মহাকবি হোমারের অমর সৃষ্টি ‘ইলিয়াড ‘ ও ‘ওদিসি ‘ প্রাচীন পুরাণের এক অমূল্য সম্পদ। প্রাচীন চারণ-কবিগণ বীরদের বিভিন্ন কীর্তি ও রোমাঞ্চকর ঘটনা সম্বন্ধে গান রচনা করে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে তা গাইতেন। গ্রিসের ট্রয় অভিযান সম্বন্ধীয় সমস্ত সংগীত একত্রিত করেই উপরোক্ত দুটি মহাকাব্য রচনা করা হয়। কিংবদন্তি অনুযায়ী, খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে মহাকাব্য দুটি লিখিতরূপে লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি তা সংকলন ও পরিমার্জন করেছিলেন। সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে গ্রীস ও ট্রয়ের উপাখ্যান, অসংখ্য বীর যোদ্ধার সচিত্র বীরগাঁথা, দেব-দেবীর শঠতাপূর্ণ কলহ ও গৌরবময় ট্রয়ের নাটকীয় পতনের করুণ ইতিহাস।
টানা দশ বছর ধরে বিরামহীনভাবে চলা গ্রিস ও ট্রয়ের এ এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন অ্যালিকিস ও হেক্টরের মতো ইতিহাসবিখ্যাত বীর যোদ্ধাগণ। দুই দেশের যুদ্ধ বাঁধানোর পেছনে মূল কারিগর ছিল প্রায়ামের পুত্র প্যারিস, যার হতবুদ্ধিতা এবং ভয়াবহ লোভ ডেকে এনেছিল ট্রয় নগরীর অনিবার্য ধ্বংস। অশান্তির ছায়া দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ট্রয় নগরে। কীভাবে শুরু হয়েছিলে যুদ্ধের মহড়া, কীভাবেই বা বেঁধেছিল এই কলহের সূত্রপাত?
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এশিয়ার মাইনরের উত্তরে অবস্থিত ট্রয় নগরী তখন ঐশ্বর্য, সম্পদ, সুখ ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। আকাশছোঁয়া পর্বতমালার খাড়া ঢাল গিয়ে মিশেছে নীল মেঘের আড়ালে। সিয়মেস ও স্ক্যামান্ডার নদীবিধৌত, সুদৃঢ় বিশাল স্তম্ভ ও প্রাচীরে পরিবেষ্টিত হয়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ট্রয় নগরী। ঈর্ষা করার মতো সকল উপাদানের অনুপম মিশ্রণে গড়া ছিল এই শহর। মহা সমারোহের অমোঘ আকর্ষণ যেন ট্রয় নগরীর দিকে হাতছানি দেয়।
মসনদে তখন আসীন আছেন ট্রয়ের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা প্রায়াম। একদিন প্রায়ামের সন্তানসম্ভবা রানী হেকুবা স্বপ্ন দেখলেন, তিনি সন্তান জন্মদানের বদলে জ্বলন্ত এক মশাল প্রসব করেছেন। স্বপ্নটা দেখার পর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল রাণীর। সাথে সাথে তিনি ট্রয়ের গণক ও জ্যোতিষীদের দ্বারস্থ হলেন। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর জ্যোতিষী মহল থেকে জবাব আসলো, তিনি যে সন্তান জন্ম দেবেন, সে হবে ট্রয় নগরীর পতনের কারণ।
প্রায়াম ও হেকুবা যেন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অকুল এক পাথারে আছড়ে পড়লেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, যে সন্তান নগরীর অমঙ্গল ডেকে আনবে, তার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু নিজ সন্তানকে প্রাণে মারতে সাহসে কুলাল না তাদের। এক রাখালের হাতে শিশুটিকে সোপর্দ করে দিয়ে বললেন, তাকে যেন আইডা পর্বতের পাথরের উপর রেখে আসা হয়। তাহলে কোনো জন্তু-জানোয়ারই এসে ছেলেটাকে খেয়ে ফেলবে।
কিন্তু তাতে মন সায় দিলো না সে রাখালের। দয়াপরবশ হয়ে আইডা পর্বতের গ্রামবাসীর কাছে নিয়ে আসে শিশুটিকে। সেখানে তার নাম রাখা হয় প্যারিস। সেখানেই শৌর্যে-বীর্যে বড় হতে থাকে ছেলেটি। রূপ-গুণ-শক্তিতে সকলকে ছাড়িয়ে সে হয়ে উঠে পরিণত সুঠাম এক যুবকে। তীর-ধনুক বা অস্ত্র চালনা, সবকিছুতেই তার অনন্য পারদর্শিতা, যেন সে একাই একশো। শক্তির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে সুদর্শন হয়ে উঠছিল সমানুপাতিক হারে। তখন ইনোনি নামক এক পার্বত্য পরীর সাকে বিয়ে করে প্যারিস। প্যারিসকে খুব ভালোবাসতো ইনোনি। হয়ত, রূপবতী এই পরীকে নিয়ে পাহাড়ের উপত্যকায় জীবনের বাকি সময়টা সে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু দেবতাদের ইচ্ছা সেরকম ছিল না।
তখন সমুদ্র-দেবী থেটিসের উপর একটা ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিল যে, তিনি এমন এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেবেন, যে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও পরাক্রমশালিতায় তার পিতাকেও পেছনে ফেলবে। প্রথম দিকে থেটিসকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকলেও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে, সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন দেবরাজ জিউস। সেজন্য দেবী থেটিসের স্বামী হিসেবে নির্বাচন করা হয় মরণশীল এক মানুষকে। সেই মরণশীল মানুষ হলো গ্রিক মহাবীর পেলেউস। ধুমধাম করেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। কিন্তু সেখানে ঘটে গিয়েছিল এক ছোটখাট গণ্ডগোল। যেটা পরে ফুলে-ফেঁপে রূপ নিয়েছে ভয়াল আকৃতিতে।
কলহ-বিবাদের দেবী ইরিসকে ছাড়া বাকি সব দেব-দেবীকে সে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। চরম অপমানে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে, প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে যান ইরিস। যেভাবেই হোক, এই অপমানের বদলা নিতেই হবে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মাঝে তিনি একটা সোনার আপেল ছুড়ে দেন। ‘সবচেয়ে সুন্দরীর জন্য এই উপহার’ এই ছলচাতুরীপূর্ণ শব্দ আপেলটার ওপর স্পষ্টাক্ষরে খোদাই করা ছিল।
নিজেকে বিশ্বসুন্দরী ভাবা রূপবতী সকল দেবীরা আপেল নিয়ে নিজেদের মধ্যে বাধিয়ে দিলেন ঝগড়া-বিবাদ। অনুষ্ঠানের দফা-রফা হবার একপর্যায়ে বেশিরভাগ দেবী নিজ থেকেই রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। বাকি রইলেন শুধু তিনজন, যারা আপেলের উপর থেকে নিজের দাবি ছাড়তে সম্পূর্ণ নারাজ। তারা হলেন যথাক্রমে, জিউসপত্নী হেরা, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি, ও বিদ্যাদেবী আথেনি। স্বর্গলোকে তিনজনই ছিলেন উঁচু পদে আসীন, তাই কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। দেবতারাও তাদের সৌন্দর্য বিচারের সাহস দেখালেন না। ঝগড়ায় ইস্তফা ও স্থায়ী সমাধানে জন্য বিচারকার্যের ভার ন্যস্ত করা হলো আইডা পর্বতের সেই সুদর্শন যুবক প্যারিসে উপর।
মহাসমারোহে আয়োজন করা হলো নাটকীয় এক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার। প্রস্তুতি পর্ব সেরে স্ক্যামান্ডার নদীতে স্নানের পর, সুগন্ধি মেখে, অনাবৃত দেহে একযোগে আইডা পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তারা। ধরাধামে দেবীদের আগমনে যেন দূর হয়ে গেল ঘোর অমানিশা, আলোকিত হলো সমগ্র ভূমি। সকলেই তিন-দেবীর অমৃত রূপ উপভোগ করছিল সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে। আচমকা এত রূপের ঝলকানি দেখে হকচকিয়ে গেল প্যারিস নিজেও। দেবীরা তখন তাকে দায়িত্ব দিলো- তিনজনের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে বেছে নিতে।
এক মহাবিপদে পড়ে গেল প্যারিস। কাকে রেখে কাকে সে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ঘোষণা করবে? তার মতো অতিসাধারণ মরণশীল এক মানুষের পক্ষে কি শক্তিশালী ও মহীয়সী তিন দেবীর সৌন্দর্য বিচার করা সম্ভব? ঠিক তখনই, প্রত্যেক দেবীই তাকে পুরষ্কারের লোভে আচ্ছাদিত করতে চাইলেন।
জিউসপত্নী হেরা সশব্দে বলে উঠলেন, প্যারিস স্বর্ণের আপেলটি তাকে দিয়ে দিলে তিনি প্যারিসকে দান করবেন সমস্ত মানবসম্প্রদায় ও নগরীর একচ্ছত্র প্রভুত্ব। সাথে তিনি আরও যোগ করেন, ক্ষমতার চেয়ে শক্তিশালী কিছু এই দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই, জগতের সকল সুখ অসীম ক্ষমতার মধ্যেই নিহিত। কথা শোনে লোভে চোখ চকচক করে উঠল প্যারিসের। যেই সে হেরাকে আপেলটা দিতে যাবে, তখন দেবী আথেনি রক্তরাঙা চোখে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “যে ক্ষমতায় পরিজ্ঞান অনুপস্থিত, তার অবক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। জ্ঞানের মাধ্যমে শুধু আত্মতৃপ্তিই নয়, অসীম ক্ষমতাও অর্জন করা যায়। তুমি চাইলে আমি তোমাকে তোমার নিজ সম্পর্কে জ্ঞান, মানবজাতি সম্পর্কে নিগুঢ় তত্ত্ব, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জ্ঞান, সবকিছু একেবারে ঢেলে দিব। জ্ঞানের চেয়ে পবিত্র ও মহৎ আর কিছু হতে পারে না।”
গম্ভীর মহিমা ও অবিচলিত ভাবধারায় আথেনি এমনভাবে কথা বললেন, প্যারিসকে পড়তে হলো বিহ্বলতার গ্যাঁড়াকলে। যে দেবীর স্ফটিকপ্রভ আঁখি যুগলে এত বড় আশ্বাসের হাতছানি, তাকে অমান্য করাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
হাস্য পরিহাস-প্রিয় আফ্রোদিতি তখন অক্রূর এক স্নিগ্ধ হাসির মাধ্যমে তাকালেন প্যারিসের দিকে। বললেন, “মরণশীল মানুষ ক্ষীণ আয়ু নিয়ে সর্বদাই ছুটে চলে শাশ্বত সুখের পেছনে। অধরা এই মরীচিকার পেছনেই ব্যয় হয় জীবনের পুরোটা সময়। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসার মধ্যেই সেই অনন্ত, চিরন্তন, ও চিরায়ত সুখ নিহিত। আমি তোমাকে উপহার দেবো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণীর প্রেম। সমস্ত গ্রীক বীরই তাকে বিয়ে করার ব্যাকুলতায় আচ্ছন্ন ছিল, ডুবে রয়েছিল তার সৌন্দর্য-সুশোভনে। সে আর কেউ নয়, স্বয়ং জিউস-কন্যা মহামতি হেলেন। এখন সে তার স্বামী মেনেলাউসকে নিয়ে স্পার্টায় বসবাস করছে। সোনার আপেলটি আমার হাতে দিয়ে দিলেই তুমি পাবে ধরিত্রীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণীর সাহচর্য।”
দেবীর দিলখোলা ও পরিতোষপূর্ণ কথাবার্তা শুনে প্যারিসের মনে হলো, তার ভেতরকার অস্থিমজ্জাগুলো গলে যাচ্ছে। হেলেনকে কাছে পাবার মোহ তাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন ও অন্ধ বানিয়ে ফেলল। নিজের সুন্দরী স্ত্রী ইনোনি ও বাকি দুই দেবীর বরের কথা একপাশে সরিয়ে সে হেলেনের আকাঙ্ক্ষায় মূর্ছা গেল। সাত-পাঁচ না ভেবে আপেলটি তুলে দিল আফ্রোদিতির হাতে। হাসতে হাসতে পুরষ্কারটি গ্রহণ করেন দেবী। বাকি দুজন তীব্র বিরক্তিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ার উপক্রম।
প্যারিসের এমন হঠকারী ও অবিবেচিত সিদ্ধান্তই খুলে দিয়েছিল অন্তহীন দুর্দশার পথ। ট্রয় নগরী ধ্বংসের সূচনা পরোক্ষভাবে শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। প্যারিসের স্ত্রী ইনোনি ভবিষ্যৎ দেখতে পেত। তাই সে প্যারিসকে একবার সতর্ক করেছিল, সে যদি কোনোদিন গ্রিসে অভিযান করে, তবে সেটা তার স্বজাতি ও দেশের জন্য ডেকে আনবে অন্তহীন দুর্ভোগ। কিন্তু প্যারিস ইনোনির সে ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো তোয়াক্কাই করেনি, উলটো দেবী আফ্রোদিতির দেওয়া প্রতিশ্রুতির উপর বিশ্বাস রেখেই সে চলে আসে সুসজ্জিত ট্রয় নগরীতে। সেখানেই নিজের রূপ-গুণ দিয়ে বাজিমাত করে প্যারিস।
বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কয়েকজন রাজকুমারকে হারিয়ে দেবার পর জনসম্মুখে দৃষ্টিগোচর হয় সে। তখন প্রায়ামের এক দৈবজ্ঞ কন্যা, ক্যাসান্ড্রা প্যারিসের বয়স, লালনপালন, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অনুপুঙ্খ প্রশ্নের মাধ্যমে বুঝতে পারে, প্যারিসই রাখালের কাছে দিয়ে আসা সেই সন্তান। দীর্ঘদিন পর নিজ সন্তানকে কাছে পেয়ে, তার সৌন্দর্য-মহিমায় আচ্ছন্ন হয়ে ভয়াল ভবিষ্যদ্বাণীর কথা পুরোপুরি ভুলে গেলেন প্রায়াম ও হেকুবা।
প্যারিস তার পিতার নিকট গ্রিসের উদ্দেশ্যে যাত্রার অনুমতি চাইলে, প্রায়াম সেটার কারণ জানতে চান। উত্তরে প্যারিস জানান দেয়, সে তার ফুফু হেসিওনিকে উদ্ধার করতে চায়, যাকে হেরাক্লিস ও তার লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। রাজদরবার থেকে প্যারিসকে সবরকম সম্মানে ভূষিত করার পাশাপাশি, একবহর সুসজ্জিত জাহাজ-সমেত গ্রীসে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তখন সে রওনা হয় দক্ষিণ গ্রিসের স্পার্টার দিকে, যেখানে রাজা মেনেলাউস ও তার স্ত্রী রাণী হেলেনের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
গ্রিস অভিযাত্রাতেই হেলেনকে গোপনে তুলে নিয়ে আসে প্যারিস। যার ফলেই মেনেলাউস ও তার ভাই আগামেমনন, স্ত্রী অপহরণের অভিযোগে পুরো গ্রিসকে ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমন্ত্রণ জানায়। যে যুদ্ধ স্থায়ী ছিল পুরো দশ বছর, এবং এর মাধ্যমেই পতন ঘটে ঐশ্বর্যশালী ট্রয় নগরীর।