তিন হাজার বছরের ইতিহাস বুকে আগলে টিকে থাকা জরাথুস্ত্রবাদ পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগুলোর একটি। সর্বোচ্চ দেবতা আহুরা মাজদার নাম অনুসারে এর অন্য নাম মাজদাইজম। সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন, এই ধর্ম পরবর্তী একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ভাষ্য অনুযায়ী-
“জরাথুস্ত্রের কাছ থেকেই পিথাগোরাস নির্দেশনা লাভ করেন এবং ক্যালিডীয়রা জ্যোতিষশাস্ত্র ও যাদুবিদ্যায় অনুপ্রাণিত হয়। জরাথুস্ত্রবাদ পরবর্তীতে ইহুদি মতবাদের অগ্রগতি ও খ্রিস্টীয় মতবাদের জন্মকে প্রভাবিত করে।” (খণ্ড- ২৯, পৃষ্ঠা- ১০৮৩)
পারস্যের মাটিতে জন্ম নেওয়া ধর্মটি ব্যাপকতা লাভ করে সাসানীয়দের (২২৪-৬৫১ খ্রিস্টাব্দ) আমলে। স্বর্ণযুগে ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর গ্রিসেও। তারপর সহ্য করতে হয়েছে আলেকজান্ডারের আক্রমণ, সেলুসিড ক্ষমতার উত্থান, আরব মুসলমানদের অভিযান, মোঙ্গলদের তাণ্ডব এবং স্থানীয় তুর্কিদের দৌরাত্ম্য। বিক্ষিপ্তভাবে শুধু ইরান না; ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আজও টিকে আছে মহান জরাথুস্ত্রের অনুসারীরা।
জরাথুস্ত্র এবং জরাথুস্ত্রবাদ
জরাথুস্ত্রবাদের জনক জরাথুস্ত্র নামের গ্রিক উচ্চারণ জরোয়েস্টার। প্রথাগত মত অনুসারে তাঁর জন্ম ৬২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বর্তমান ইরানে এবং মৃত্যু ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। যদিও তাঁর জন্ম-মৃত্যুর কাল নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। কিছু সূত্র বলছে, আলেকজান্ডারের পার্সিপোলিস জয়ের ২৫৮ বছর আগে তিনি বেঁচে ছিলেন। সে হিসেবে তাঁর মৃত্যুসাল ৮২ খ্রিস্টাব্দ। এমনও জানা যায়, ৪০ বছর বয়সে অনুগত শিষ্য ভিশতাস্পকে ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বে ধর্মান্তরিত করেন। সে সূত্র মোতাবেক তার জন্মসাল ৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ। কেউ আবার আরো পিছিয়ে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জরাথুস্ত্রের সময় বলে দাবি করেছেন। এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন বলছে-
“পূর্ব ইরানের গ্রাম্য সংস্কৃতিতে প্রোথিত জরাথুুস্ত্রবাদের শেকড়। ধর্মটি খ্রিস্টের জন্মের ১০০০ বছর আগে উৎপত্তি লাভ করে এবং পারসিক সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।” (খণ্ড- ১৫, পৃষ্ঠা- ৫৮০)
জরাথুস্ত্রবাদের কত অংশ জরাথুস্ত্রের শিক্ষা, আর কত অংশ প্রাচীন পারসিক বিশ্বাস থেকে গৃহীত, তাও স্পষ্ট বের করে আনা শক্ত। জরাথুস্ত্রবাদ অনুযায়ী, ঈশ্বর ‘আহুরা মাজদা’ কর্তৃক সত্য প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন জরাথুস্ত্র।
যদিও প্রথাগত বহু-ঈশ্বরবাদী পারসিক ধর্মকে পুরোপুরি নাকচ করার চেষ্টা করেননি। শুধু চেয়েছেন ঈশ্বর হিসেবে আহুরা মাজদার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনেকেই তাকে বাইবেলে বর্ণিত নবী এজিকিয়েল, সেথ, নিমরোদ, বালাম এমনকি স্বয়ং যীশু বলে দাবি করেন। আদতে জরাথুস্ত্রবাদকে ইহুদি বা ইসলামের মতো একত্ববাদী বলা যায় না। বরং একে গ্রিক, ল্যাটিন ও ভারতীয়দের সাথে তুলনীয় বহু-ঈশ্বরবাদী প্রথাকে একক ও সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণায় আনার প্রয়াস বলা চলে।
