প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (শেষ পর্ব): সূর্যোদয়ের ভূমি

জাপান, সূর্যোদয়ের দেশ। প্রাচীন জাপানি সভ্যতার রয়েছে নিজস্ব সমৃদ্ধশালী মিথোলজি। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি জাপানের আরেক প্রধান ধর্ম শিন্টো। অন্যান্য ধর্মের মতো শিন্টোর কোনো পবিত্র গ্রন্থ নেই, নেই কোনো প্রচারকও। শিন্টো জাপানি ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে এত গভীরভাবে প্রোথিত যে এর কোনো প্রয়োজনও নেই। জাপানের উৎপত্তির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে এ ধর্মের গল্প। এর দেবতাদের বলা হয় কামি। কামিরা হলেন পবিত্র আত্মা বা স্পিরিট, যারা জীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের রূপ দিয়ে থাকেন, যেমন: বৃষ্টি, বাতাস, পানি, পাহার-পর্বত, গাছপালা ইত্যাদি।

সূর্যদেবী আমাতেরাসু অন্যতম একজন কামি। শিন্টো ধর্মের বর্ণনায় কেমন করে জগত সৃষ্টি হলো, তা লিপিবদ্ধ করা আছে কজিকি বা প্রাচীন ঘটনাবলিতে, যা ৫০০ থেকে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝে কোনো এক সময়ে সংকলিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

আদি আত্মা

এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা আর অন্ধকারে মহাবিশ্ব আচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে এ বিশৃঙ্খলা আর আঁধার ঘনীভূত হয়ে তৈরি হলো স্বর্গ আর পৃথিবী। তারা ছিল একসাথেই, কিন্তু তখনও তাদের কোনো নাম নেই, নেই জীবনের শৃঙ্খলা। এর মাঝেই উৎপত্তি হলো তিন প্রধান অস্তিত্বের-

  • স্বর্গের কেন্দ্রে আত্মাদের প্রভু বা স্পিরিট মাস্টার
  • প্রধান অগাস্ট, যিনি সৃষ্টি করলেন আত্মার
  • দ্য ডিভাইন, যিনি সৃষ্টি করলেন মানুষের পূর্বপুরুষ

একসময় তারা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এদিকে পৃথিবী ধীরে ধীরে স্বর্গ থেকে আলাদা হয়ে যেতে লাগল। এখানে উৎপত্তি হলো এক গাছের, যা থেকে জন্ম নিলেন নতুন দুজন স্পিরিট:

  • প্রিন্স এল্ডার
  • স্বর্গে চিরকাল দণ্ডায়মান সত্ত্বা

প্রথম তিনজন এবং পরের দুজন, মোট পাঁচজনে মিলে পৃথিবী আর স্বর্গ আলাদা করে ফেলেন। পৃথিবী জুড়ে তখন এক সীমাহীন সমুদ্র। এদিকে প্রথম তিনজনের মতো প্রিন্স এল্ডার ও দণ্ডায়মান সত্ত্বাও সময়ের পরিক্রমায় মিলিয়ে গেলেন। তাদের স্থানে এলেন পাঁচ জোড়া নতুন কামি-

  • পৃথিবীতে চিরকাল দণ্ডায়মান সত্ত্বা এবং আরেক মাস্টার স্পিরিট
  • কাদামাটির প্রভু আর তার বোন কাদামাটির দেবী
  • রোগশোকের প্রভু আর তার বোন জীবনদাত্রী দেবী
  • মহিমাময় স্থানের দেব ও দেবী
  • ত্রুটিহীনতার স্পিরিট এবং একজন দেবী
  • ইজানাগি (যে পুরুষ হ্বান করে এবং ইজানামি (যে নারীকে আহ্বান করা হয়)- এরাই শিন্টো ধর্মে জাপান ও তার মানুষের সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন
অসীম সাগর © CC0 Public Domain/ phys.org

প্রথম দ্বীপের উৎপত্তি

স্বর্গ ও পৃথিবীর সিঁড়ি আমা-নো-হাশিদা দাঁড়িয়ে অন্যান্য কামির দেয়া এক মণিমুক্তোখচিত বর্শা হাতে নিলেন ইজানাগি আর ইজানামি। তারা দেখতে চান, নিচে পৃথিবীতে কী হচ্ছে। তাদের বর্শার ডগা সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে তারা তুলে নিলেন। তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে জমে থাকা পানির ফোঁটা, মতান্তরে কাদামাটি গড়িয়ে নিচে পড়তেই সেখান থেকে সাগরের মাঝে জেগে উঠল প্রথম ভূমি, অনোগোরো-শিমা। উল্লসিত ইজানাগি আর ইজানামি সেখানে বানালেন বিশাল এক প্রাসাদ, আর তৈরি করলেন স্বর্গের দিকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো সুউচ্চ স্তম্ভ।  

বর্শা হাতে ইজানামি আর ইজানাগি © Print Collector / Getty Images
প্রথম দ্বীপ; Image Source: mesosyn.com

ইজানাগি আর ইজানামির সৃষ্টিকর্ম

ইজানামি মন দিয়ে নিজের শরীর পরীক্ষা করলেন। তিনি ইজানাগিকে জানালেন, তার দেহের এক স্থানে অসম্পূর্ণতা আছে। ইজানাগি প্রত্যুত্তরে বললেন, তার শরীরের অতিরিক্ত এক অংশ তিনি দেখতে পান। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন এই দুই অংশ একত্রিত করে সৃষ্টির শুরু করবেন। সেই মতো তারা বিয়ে করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। রীতি অনুযায়ী, সুউচ্চ স্তম্ভ ঘিরে দুজন দু’দিকে হাঁটা দিলেন, যতক্ষণ না তারা সে স্তম্ভ ঘুরে পরস্পর মিলিত হন। দেখা হওয়ামাত্র ইজানামি বলে উঠলেন, “আহা! কী সুদর্শন পুরুষ!” ইজানাগি জবাব দিলেন, “আহা! কী অপরূপা নারী!”; তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।

ইজানামি আর ইজানাগির মিলন; Image Source: greenshinto.com

ইজানামি আর ইজানাগির মিলনে প্রথম সন্তান জন্ম নিল। কিন্তু এ কী! এ সন্তান তো বিকলাঙ্গ, তার শরীরে কোনো অস্থি নেই। হতাশ পিতামাতা তাকে সাগরে ভাসিয়ে দিলেন। এই সন্তান হলেন জাপানিজ কামি হিরোকো, পরে যাকে ‘এবিসু’ নামে অভিহিত করা হয়। তিনি জেলেদের সুরক্ষাকারী দেবতা এবং জাপানের সাত সৌভাগ্যের দেবতার একজন। দ্বিতীয় সন্তান জাপানের আওয়া দ্বীপ। কিন্তু ইজানামি আর ইজানাগি অনুধাবন করলেন, কোথাও গড়বড় হচ্ছে। তারা অন্য দেবতাদের সাথে পরামর্শ করলে তারা জানালেন যে, তাদের বিয়ের রীতিতে ভুল হয়েছে। স্তম্ভ ঘুরে যখন তারা একসাথে হয়েছিলেন, তখন ইজানামি প্রথমে কথা বলেছেন, যা উচিত নয়। প্রথম কথা বলার অধিকার ছিল ইজানাগির।

ফলে, ইজানামি আর ইজানাগি আবার স্তম্ভ ঘুরে নতুন করে শুভকাজ সম্পন্ন করলেন। এবার তাদের থেকে সৃষ্টি হলো জাপানের আটটি প্রধান দ্বীপ- আওয়াজি, শিকোকু, ওকি, সুকুশি (কায়ুশু), ইকি, সু, সাডো আর অয়ামাতো। এছাড়াও ছয়টি ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি হলো। এসব দ্বীপে গড়ে উঠল মানুষের বসতি। ইজানামি আর ইজানাগি থেকে আরো জন্ম নিলেন প্রায় আটশত কামি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সাগরদেবতা ওহো-ওয়াটাসুমি গাছপালার স্পিরিট কুকুনোশি, পর্বতদেব ওহো-ইয়ামাটাসুমি আর আগুনের দেবতা কাগুতসুচি।

