আধুনিক এ সমাজে কুসংস্কারের খুব একটা স্থান নেই, অন্তত চলতি সময়ে তো অবশ্যই নয়! তবে ইতিহাসের বিশাল এক অধ্যায়জুড়ে গোটা বিশ্বে বিভিন্ন সমাজ এবং সংস্কৃতির পুনর্বিন্যাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসেছে কুসংস্কার। সেই কুসংস্কারে বৃদ্ধা স্ত্রীর গল্প আছে, আছে শহুরে উপকথা, সেই সাথে আছে ভুতুড়ে সব কেচ্ছা-কাহিনীও। তার মধ্যে থেকেই তেরোটি কুসংস্কারের কথা শোনাবো আজকের এই প্রবন্ধে।
আয়নাবন্দী
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত দরকারি একটি বস্তু হচ্ছে আয়না। এই আয়নাকে ঘিরেও বেশ কিছু লোমহর্ষক কুসংস্কার জড়িয়ে আছে। প্রাচীনকালে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতেন, আয়নার ভেতরে লুকিয়ে আছে অলৌকিক কোনো এক শক্তি। সেই শক্তির বলে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তির আত্মা মুহূর্তের মধ্যে আয়নাবন্দি হয়ে যায়। এই কুসংস্কার স্রেফ লোকমুখেই আবদ্ধ থাকেনি, জার্মানিতে এ নিয়ে রয়েছে এক বিখ্যাত উপকথা ‘স্নো হোয়াইট’। সেই গল্পের দুষ্টু রানীও আয়না ব্যবহার করতেন। সেই আয়নার মাঝে বন্দি ছিল এক আত্মা, যে রানীর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতো এবং রানী সেই আয়নাকেই ব্যবহার করতেন স্নো হোয়াইটের ক্ষতি করার জন্য।
আয়নার কি তাহলে আসলেই কোনো অশুভ শক্তি আছে? আর সে কারণেই কি নার্সিসাস বন্দী হয়েছিলেন নিজেরই প্রতিবিম্বের ফাঁদে? তাছাড়া রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের ছায়া নাকি আয়নায় ধরা পড়ে না। এর পেছনে আয়নার আত্মাপ্রীতির যোগসূত্র নেই তো? সবকিছু তো সেদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে! এ কারণেই তাই কুসংস্কারাচ্ছনরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূপচর্চার আগে সতর্ক থাকতেন; বলা তো যায় না, কোন সময় কী বিপদ ঘটে!
চার পাতার ক্লোভার
কুসংস্কারের গোড়াপত্তনে চার পাতার ক্লোভারের গল্প আজ ইতিহাসের অতল গহ্বরে বিলীন হওয়ার পথে। শুরুর দিকে একে স্রেফ সৌভাগ্যের প্রতীক ধরা হতো। কিন্তু দিন দিন লোকমুখে নানান রসালো রীতিনীতির জন্মের মাধ্যমে এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। একটা সময় একাকী মানুষের নিঃসঙ্গতার পাথেয় হিসেবে আবির্ভূত হয় এই ক্লোভার পাতা। বিভিন্ন সমাজে স্বামী বা স্ত্রী পছন্দ করতেও ক্লোভার পাতার ইঙ্গিতের দিকে মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
কিন্তু তারা সামান্য পাতা দিয়ে এতকিছু কীভাবে করতেন? প্রথমেই চার পাতার ক্লোভার পাতার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তেন তারা। এই কষ্টকর কাজে যদি ভাগ্য কারো সহায় হয়, সেক্ষেত্রে তার জন্য পরবর্তী কাজ হবে তৃণভোজী প্রাণীর মতো পুরো পাতা গিলে খাওয়া। এরপর অদৃশ্য শক্তিবলে তার ভাগ্য খুলে যাবে। সেদিন প্রথমেই যে রূপসী বা রূপবানের মুখ দর্শন করবে, সে-ই তার বাকি জীবনের পথচলার সঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হবে। একারণে বুদ্ধি খাটিয়ে পছন্দমতো জায়গায় ক্লোভার পাতা ভক্ষণের আয়োজন করত সে যুগের মানুষ।
ক্যামেরার ইন্দ্রজাল
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়, তখন এর সাথে সাথে জন্ম হয়েছিল নতুন এক কুসংস্কারের। সেই সময় অনেকেই মনে করতেন, কারো ছবি তোলার মানে হচ্ছে তার আত্মা কবজ রাখা এবং কোনো শত্রু যদি কোনোভাবে আপনার ছবি পেতে সক্ষম হয়, তাহলে সে শুধু আপনার আত্মা নয়, বরং আপনার পারিপার্শ্বিক সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে।
নতুন বাড়ি, নতুন ঝাড়ু
ঝাড়ু নিয়ে কুসংস্কারের অভাব নেই। এমনকি নতুন ঝাড়ু এবং নতুন বাড়ি নিয়েও আছে এক অদ্ভুত কুসংস্কার। কেউ যদি নতুন বাসায় উঠে নতুন ঝাড়ু নিয়ে দিব্যি সেটা দিয়ে ময়লা বাইরে ফেলা শুরু করেন, বাড়ির ময়লার সাথে সাথে ব্যক্তির সৌভাগ্যও নাকি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে!
