ভাইকিং মানেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অধিবাসী; কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মানেই ভাইকিং নয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং মোটা দাগে উত্তর ইউরোপের বিশেষ এক জাতিগোষ্ঠীর নাম ভাইকিং; যারা সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক বলয়। কেবল সমুদ্র অভিযান বললে ভুল হবে। আক্রমণ, লুণ্ঠন, ব্যবসা এবং আধিপত্যের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে স্বতন্ত্র সভ্যতা; যার স্বর্ণযুগ স্থায়ী ছিল ৭৯০ সাল থেকে ১১০০ সাল অব্দি। ইউরোপের অন্যান্য অংশের বণিক এবং ধর্মযাজকরা তাদের আখ্যায়িত করেছে নর্সম্যান বা নর্থম্যান হিসাবে। নর্স মিথোলজি বলতে মূলত তাদের বিশ্বাসের সংকলনকেই বোঝানো হয়।
মিথ স্বপ্নের মতো; যার সাথে সরাসরি মানুষের অবচেতন মনের যোগাযোগ। স্বপ্নের মতো উপকথাও তোয়াক্কা করে না স্থান কিংবা সময়ের। প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্র কিংবা নিয়ম যুগের পর যুগ রূপকের আকারে বাহিত করে নিজের ভেতর। সৃষ্টির শুরুর লগ্ন থেকে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের ব্যাখ্যা- সবকিছুই। নর্সদের সংস্কৃতির মতোই তাদের মিথও পরবর্তী সময়ে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে ইউরোপকে। তার বড় প্রমাণ সপ্তাহে বারের নামগুলোতে নর্স দেবতাদের নামের দাগ। মিশর, ব্যবিলন, গ্রীস কিংবা চৈনিক সৃষ্টিতত্ত্বের চেয়ে তাদের সৃষ্টি বিবরণীও কম সমৃদ্ধ নয়।
আখ্যানের শুরু
তখনও আকাশ, মাটি, নক্ষত্র কিংবা সমুদ্রের জন্ম হয়নি। কেবল আছে গিনুনগ্যাগাপ– এক বিস্তৃত অতল শূন্যতা। গিনুনগ্যাগাপের উত্তরের অংশে অবস্থিত নিফলহেইমার। বরফ, তুষারপাত আর কুয়াশায় আচ্ছাদিত জায়গাটা বস্তুত শীতল অন্ধকারের আঁতুড়ঘর। নিফলহেইমারের ঠিক কেন্দ্রস্থলকে বলা হয় হুয়েরগেলমির; যেখান থেকে প্রবাহিত হয় এগারোটি শীতল নদী। কেন্দ্রটাই সমস্ত জীবনের উৎস এবং একদিন সবকিছু সেখানেই ফিরে যাবে। যা-ই হোক, হুয়েরগেলমির থেকে শীতল স্রোত বাহিত হয়ে যখনই গিনুনগ্যাগাপে আসে; পরিণত হয়ে যায় কঠিন বরফে। আবার গিনুনগ্যাগাপের দক্ষিণে অবস্থিত মুসপেলহেইমার বা সংক্ষেপে মুসপেল। আগুন, লাভা আর উত্তপ্ত ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ। পরে স্থানটি আগুনদানবদের আবাসভূমিতে পরিণত হয়।
