প্রায় ৩৭০০ বছর আগের এক ব্যবিলনীয় গণিত ফলক সংরক্ষিত রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। এটি থেকে গবেষকরা জানতে পারেন, সেই তখনই ব্যবিলনবাসীরা আধুনিক ত্রিকোণমিতি সম্বন্ধে জানতো। তারা বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথও হিসেব করছিল সে যুগেই। এ তো গেল প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। প্রত্নতত্ত্ব থেকে বহু দূরে যদি ঘুরে আসা যায়, তাহলে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অধ্যায়। এক জাদুকরী যুগ। যার দেখা প্রত্নতত্ত্বে মেলে না। মেলে বরং ইসলাম, ইহুদি আর পারসিক ধর্মগ্রন্থের পাতায়।
কথা হচ্ছিল জাদুবিদ্যা নিয়ে। আর জাদু বলতে মোটেও ক্রিস অ্যাঞ্জেল কিংবা ডেভিড কপারফিল্ডের স্টেজ শো কিংবা হাতসাফাইয়ের কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে এমন জাদুর কথা যার অস্তিত্ব বিজ্ঞান অস্বীকার করে, কারণ প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরের এমন কিছু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে নেই এমন বাঁধন বা সীমাবদ্ধতা। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো বিশেষ করে সেমেটিক ধর্মগুলোতে যে জাদুর উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোর অতীত ঘাঁটতে গেলে শুরুর মুহূর্তটা গিয়ে ঠেকে প্রাচীন ব্যবিলনে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (ইরাক) ফোরাত নদীর তীরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া উন্নত এক শহর ব্যবিলন। আর সেই সাথে চলে আসে দুজন ফেরেশতার নাম- হারুত আর মারুত।
ব্যবিলন (Babylon) পরিচিত নানা নামে, নানা কারণেও- যার মাঝে সবচেয়ে সুপরিচিত ব্যবিলনের শুন্য উদ্যান আর বাইবেলের পাতায় পাওয়া টাওয়ার অফ বাবেল। ব্যবিলনের নানা উচ্চারণের মাঝে আছে ‘বাবেল’, যা একইসাথে আরবি (بَابِل), হিব্রু (בָּבֶל) ও আরামায়িক (בבל) উচ্চারণ। আক্কাডিয়ান ভাষায় ডাকা হত বাবিলি।
এ লেখায় আমরা ব্যবিলনের ইতিহাস নিয়ে কথা বলব না, বরং ব্যবিলনের সাথে জাদুবিদ্যার সম্পর্ক নিয়ে কথা হবে। আর এর শুরুটা পাওয়া যায় খোদ কুরআনের আয়াতেই। সুরা বাকারার ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ আছে-
তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফরি করেননি; শয়তানরাই কুফরি করেছিল। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই এ কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, ‘আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।’ অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তা দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। তারা তাই শিখে যা তাদের ক্ষতি করে এবং কোনো উপকার করে না। তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ জাদুবিদ্যা চর্চা করে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্নবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ- যদি তারা জানত!” (কুরআন, বাকারা, ২:১০২)
এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে, এখানে বাবেল অর্থাৎ ব্যবিলন শহরের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে হারুত (هَـارُوت) ও মারুত (مَـارُوت) নামের দুই ফেরেশতার কথা আছে, যাদের উপর কিছু একটা অবতীর্ণ হয়েছিল যা কিনা ‘তারা’ অর্থাৎ অসৎ বা খারাপ লোকেরা ‘শিক্ষা দিত’। একই বাক্যাংশে বলা হয়েছে তারা জাদুবিদ্যাই শিক্ষা দিত। তারা সেটা শিখেছিল হারুত-মারুতের কাছ থেকেই; কিন্তু এটাও বলা হয়েছে, এই দুজন ফেরেশতা এ শাস্ত্র শেখাতেন বটে, কিন্তু সাথে এটাও তারা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে বলে দিতেন, “আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।'” কিন্তু এই পরীক্ষামূলক বিদ্যা গ্রহণ করে তারা অসৎ কাজে ব্যবহার করতে শুরু করল, যার মাঝে আছে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, ইত্যাদি। শেষে সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে, যারা এই জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে, তাদের জন্য পরকালে কিছুই নেই, তারা নিজেকে বিক্রয় করেছে, এতে তার অপকার বৈ কিছু হবে না।
কিন্তু এ আয়াতের সাথে সুলাইমান (আঃ) বা কিং সলোমনের কী সম্পর্ক? সেটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ইহুদি জাতির ইতিহাসের সুলাইমান (আঃ) অধ্যায়ের বিশদ আলোচনায়, যেটা অবশ্য এ লেখার বিষয় নয়। ইবনে কাসিরের তাফসিরে উল্লেখিত ঘটনা সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিশেষ এক ঘটনার পর সুলাইমান (আ)-কে জাদুকর অপবাদ দেওয়া হয়, এবং তার সিংহাসনের নিচ থেকে অন্যের লুকোনো জাদুবিদ্যার বই উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, সেগুলো সেই প্রাচীন বাবেলের জাদুবিদ্যার বই। কুরআনে সেই অপবাদ কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, সুলাইমান (আঃ) এ কুফরি কালাম বা জাদুবিদ্যা বা ডার্ক আর্টস আদৌ ব্যবহার করেননি, বরং সেসব ‘আবৃত্তি’ বা মন্ত্রপাঠ করত শয়তানেরা।
সুলাইমান (আঃ) সে বইগুলো পরে পুঁতে ফেলেন, আর সে বইগুলো নিয়ে যেকোনো কথা বলা নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেগুলো খুঁড়ে বের করা হয়, এবং রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেগুলো। এখনো তাবিজ-কবচ এমনকি ‘জাদুবিদ্যার’ বইতে অনেক সময় সুলেমানি জাদু কথাটি উল্লেখ করা হয় বা নাম দেওয়া হয়। ১০২ নং আয়াতটি সে অপবাদের বিরুদ্ধেই অবতীর্ণ হয় বলে তাফসিরে জানা যায়।
কিন্তু কথা হলো, এই হারুত আর মারুত ফেরেশতা কারা? কুরআনে কেবল তাদের নামখানাই বলা হয়েছে, বিস্তারিত উল্লেখ হয়নি। বিস্তারিত জানবার আগ্রহ থাকলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে তাফসিরে, এবং ফেরেশতাদের উল্লেখ থাকা ইহুদি ও পারসিক ধর্মের দিকে।
তাফসির থেকে আমরা জানতে পারি, ইবনে জারির (র) এর মতে, হারুত ও মারুত ফেরেশতা দুজনকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান বান্দাদের পরীক্ষা করবার জন্য। এজন্য তিনি তাদের জাদুবিদ্যা শেখাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। তারা আল্লাহর আদেশ পালন করেছিলেন। কথিত আছে, সেটা ইদ্রিস (আঃ) এর সময়কাল ছিল।
ইসলামি তাফসিরে বলা হয়েছে, হারুত ও মারুত ফেরশতাদের কাহিনী নিয়ে নিশ্চিত কোনো বর্ণনাই কুরআন তো দূরের কথা, সহিহ হাদিসেও নেই। তাই এই কাহিনীগুলোতে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা বিষয়ে সতর্কবাণীর উল্লেখ আছে। তবে ইবনে কাসির সেই যুগে এই তাফসির লিখতে গিয়ে মন্তব্য করেন, এ ঘটনাগুলো ‘হয়তোবা’ ইসরায়েলি কাহিনী থেকে এসেছে; কিন্তু সেটা মিলিয়ে দেখবার উপায় হয়তো তার কাছে ছিল না। এখন আমরা মিলিয়ে দেখতে পারি আসলেই এগুলো ইহুদিদের উৎস থেকে এসেছে কিনা।