এর মানে কি তাহলে নতুন বাড়িতে কখনোই ঝাড়ু দিতেন না এই কুসংস্কারাচ্ছন্নরা? অবশ্যই দিতেন। তবে ময়লা বাইরে ফেলার আগে, বাইরে থেকে কিছু ময়লা একটু যত্ন সহকারে ঝাড়ু দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করাতেন। এরপর মনের আনন্দে পুরোটা ময়লা ঝাড়ু দিয়ে বের করে দিতেন। তাদের বিশ্বাস, তাতে অন্তত ভাগ্যটা খারাপ কিছুর হাত থেকে বেঁচে যাবে!
চুইংগাম নাকি মরা মানুষের মাংস?
চুইংগাম নিয়ে তুরস্কে আছে এক অদ্ভুত কুসংস্কার। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, রাতে চুইংগাম চিবানোর মানে হচ্ছে মরা মানুষের মাংস চিবানো। তাই তুরস্ক ভ্রমণে যাওয়ার আগে সাবধান। জনসম্মুখে রাত-বিরাতে চুইংগাম মুখে দেবেন না! তারা আবার বিরূপ ধারণা করে বসতে পারে আপনাকে নিয়ে।
ছায়াশ্বাপদ
বিড়াল নিয়ে কুসংস্কার আছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই। বিশেষ করে কালো বিড়াল মানেই যেন অনেকের কাছে দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। এই কুসংস্কারটির উৎপত্তি হয়েছে মধ্যযুগীয় এক ভুল ধারণা থেকে। সেই সময়কার মানুষ মনে করতেন, যেসব অবিবাহিত নারী বিড়াল নিয়ে মেতে থাকতেন, তারা আসলে এক জাতের ডাইনী এবং তারা চাইলে নিজেদেরকে বিড়ালে রূপান্তর করতে পারেন!
তাছাড়া এখনও অনেকে বিশ্বাস করে, ডাইনীরা যেসব প্রাণীদের সাথে কথা বলতে পারে, বিড়াল তাদের মধ্যে প্রধান। কালো বিড়ালকে সবচেয়ে খারাপ বলে মনে করার আরেকটি কারণ হলো, লোকে ভাবতো এর রয়েছে স্বয়ং শয়তানের আত্মা ধারণ করে রাখার ক্ষমতা!
ওপাল পাথরের অভিশাপ
আপনার প্রিয় পাথর যদি ওপাল হয়ে থাকে, তাহলে জেনে নিন, অনেকের ধারণা অনুসারে, আপনার ভাগ্যের দিন ফুরিয়েছে। কিছু লোকের বিশ্বাস, যিনি এই পাথরটি পরেন, তিনিই নাকি তার দুর্ভাগ্য ডেকে আনেন।
এই কুসংস্কারটির চালু হয় ১৮২৯ সালে। স্কটিশ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের উপন্যাস ‘অ্যান অফ গিয়ারস্টেইন’-এর এক পর্যায়ে লেডি হারমায়নিকে মিথ্যাভাবে পিশাচ বলে অভিহিত করা হয়। ঘটনাক্রমে তার পরনে থাকা ওপালের গয়নায় পবিত্র পানির ফোটা পড়ার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান এবং পাথরটির রং বদলে যায়। বইয়ের এই ঘটনাটি মানুষের মাঝে এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, বই প্রকাশ হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওপাল পাথরের বাজার বিপর্যস্ত হয় এবং এর মূল্য অর্ধেক হ্রাস পায়!
গেছো আত্মা
আপনার কোনো চাওয়া বা ইচ্ছা পূরণ করতে চান? কাঠের উপরে দু’বার ঠকঠক আঘাত করুন। ব্যাপারটি অবশ্যই অদ্ভুত, কিন্তু এই কুসংস্কারটির এখনও ব্যাপক প্রচলন রয়েছে বিশ্বের নানা জায়গায়।
এই কুসংস্কারটির এসেছে পৌত্তলিক বিশ্বাস থেকে। রোমান মূর্তি পূজারীরা বিশ্বাস করতো, যে মানুষেরা সারাজীবন পুণ্য করে কাটিয়েছে, মারা যাওয়ার পর তাদের আত্মা কাঠের মধ্যে বসবাস করে এবং চাইলে যে কারো ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারে। তাদের মতানুসারে, আপনি যদি কোনো অভিলাস পূরণ করতে চান, তাহলে গাছের সামনে দাঁড়িয়ে সেটা ফিসফিস করে বলুন। তারপর দু’বার টোকা দিন, যাতে গাছের আত্মা জাগ্রত হয়ে আপনার আশা পূরণ করতে পারে।
যে পরিমাণ মল পাখির, ঠিক সেই পরিমাণ ধনসম্পদ
রাশিয়াতে প্রচলিত আছে এক বিচিত্র কুসংস্কার। তারা মনে করে, উড্ডয়নকালে যদি কোনো পাখি আপনার গাড়ি অথবা বাড়ি-ঘর কিংবা আপনার গায়ের উপর তার মলত্যাগ করে, তাহলে সেটা শুভ লক্ষণ এবং শীঘ্রই আপনার ধন-সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এই শুভ কর্মে জড়িত পাখির মলের পরিমাণ যত বেশি হবে, সম্পত্তির পরিমাণও তত বেশি হবে। একারণেই তারা হয়তো পাখির বিষ্ঠা এসে গায়ে পড়লে, তাকে গালাগাল না দিয়ে বিষয়টাকে শুভ লক্ষণ হিসেবেই ধরে নিতেন!