মুসপেল থেকে উত্তপ্ত লাভা আর ফুলকি আসে গিনুনগ্যাগাপে। ঠিক একইভাবে নিফলহেইমার থেকে আসে তুষার। গিনুনগ্যাগাপের ঠিক মধ্যিখানে মিলিত হয় বিপরীত দিক থেকে আগত বাতাস। গলতে শুরু করে বরফ; আকৃতি নিতে থাকে মানুষের মতো, কিন্তু অতিকায় দানবের। নর্স মিথোলজিতে সর্বপ্রথম জন্ম নেয়া এই ইয়োতুন (উচ্চারণ ‘জতুন’ আর ‘ইয়োতুন’ এর মাঝামাঝি) বা দানবের নাম ইমির। পরবর্তী সময়ে জন্ম নেয়া সমস্ত দানবের আদিপিতা এই ইমির। যদিও তাকে নারী বা পুরুষ না বলে একসাথে উভয়টি বলাই যৌক্তিক হবে। রাতে যখন ইমির ঘুমে আচ্ছন্ন, তার দুই বাহুর ঘাম থেকে জন্ম নিলো আরো দু’টি দানব। একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। আবার দুই পা যখন একটি আরেকটির সাথে মিলিত হলো, জন্ম নিলো তৃতীয় জন- থ্রুদগেলমির।
দেব ও দানব
লাভা আর শীতল বরফের মিলনস্থলে কেবল ইমিরের জন্ম হয়নি। হয়েছে আওদুমলা নামে শিংবিহীন গাভীর। গাভীটির দুধ পান করত ইমির আর গাভী নিজের জিভ দিয়ে চাটত নোনতা বরফ। তাতেই জন্ম হয় এক বিস্ময়কর ঘটনার। প্রথমদিন ক্ষয়ে যাওয়া বরফ থেকে উঁকি দেয় কালো চুল। দ্বিতীয়দিনে বের হয় মাথা আর তৃতীয়দিন সমস্ত শরীর। নতুন আবিষ্কৃত এই ব্যক্তিই দেবতাদের পূর্বপুরুষ বুরি। দানবদের মধ্যে থেকে স্ত্রী গ্রহণের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বুরির সন্তান বোর। পরে বোরের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে ওদিন, ভিলি এবং ভে নামের তিন পুত্র। ওদিন (প্রচলিত উচ্চারণ ‘ওডিন’ ঠিক নয়) দেবতাদের প্রধান।
নিফলহেইমার এবং মুসপেলহেইমার- দুটোই ছিল বসবাসের অনুপযোগী। দিনে দিনে বেড়ে উঠতে থাকা ওদিন এবং তার ভাইদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, সবকিছু আটকে আছে গিনুনগ্যাগাপ নামের কারাগারে। ওদিকে ইমিরের মাধ্যমে ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে দানবদের দল। কোনো একটা সমাধান দরকার; বুদ্ধিও বের হতে দেরি হলো না। রাতে ইমির ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথে তিন ভাই অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়লো বেচারার ওপর। ভয়ানক সংঘর্ষে শেষ অব্দি পতন ঘটলো ইমিরের। তার রক্তের স্রোতে ভেসে গেলো অন্য দানবেরা। ভেলার মতো কাঠের বাক্সে আশ্রয় নিয়ে টিকে থাকল ইমিরের নাতি বেরগেলমির এবং তার স্ত্রী। বর্তমান যত দানবেরা জীবিত; তারা সব তাদেরই বংশধর।
ওদিন তার ভাইকে নিয়ে সৃষ্টিতে নেমে পড়লেন এবার। ইমিরের মাংস দিয়ে তৈরি করা হলো মাটি আর হাড়গুলো দিয়ে পাহাড়। পাথর, বালু এবং মার্বেলের সৃষ্টি হয়েছে দাঁত থেকে। সমুদ্র এবং নদীগুলোকে জন্ম দিয়েছে রক্ত আর ঘাম। ইমিরের মস্তিষ্ক পরিণত হয়েছে মেঘ এবং মাথার খুলি আকাশে। মুসপেলহেইমার থেকে আগুনের ফুলকি এনে ভাইয়েরা ছড়িয়ে দিল আকাশে, যা আমাদের কাছে তারা বলে পরিচিত। তৈরি করা হলো দেবতাদের বাসভূমি আসগার্দ। অনেক দূরে ইয়োতুনহেইমে থাকার অনুমতি পেল দানবেরাও।
