গ্রিনল্যান্ড সবুজে ঢাকা কোনো জায়গা নয় এবং আইসল্যান্ডও নামের মতোই বরফাবৃত নয়। শুনলে সত্যিই অবাক হবেন, গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০ ভাগ অঞ্চলই স্থায়ী বরফে আবৃত। অন্যদিকে, আইসল্যান্ডের মাত্র ১১ ভাগ অংশ বরফে ঢাকা। গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের এই ‘প্যারাডক্স’ ধরনের নাম ও বৈশিষ্ট্য খুব স্বাভাবিক কারণেই বিখ্যাত গোটা পৃথিবী জুড়ে। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, কেন এই রকম অদ্ভুত নামকরণ?
নামকরণের এই ব্যাপারটি ছিলো সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। ভাইকিংরা যখন প্রথম এই ভূখণ্ড দুটিতে পা রাখে, তখনই নিজেদের খাতিরে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে সবকিছু বিপরীত দিকে পরিচালিত করলো। ভাইকিংরা সবুজ ভূখণ্ডটির নাম দিলো আইসল্যান্ড। কারণ উর্বর ও অনুকূল আবহাওয়ার অঞ্চলটি যেন সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এবং খুব বেশি লোকারণ্যে পরিণত না হয়। অন্যদিকে কঠিন বরফে আবৃত ভূখণ্ডটির নামকরণ করা হলো গ্রিনল্যান্ড, এই প্রতিকূল পরিবেশের দ্বীপটি কে দখল করতে গেলো কিংবা বসবাস করতে লাগলো তা নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামালেও চলতো। কিন্তু বাস্তবতা মাত্র তিন-চার বাক্যের মতোই সহজ নয়, নামকরণের পিছনে রয়েছে জটিল ঘটনাবলী, যার সাথে জড়িত রয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন ও ভাইকিং প্রথা। নামকরণের এই উপাখ্যান লোকগাঁথা ও উপকথার মতো প্রচলিত।
নরওয়েজিয়ান ভাইকিংদের প্রথা ছিলো, প্রথমে যা তাদের দৃষ্টিগোচর হবে, সেই অনুসারে তার নামকরণ করা। ভূখণ্ডের নামকরণের ক্ষেত্রে শেষে শুধুমাত্র ‘ল্যান্ড’ যুক্ত করে দিলেই হলো। যেমন বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান ভাইকিং এরিক দ্য রেডের ছেলে লিফ এরিকসন কানাডার একটি অঞ্চলের নামকরণ করেছিলো ভিনল্যান্ড (Vinland)। ‘Vin’ শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে, যার অর্থ ওয়াইন। সম্ভবত যে অংশে এরিকসন প্রথম নোঙর করেছিলেন সেখানে প্রচুর বন্য আঙুর দেখতে পেয়েছিলেন। তাই এমন নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
উত্তর আটলান্টিক সাগরের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র আইসল্যান্ড, মোট আয়তন ১,০২,৭৭৫ বর্গ কিলোমিটার। উপসাগরীয় প্রবাহের দরুন আইসল্যান্ডের সাধারণ তাপমাত্রা যথেষ্ট উষ্ণ। বর্তমানে আইসল্যান্ডের তাপমাত্রা ফেব্রুয়ারিতে সাধারণত গড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও জুলাই থেকে আগস্টে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করে। আইসল্যান্ড এক সময় ছিলো বিরান ভূমি। লোককাহিনী অনুসারে, ভাইকিংদের হাত ধরে সেখানে জনপদ গড়ে উঠেছিলো।
আইসল্যান্ড নামকরণের ইতিহাস নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে নিহিত। লোককাহিনী অনুযায়ী, নরওয়েজিয়ান ভাইকিং নাদাদর প্রথম আইসল্যান্ড আবিষ্কার করেন এবং যখন এই দ্বীপের উপকূলে তিনি পৌঁছান তখন সেখানে তুষারপাত হচ্ছিলো। প্রথা অনুযায়ী, নাদাদর দ্বীপটির নামকরণ করলেন ‘Snow land‘। নাদাদরের পর আইসল্যান্ডে পা রাখেন সুইডিশ ভাইকিং গারোর সভাভারোসন। সভাভারোসন বসতি স্থাপন করার পর সেটি নিজের নামে নামকরণ করেন ‘Garðarshólmur‘ বা গারোর দ্বীপ (Garðar’s Isle)। আজও এই নাম টিকে রয়েছে, আইসল্যান্ড আরেকটি যে নামে পরিচিত তা হলো ‘Garðarshólmur‘। গারোর পরে দ্বীপে যে ভাইকিং বসতি স্থাপন করেছিলেন, তার ভাগ্য ছিলো দুঃখ-দুর্দশায় পূর্ণ।
