আলিফ লায়লার নাম শোনেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো না কোনো বার আলিফ লায়লার কোনো পর্বের উপর দৃষ্টি আটকেছে কিংবা সেই জনপ্রিয় টিভি সিরিজের সুর মনের চিলেকোঠায় খেলে যাচ্ছে- এমনটা হয়েছে প্রায় প্রত্যেকের সাথেই। কিন্তু এক হাজার এক রাত্রির সেই আসল বইটি কতজন পড়েছেন? দেখা যাবে হাতে গোণা কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী ছাড়া কারোরই সে ভাগ্য কিংবা ধৈর্য হয়নি। আর, যারা সিরিজ শুরু করেছিলেন, তাদেরও বেশিরভাগ শেষ পর্ব পর্যন্ত আর পৌঁছাতে পারেননি। তাদের অনেকেরই জানবার আগ্রহ, আলিফ লায়লার শেষ রাত্রে কী হয়েছিল? গল্পকথক স্ত্রী শাহরাজাদ কি রক্ষা পেয়েছিল সুলতান শাহরিয়ারের হাত থেকে?
ইসলামি স্বর্ণযুগে একত্র করা ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ (أَلْف لَيْلَة وَلَيْلَة) গ্রন্থটি ইংরেজিতে পরিচিত ‘The Arabian Nights’ নামে। ১৭০৬ সালে বেরিয়েছিল প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, আলী বাবা ও চল্লিশ চোর, সিনবাদের সাত সমুদ্রাভিযান ছাড়াও আরও আকর্ষণীও সব গল্পের ভাণ্ডার এ আলিফ লায়লা। গর্দান বাঁচাবার জন্য একের পর এক রাত্রি স্ত্রী শাহরাজাদ (شهرزاد) সুলতান শাহরিয়ারকে (شهریار) গল্প বলে যেতে থাকেন। সে গল্পগুলো চলে এক হাজার এক রাত। মাঝে অবশ্য সন্তান জন্মদানের জন্য কয়েক রাতের বিরতি ছিল, অর্থাৎ গল্প বলা বা শোনাই এ হাজার রাতের একমাত্র কাজ ছিল না রাজা আর উজিরকন্যা শাহরাজাদের।
কীভাবে শুরু হয়েছিল আলিফ লায়লার কাহিনী আর কেনই বা প্রতি রাত্রে একজন করে মেয়েকে বিয়ে করে গর্দান নিতেন সুলতান সে কাহিনী জানতে আমাদের এ লেখাটি পড়ে আসুন। সে যা-ই হোক, হাজার রাত্রির গল্প শেষে কী হয়েছিল জানতে আমরা সরাসরি চলে যাব ১০০১তম রাত্রির গল্পের শেষে।
শাহজাদা জুঁই আর শাহজাদী বাদামের প্রেম কাহিনী শেষ করবার পর শাহরাজাদ থামলো।
তখন সুলতান শাহরিয়ার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “গল্পটা কিন্তু বড়ই চমৎকার!” এরপর বললেন, “শাহরাজাদ, তুমি আমাকে কেবল গল্পই শোনাওনি এতদিন ধরে, তোমার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি আমি। তুমি আমাকে অনেক অজানা জিনিস জানিয়েছ। আমার কুসংস্কারাচ্ছান্ন মনে জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়েছো তুমি।