জরাথুস্ত্র পূর্ববর্তী পারসিক ঐতিহ্য
পারসিক ভাষা সম্পর্কের দিক থেকে উত্তর ভারতের ভাষার খুব কাছাকাছি। দুই অঞ্চলের ভাষাই বুৎপত্তিগতভাবে ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত। এমনকি ধারণা করা হয়, তাদের একটা সাধারণ পূর্বপুরুষও ছিল। ফলে সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। ধর্মগ্রন্থগুলো দেখে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। বেদ আর আবেস্তার মধ্যে রয়েছে বিস্ময়কর মিল। উভয় ধর্মই কাছাকাছি ধরনের বহু-ঈশ্বরবাদের ধারণা দেয়। দেবতাদের নামে পর্যন্ত পাওয়া যায় সাদৃশ্য। ভারতের ‘মিত্র’ পারস্যের মাটিতে ‘মিথরা’য় পরিণত হয়েছে। এসেছে ইন্দ্রসহ অন্যান্য বহু দেবতার নাম।
ইন্দো-ইরানীয়রা অলৌকিকতাকে দুটি ভাগে ভাগ করত- দেব ও অসুর। সংস্কৃত ‘দেব’ এর সাথে তুলনা করা যায় পারসিক আবেস্তার শব্দ ‘দৈব’, যার অর্থ স্বর্গীয় সত্তা। বৈদিক ভারতে অসুর মানে অতিপ্রাকৃতিক শক্তি। সংস্কৃতে শব্দটির দ্বারা বিশেষ প্রকার দানবকে বোঝানো হয়। পারস্যে ব্যাপারটি প্রায় উল্টো। আহুর (অসুর) এখানে প্রশংসিত হয় এবং দেবতাদের স্থান হয় দানব শ্রেণীতে। যেমন সর্বোচ্চ প্রশংসিত আহুরা মাজদা বা প্রজ্ঞাবান আহুরা।
প্রাথমিক দিনগুলো
অনেক আহুরার মধ্যে জরাথুস্ত্র শুধু আহুরা মাজদাকে প্রাধান্য দেন। জরাথুস্ত্রের প্রশস্তিগুলো ‘গাথা’ নামে পরিচিতি পায়। দারিয়ুস এবং তার উত্তরাধিকারীরা আহুরা মাজদার উপাসনা করতো।
প্রভাবশালী গৌমাতা জরাথুস্ত্রবাদ গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে সমাজের অভিজাতবর্গের মধ্যে প্রিয় হয়ে ওঠে আহুরা মাজদা। দারিয়ুস এক অর্থে সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার জন্যই খাপ খাইয়ে নেন। পরবর্তীকালে বহু দেবতার বিকল্প হিসেবে জার্কসিস জরথুস্ত্রবাদ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় আর্টাজার্কসিসের আমলে (৪০৪-৩৫৯ খ্রিস্টপূর্বে) আহুরা মাজদার পাশাপাশি মিথরা এবং অনাহিতের নাম শোনা যায়। তাদের উপস্থিতি মোটেও নতুন উপাস্যের আবির্ভাব নয়, কেবল গুরুত্বের ফারাকই নির্দেশ করে।
পার্থিয়ান সময়কালে (২৪৭ খ্রিস্টপূর্ব- ২২৪ খ্রিস্টাব্দ)
আলেকজান্ডারের অভিযানের মধ্য দিয়ে গোটা পারসিক সংস্কৃতি থমকে যায়। প্রথমদিকের মুদ্রা এবং শিলালিপিতে কেবল গ্রিকের উপস্থিতি থাকলেও পরবর্তীকালে উভয় সংস্কৃতি সামনে আসে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের মাঝামাঝি গ্রিক এবং পারসিক উপাস্যের নামের মধ্যে অন্যরকম সামঞ্জস্যতা তৈরি হয়, যেমন- জিউস অরোমাজদেস, অ্যাপোলো মিথরা, হেলিয়োস হার্মেস প্রভৃতি। খ্রিস্টপূর্ব ৪০ অব্দে বর্তমান তুর্কমেনিস্তানে জরাথুস্ত্রীয় দিনপঞ্জিকার প্রচলন এই ধর্মের বিশেষ স্বীকৃতি প্রমাণ করে। সাসানীয়দের সময়ে স্থানীয় ইরানীয় ধর্মের প্রতি আগ্রহ কমে আসে।
সাসানীয় আমল (২২৪- ৬৫১ খ্রিস্টাব্দ)