আইসল্যান্ডের পথে ভাইকিং ফ্লোকি ভিলগারোরসন পাড়ি জমানোর পথে তার মেয়ে নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। যতদিনে আইসল্যান্ডে পৌঁছান ফ্লোকি, ততদিনে দ্বীপের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া সকল পশু-পাখিও মারা যায়। সবকিছু হারিয়ে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ফ্লোকি। প্রচলিত উপকথা অনুসারে, এরপর সমুদ্রের ধারে কোনো এক পর্বতশীর্ষে আরোহণ করেন ফ্লোকি। পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এক বিশাল বরফ খণ্ড নজরে আসে ফ্লোকির। রাগে ও হতাশায় নিঃস্ব ফ্লোকি তখন দ্বীপটির নাম বদলে নতুন নাম দেন আইসল্যান্ড। সেই থেকে আজও এই নামেই পরিচিত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের এই দ্বীপটি।
যেখানে সব হারিয়েছেন ফ্লোকি, সেখানে আর কোনো ধরনের বসতি গড়ে উঠুক তা বোধ হয় আর চাননি তিনি। তাই মাতৃভূমি নরওয়েতে ফিরে গিয়ে ফ্লোকি গুজব রটাতে থাকে দ্বীপটি বসবাসের একেবারে অনুপযোগী ও বরফে ঢাকা। কিন্তু ফ্লোকির সাথে থাকা নাবিকদলের একজন থরোফ প্রচার করে বেড়ায় যে দ্বীপটি দারুণ উর্বর এবং সবুজ ঘাসে ভরপুর। ক্রমেই লোকারণ্যে পরিণত হয় আইসল্যান্ড। ফ্লোকির পরে যারা আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন, তারা আর পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করেননি।
আইসল্যান্ডের নামকরণ নিয়ে আরেকটি উপকথা প্রচলিত রয়েছে। নরওয়েজিয়ান ভাইকিংদের দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধ থেকে একদল পালিয়ে নৌকায় পাড়ি জমায়, শেষপর্যন্ত তারা সত্যিকার অর্থেই সবুজ এক দ্বীপে পৌঁছায়। ভাইকিংদের এই দলটির আশংকা ছিলো শত্রুপক্ষ ও বিরোধীগুলো এমন সবুজ দ্বীপের কথা জানতে পারলে বার বার আক্রমণ করে দখল করা চেষ্টা করবে।
তাই তারা দ্বীপটির নাম দিলো আইসল্যান্ড এবং বাইরের পৃথিবীতে গুজব রটিয়ে দিলো যে দ্বীপটি বরফাচ্ছাদিত ও বসবাসের অযোগ্য। বিরোধী দলগুলোকে তাদের সবুজ দ্বীপ থেকে আরও দূরে সরিয়ে রাখতে তারা আরও প্রচার করেছিলো যে দূরে দারুণ সুন্দর সবুজ ও বিশাল একটি দ্বীপ রয়েছে। আসলে বিশাল এই দ্বীপটি ছিলো বরফে ঢাকা ও খুবই প্রতিকূল ভূখণ্ড। এই বিশাল দ্বীপটিই আজ গ্রিনল্যান্ড নামে পরিচিত।
২১,৬৬,০৮৬ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে থাকা গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপ। গ্রিনল্যান্ড যদিও উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত কিন্তু দ্বীপটির প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইউরোপের হাতে। গ্রিনল্যান্ডের তাপমাত্রা আজকে যত কম, একসময় এত হিমশীতল ছিলো না। বরফ ও শামুকের খোলসের প্রাপ্ত অংশ নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৮০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ অংশ বর্তমানের তুলনায় অনেক উষ্ণ ছিলো।