হ্যাঁ, আসলেই এসেছে। আমরা ইহুদিদের তালমুদ আর মিদ্রাশ ইয়ালকুত উল্টিয়ে হারুত আর মারুতের কাহিনী দেখতে পাই, যা বিভিন্ন দুর্বল হাদিসেও এসেছে। চলুন জেনে আসি কাহিনীটা কী। এ ব্যাপারে আমরা সেই ইহুদি উপকথা তাফসিরে ইবনে কাসিরের লেখনিতে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার বিভিন্ন সংস্করণ সংক্ষেপে তুলে ধরব।
যখন আল্লাহ আদম (আঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন এবং তার সন্তানেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারা নাফরমানি করতে থাকে আল্লাহর। ফেরেশতারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন, “দেখ এরা কত দুষ্ট প্রজাতি! কত অবাধ্য! আমরা এদের জায়গায় থাকলে কখনোই অবাধ্য হতাম না।”
তখন আল্লাহ তাদের বলেন, “তোমরা তোমাদের মাঝ থেকে দুজন ফেরেশতাকে বাছাই কর। আমি তাদের মাঝে মানবীয় প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখা যাক এরপর তারা কী করে।”
তারা তখন হারুত আর মারুতকে হাজির করলেন। আল্লাহ তাদের বললেন, “দেখো, মানুষকে তো আমি নবীর মাধ্যমে বাণী পাঠাই, কিন্তু তোমাদের সরাসরিই বলে দিচ্ছি- আমার সাথে কাউকে অংশীদার করবে না উপাস্য হিসেবে, কখনো ব্যভিচার করবে না আর মদপান করবে না।”
তারা দুজন তখন পৃথিবীতে অবতরণ করলেন। তাদের কাজ ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা জনগণের সমস্যার সমাধান করা, বিচার-ফয়সালা করা ইত্যাদি। সন্ধ্যা হলে তারা আবার আকাশে ফেরত যেতেন, এবং সে কাজে তারা ব্যবহার করতেন ইসমে আজম- স্রষ্টার যে পবিত্র নাম উচ্চারণ করার পর যেকোনো অসাধ্য আকাঙ্ক্ষা সাধন করা যায়। ইসমে আজম ব্যবহারের কারণ ছিল, ফেরেশতাদের সাধারণ ক্ষমতাগুলো তাদের ছিল না তখন।
একবার জোহরা নামের এক নারী হাজির হলো তার স্বামীর বিরুদ্ধে বিচার চাইতে। অসম্ভব সুন্দরী সে নারীকে দেখে তারা বিমোহিত হয়। তারা তার সাথে ব্যভিচার করবার ইচ্ছে প্রকাশ করে [তাফসিরে ইবনে কাসিরের (তাফসির পাবলিকেশন কমিটি প্রকাশনী, ড. মুহম্মদ মুজীবুর রহমান অনূদিত) বাংলা অনুবাদ প্রথম খণ্ডের ৩৩৮ পৃষ্ঠায় সেটিই উল্লেখ আছে, সাথে স্ক্রিনশট জুড়ে দেওয়া হলো]। কিন্তু জোহরা অস্বীকার করে বসে, কারণ হারুত বা মারুত জোহরার দেব-দেবী মানেন না। জোহরা জানায়, যদি তারা জোহরার মতো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মেনে নেয় উপাস্য হিসেবে তবেই সে মিলিত হবে (অর্থাৎ যদি ‘শিরক’ করে)।
হারুত মারুত জানালেন, “এটা আমাদের দ্বারা হবে না।” এটা শুনে জোহরা চলে গেল।
পরের বার জোহরা এক শিশুকে নিয়ে এসে বলল, “তোমরা যদি এ শিশুকে হত্যা করে দেখাতে পারো তাহলে বুঝব তোমরা আসলেই আমাকে চাও। আমি তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করব।” শিশুহত্যার তো প্রশ্নই আসে না, তাই তারা সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন।
এরপরের বার জোহরা এলো মদ নিয়ে। বলল, “আচ্ছা, এ মদ তো পান করো।”
হারুত মারুত মনে করলেন, এ তো অল্প পাপ। তারা মদ পান করে নিলেন। বেশি পরিমাণেই পান করলেন। হুঁশ হলে তারা আবিষ্কার করলেন, তারা মদের নেশায় ব্যভিচার তো করেছেনই, সাথে শিশুটিকে হত্যাও করে ফেলেছেন। তারা তখন অনুতপ্ত হয়ে যায়।
