, কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিতে তিনি ব্যক্তি তাকেও ছাড়িয়ে যান প্রায়ই। তার লেখা তার চেয়ে অনেক বেশি সীমাবদ্ধতাহীন, অনেক বেশি আধুনিক। তার স্ত্রী সোনামন মুখোপাধ্যায়ের মতে, স্বামীর চেয়ে লেখক হিসেবে তিনি বেশি আধুনিক। লেখক নিজেও এ কথা অকপটে স্বীকার করেন।
তার দৃশ্যমান প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে ১৯৮৫ সালে পাওয়া বিদ্যাসাগর পুরস্কার (শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য), ১৯৭৩ ও ১৯৯০ সালে পাওয়া আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে পাওয়া সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (মানবজমিন উপন্যাসের জন্য) এবং ২০১২ সালের বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার।
আত্মজীবনী লেখা হয়নি এখনও, তবে আগামীতে লিখবার সম্ভাবনা আছে। ‘উজান’ বইয়ে তার জীবনের শুরুর দিকের বেশ কিছু কথা উঠে এসেছে তবে পরিবারের লোকজন তাকে আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন এবং তারও ইচ্ছে আছে লেখার।
লেখক হিসেবে কখনও উত্থান কখনো পতনের পরও অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শীর্ষেন্দু, আর ব্যক্তি হিসেবে আধ্যাত্মবাদের চর্চাকারী প্রচণ্ড সত্যভাষী। তার অকপটতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি কোনো স্তাবকমহলের তোষামোদে তার পোষায় না, নিজেকে আমজনতার ভিড়ে মিশিয়ে দিতেই স্বচ্ছন্দ তিনি।
ফিচার ইমেজ- edited by writer