জাপানের দ্বীপ; Image Source: thetimes.co.uk

ইজানামির মৃত্যু

ইজানামি আর ইজানাগি সুখেই দিনাতিপাত করছিলেন। কিন্তু কাগুতসুচিকে জন্ম দিতে গিয়ে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। নিজের সন্তানের আগুনে নিজেই পুড়ে গেলেন ইজানামি। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তার মৃত্যু হলো। স্ত্রীর মৃত্যুশোকে ইজানাগি উন্মাদ হয়ে উঠলেন। তার চোখের পানি থেকে সৃষ্টি হলো বহু নতুন কামির। এরপর বিশাল এক তরবারি বের করে কাগুতসুচিকে দু’টুকরো করে ফেললেন তিনি। কাগুতসুচির দেহের কাটা অংশ থেকে বেরিয়ে এলো আটজন কামি। তরবারিতে লেগে থাকা রক্ত থেকে এলো পাথরের তিন, আগুনের দুই আর পানির এক দেবতা। এই সমস্ত উপাদানই লাগত তরবারি তৈরি করতে।    

ইজানামির মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট দেবতারা; Image Source: Wikimedia Commons

ইজানাগির পাতাল গমন

স্ত্রীকে ছাড়া ইজানাগির জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে উঠলে তিনি ইয়োমি, বা পাতালে নেমে গেলেন। উদ্দেশ্য, ইজানামিকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। পাতালের ঘোর অন্ধকারে শেষ পর্যন্ত প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে তাকে খুঁজে পেলেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যেই ইজানামি সেখানকার খাদ্য গ্রহণ করে ফেলেছেন। ফলে, নিয়মানুযায়ী তার আরা মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ নেই। তবে ইজানামি স্বামীকে কথা দিলেন, তিনি পাতালের দেবতাদের সাথে দেন-দরবার করবেন। কিন্তু তার শর্ত একটাই, যতক্ষণ তিনি পাতাল ত্যাগ না করছেন, ততক্ষণ ইজানাগি তাকে দেখার চেষ্টা করবেন না।

পাতাললোকে ইজানামি; Image Source: deviantart.com

ইজানামি তো চলে গেলেন নিজের মুক্তির ব্যবস্থা করতে, কিন্তু ইজানাগির তো আর কিছুই করার নেই। বহু সময় চলে গেল। অস্থির হয়ে ইজানামি চেষ্টা করলেন আলো জ্বালিয়ে স্ত্রীকে দেখতে। কিন্তু হায়, সে চেষ্টা না করলেই বোধহয় ভাল ছিল। তার অনিন্দ্যসুন্দর স্ত্রীর পচাগলা মৃতদেহ কুরে কুরে খাচ্ছিল আটটি পোকা, যারা আবার বজ্রের প্রতিনিধিত্ব করে। ইজানাগি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করায় ইজানামি ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। বজ্রের আট দেবতাকে তিনি পাঠালেন ইজানাগিকে তাড়া করতে। নিজের লাঠি ছুঁড়ে দিয়ে ইজানাগি তাদের ঠেকালেন। এখানেই জন্ম নিল দুই শিন্টো কামি চিমাটা-নোকামি আর ইয়াচিমাটা-হাইকো ।

এদিকে শেষপর্যন্ত ইজানামি নিজেই স্বামীকে ধাওয়া করলেন। প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে পাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন ইজানাগি। বিশাল এক পাথর দিয়ে পৃথিবী থেকে পাতালে যাবার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন চিরতরে। পাথরের ওপাশ থেকে তার ক্রোধান্বিত মৃত স্ত্রী শপথ করলেন, ইজানাগির প্রতিজ্ঞা পালন না করার শাস্তি হিসেবে প্রতিদিনই জাপানের ১,০০০ জন মানুষকে তিনি হত্যা করবেন। ইজানাগি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, যদি তা-ই হয়, তবে তিনিও প্রতিদিন ১,৫০০ মানুষ সৃষ্টি করবেন শূন্যস্থান পূরণের জন্যে।   