তাদেরকে বলা হয়, তারা কি দুনিয়াতেই শাস্তি নিয়ে নেবে, না পরকালের শাস্তি নেবে? তারা দুনিয়ার শাস্তি বাছাই করে নেয় (ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা ৩৩৮)। তাদের শাস্তি হয় ব্যবিলনের এক কুয়ায় কিয়ামত পর্যন্ত উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) এই দুর্বল হাদিস বর্ণনা করেন ইসরায়েলি বর্ণনা থেকে। (ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা ৩৩৭)
আবার ইবনে আব্বাস (রা) আরেকটি ইসরায়েলি বর্ণনা জানান এ বিষয়ে। জোহরার (বা যাহরা) নাম ফারসি ভাষায় আনাহীদ। সে স্বামীর বিরুদ্ধে যে বিচার চেয়েছিল সেটি সাথে সাথেই রায় দিয়ে দিয়েছিল ফেরেশতা দু’জন। এরপর জোহরা দাবি করে বসে, “তোমরা যে মন্ত্র পড়ে আকাশে উঠে থাকো আর নিচে নেমে আসো সেটা আমাকে শিখিয়ে দাও।”
মানুষরূপী ফেরেশতা দুজন সেটিও তাকে শিখিয়ে দেয় (ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা ৩৩৯)। কিন্তু নিচে নেমে আসবার জন্য নাকি ভিন্ন কিছু বলার কথা ছিল, যেটা জোহরা ভুলে যায়। জোহরা উর্ধ্বে আরোহণ করে নিচে নামতে পারেনি আর। সেখানেই তার দেহকে তারকায় রূপান্তরিত করা হয়। সে তারকাকে শুকতারা নামে চেনে মানুষ। জোহরা তারকা বলা হয়ে আরবিতে। আজকে আমরা জানি সেটা শুক্রগ্রহ।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, যখন এ ফেরেশতা দু’জনের কাছ থেকে অবাধ্যতা প্রকাশ পায় তখন আকাশের ফেরেশতারা স্বীকার করে নেন, মানবজাতি আল্লাহ থেকে দূরে অবস্থানের কারণে এবং তাকে না দেখেই ঈমান আনবার কারণে, তাদের ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না (ইবনে কাসির, ৩৩৯ পৃষ্ঠা)।
তাফসির-ই-ইবনে জারিরের মধ্যে একটি দুর্বল হাদিস আছে (ইবনে কাসির, ৩৪০ পৃষ্ঠা থেকে বিস্তারিত পাওয়া যাবে)। আয়েশা (রা) বলেন, মহানবী (সা) মারা যাবার পর এক মেয়ে তার খোঁজে আগমন করে দাওমাতুল জান্দাল থেকে। সে জানত না, নবী (সা) মারা গিয়েছেন। জানামাত্রই সে কাঁদতে শুরু করে। আয়েশা (রা) জিজ্ঞেস কলেন, “কাহিনী কী?”
সে বলে, আমার আর আমার স্বামীর মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। একবার সে আমাকে ছেড়ে কই যেন চলে যায়। এক বুড়ির কাছে গিয়ে আমি আমার এ কথাগুলো বলি। বুড়ি আমাকে বলে, “তোমাকে যা যা করতে বলি করো, সে আপনা-আপনি চলে আসবে।”
আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। রাতের বেলা সে দুটো কুকুর নিয়ে আমার কাছে এলো। একটির উপর সে উঠে বসলো। আর আমি আরেকটির উপর। (বিস্ময়কর ব্যাপার,) কিছুক্ষণের মাঝে আমরা অন্য শহরে পৌঁছে যাই। সেটি বাবেল শহর। আমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে দুটো লোক শেকলে বাঁধা।
আমাকে বুড়ি বলে, “ওদের কাছে যাও, বল, আমি জাদু শিখতে এসেছি।”
আমি গেলাম, এ কথা বললাম। তারা বলল, “জেনে রেখো, আমরা পরীক্ষার মধ্যে আছি। তুমি জাদু শিক্ষা করো না, এটা কুফরি কাজ।”
আমি বললাম, “শিখব আমি।”
তারা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে যাও, ঐ চুল্লীর মধ্যে প্রস্রাব করে চলে এসো।”
আমি গেলাম। প্রস্রাবের ইচ্ছেও করলাম, কিন্তু আমার অন্তরে তখন ভয় সঞ্চার হয়। আমি তাই ফিরে এসে বললাম, “করে আসলাম।”
তারা জিজ্ঞেস করল, “কী দেখলে?”