বিভিন্ন উৎস থেকে কার্তার এবং তানসার নামে দুজন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। সাসানীয় যুগে তারা জরাথুস্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন। তানসার ছিলেন প্রভাবশালী এহরপাত, যার অর্থ ধর্মতাত্ত্বিক ও পণ্ডিত। তানসার লিখিত বাণীগুলো একত্র ও সুসংবদ্ধ করেন। শাপুরের (মৃত্যু ২৭২ সাল) আমলে কার্তারও এহরপাত ছিল। দ্বিতীয় বাহরাম (২৭৬-২৯৩ সাল) কার্তারকে ‘সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারক’ উপাধি প্রদান করেন।
সাফল্যের চরমতম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে তিনি ইহুদি, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, খ্রিস্টান এবং ধর্মত্যাগীদের উপর ব্যাপকভাবে চড়াও হন। দ্বিতীয় শাপুরের তার ক্ষমতাকালে (৩০৯-৩৭৯ খ্রিস্টাব্দ) প্রধান পুরোহিত আতুরপাত আবেস্তা সংকলনের জন্য সম্মেলন আহ্বান করেন। অনেকটা সফল হয় এই উদ্যোগ। ৪৮৮ – ৪৯৬ এবং ৪৯৮ – ৫৩১ খ্রিস্টাব্দ এই দুই দফায় ক্ষমতায় ছিলেন কোবাদ। তার সময়েই মাজদিয়ান মতবাদের উত্থান গোটা ইতিহাসকে বদলে দিতে শুরু করে। কোবাদের পুত্র প্রথম খসরু মাজদিয়ান চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। এই টানাপোড়েনের শেষপ্রান্তে দ্বিতীয় খসরু (৫৯১-৬২৮ সাল) এক খ্রিস্টান রমণীকে বিয়ে করেন। খুব সম্ভবত নিজেও ধর্মান্তরিত হন।
মুসলিম আগমনের পর
৬৩৫ সালে মুসলমানরা কাদিসিয়ার যুদ্ধে শেষ সাসানীয় সম্রাট ইয়াজদিজার্দকে পরাজিত করে। জরাথুস্ত্রবাদীরা বিদ্রোহ করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়।
শেষ অবধি পুরোনো বিশ্বাস ও চর্চাকে আঁকড়ে ধরে খুব অল্প সংখ্যকই টিকতে পারলেন। ধর্ম রক্ষার জন্য বই প্রস্তুত করা হতে থাকলো। সংখ্যালঘুরা পরিচিত হতে থাকলেন ‘গাবার’ নামে। যাদের বেশিরভাগ থাকতেন ইয়াজদ্ এবং কিরমান অঞ্চলে। পরবর্তীকালে অনেকেই ইরান ত্যাগ করে বর্তমান ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমান।
কিতাব ও দলিলাদি
আবেস্তা হলো বিভিন্ন সময়ে লেখার সংকলন, যা শেষ হয় সাসানীয় আমলে। তৎকালীন আবেস্তা ছিল বর্তমানে টিকে থাকা আবেস্তার ৪ গুণ। কেবলমাত্র ‘গাথা’কেই জরাথুস্ত্রের বাণী বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
ভেনদিদাদের প্রথম দুই অধ্যায়ে মানুষের জন্য কীভাবে আইন এসেছে, তা বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তী আঠারো অধ্যায়ে আছে বিভিন্ন আইন। অন্যদিকে ইয়াশত পরিচয় করিয়ে দিয়েছে মিথরা, অনাহিতা এবং ভেরেথ্রাগ্ন এর মতো একুশজন উপাস্যের সাথে। জরাথুস্ত্রবাদের উপর নয় খণ্ডে রচিত বিশ্বকোষ দিনকার্ত রচিত হয় নবম শতকে মুসলিম শাসনামলে। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে আছে মেনক-ই-খরাত, বুন্দাহিশন নামে আবেস্তার ব্যাখ্যা এবং বুক অব আরতায় ভিরাফ।
বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য
ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে জরাথুস্ত্র একত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু তার একত্ববাদ এবং দ্বৈতবাদ পরস্পর বিরোধী নয়, বরং সামঞ্জস্যকারী। স্পেনটা মাইনু এবং আঙরা মাইনু দুই জমজ সত্ত্বা। স্পেনটা মাইনু হলো সত্য ও শুভর প্রকাশক এবং আঙরা মাইনু মিথ্যা ও অশুভর নির্দেশক। উভয়ের জন্মই পরম একক সত্তা আহুরা মাজদা থেকে, ‘আশা’ বা সত্য এবং ‘দ্রুজ’ বা মিথ্যা থেকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে। সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম এবং অসৎ চিন্তা, অসৎ বাক্য, অসৎ কর্ম বেছে নেবার মাধ্যমে উভয়ের প্রকাশ। জমজ এই দুই সত্তার বেছে নেবার ধারণাই দ্বৈতবাদের জন্ম দেয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে আদিম সেই তাৎপর্য বিদ্যমান।
আহুরা মাজদাই আকাশ-মাটি, আলো-অন্ধকার ও দিন-রাত সৃষ্টি করেছেন। সেই সাথে সৃষ্টি করেছেন ভালো ও মন্দ। সৃষ্টির প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে বলা হয় তিনটি সময়ের কথা; প্রথমে বুন্দাহিশন বা সৃষ্টি, তারপর গোমেজিশন বা দুই বিপরীত শক্তির সমাবেশ এবং সর্বশেষ উয়িজারিশন বা পৃথকীকরণ। জগতে অস্তিত্বশীল সবকিছুই এজন্য দুটি অবস্থায় বিরাজ করে- আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক। একটা ভাব এবং অন্যটা বস্তু। এখানে প্লেটো ও এরিস্টটল নামদ্বয় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
আবেস্তার মতে, পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে ছয়টি ক্রমিক ধাপে। প্রথম মানব এবং প্রথম মানবী আঙরা মাইনুর দ্বারা পথভ্রষ্ট হয়। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মরণশীল হিসেবে। কিন্তু তার ভেতর অমরত্বের গুণাবলি বিদ্যমান। মৃত্যুর পর সবাইকে চিনবৎ সাঁকো পার হতে হবে। পূন্যশীলেরা সেটি পার হয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবে আর পাপীরা নিচে দোজখে পতিত হবে। ভালো আর মন্দের বিচারও হবে সেই দিন। যাদের ভালো আর মন্দের পরিমাণ সমান, তারা হামিস্তাগান নামক মধ্যবর্তী স্থানে থাকবে।
জরাথুস্ত্রের মতে, জগৎ হলো ভালো ও মন্দের মধ্যকার যুদ্ধক্ষেত্র। যদিও এখন আঙরা মাইনুর জয়জয়কার। তবে খুব দ্রুতই আহুরা মাজদার জয় আর আঙরা মাইনুর ধ্বংসপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সব দ্বন্দ্বের শেষ হবে। আর সবকিছু শেষ হবার আগে তিনজন ত্রাতা আসবেন। ভবিষ্যতে ধর্মের রক্ষক আগমনের উক্ত ধারণা পরবর্তীকালে অনেক ধর্মই গ্রহণ করেছে।
চর্চা ও রীতিনীতি
জরাথুস্ত্রবাদের কিছু উপাসনাকেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। নকশাগত দিক থেকে এগুলো টাওয়ার ও বর্গাকৃতির। চার দরজা বিশিষ্ট পবিত্র দেয়ালকে বলা হয় চাহারতাক। ইরান জুড়ে এর অসংখ্য নজির বিদ্যমান। পবিত্র আগুনের মধ্যে আবার বিস্তর ফারাক। যাজকদের জন্য আগুনের নাম ফারবাগ, যা প্রথমে খাওয়ারিজমে দেখা যায়, পরে ফারসে স্থানান্তরিত হয়। যোদ্ধাদের জন্য আগুন ছিল গুশনাস্প। তবুও ধর্মীয় একত্বতার প্রতীক এই আগুন। অন্যদিকে বুর্জেন-মিহর আগুন ছিলো কৃষকদের জন্য। এর বাইরেও আগুন দুইভাগে বিভক্ত। আদুরান বা গ্রাম্য আগুন এবং ভারহরান বা রাজকীয় আগুন।
