আমাদের জীবন প্রবাহ দুটি অসাধারণ চক্র দ্বারা প্রভাবিত। একটি ঘটে খুব দ্রুত গতিতে, আরেকটি ঘটে তুলনামূলক ধীর গতিতে। দ্রুত গতিরটি হচ্ছে আলো ও আঁধারের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন। এটি প্রতি ২৪ ঘণ্টা পর পর একবার করে ঘটে। ধীর গতিরটি হচ্ছে বাৎসরিক ঋতুর পরিবর্তন অর্থাৎ শীত ও গ্রীষ্ম। এক বছর পর পর ঋতুর চক্র সম্পন্ন হয়। আলো-আঁধার ও শীত-গ্রীষ্মের নিয়মিত আবর্তন সম্পন্ন হয় বলে স্বভাবতই এদের ঘিরে আগ্রহের জন্ম নেয় প্রাচীন মানুষদের মনে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে সেসব মানুষেরা সৃষ্টি করে নানা রকম পৌরাণিক গল্প। মূলত সকল পৌরাণিক গল্পই এভাবে গড়ে উঠে। সূর্যের নিয়মিত উদয় হওয়া ও অস্ত যাওয়ার নাটকীয় উপস্থিতির ফলে দিন ও রাতের আবর্তন নিয়ে পৌরাণিক গল্পের হাড়ি একটু বেশি সমৃদ্ধ। কেউ কেউ মনে করে সূর্য হচ্ছে সোনালি এক ঘোড়ার গাড়ি বা রথ যা কোনো এক দেবতা প্রতিদিন পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চালিয়ে নিয়ে যায়। এরকম কয়েকটি গল্প নিয়ে আজকের আয়োজন।
অস্ট্রেলীয় উপকথা
অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীরা তাদের দ্বীপ মহাদেশে ৪০ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের কাছে পাওয়া যায় পৃথিবীর প্রাচীনতম কিছু পৌরাণিক কাহিনী। কাহিনীগুলোর অধিকাংশই একটি বিশেষ সময়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই সময়কে বলা হয় নিদ্রাকাল। এ সময়েই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। নিদ্রাকালের সময়ে দিন ও রাতের সৃষ্টি নিয়ে প্রাচীনতম এই কাহিনীটি এসেছে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স পর্বতমালায় বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী থেকে।
তাদের বিশ্বাস অনুসারে নিদ্রাকালের সময়ে দুই সম্প্রদায়ের দুটি টিকটিকি ছিল পরস্পর বন্ধু। সম্প্রদায় দুটি হচ্ছে গোয়ানা (goanna) ও গেকো (gecko)। Monitor lizard’কে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে গোয়ানা বলা হয়। আর গেকো হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির টিকটিকি, এদের পায়ে একধরনের বিশেষ ব্যবস্থা থাকে যার দ্বারা এরা খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে পারে। একদিন দুই বন্ধু দেখলো তাদের অন্যান্য বন্ধুদেরকে ‘নারী-সূর্য’ তার কুকুরের দলকে দিয়ে গণহারে মেরে ফেলছে। এই দৃশ্য দেখে বড় গোয়ানা টিকটিকি খুব রাগান্বিত হয়ে সূর্যকে লক্ষ্য করে তার হাতের বুমেরাং ছুড়ে মারে। বুমেরাং দিয়ে আকাশের সূর্যকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে নিচে নামিয়ে এনে ফেলে। আকাশ থেকে সূর্য হয়ে গেল অদৃশ্য। ঐ সময় সূর্য পশ্চিম দিকে ছিল, তাই সূর্য ছিটকে যাওয়াতে পশ্চিম দিক থেকে অন্ধকার এসে সমস্ত পৃথিবী ছেয়ে ফেলে।