পুরানো, নতুন, ধার করা, নীল
বিয়েতে কনেকে নানা রকমের উপহার দেওয়ার প্রচলন রয়েছে একদম শুরুর জমানা থেকেই। তবে রানী ভিক্টোরিয়ার আমল থেকে চালু হয়েছে এক নতুন রীতি। সব ধরনের উপহারের মধ্যে অবশ্যই একটি উপহার হতে হবে পুরনো, যা নির্দেশ করে নিরবচ্ছিন্নতার; আরেকটি উপহার থাকবে একদম নতুন, যা নির্দেশ করে প্রত্যাশাপূর্ণ ভবিষ্যৎ; তৃতীয় উপহারটি হবে ধার করা, যা সুখ-শান্তি ধার করে নিয়ে আসবে এবং সর্বশেষ উপহারটি হবে নীল রঙের, যা দাম্পত্য জীবনে বয়ে আনবে পবিত্রতা, ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততা। মানুষের জীবনে এসবের কোনো কিছুরই কোনো প্রভাব থাকা সম্ভব নয়, তবুও এই কুসংস্কার মেনে চলেন অনেকেই।
হাত চুলকালে টাকা আসে
হাতের তালু চুলকানো নিয়ে আছে বিচিত্র কিছু কুসংস্কার। কেউ বিশ্বাস করেন, যাদের হাতের তালু চুলকায়, তারা সাধারণত লোভী হয় কিংবা অর্থের জন্য রয়েছে তাদের অতৃপ্ত বাসনা। অনেকেই মনে করেন, ডান হাতের তালু চুলকানোর মাঝে লুকিয়ে থাকে অর্থহানির আশঙ্কা আর বাম হাত চুলকালে অর্থপ্রাপ্তি!
জিনক্সটারকিলা
আবারও আসি পাখিতে। রাইনেক কিংবা জিনক্সটারকিলা পাখির নাম শুনেছেন কি? এ পাখিটি মুক্তভাবে তার মাথা চারদিকে ঘোরাতে পারে। প্রাচীন গ্রীসের মানুষেরা বিশ্বাস করত, যদি এই পাখি কারো দিকে তাকিয়ে তার মাথা ঘুরায়, তাহলে তার মৃত্যু অতি সন্নিকটে!
নিষিদ্ধ তেরো
তেরো সংখ্যা নিয়ে মানুষের এত ভয় কেন? কখনও ভেবে দেখেছেন এর সূত্র কোথায়? আমাদের উপমহাদেশ তো বটেই, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই বেড়ে উঠেছেন তেরো সংখ্যার প্রতি অজানা ভয় নিয়ে। তবে এর একটি প্রাচীন উৎস রয়েছে। এই ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয় ‘দ্য কোড অফ হামুরাবি’ গ্রন্থকে। বিশ্বের প্রথম আইন বই হিসেবে পরিচিত প্রাচীন এই পুস্তকের তেরো নম্বর আইনটি বাদ দেওয়া হয়েছিল কেরানীর ত্রুটির কারণে এবং সেই সময় থেকেই তেরো সংখ্যাকে অপয়া বলার রীতি চলে আসছে।
এখন তেরো সংখ্যাটি নিয়ে কুসংস্কার রয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। তেরো নিয়ে মানুষের ভয় এতোটাই প্রবল যে, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ফোবিয়া, নাম ট্রিসকাইডেকেফোবিয়া। এই ফোবিয়ার কারণেই অনেক আর্কিটেক্ট কখনো তেরো ধাপের সিঁড়ি কিংবা তেরো তালা দালান বানাতে চান না।
এরকম আরও নানা রকম কুসংস্কার চালু আছে আমাদের সমাজেও। যেমন, মইয়ের নিচে দিয়ে কখনও যেতে হয় না অথবা ঘরের ভেতরে ছাতা মেলা অমঙ্গলজনক। প্রচলিত এই কুসংস্কারগুলো অবশ্যই প্রকৃত সত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। এগুলো দৃঢ়তা পেয়েছে মানুষের মনের ভয়ের উপর ভর করেই। আজকের যুগে যখন বিজ্ঞান মানুষকে দেখাচ্ছে দূর মহাকাশের দৃশ্য, যখন অজানা পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য ভেদের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞান চর্চা; তখন এসব কুসংস্কারের ঠাঁই হওয়া উচিত কেবলই ইতিহাসের পাতায়, মানুষের অজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে।