Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিরো উপত্যকার বিস্ময়কর আপাতানি নৃ-গোষ্ঠী

চতুর্দিক পাহাড়ে ঘেরা এক জনবিচ্ছিন্ন অঞ্চল। ঢালু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট ছোট ধানক্ষেত। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ক্রমাগত বৃষ্টির পানি এসে জমা হয় ধানক্ষেতগুলোতে। তারই আশপাশ জুড়ে দেখা যায় ছোট ছোট বাড়ি ও আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই ‘জিরো উপত্যকা’। অরুণাচল প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্য। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে বহুশতাব্দী ধরে অজানা অনেক বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর বাস। শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা এসব বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর  নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কৌতূহলের জন্ম দেয় আমাদের মনে। তেমনি এক জনগোষ্ঠীর নাম আপাতানি। অরুণাচল প্রদেশের জিরো উপত্যকায় তাদের বাস। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান ও পরস্পর নির্ভরশীলতার এক অনন্য উদাহরণ এই ‘আপাতানি’ জনগোষ্ঠী।

Ziro Valley: An Offbeat Destination in Arunachal Pradesh -
জিরো উপত্যকা; Image Source: www.onhisowntrip.com

২০১১ সালের আদমশুমারি মতে, আপাতানি নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ৪৩,৭৭৭ জন। পূর্বে এ নৃ-গোষ্ঠী শুধুমাত্র জিরো উপত্যকায় বসবাস করলেও বর্তমানে আরো বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের বসবাস। প্রায় ৩২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে তাদের আবাদি জমি। আপতানি নৃ-গোষ্ঠীর সীমিত ভূমির বিচক্ষণ ব্যবহারই তাদেরকে আলাদা করেছে অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠী থেকে। উপত্যকার অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে ভেজা-ধান চাষ এবং তার সাথে মাছ চাষ করে তারা। এই নিয়মতান্ত্রিক ভূমি ব্যবহারের প্রথা একাধারে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের সংরক্ষণ নিশ্চিত করে। 

আপাতানি নৃ-গোষ্ঠীর কোনো লিখিত ইতিহাস নেই, যা আছে সবই মৌখিক। এ কারণে ঠিক কবে থেকে জিরো উপত্যকায় তাদের বাস তা সুনির্দিষ্ট জানা যায় না। তিব্বত ও অহম সূত্র থেকে জানা যায়, আপাতানিরা অরুণাচলের মূল গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৫শ শতাব্দী কিংবা তার আগে থেকেই তাদের বসবাস জিরো উপত্যকায়। তবে জিরো উপত্যকায় বসবাসের আগে তাদের নিবাস ছিল তালী উপত্যকায়। পূর্বে জিরো উপত্যকা ছিল বিস্তীর্ণ জলাভূমি। মৌখিক ইতিহাসে জানা যায়, সেখানে বাস করত এক প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ ‘বুরু’। শেষ বুরুকে হত্যা করা হয় এক পিতল ফলক দিয়ে যাকে ‘মিয়ামিয়া তালো’ বলা হয় যা এখনো সংরক্ষিত আছে। 

আপাতানি নারীদের নাকের নথ ও ট্যাটু 

আপাতানি নৃ-গোষ্ঠীর প্রধান দৃশ্যমান প্রথা হলো তাদের নারীদের বিচিত্র নাকের নথ। আপাতানি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ইয়াপিং হুল্লো’। কাঠের তৈরি এসব আঁটোসাঁটো নথ সাধারণত বৃদ্ধ আপাতানি নারীদের ব্যবহার করতে দেখা যায়। ধারণা করা হয়, অতীতে অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর আক্রমণ ও অপহরণের শিকার হতো নারীরা। আপাতানি নারীদের সৌন্দর্যের বেশ সুনাম ছিল। অপহরণ ও আক্রমণের শিকার নারীরা পরবর্তীতে কাঠের তৈরি বিশালাকার নথ পরিধান করা শুরু করে নিজেদেরকে অনাকর্ষণীয় করে তোলার জন্য। তবে ১৯৭০ সালে ভারত সরকার এ প্রথা নিষিদ্ধ করে। এখন শুধুমাত্র বৃদ্ধাদের নাকেই এই নথ দেখা যায়। 