‘ভিনল্যান্ড’ নামকরণের হোতা ভাইকিং এরিকসনরের বাবা এরিক দ্য রেডের আসল নাম এরিক থরভালদসন। এরিকই ছিলো প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি সর্বপ্রথম পা রাখেন গ্রিনল্যান্ডে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। গ্রিনল্যান্ডে এরিকের পা রাখার ঘটনা ছিলো ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। প্রচলিত রয়েছে, নরওয়েতে থাকাকালীন সময়ে কোনো এক বিবাদে জড়িয়ে তিনজনকে হত্যা করে এরিক। তৎকালীন আইনানুসারে, হত্যার শাস্তি ছিলো মৃত্যদন্ড কিংবা নির্বাসন। এরিক বেছে নিয়েছিলেন নির্বাসন, যা তাকে পথ দেখিয়েছিলো সমুদ্র অভিযানে এবং নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের।
এরিক তার দলবল নিয়ে গ্রিনল্যান্ডের যে অংশে পা রাখেন, তা ছিলো দ্বীপটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং সময়টি ছিলো গ্রীষ্মকাল। এই উষ্ণ অংশটি একেবারে কঠিন বরফে আবৃত ছিলো না। যদিও বসবাসের জন্য এটি কিছুটা অনুকূলে থাকলেও, একেবারে সহজও ছিলো না এখানে বসতি স্থাপন করা। উষ্ণ তাপমাত্রা ফসল ও সবুজ প্রকৃতির জন্য সহায়ক ছিলো। বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ অংশে জুন মাসের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবিষ্কারের সময়, ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে গ্রিনল্যান্ডের ঘাস হয়তো যথেষ্ট সবুজ ছিলো। এই বিবেচনায় ভাইকিংদের দেওয়া এই নাম সম্ভবত সময়ের বিবেচনায় সঠিক ছিলো। অবশ্য উপকথা অনুযায়ী, বসতি স্থাপনের জন্য এরিক তখন অন্যান্যদের আকৃষ্ট করার জন্য দ্বীপটির নাম দিয়েছিলো গ্রিনল্যান্ড।
কিন্তু চৌদ্দ শতকের দিকে দ্বীপটির তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে, তখন বাইরে থেকে এসে সেখানে বসতি স্থাপন করা লোকদের সংখ্যা কমে গেলো। গ্রিনল্যান্ডে মাসের উষ্ণতম সময়েও তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে বিরাজ করে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব উপকূলের তাপমাত্রা -৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে আসে, অনেক সময় এটি -৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসও হয়। ভাইকিংরা বসতি স্থাপনের আগে থেকেই গ্রিনল্যান্ডে বসবাস করতো সেখানকার স্থানীয় জাতিগোষ্ঠী ইনুয়িত। স্থানীয় ইনুয়িতদের কাছে গ্রিনল্যান্ড পরিচিত ‘কালালিত নুনাত’, অর্থ ‘দ্য ল্যান্ড অব দ্য পিপল’।
জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের কারণে ক্রমেই গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলতে শুরু করেছে, অন্যদিকে আইসল্যান্ডের দিকে উপসাগরীয় উষ্ণ প্রবাহও ধীর গতির হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হাজার বছর পূর্বে ভাইকিংদের দেওয়া নাম হয়তো সার্থকতা পাবে অদূর ভবিষ্যতে। কারণ তাহলে আইসল্যান্ডের তাপমাত্রা কমে হিমাংকের নিচে নামবে ও কঠিন বরফ জমতে শুরু করবে সমুদ্র উপকূলে। অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ড উষ্ণ হতে শুরু করবে, বরফ গলে যাবে এবং হয়তো আরও বেশি সবুজের সমারোহ দেখা যাবে। কিন্তু এমন আমূল পরিবর্তন বয়ে আনবে বিশাল বিপর্যয়, যা হবে কল্পনাতীত।
ফিচার ইমেজ- CNN & NASA