ওদিন আর তার ভাইয়েরা নতুন পৃথিবী সৃষ্টির খেলায় মগ্ন। ঠিক সেই সময় ইমিরের অবশিষ্ট শরীরের পঁচে যাওয়া অংশ থেকে জন্ম নিল বিশেষ ধরনের পোকা। এরা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয় বামনে। জে. আর. আর. টোলকিনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হবিট’-এ কিলি, বিলির মতো যে নামগুলো ব্যবহার করেছেন; তা নর্স বামনদের নাম থেকেই প্রাপ্ত। ওদিন আশঙ্কা করেছিলেন, যেকোনো সময় ধ্বসে পড়তে পারে আকাশ। সুতরাং, চারজন বামনকে চারদিকে প্রেরণ করা হলো আকাশ ধরে রাখার জন্য।
নর্দ্রি, ভেস্ত্রি, সুন্দ্রি এবং এস্ত্রি- এই চার বামনের নাম থেকেই হাল আমলের দিকের নাম নর্থ, ওয়েস্ট, সাউথ এবং ইস্ট উৎসারিত। অবশিষ্ট বামনদের আবাস হয় অতল সোয়ারতালফাহেইম। বামনরা সেখানে নির্মাণবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে। থরের জাদুকরি হাতুড়ি মিওলনিরসহ বেশ কিছু শক্তিশালী অস্ত্র এসেছে তাদের কাছ থেকেই।
চন্দ্র এবং সূর্যের গল্প
মিদগার্দের বাসিন্দা মুন্ডিলফারির ছিল দুই সন্তান। অতুলনীয় সৌন্দর্যের দরুন কন্যাকে সূর্যের নামে ‘সোল’ এবং পুত্রকে চাঁদের নামে ‘মানি’ ডাকা হতো। ইতোমধ্যে মুসপেলহেইমের ফুলকি থেকে জন্ম নেওয়া সূর্য একটি রথে চড়ে ওঠানামা করত। রথটির কোনো চালক ছিল না। সন্তানদের নামকরণে মুন্ডিলফারির দুঃসাহস ফুটে ওঠে; ফলে ক্রুদ্ধ হলেন দেবতারা। কন্যা সোলকে তুলে নিয়ে সেই রথের চালক করে রাখলেন। রথে ব্যবহৃত ঘোড়া দু’টির নাম আরবাকার এবং এলসভিনির। রথের নিচে ঝোলানো বর্মে আগুন থেকে রক্ষিত হয় আকাশ।
মানির নিয়তিতেও ব্যতিক্রম ঘটল না। ধরে নিয়ে চালক করা হলো চন্দ্ররথের। খেয়াল করা যেতে পারে, অন্যান্য সংস্কৃতিতে সূর্যদেবতা পুরুষ আর চন্দ্রদেবী নারী হলেও, নর্স পুরাণে ব্যতিক্রম। যা-ই হোক, মানি পরে মিদগার্দ থেকে আরো দু’টি সন্তান চুরি করে। কাজে লাগায় নিজের সাহায্যকারী হিসেবে। ছেলে দুটোর নাম বিল এবং ইয়োকি। আবার স্কল (শাব্দিক অর্থ: যে তিরস্কার করে) এবং হা-তি (শাব্দিক অর্থ: যে ঘৃণা করে) নামের দুই নেকড়ে তাদের প্রতিনিয়ত খুঁজে চলছে। হা-তি প্রতিবার চাঁদকে কামড় দিয়ে অল্প করে খসিয়ে নেয়। কিন্তু চাঁদ দ্রুত ফসকে গিয়ে নিজে নিজে ঠিক হয়ে যায়। এ কারণেই আমরা দেখি চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধি। একদিন নেকড়ে দু’টি ঠিকই চাঁদ আর সূর্যকে ধরে ফেলবে। আর সেদিনই হবে মহাপ্রলয় রাগনারক।
রাত এবং দিন