বুমেরাং হচ্ছে বাঁকানো লাঠির মতো একধরনের সরল অস্ত্র। কোনো বস্তুকে লক্ষ্য করে যদি বুমেরাং ছোড়া হয় আর এটি যদি লক্ষবস্তুতে না লাগে তাহলে এটি আগের জায়গায় ফিরে আসে। সামনে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে আসার পেছনে কাজ করছে পদার্থবিজ্ঞানের চমকপ্রদ কিছু নিয়ম। অস্ট্রেলিয়ার মানুষেরা এমন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
তো অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে অন্যদের পাশাপাশি টিকটিকিদ্বয়ও খুব অসুবিধায় পড়ে। তাই আলো ফিরিয়ে আনবার জন্য তারা সূর্যকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হয়। বুমেরাংয়ের সাহায্যে বার বার চেষ্টা করেও তারা সূর্যকে আকাশে ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। যেদিক থেকে সরিয়েছে সেদিকে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অন্য সব দিকে ছুড়ে দেখল, কোনো কাজ হলো না। ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে শেষে তারা দেখলো তাদের কাছে আর মাত্র একটি বুমেরাং অবশিষ্ট আছে। গোয়ানা মরিয়া হয়ে সর্বশেষ বুমেরাংটি নিয়ে যেদিক থেকে সূর্য অদৃশ্য হয়েছিল তার ঠিক বিপরীত দিক, পূর্বদিকে ছুড়ে মারে। এবারে বুমেরাংটি সূর্যকে আকাশে বসিয়ে দিতে সমর্থ হয়। এই ঘটনার পর থেকে প্রতিদিন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে অদৃশ্য হয় এবং পূর্বদিক থেকে দৃশ্যমান হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত একই চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলছে। সেজন্যই সূর্য সবসময় পূর্ব দিক থেকে উঠে।
অস্ট্রেলিয়ার আরেকটি উপকথা
দিন-রাত নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দাদের আরেকটি প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী আছে। অনেক কাল আগে কেউ একজন আকাশে উটপাখির ডিম ছুড়ে মেরেছিল। আকাশে গিয়ে ডিম থেকে ডিমের কুসুমটি ফেটে বের হয়ে যায়। কোনো কারণে ঐ স্থানে কিছু জ্বলন্ত কাঠ ছিল, ফলে কুসুমটি জ্বলে উঠে। আকাশের দেবতা খেয়াল করে দেখলেন এই আগুন মর্তের মানুষের অনেক উপকারে আসছে। তাই তিনি তার ভৃত্যকে আদেশ দিলেন, প্রতিদিন ভোরে যেন সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঠ রেখে আসে, এই কাঠের যোগান দিয়ে যেন পূর্ণ একদিন জ্বলতে পারে এটি। যখন কাঠ জ্বলে শেষ হয়ে যায় তখন রাত নামে, আবার যখন নতুন জ্বালানী দিয়ে যায় তখন সকাল হয়, সূর্য উঠে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে এভাবেই চলছে আজকের দিন পর্যন্ত।
কানাডীয় উপকথা
দীর্ঘতম চক্র শীত ও গ্রীষ্ম নিয়েও পৃথিবীব্যাপী অনেক পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে। পশ্চিম কানাডা অঞ্চলের একটি কাহিনী- শীতকাল কত মাস ব্যাপী থাকবে এই নিয়ে পারসুপাইন ও বিভার নামের দুজন দেবতা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে গেলেন। পারসুপাইন চাইলেন শীতকাল পাঁচ মাস ব্যাপী থাকুক, তাই তিনি তার হাতের পাঁচটি আঙুল তুলে ধরলেন। কিন্তু বিভার চাইলেন শীত এর চেয়েও বেশি সময় ধরে