২০১৮ সালের বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা জিততে পারবে কিনা, এ প্রশ্ন অনেক আজেন্টিনা ভক্তদের মনেই প্রতিনিয়ত উঁকি দিয়ে থাকে। এবারের বিশ্বকাপ হয়তো মেসির শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে, মেসিভক্তদের চাওয়া এবাবের বিশ্বকাপ মেসির হাতে তথা আর্জেন্টিনার হাতেই শোভা পাক। আর্জেন্টিনা দলটি কতটা শক্তিশালী বা এবারের আর্জেন্টিনা দল বিশ্বকাপ জেতার দাবি রাখে কিনা- সে প্রশ্নের উত্তর দিতে অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞই নানা অভিমত ব্যক্ত করছেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার জনগণ এ নিয়ে কী ভাবছে? দেশটির একাংশের মতে, এবারেও মেসির কপালে বিশ্বকাপ উঠছে না। আর তাদের এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে এক অভিশাপ।
১৯৮৬ সালের পর থেকে আর্জেন্টিনা দল যতবার বিশ্বকাপে গিয়েছে, প্রতিবারেই দলের মধ্যে এই অভিশাপই তাড়া করছে বলে দেশটির অনেক নাগরিকই বিশ্বাস করেন। যে অভিশাপ এখনো পুরো আজেন্টিনা দলকে তাড়া করে চলেছে। দেশটির সেসব মানুষ এখনো মনে করেন যে, এই ‘তিলকারার অভিশাপ’ থেকে এবারও মুক্তিলাভ ঘটবে না মেসির দলটির। আর এ কারণেই এবারও বিশ্বকাপ অধরাই থেকে যাবে ফুটবল বরপুত্রের।
এ মতানুসারে, অভিশাপটির জন্য দায়ী ১৯৮৬ সালের দিয়েগো ম্যারাডোনার সেই বিশ্বকাপ জয়ী দল। তাই অনেক আর্জেন্টিনাবাসীই মনে করেন ২০১৮-এর রাশিয়ার মটি থেকে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ী করতে হলে শুধু মেসি ক্যারিশমার ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। মেসির ছন্দময় শিল্পের সাথে সাথে তাদের খুঁজে বের করতে হবে ১৯৮৬ সালের পাওয়া অভিশাপ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়।
কী সেই তিলকারার অভিশাপ, যার কারণে আর্জেন্টিনার জনগণের মনে এই ভাবনা বারবার উঁকি দিচ্ছে?
তিলকারা আর্জেন্টিনার ছোট্ট এক গ্রাম। আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গ্রামটি অবস্থিত। আন্দিজ পর্বতমালার খুব কাছেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত তিলকারা গ্রামটি। বেশ শান্ত, নিবিড়, এক অপরূপ মায়ময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হাতছানি দেয় গ্রামটিতে।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল মেক্সিকো। মেক্সিকোর যে মাঠগুলোতে আর্জেন্টিনার খেলা পড়েছিল, সেগুলো ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে। এই ধরনের মাঠগুলোতে খেলতে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা খুব একটা অভ্যস্ত নন। এসব মাঠে খেলতে গেলে অনেক সময় খেলোয়াড়দের অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। আর তাই মেক্সিকোর এই মাঠগুলোর উচ্চতার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সে সময়ের আর্জেন্টিনার দলের কোচ কার্লোস বিলার্দো ঠিক করেন, তিনি দলের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শিবির করবেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই তিলকারা গ্রামে। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে তিনি ও তার দল ঘাঁটি গাড়েন তিলকারা গ্রামে, যেখানে তখন গ্রামের কারো ঘরে ছিল না একটি টিভিও। গোটা গ্রাম মিলে টেলিফোন ছিল একটি।
এই প্রস্তুতি শিবির চলাকালে আলবিসেলেস্তে কোচের কানে আসে গ্রামের একটি প্রাচীন উপকথা। গ্রামে রয়েছে অনেক বছরের পুরনো একটিমাত্র গির্জা। সে গির্জাতে রয়েছে ‘ভার্জিন অব কোপা কাবানা’র মূর্তি। এই মূর্তিকে অসম্ভব মান্য করেন গ্রামের অধিবাসীরা। তাদের বিশ্বাস, এই মূর্তির সামনে প্রার্থনা করে কেউ যদি কোনোকিছু প্রবলভাবে চায়, তাহলে তা অবশ্যই পূরণ হয়। আবার মূর্তির সামনে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে, তাও রক্ষা করতে হয়। আর তা না হলেই যত বিপদ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীর ওপর নেমে আসে অভিশাপ।
তিলকারা গ্রামবাসীদের দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, ‘ভার্জিন অব কোপা কাবানা’র মহিমার কথা গ্রামবাসীদের মুখ থকে জানতে পেরে আর্জেন্টিনার কোচ ও খেলোয়াড়রা ওই চার্চে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসুক হয়ে পড়েন। পরে কোচ আর ফুটবলাররা সেই চার্চে যান। তারা বিগ্রহের সামনে প্রতিশ্রুতি দেন যে, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিততে পারলে তারা আবার তিলকারায় ফিরে ‘ভার্জিন অব কোপা কাবানা’কে ধন্যবাদ জানাবেন।
আসলেই কি ১৯৮৬-র আর্জেন্টিনার দল এ ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি ‘ভার্জিন অব কোপা কাবানা’কে জানয়েছিলেন? তা জানার জন্য আর্জেন্টিনার এক দল সাংবাদিক গিয়েছিলেন তিলকারায়। সেখানে গিয়ে তারা বত্রিশ বছর আগের সেই ঘটনার কথা জানতে চান স্থানীয় মানুষদের কাছে। সেখানে তাদের সাথে কথা বলেন ডেভিড গর্দিলো এবং সারা ভেরাও নামের দুই স্থানীয় বাসিন্দা।
সে সময় ডেভিড গর্দিলো ছিলেন পঁচিশ বছরের এক যুবক। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলটির সাথে অনুশীলনও করতেন তিনি। একদিন ফুটবলারদের কাছে সেই চার্চের কথা তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন। তারপর ফুটবলাররা নাকি তার সাথে সেই চার্চ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন এবং সেদিন তারা ‘ভার্জিন অব কোপা কাবানা’র কাছে প্রতিশ্রুতি দেন বিশ্বকাপ জিততে পারলে তারা আবার এই গ্রামে ফিরে আসবেন তাকে ধন্যবাদ জানাতে।
অনেকটা একইরকম বক্তব্য দিয়েছেন গ্রামের আরেক বাসিন্দা সারা ভেরা। আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা যে মাঠে অনুশীলন করতেন, সেই অনুশীলনের জন্য মাঠটি ভেরাই ভাড়া দিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ভেরা জানান যে তিনিই আর্জেন্টিনা দলের কোচ বিলার্দোকে ওই চার্চে নিয়ে যান এবং বিলার্দো ভার্জিনের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে একটি প্রতিজ্ঞা করেন। মেক্সিকোর বিশ্বকাপ ট্রফিটি যদি আর্জেন্টিনার ঘরে আসে, তাহলে তিনি বিগ্রহের কাছে ফিরে এসে তাকে হাঁটু মুড়ে ধন্যবাদ জানাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করা হয়।
দিয়েগো ম্যারাডোনার সেই দল বিশ্বকাপে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিল। ১৯৭৮ সালের পর আবার ১৯৮৬ সালের সেই বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানিকে ফাইনালে হারিয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি জেতে আর্জেন্টিনা। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ী সেই ফুটবলাররা ও তাদের কোচ আর ফিরে যাননি তিলকারায়। তারপর থেকেই আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের ওপর নেমে আসে অভিশাপ।
এরপর থেকেই গ্রামবাসীর বিশ্বাস, সেই অভিশাপেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলকে। এজন্যই ১৯৯০ এবং ২০১৪ সালে দু’বার ফাইনালে উঠলেও শিরোপার স্বাদ পাওয়া হয়ে উঠেনি আর্জেন্টিনা দলের। দু্’বারই ফাইনালে হারতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দু’বারই তাদের প্রতিপক্ষ দল ছিল সেই জার্মানি। আর দু’বারই ফাইনালে জার্মানির কাছে এক গোলে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। বিষয়টা বেশ কাকতালীয়, তা-ই না!
আর এই ঘটনাই তিলকারা গ্রামবাসীদের মতো আর্জেন্টিনার অনেক নাগরিকেরই মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, তিলকারার সেই অভিশাপ না খণ্ডানো গেলে বিশ্বকাপ এবারও অধরা থেকে যাবে আর্জেন্টিনার।
সেই বিতর্কের রেশ এখনো কাটেনি, তা বলাই বাহুল্য। সেই বিতর্ক এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ’৮৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা দলের কোচ ও ফুটবলারদের। কিছুদিন আগে বিলার্দো এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, তারা এ ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি কোথাও দেননি। প্রায় একইরকম বক্তব্য দিয়েছিলেন সে দলের কয়েকজন ফুটবলাররাও।
কিন্তু তারপরও বিতর্ক থেমে থাকেনি। বরং বন্ধ হওয়ার বদলে তা আরো তীব্রভাবে আর্জেন্টিনার ভক্তদের মধ্যে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। তিলকারার গ্রামবাসীরাও বিষয়টা খুব একটা ভালোভাবে নেননি। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রতিজ্ঞাভঙ্গের অভিশাপ এখনো আর্জেন্টিনা দলকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একসময় আর্জেন্টিনার বিভিন্ন শহরে এবং নাগরিকদের মধ্যে বিষয়টি বেশ চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে দেশে কিছুটা উত্তপ্ত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০০৬ সালে আর্জেন্টিনার ফুটবল সংস্থা বিশ্বকাপের একটি রেপ্লিকা তিলকারার চার্চে পাঠায়। কিন্তু তারপরও বিশ্বকাপে সৌভাগ্যের দেখা পায়নি আর্জেন্টিনার জাতীয় দল।
এবারের বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পূর্বে শাপমুক্তির একটা চেষ্টা নেয়া হয়েছিল। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমের দেয়া তথ্য হতে জানা গেছে, ২০১১ সালের দিকে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত কোপা আমেরিকার শুরুতে ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ী দলের কয়েকজন ফুটবলার তিলকারার গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। যাদের মধ্যে আছেন জোসে লু্সইস (দলের তৎকালীন ম্যানেজার), সার্জিও চেকো, হর্হে বুরুচাগা, রিকার্দো বচিনিরার মতো ফুটবলার। তবে এ ব্যাপারে তাদের মুখ থেকে কিছু জানা যায়নি। আর কয়েকদিন পরেই বেজে উঠবে ২০১৮ বিশ্বকাপের বাঁশি। কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী সেসব ফুটবলারদের এখনও পর্যন্ত তিলকারায় যাওয়ার কথাও জানা যায়নি। আর সেই অভিশাপও খণ্ডন না করেই আর্জেন্টিনা দলকে রওনা দিতে হবে রাশিয়ায়।
তিলকারার সেই শিবিরে ম্যারাডোনা না থাকলেও তার দলের অনেক ফুটবলারদের সেই অভিশাপের বোঝা এখনো মাথায় নিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের উত্তরসূরীরা। যা থেকে মুক্তি মেলে কিনা, তা জানা যাবে ২০১৮ এর রাশিয়ার বিশ্বকাপে। ততদিন না হয় অপেক্ষায় রইলাম আমরা।
ফিচার ইমেজ- chasingcorners.com