রাত আর দিনের জন্মের পেছনেও আছে অন্যরকম এক গল্প। দানব নরভির কন্যা নট (রাত) ছিল অন্যান্য স্বজনদের মতন কালো এবং অন্ধকারময়। নাগলফারির সাথে নটের প্রথম বিয়ে হলে সেখানে সন্তান আউদ জন্ম নেয়। দ্বিতীয় বারে বিয়ে হয় আনারের সাথে। এই দফায় জন্ম নেওয়া কন্যা ইয়র্দ; যিনি পরবর্তী দেবরাজ ওদিনের স্ত্রী এবং থরের মাতা।
সময় যায়। নটের তৃতীয় দফায় বিয়ে হয় দেবতা দেলিনগারের সাথে। তাদের কোলে জন্ম নেওয়া দ্যাগ (দিন) হলেন পিতার পরিবারের মতোই উজ্জ্বল এবং ফর্সা। দেবরাজ ওদিন নট এবং দ্যাগকে দু’টি ঘোড়া এবং দু’টি রথ দিয়ে আকাশে পাঠালেন। নট সামনে এগিয়ে যায় তার ঘোড়া রিমফ্যাক্সিতে আরোহণ করে। নিজের ঘোড়া স্কিনফ্যাক্সির সাহায্যে মায়ের অনুসরণ করে দ্যাগ। চলতে হয় তাদের অনন্ত অভিযাত্রা। আর পৃথিবীও অবলোকন করে রাত ও দিনের ক্রম বিবর্তন। অবশ্য কিছু কিছু বর্ণনায় রাত আর দিনের উপকথাও চন্দ্র ও সূর্যের উপকথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে দেখানো হয়েছে।
মানুষের আগমন
সমতল পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করে আছে সমুদ্র। দানবের বাস পৃথিবীর এক প্রান্তে গভীর সমুদ্রের পাশে। তাদের থেকে রক্ষা করার জন্য ইমিরের চোখের পাঁপড়ি দিয়ে কেন্দ্রের দিকে তৈরি করা হলো দেয়াল। দেয়ালে আবদ্ধ সেই অংশের নাম মিদগার্দ। সবদিক থেকে অতুলনীয় হওয়া সত্ত্বেও নতুন সৃষ্ট মিদগার্দ ছিল খালি। ওদিন, ভিলি এবং ভে বুঝতে পারলেন, কেউ বসবাস না করলে এই সৃষ্টির কোনো অর্থ থাকবে না। তাই তিনি মনস্থ করলেন মানুষ সৃষ্টির।
একদিন ওদিন এবং তার দুই ভাই সমুদ্র সৈকতে দু’টি চ্যালাকাঠ খুঁজে পেল। প্রথমটি অ্যাশ এবং অন্যটি এলম্ গাছের। ওদিন তাদের কাছে নিয়ে জীবন ফুঁকে দিলেন। ভিলি দিলেন বুদ্ধিমত্তা, ইচ্ছাশক্তি এবং চলাচলের ক্ষমতা। অন্যদিকে ভে দিলেন মানুষের আকৃতি, প্রস্তুত করলেন ঘ্রাণ নেবার জন্য নাক, শোনার জন্য কান এবং কথা বলার জন্য ঠোঁট। ভে-ই দুইটি চ্যালাকাঠের একটিকে পুরুষ এবং অন্যটিকে নারীর আকৃতি দিলেন। প্রথম নরনারীর জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করলেন তিনজনে মিলেই। সবিশেষ রাখা হলো নাম। পুরুষের নাম আস্ক এবং নারীটির নাম এমব্লা।
মানবজাতির আদিপিতা আস্ক এবং মাতা এমব্লা। মিদগার্দে তাদের নিরাপদে বসবাসের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় সন্তান-সন্তুতি। মিদগার্দ পরিণত হয় জনারণ্যে। আজকের প্রতিটি ব্যক্তিই তাদের উত্তরাধিকার বহন করে চলছে। এজন্যই ওদিনকে বলা হয় সর্বপিতা। কেবল দেবতাদের পিতাই না; নর্স সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী, তার হাতেই জীবন পেয়েছে মানবজাতির প্রথম পিতামাতা।