এক এক করে এক হাজার রাত পার হয়ে গেছে তোমার পবিত্র সাহচর্যে। আমার কলুষিত মনটাকে তুমি পবিত্র করে তুলেছ। দু’চার কথায় তোমার মহিমা প্রকাশ করি কী করে? আজ আমি সব কলুষমুক্ত হয়ে আনন্দের ঝর্ণাধারা হলাম। এজন্য কৃতিত্ব তোমারই।”
দুনিয়াজাদ (دنیازاد) তখন উঠে এসে বড় বোনকে জড়িয়ে বলে, “সত্যি আপু, তুমি অসাধ্য এক কাজ করেছ। তোমার বিদ্যা বুদ্ধির তুলনা নেই। কী সুন্দর সব গল্প তুমি আমাদের শোনালে। সেগুলো তোমার মুখ থেকে মধুর মতো ঝরেছে। আমরা অমৃত পান করেছি তোমার গল্প শুনে।”
ছোট বোনের কানে কানে শাহরাজাদ কী যেন ফিস ফিস করে বলল। দুনিয়াজাদ তখন উঠে গিয়ে পাশের ঘরে গেল। সেখান থেকে দুই জমজ শিশু পুত্রকে নিয়ে প্রবেশ করল। আর তার পেছনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঢুকল আরেকটি ফুটফুটে ছেলে।
শাহরাজাদ তার তিন পুত্রকে আদর চুম্বন করে সুলতান শাহরিয়ারের দিকে এগিয়ে দিল।
অশ্রু চোখে নিয়ে শাহরাজাদ সুলতানকে সম্বোধন করে বলল, “জাঁহাপনা, এদের একটু আদর করুন। এরা আপনার ঔরসের সন্তান। এ বড় জনের বয়স দু বছর, আর এ জমজ দুজনের বয়স এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আল্লাহর দয়ায় তারা সুস্থ সবল। আপনার মনে আছে হয়ত জাঁহাপনা, ৬৭৯ তম রজনী থেকে ৭০০ তম রজনী পর্যন্ত আমি আপনাকে কোনো গল্প শোনাতে পারিনি। সে সময় আমি এ জমজদের জন্মদানের জন্য সুতিকাগারে ছিলাম। বড় ছেলের জন্মের চেয়ে এদের জন্মটাই আমার জন্য কষ্টের ছিল বেশি। বড় জনের সময় মাত্র কয়েক রজনী আমি গল্প শোনাতে পারিনি। আর এছাড়াও অসুখ বিসুখের কারণে কয়েক রাত আমি গল্প বলতে পারিনি। কিন্তু একটানা তিন বছর আমি আপনাকে গল্প শুনিয়ে গিয়েছি। জানি না, সেগুলোর কতোটা আপনার মনে দাগ কাটতে পেরেছে। যদি কোনো কাহিনী ভালো না লেগে থাকে, তাহলে সে দোষ গল্পের নয়, আমার বলার অক্ষমতার। আর যদি কোন গল্প আপনার মনে দাগ কেটে যায়, তবে সে পুরস্কার আমার প্রাপ্য নয়। সেসব গল্প যারা রচনা করে গেছেন, সে পুরস্কার তাদের জন্যই।”
এ পর্যন্ত বলে শাহরাজাদ থামলো। বোন দুনিয়াজাদ তখন শিশু তিনটিকে চুমু খাচ্ছিলেন। এরপর সে বলল, “তবে জাঁহাপনা, এবার কি আমার আপুর গর্দান নেবেন আপনি? এই যে ফুলের মতো তিনটি শিশু আপনার, এদের মা-কে হত্যা করবেন আপনি আজ? এ অবোধ শিশু শাহজাদাদের মাতৃহারা করবেন না?”
তখন সুলতান শাহরিয়ার বলে উঠলেন, “ঢের হয়েছে দুনিয়াজাদ, এবার ক্ষান্তি দেবে? আমি তো আমার ভুল স্বীকার করেছি, তবুও কেন এত যাতনা দিচ্ছ?”