থাকুক। বিভারের লেজের মাঝে যতগুলো পশম আছে তত মাস ব্যাপী থাকার কথা জানালেন তিনি। লেজের মাঝে পশম ছিল অনেকগুলো, পরিমাণে এত বেশি দেখে পারসুপাইন প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে গেলেন। রাগের চোটে উদ্ভ্রান্ত হয়ে নিজের আঙুলে কামড় বসিয়ে দিলেন। এই কামড়ে একটি আঙুল হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে তিনি চারটি আঙুলই তুলে ধরেন, এবং আরো এক মাস কমিয়ে বলেন শীত হবে চার মাসের। এমন রাগান্বিত অবস্থা দেখে বিভার কোনো ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেননি, চার মাসই মেনে নিলেন। ফলে এ থেকেই চুড়ান্ত হয়ে গেল, প্রতি বছর শীত থাকবে চারমাস করে। বাকি আটমাস গ্রীষ্ম।
এখানে উল্লেখ্য পৃথিবীর সব দেশে বাংলাদেশের মতো ছয় ঋতু নেই। বেশিরভাগ দেশই দুই ঋতুর। কোনো কোনো দেশ আছে এক ঋতুর। যেমন মালদ্বীপ। তবে বাংলাদেশে ঋতু ছয়টি হলেও, মোটা দাগে বাংলাদেশও দুই ঋতুরই দেশ। তবে এক হিসেবে এই পৌরাণিক কাহিনীটি খুব একটা চিত্তাকর্ষক নয়। কারণ আগে থেকেই নির্ধারিত যে শীত ও গ্রীষ্ম থাকবে। শুধু কোনটা কয় মাস ব্যাপী বিরাজ করবে তার সিদ্ধান্ত এসেছে এই কাহিনী থেকে। যদি নাটকীয় কোনো ঘটনার ফলে শীত ও গ্রীষ্মের ‘জন্ম’ হতো তাহলে গল্পটি অধিক চিত্তাকর্ষক হতো। এদিক থেকে গ্রিক পুরাণের পার্সিফনির কাহিনী কিছুটা উন্নত।
গ্রিক উপকথা
পার্সিফনি ছিলেন দেবরাজ জিউসের কন্যা। উর্বরতার দেবী দিমিতার ছিলেন তার মাতা। দিমিতার তার কন্যা পার্সিফনিকে খুব ভালোবাসতেন। পার্সিফনি তার মাতার এলাকার ভূমিতে জন্ম নেয়া গাছগাছালির দেখাশোনা করে মাতাকে সাহায্য করতেন। কিন্তু ভূমির তলদেশের দেবতা হেইডিসও ভালোবাসতো তাকে। একদিন ফুলে ছাওয়া তৃণভূমিতে তিনি খেলা করছিলেন, এমন সময় মাটিতে বড় ফাটল দেখা দেয়। ফাটল দিয়ে তলদেশ থেকে উঠে আসে হেইডিস। জবরদস্তি করে তুলে নিয়ে যায় তাকে। নিয়ে অন্ধকার তলদেশের রানী বানায়।
এই দুঃখময় বিচ্ছেদে দিমিতার অসংলগ্ন হয়ে পড়েন। ভূমিতে শস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেন। শস্যের অভাবে মর্তের মানুষেরা অনাহারে দিন কাটাতে শুরু করে। এ অবস্থা দেখে দেবরাজ জিউস তার বার্তাবাহক হার্মিসকে ভূমির তলদেশে পাঠালেন পার্সিফনিকে ফিরিয়ে আনতে। তাকে ফিরিয়ে আনলেই তবে মর্তে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু পার্সিফনি একটি ভুল করে বসেন। তিনি ডালিমের ছয়টি দানা খেয়ে ফেলেন, ফলে সিদ্ধান্ত হয় পার্সিফনি সারা বছরের জন্য মর্তে যেতে পারবে না, ছয় মাস থাকতে হবে অন্ধকার তলদেশে আর ছয় মাস থাকতে পারবে মর্তে। ছয়টি দানা খাওয়ার জন্য ছয় মাসের শাস্তি। সেই থেকে পার্সিফনি বছরের কিছু সময় মর্তে থাকে। সময়টা বসন্তের আগমনের সাথে সাথে শুরু হয় এবং গ্রীষ্ম পর্যন্ত বিরাজমান থাকে। পার্সিফনি সাথে করে গ্রীষ্ম নিয়ে আসেন। এ সময়ে শীতপ্রধান দেশগুলোতে বরফ গলে যায়, ফলে শাঁক সবজি সহ অন্যান্য ফলমূল ফলে। তিনি চলে গেলে গ্রীষ্মের অনুপস্থিতিতে মর্তে শীত নেমে আসে।