এ রাজকীয় আগুনের দেখভাল যারা করতেন, তাদেরই পেশাগত পদবি ছিল এহরপাত। গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার ভূমিকা থাকতো অনেকটা সহকারী যাজকের মতো। তার ওপরের পদবি হলো মোবেদ আর সর্বোচ্চ পদবি ‘দস্তুর’। দস্তুরের কাজ প্রধান ধর্মযাজকের মতো, যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাজকত্বের দায়িত্ব বংশানুক্রমিক। কিন্তু প্রত্যেককেই একটা নির্দিষ্ট শিক্ষা ও চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। প্রত্যেক জরাথুস্ত্রবাদীর ৭ বা ১০ বছর বয়সে অভিষেক হয়। তখন তাকে ‘সাদরে’ (শার্ট) এবং ‘কুস্তি’ (কোমরবন্ধনী) দেওয়া হয়, যা তাকে পরতে হয় পরবর্তী জীবনভর। পায়দাব, নাহন ও বারেশনুম নামে তিন ধরনের পবিত্রতা পদ্ধতি আছে।
পবিত্র অনুষ্ঠান ইয়াসনা মূলত পবিত্র আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আবেস্তার শ্লোক পাঠ করা ও আহুতি দেয়া। পবিত্র আগুনকে নিরন্তর প্রজ্বলিত অবস্থায় রাখা ও দিনে পাঁচবার উপাসনা করা অন্যতম প্রধান আচার। মৃত্যুর পর লাশকে যথাযথভাবে গোসল করানো হয়। সামনে বিশেষ কুকুর নিয়ে আসা হয়। পরের ধাপে একটা ঘরে রাখা হয় পবিত্র আগুনের সাথে। সবশেষে জোড় সংখ্যক বাহকের দ্বারা লাশকে দাখমাত (Tower of Silence)-এ সরিয়ে নেওয়া হয়।
এ ধর্মমতে, যেহেতু মৃত্যু আঙরা মাইনুর কাজ, তাই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহ অপবিত্র হয়। এ অপবিত্র দেহ যদি মাটির ওপর রেখে পোড়ানো হয় বা পুঁতে ফেলা হয়, কিংবা পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তবে দেহের শুদ্ধিলাভ হয় না। উল্টো পৃথিবীই অপবিত্র হয়। তাই তারা দাখমাত নামক উঁচু টাওয়ারের ওপর লাশকে ফেলে যায় শকুনের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তা নিঃশেষিত হয়।
উৎসব ও অন্যান্য
উৎসব জরাথুস্ত্রবাদে উপাসনারই অংশবিশেষ। প্রধান উৎসব ‘গাহামবার’ বছরে ছয় পর্বে পালিত হয়। প্রতি পর্ব পাঁচদিন ব্যাপী বিস্তৃত। প্রতি মাসের একদিন ও প্রতি বারোমাসের একমাস উপাস্যের জন্য উৎসর্গকৃত। এছাড়া নওরোজ বা বছরের প্রথম দিন, ফ্রাওয়ারদিগান বা ১০ দিনব্যাপী হামাসপাথমাইদিয়াম গাহামবার, পাতেতি বা বছরের শেষ দিন, সাদেহ এবং জরাথুস্ত্রের জন্ম ও মৃত্যুদিন উদযাপন করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে চিত্রচর্চার ধারা গড়ে উঠেছে সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে। সাসানীয় ও পরবর্তীদের মধ্যে যার প্রভাব স্পষ্ট।
পরিশেষ
বর্তমান বিশ্বে জরাথুস্ত্রবাদীদের আনুমানিক সংখ্যা দুই লাখ। কিন্তু তার চিন্তা প্রভাবিত করেছে বহু পণ্ডিতকে। জরাথুস্ত্রবাদকে প্রথম দেখায় ততটা নৈতিকতা নির্ভর মনে না হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পরিধি ব্যাপক। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সকল প্রকার মন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা এবং ভালো কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছে এতে। প্রাচীন পৌত্তলিকতা থেকে বের হয়ে ইহ ও পরজাগতিক যে চিন্তার বিপ্লব জরাথুস্ত্র ঘটিয়েছেন, তা বিবর্তিত অবস্থায় প্রবাহিত হয়েছে অন্যান্য বেশ কিছু ধর্মেও। তিন হাজার বছর পরে এসেও জরাথুস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। এজন্যই আধুনিক কালের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক ফ্রেডেরিখ নীৎশেকে লিখতে হয় ‘দাজ স্পোক জরাথুস্ত্র’।