মুখে ট্যাটু, নাকে কাঠের নথে আপাতনি বৃদ্ধা; Image Source: Dailymail

১৯৭৪ এর আগপর্যন্ত আপাতানি নারীরা তাদের কপালে একটি ও চিবুকে পাঁচটি লম্বা কালো দাগ সম্বলিত ট্যাটু বা উল্কি করতো। অপরদিকে পুরুষরা তাদের চিবুকে ইংরেজি ‘T’ অক্ষরের মতো দেখতে ট্যাটু করত। ‘তিপে তেরে’ নামক  একটি কাঁটাযুক্ত গাছের সাহায্যে ট্যাটুগুলো করা হতো। পিগমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো কালি ও শুকরের চর্বি। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কাঁটাযুক্ত বাকলে বার বার আঘাত করে উল্কি করা হতো মুখে। যন্ত্রণাদায়ক এ প্রক্রিয়াটি  পরবর্তীতে বন্ধ করা হয়। শিক্ষার প্রসার ও সময়ের পরিক্রমায় আপাতানিদের নথ ও ট্যাটুর ধারণা পাল্টেছে। বর্তমানে তরুণ আপাতানি এসব প্রথা অনুসরণ না করলেও বৃদ্ধাদের মধ্যে আদি বিশ্বাস ও প্রীতি রয়ে গেছে।

স্বকীয় কৃষি পদ্ধতি

সীমিত ভূমির বিচক্ষণ ব্যবহার ও প্রাকৃতিক নিয়মের আলোকে খাদ্য উৎপাদন আপাতানি নৃ-গোষ্ঠীর সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ি অঞ্চল ও এর জীববৈচিত্র্যকে সাথে করে খাদ্য উৎপাদন ও বসবাসের সংস্কৃতি আপাতানিদের অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীদের থেকে আলাদা করেছে। ধান আপাতানিদের প্রধান খাদ্যশস্য। পাহাড়ি ঢাল ও এর পাদদেশে আপাতানিরা তৈরি করে ধানক্ষেত। ক্রমাগত বৃষ্টির পানি এসে জমা হয় সে ক্ষেতে। ধানের সাথে মাছ চাষও করা হয় একই জায়গায়। বর্তমানের Permaculture প্রক্রিয়াটি বহু শতাব্দী আগে থেকেই করে আসছে আপাতানিরা। Permaculture বলতে বাস্তুতন্ত্রকে (Ecosystem) ব্যাহত না করে খাদ্য উৎপাদনকে বোঝায়। অন্যান্য অনেক নৃগোষ্ঠীর মতো প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের সংস্কৃতি আপাতানিরাও ধারণ করে আসছে। 

একই সাথে ধান ও মাছ চাষ; Image Source: EastMojo.com

সেচের পানির সহজলভ্যতা এবং জিরো উপত্যকার আশেপাশের বন ও পানির উৎস সংরক্ষণের প্রথাগত নিয়মের ফলে পাহাড়ের পাদদেশে ধান চাষ সম্ভব হয়। সেই সাথে বন সম্পদের ব্যবহার ও শিকার চর্চার প্রথাগত আইনের ফলে জীববৈচিত্র্য ও খাদ্যশস্য উৎপাদনের ধারা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। যেখানে বর্তমান আধুনিক বিশ্বে প্রকৃতির ওপর নির্মম শোষণ ও এর বিনাশ সবার উদ্বেগের কারণ, সেখানে আপাতানি নৃ-গোষ্ঠী ঠিকই প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি ভালোবাসা টিকিয়ে রেখেছে।