বললাম, “কিছুই না।”
তারা বলে, “তুমি ভুল বলছো। এখন পর্যন্ত তুমি বিপথে যাওনি। তোমার ঈমান ঠিক আছে, তুমি ফিরে যাও বাসায়, কুফরি করো না।”
আমি বললাম, “আমাকে জাদু শিখতেই হবে।”
তারা আবার বলল, “ঐ জায়গায় প্রস্রাব করে এসো।”
আমি আবার গেলাম। কিন্তু মন চাইলো না। ফিরে এলাম। আবার একই কথোপকথন হলো। এবার আমি আসলেই চুল্লীর কাছে গিয়ে প্রস্রাব করলাম। দেখলাম, এক ঘোড়সওয়ার মুখের উপর পর্দা ফেলে আকাশের উপর উঠে গেল!
আমি ফিরে এসে এ ঘটনা বললাম। তারা বলে, “হ্যাঁ। ঠিক। ওটা তোমার ঈমান ছিল, যা তোমার মধ্য থেকে বেরিয়ে গেল। এখন যাও।”
আমি বুড়ির কাছে ফিরে এলাম, বললাম, “তারা আমাকে কিছুই শেখায়নি।”
বুড়ি বলল, “যথেষ্ট হয়েছে। সবই এখন তোমার মাঝে আছে। তুমি যা বলবে তা-ই হবে।”
আমি পরীক্ষা করবার জন্য একটি গমের দানা নিয়ে মাটিতে ফেলে বললাম, “গাছ হও।” গাছ হয়ে গেল।
তারপর বললাম, “শুকিয়ে যাও।” ডালপালা শুকিয়ে গেল।
তারপর বলি, “পৃথক পৃথকভাবে দানা দানা হয়ে যাও।” তা-ই হয়ে গেল।
বললাম, “আটা হয়ে যাও।” আটা হয়ে গেল।
এরপর বললাম, “রুটি হয়ে যাও।” রুটি হয়ে গেল।
এরপরই আমার আফসোস শুরু হলো, আমি বুঝতে পারলাম আমি আসলেই ঈমানবিহীন হয়ে গেছি।
হে উম্মুল মুমিনিন (আয়িশা)! আল্লাহর কসম, আমি জাদু দিয়ে কোনো লাভ নেইনি, কারো উপর প্রয়োগ করিনি! এভাবে কাঁদতে কাঁদতে রাসুল (সা) এর সেবায় হাজির হতে এসেছি। কিন্তু পেলাম না তাকে। কী করি আমি এখন?”