বর্তমান দেবতাদের জন্ম

বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে ইজানাগি ঠিক করলেন, প্রথমে তাকে গোসল করে পাতালের সব অপবিত্রতা ধুয়ে ফেলতে হবে। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। তিনি চলে গেলেন ওটো নদীতে, নিজেকে ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করলেন। এ সময়ই সৃষ্টি হলো আজকের শিন্টো ধর্মের অনেক প্রধান কামির। ইজানাগি যখন তার ডান চোখ মুছলেন, তখন জন্ম নিলেন সূর্যদেবী আমাতেরাসু, বাম চোখ মুছলে উৎপত্তি হলো ঝড়ের দেবতা সুসানোর। ইজানাগি নাক মুছলে তার শ্বাস থেকে জেগে উঠলেন বাতাসের দেবতা শিনা-সু-হিকো। তার ফেলে দেওয়া কাপড়ের ১২ খণ্ড থেকে জন্ম হলো আরো ১২ রকমের দেবতার। আজো শিন্টো ধর্মের অনুসারীরা তাই মন্দিরে ঢোকার আগে নিজেরা রীতি অনুযায়ী গোসল করে নেয়।

আমাতেরাসু; Image Source: wattpad

জাপানের সূচনা

আমাতেরাসু আর সুসানোর কাছ থেকে আটজন দেবতার জন্ম হয়, এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন ইয়ামাটো পরিবারের পূর্বসূরী। এই ইয়ামাটো পরিবারই ছিল জাপানের প্রথম শাসক। অন্যান্য দেবতাদের থেকে ১৯টি অভিজাত জাপানি পরিবারের উৎপত্তি ঘটে। আমাতেরাসু আর সুশানোর ছেলেমেয়েরা মর্ত্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করলে আমারিতাসু জাপানের প্রথম সম্রাটকে স্বর্গ থেকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আমা-নো-হাশিদাত দিয়ে পর্বতচূড়ায় নেমে এলেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন বিরাট এক রাজপ্রাসাদ।

জাপানের সম্রাট; Image Source: japantravel.com

 

সম্রাট একসময় এক রাজকুমারীর দেখা পেয়ে তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার বাবা নিজের দুই কন্যাকেই সম্রাটের হাতে তুলে দিতে চাইলে সম্রাট তার অন্য কন্যা কুৎসিত হবার কারণে তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। বিয়ের পরে রাজকন্যার বাবা ব্যাখ্যা করলেন, কেন তিনি অন্য মেয়েকেও সম্রাটের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি সম্রাটকে বললেন

“আমার কুৎসিত মেয়েটির সন্তানেরা হবে অমর। আর আপনি যাকে বিয়ে করেছেন, তার সন্তানেরা হবে নশ্বর মানব।”

তখন থেকেই জাপানের সম্রাটেরা খুব দীর্ঘায়ু হন না। যা-ই হোক, তাদের থেকেই জাপানের সর্বপ্রথম রাজকীয় পরিবারের ধারা শুরু হলো।

এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:

১) প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (পর্ব-১) : পার্সিয়ার উপাখ্যান
২) প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (পর্ব-২) : সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার গল্প
৩) প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (পর্ব-৩): রা, ওসাইরিস আর আইসিসের উপাখ্যান
৪) প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (পর্ব-৪): অ্যাডাম, ইভ আর লিলিথ

This is a Bengali language article and the final part of the series of ancient creation myths. This article describes the myth of the Japanese religion Shinto. 

References

  1. Campbell, J. (1991). The masks of God: Oriental mythology. New York: Penguin Compass.
  2. Shinto
  3. The Origin of Japan and her People
  4. Cartwright, M. (2012, December 06). Izanami and Izanagi. Ancient History Encyclopedia

Featured Image: Yamato Magazine

Related Articles

Exit mobile version