তারপর শাহরাজাদের দিকে ফিরে বললেন, “এরা তোমার কোলে আসার অনেক আগে থেকেই তুমি আমার হৃদয়ে পাকাপাকিভাবে আসন পেতে নিতে পেরেছ শাহরাজাদ। ভেবো না, এ শিশুপুত্রদের মুখ চেয়ে আমার মন কোমল হয়েছে। ওরা আমার কাছে পরম আদরের তো বটেই, কিন্তু তুমি তাদের চেয়েও বেশি। তোমার পেয়ে আমি আজ পরিপূর্ণ মানুষ হতে পেরেছি, শাহরাজাদ। আমি যতদিন বাঁচব, তুমি আমার জীবনে ধ্রুবতারার মতো জ্বলবে চিরদিন। আমি তোমাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি, তার কারণ তোমার মতো নম্র বিনয়ী বিদুষী বিচক্ষণ নারী আমি আগে কখনও পাইনি আমার জীবনে। আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করবেন প্রিয়তমা। তোমার পরিবারের সকলকে তিনি সুখে রাখুন। শাহরাজাদ, এক সহস্র এক বিনিদ্র রজনী আমরা পার করেছি। কিন্তু সে রাতগুলো প্রকাশ্য দিবালোকের চেয়েও আরও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আমাদের জীবনে।”
সুলতান শাহরিয়ার আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে শাহরাজাদের মাথা টেনে নিলেন বুকে। শাহরাজাদ সুলতানের একখানা হাত অধরে ঠেকিয়ে মিনতি জানিয়ে বলল, “জাঁহাপনা, আজকের এ আনন্দের মুহূর্তে আপনার দুঃখকাতর বুড়ো উজিরকে এ খবর শোনালে তিনিই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠবেন।”
সুলতানের ইশারায় প্রহরী তখনই উজির জাফরকে (جعفر) নিয়ে এলো। তখনও তাঁর হাতে একটি কফিন। সারা দিন রাত সে কফিন বয়ে বেড়াতো।
সুলতান উজিরকে আলিঙ্গন করে বললেন, “আপনার কন্যাকে আমি আমার হারেমে শুধু নয়, নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছি। আপনি আর কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে সুখে থাকবে আমার কাছে।”
বৃদ্ধ উজির আনন্দে অধীর হয়ে চেতনা হারিয়ে ফেললেন। দুনিয়াজাদ তখন গোলাপজল এনে বাবার চোখে মুখে ঝাপটা দিল। একটু পরে জ্ঞান ফিরল উজিরের। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “আজ তিন বছর আমি চোখের দু’পাতা এক করতে পারিনি, মা। প্রতিটি রাত্রি আমার সামনে দারুণ এক বিভীষিকার রূপ ধরে এসে দাঁড়িয়েছে।”
সুলতান শাহরিয়ার ছোট ভাই শাহজামানকে (شاهزمان) সংবাদ দিলেন। তিনি ছিলেন সমরখন্দের অল আজমের সুলতান। কয়েকদিনের মাঝেই তিনি এসে হাজির হলেন বড় ভাইয়ের কাছে।
সারা শহর আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠল। আতর ধূপের গন্ধে মেতে উঠল আকাশ বাতাস। খানাপিনার মহোৎসবে সুলতান শাহরিয়ার শাহজামানকে শাহরাজাদের অসাধারণ গুণকীর্তন করতে লাগলেন। প্রায় তিন বছর গল্প শুনিয়ে কীভাবে সুলতানকে মানুষ করেছে শাহরাজাদ, সেই গল্পই চলতে লাগলো। সুলতান বললেন, “এখন সে আমার নিত্যসঙ্গী, আমার বেগম, আমার সন্তানের জননী।”
সুলতান শাহরিয়ারের অনুরোধে শাহজামান দুনিয়াজাদকে বিবাহ করলেন। শাহরাজাদ তখন বললেন, “জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত দুনিয়াজাদ আমার কাছ থেকে আলাদা হয়নি কোনদিন। আজ সে অন্য দেশে চলে যাবে এটা আমি সহ্য করতে পারছি না, জাঁহাপনা।”
তখন শাহজামান বললেন, “আমি বড় ভাই এর কাছেই বাকি জীবনটা কাটাতে ইচ্ছা পোষণ করি, কিন্তু কী করব, সমরখন্দের মসনদ রক্ষা করতে হবে না? যা হোক, কথা দিচ্ছি, বেশিরভাগ সময় দুনিয়াজাদ এখানেই থাকবে। আমি থাকবো এখানে এসে।”
সুলতান শাহরিয়ার লিপিকারদের ডেকে শাহরাজাদের কাহিনীগুলো সোনার জলে লিপিবদ্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। এরপর ৩০ খণ্ডে লেখা হয় সে গ্রন্থ, নাম দেয়া হয়েছিল ‘আলিফ লায়লা’; বাংলায় যাকে বলে আরব্য রজনীর গল্প।
আজও সে বই পৃথিবীর এক মহান সাহিত্য সম্পদ।
ফিচার ইমেজ: Daily News