এ কথা বলেই সে কাঁদতে থাকে, এত কাঁদে যে সবার মনে দয়া জাগে। কী ফতোয়া দেওয়া যেতে পারে সে নিয়ে সাহাবীরা বেশ উদ্বিগ্ন হলেন। তারা বললেন অবশেষে, “এখন এ ছাড়া আর কী বলার আছে- তওবা করবে, ক্ষমা চাইবে আল্লাহর কাছে। আর বাবা-মায়ের সেবা করবে।”
আল-কালবির বিবরণে দেখা যায়, আসলে তিনজন ফেরেশতাকে বাছাই করা হয়েছিল। তারা ছিলেন ফেরেশতা আয, আযাবি এবং আযরাইল (আঃ)। এর মাঝে যখন আযরাইল (আঃ) নিজের মাঝে কামনা অনুভব করেন তখন ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকে তুলে নিতে বলেন, তাকে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু বাকি দুজন কামনা চরিতার্থ করেন, তখন আল্লাহ তাদের নাম পরিবর্তন করে হারুত ও মারুত করে দেন যথাক্রমে।
কাতাদার ভাষ্যে জানা যায়, এক মাস লেগেছিল ফেরেশতা দুজনের অবাধ্য হতে। আর অন্য এক বিবরণে শোনা যায়, জোহরা আসলে যেন-তেন মহিলা ছিলেন না, পারস্যের রানী ছিলেন। আরেক ইহুদি বিবরণে জানা যায়, ফেরেশতা দুজনের আগের নাম ছিল শামহাজাই এবং আযাইল। আর জোহরার নাম সেখানে এস্থার। ইহুদি মিদ্রাশের অন্য বিবরণে এও জানা যায়, এস্থার বা জোহরা আসলে ব্যভিচারে জড়িত হয়নি, বরং তার ইচ্ছে ছিল কেবল স্রষ্টার পবিত্র নাম জানা, যেন সে স্রষ্টার নৈকট্য পেতে পারে। সে নাম জপ করবার পর যখন জোহরা স্বর্গারোহণ করল, তখন স্রষ্টা নিজে খুশি হয়ে তাকে কিমাহ নক্ষত্রমালায় স্থান দেন। তৎকালীন আরবে জোহরার শুকতারা হয়ে যাবার কাহিনী প্রচলিত ছিল।
হারুত-মারুতের ঘটনা বংশের পর বংশ ধরে চলে আসে। যাদের হাতে ছিল জাদুর মতো অলৌকিক ক্ষমতা, একটা সময় পর যে তাদেরকে পুজো শুরু করে দিবে তখনকার মানুষ, সে কী আর বলতে! সত্যি সত্যি এক সময় তারা উপাস্যে পরিণত হন; না, এটা কোনো ইহুদি, খ্রিস্টীয় বা ইসলামিক বই থেকে বলা হচ্ছে না, খোদ ইতিহাস থেকে বলা হচ্ছে। যেমন- আরমেনিয়াতে হারুত আর মারুত নামের দুই মূর্তির পুজা করা হতো। তারা ছিল আমিনাবেগ এবং আরারাত পর্বতের দেবী আসপারদারামলতের (Aspandaramlt) দুই উপদেবতা। ইরানেও (অর্থাৎ, পারস্যে) এই দেবীর পুজা হতো। আরমেনীয়রা তাকে দ্রাক্ষাক্ষেতের দেবী মানলেও ইরানে অর্থাৎ পারস্যের জরথুস্ত্রুর ধর্মে আসপারদারামলত আসলে একেবারে পৃথিবীর আত্মা। হোরোত আর মোরোত (হারুত মারুত) তার দুই সহকারী। তারা বাতাস আর বৃষ্টি আনত বলে বিশ্বাস করা হতো। আরারাত পর্বতের চুড়ায় তাদের বাস।
মজার ব্যাপার, আরো ঘাঁটলে আমরা জানতে পারি, জোহরার হিব্রু নাম ইস্থার। যাকে ব্যবিলন আর সিরিয়ায় কামের দেবী এবং জন্মের দেবী হিসেবে উপাসনা করা হতো। গিলগামেশ আর ইস্থারের এক করুণ প্রেমকাহিনী আমরা সেখানে পাই, তবে সে অন্য কথা।
জরথুস্ত্রুর পারসিক ধর্মে আমরা আভেস্তা ভাষায় ‘হাওরভাতাত’ (Haurvatat) নাম পাই, যার সাথে পানি, উন্নতি আর স্বাস্থ্যের সম্পর্ক ছিল। হাওরভাতাত নারী না পুরুষ সে বিষয়ে আছে বিতর্ক। তবে তার সাথে গ্রিক ধনের দেবতা প্লুটাসের মিল পাওয়া যায়। আবার আরেকটি নাম পাওয়া যায় যেটি হলো ‘আমেরাতাত’ (Ameretat)। আমেরাতাতের সাথে জড়িত ছিল ইহকাল আর পরকালের আয়ু আর সমৃদ্ধি।
ভাবছেন এ দুজনের কথা কেন বলছি? ইতিহাস এখানেই শেষ না। ইসলাম আবির্ভাবের প্রায় ৬০০ বছর আগে থেকে ইরানে বা পারস্যের একটি অঞ্চলে সগদিয়ান ভাষায় কথা বলা হতো, বর্তমানে সেটি উজবেকিস্তান আর তাজিকিস্তান, সমরকন্দ যার রাজধানী। সে ভাষায় আমরা দেখতে পাই হাওরভাতাত আর আমেরাতাত এর উচ্চারণ হারুত আর মারুত। হতে কি পারে না তারা একই? হারুত-মারুতের নাম শুধু এ ভাষায় না, বরং ইরানের নানা উপভাষাতেও প্রচলিত হয়ে যায়। এমনকি তারা এক জাতের ফুলের নামও রাখে হারুত-মারুত।
আবু দাউদ শরিফের ৪৯০ নং হাদিসে এসেছে, একবার আলী (রা) বাবেলের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেলেও তিনি সেখানে নামাজ পড়লেন না। একেবারে বাবেল সীমান্ত পার হয়ে যাবার পর নামাজ পড়লেন। এরপর বললেন, “রাসুল (সা) আমাকে কবরস্থানে নামাজ পড়তে মানা করেছেন, আর বাবেলের ভূমিতে নামাজ পড়তে মানা করেছেন। কারণ বাবেল অভিশপ্ত ভূমি (সেই জাদুর কারণে)।”
তবে, ‘ফলেন অ্যাঞ্জেল’ ধারণা কিংবা ফেরেশতার অবাধ্যতার ধারণা ইসলামে অনুপস্থিত থাকায় এসব ইহুদি উপকথা মিথ্যা বলে মেনে নেন আধুনিককালের ইসলামি আলেমগণ। ইমাম কুরতুবিরও তাই মতামত। কারণ, কুরআন বলছে,
ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তা-ই করে।” (কুরআন, ৬৬:৬) “তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারে না এবং তারা তাঁর আদেশেই কাজ করে। (কুরআন, ২১:২৬-২৭)
ইমাম তাবারি আর ইবনে জারির মনে করেন, হারুত মারুত আসলে ফেরেশতা ছিলেন না, মানুষই ছিলেন, তাদেরকে ফেরেশতা মনে করা হতো।
বর্তমানে ইসলামে যে ফতোয়া এ বিষয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটি সৌদি ফতোয়া কাউন্সিলের শেখ সালিহ আল ফাওজানের, “হারুত ও মারুত ফেরেশতাই ছিলেন, কিন্তু তারা কখনোই অবাধ্যতা করেননি। তাদের আল্লাহ কেবল পাঠিয়েছিলেন মানুষের পরীক্ষা নেবার জন্য। তারা যে জাদুবিদ্যা শেখাবার কথা বলতেন, সাথে সতর্কবাণীও দিতেন। আল্লাহর হক বান্দাগণ সে সতর্কবাণী মেনে জাদু শিখবে না, কিন্তু নাফরমানি যারা করতে চায় তারা শিখবে। এটা ছিল ছিল সে পরীক্ষা। আর কিছুই নয়।”
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) আকাশে শুকতারা দেখলেই প্রচলিত ইহুদি কাহিনীটি স্মরণ করে অভিশাপ দিতেন বলে ইবনে কাসিরের তাফসিরে উল্লেখ আছে। ইসলামে সরাসরি হারুত আর মারুত নিয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলেও ইহুদি উপকথার মিশেল সহস্রাব্দেরও বেশি সময় জুড়ে কাহিনীর যোগান দিয়ে এসেছে বটে মুসলিম বিশ্বে। হয়তো পাঠক আপনারাও তেমন কাহিনী শুনে থাকবেন কোনো না কোনো সময়।
ফিচার ইমেজ: Wallpaper Abyss