আপাতানি ধানচাষী; Image Source: Picture-allinace

আপাতানি উৎসব 

মিয়োকো উৎসব

আপাতানিরা মূলত প্রকৃতিপূজা করে। তবে তাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীও দেখা যায়। তাদের মূল উৎসব হলো ‘মিয়োকো’— প্রায় দশদিন ব্যাপী এ উৎসবে চন্দ্র ও সূর্যের পূজা হয়। পূজাগুলো পরিচালনা করেন একজন ‘শামান’ বা ওঝা। শূকর ও মুরগি বলি দেয়া হয় এ উৎসব। শূকর ও মুরগি বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয়। তারপর মন্ত্রপাঠের পর তা বলি দেয়া হয়। সাধারণত মার্চের ২০-৩০ তারিখ পর্যন্ত এ উৎসব পালিত হয়। মিয়োকো এ সম্প্রদায়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। সমৃদ্ধি, বন্ধুত্ব, ও উর্বরতার জন্য এ উৎসব পালন করা হয়। 

মিয়োকো-উৎসবের সময় এক আপাতানি বৃদ্ধ; image source: Anthony Pappone Photography

 

দৃ উৎসব

দৃ উৎসব সাধারণত জুলাই মাসে হয়। আবাদকেন্দ্রিক এ উৎসবে চাল ও বিশেষ একপ্রকার মদ পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও বিশেষ দৃ নৃত্যও পবিবেশন করা হয়। ফলন মৌসুম উদযাপন করার জন্যই দৃ পালিত হয়। 

ফসল উৎসবে আপাতানি নারীদের দৃ নৃত্য; Image Source: Rgyan

কৃষি বনায়ন ও প্রকৃতি জ্ঞান 

অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠী যেখানে সমতল বন কেটে শুষ্ক ভূমিতে চাষাবাদ করে সেখানে আপাতানি নৃ-গোষ্ঠী পাহাড়ি ভেজা ঢালু  জমিতে স্থায়ী চাষাবাদ করে। পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চল সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার উপযুক্ত ব্যবহারের প্রথা আপাতানিদের অন্য নৃ-গোষ্ঠীদের থেকে স্বকীয়তা দেয়। প্রকৃতি ও এর সাথে বসবাসরত জীবকূলের সম্বন্ধে বিপুল জ্ঞান তাদের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। কৃষি-বনায়ন বা ‘Agro-Forestry’-এর সাহায্যে খাদ্য উৎপাদন ও জীবিকার যোগান আপাতানি নৃ-গোষ্ঠীর অনুপম বৈশিষ্ট্য। 

জিরো উপত্যকায় কৃষি বনায়নের চর্চা ও চারণভূমিতে পশুপালনের মাধ্যমে সীমিত ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। উর্বর উপত্যকায় অধিক ফলনও এর ফলে সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের ঐতিহ্যগত পরিবেশ জ্ঞান বর্তমান বিশ্বে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাদের ভেজা ধান চাষ, কবরস্থান, পাইন ও বাঁশের বাগান, এবং কমিউনিটি ফরেস্ট বা সামাজিক বনায়নের পৃথক জায়গা রয়েছে। এতে প্রমাণ হয় শত বছর ধরে প্রকৃতি এবং সীমিত ভূমির উপযুক্ত ব্যবহারের ঐতিহ্য। 

প্রকৃতির সাথে একাত্ম আপাতানি জনগোষ্ঠী; Image Source: travelmynation.in

২০১৪ সালে ইউনেস্কো আপাতানি সংস্কৃতির ভূদৃশ্যকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধারণ এবং মানব সভ্যতার বৈচিত্রের এক উদাহরণ এই আপাতানি নৃ-গোষ্ঠী। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা প্রথা, রীতি ও সংস্কৃতির পালন আপাতানিদের করেছে অন্যদের থেকে আলাদা। হাজার হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাসে বৈচিত্র্যময় বহু নৃ-গোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মাঝে মানব ও প্রকৃতির সহাবস্থানের জীবনযাত্রা খুব সাধারণ ও স্বাভাবিকভাবে চলে আসছে। আপাতানি নৃ-গোষ্ঠীর মতো প্রাণ-প্রকৃতির সাথে ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যাক মানুষের ইতিহাস। 

Related Articles