বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশেষ জনগোষ্ঠী- গারো। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাংগাইল, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা এবং গাজীপুরের শ্রীপুরে তাদের জনমিতি লক্ষণীয়। ভারতে বসবাস প্রধানত ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এবং অরুণাচলে। মঙ্গোলয়েড মহাজাতির টিবেটো-বার্মা দলের অন্তর্ভুক্ত টিবেটো-চাইনিজ পরিবারের সদস্য তারা। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে গারো জনসংখ্যা ৬৮,২১০; তার পরে আর জাতিভিত্তিক শুমারি হয়নি। বর্তমান সে সংখ্যা এক লক্ষ বিশ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। অবশ্য অনেকেই সেই সংখ্যা দুই লাখ হবার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। গারো নামটি কিন্তু নিজেদের দেয়া নয়; বরং আরোপিত। নিজেদের তারা মান্দি বা আচিক হিসাবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
মান্দি শব্দটি এসেছে Manni de থেকে; যার অর্থ মানবসন্তান। ইরাবতী নদীর তীরে মন্দালয় নামক স্থানে লম্বা সময় বসবাস কিংবা পূর্বপুরুষ নরমান্দির নাম থেকেও ‘মান্দি’ নামের উদ্ভব বলে অনেকের ধারণা। অন্যদিকে ‘আচিক’ শব্দের অর্থ মাটি কামড়ে থাকা। পুরাণ মতে, গারো পাহাড় ত্যাগ না করা এবং বহিঃশত্রুর হাত থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য এক মুঠো মাটি মুখে নিয়ে পণ করে কিছু মানুষ। তারাই পরে পরিচিত হয় আচিক নামে। ভাষায় কিংবা সামাজিক রীতি-নীতিতে শুধু না; তাদের স্বাতন্ত্র্য উঠে এসেছে ধর্মবিশ্বাস এবং উপকথাতেও।
সবকিছুর আগে
গ্রিক, রোমান কিংবা নর্স মিথের আখ্যানগুলো অনেকটাই বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আরো গভীরে গেলে মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় কিংবা মায়া সভ্যতার উপকথার আলাপ উঠতে পারে। অনেকটা অপ্রচলিত হলেও নেহায়েত কম সমৃদ্ধ না গারো পুরাণ। গারো বিশ্বাস মতে, সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগত বলতে আদতে কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। চারিদিকে কেবল নিঃসীম ঘোর অন্ধকার এবং অসীম জলরাশি। হিন্দু, ইসলাম এবং খ্রিষ্টধর্মের গ্রন্থগুলোতেও সৃষ্টির সাথে পানির সম্পর্কের উল্লেখ দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক থেলিস (৬২৪-৫৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) জগৎ সৃষ্টির মূল উৎস বলে ঘোষণা করেন, যা পরে ওয়াটার ফিলোসফি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
যা-ই হোক, প্রধান দেবতা তাতারা-রাবুগা প্রথম পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে মনস্থির করলেন। তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য মনোনীত করা হলো সহকারী দেবতা নন্তু-নপান্তুকে। বস্তুত এ কাজের জন্য তিনিই ছিলেন সকল দিক দিয়ে যোগ্যতম। নন্তু-নপান্তু একজন স্ত্রীলোকের বেশে শুরু করলেন পৃথিবী সৃষ্টির প্রক্রিয়া। সঙ্গ ও সহযোগিতা দিল সহকর্মী ‘মাচি’।
পৃথিবীর জন্ম
নন্তু-নপান্তু প্রথমে পানির উপর বিছানো মাকড়সার জালে আশ্রয় নিলেন। হাতে ছিল তাতারা-রাবুগার কাছ থেকে পাওয়া এক মুঠো বালি। কাজটা শুরু হলো এর পরেই। হাতের বালি দিয়ে পৃথিবীর আকার দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বালিকে একত্র করে আটকে রাখাটা অসম্ভব। আটকে রাখতে হলে প্রয়োজন একটু কাদামাটির। নন্তু-নপান্তু কাদা মাটির জন্য কাঁকড়া আকৃতির অতিকায় এক প্রাণীকে পাঠালেন পানির নিচে। গভীরতা খুব বেশি হবার কারণে সেই প্রাণীর পক্ষে কাদা অব্দি পৌঁছানোই সম্ভব হলো না। বরং ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এল কাঁকড়া।
নন্তু-নপান্তু এবার একই কাজের জন্য নিযুক্ত করলেন ‘চিফং-নকমা বালফং-গিটেল’ নামক প্রাণীকে। আকৃতির দিকে দিয়ে সে প্রথমটির চাইতে ছোট। পানির গভীরতা দেখেই ভয় পেয়ে ফিরে এলো বেচারা। অর্থাৎ, ব্যর্থ হলো দ্বিতীয় দফার প্রচেষ্টাও। চিন্তিত নন্তু-নপান্তু হাল ছাড়লেন না। আরো একবার ভেবে দায়িত্ব দিলেন ‘চিচিং বারচিং’ নামের ছোট্ট এক প্রাণীকে। পানির গভীর তলদেশে প্রবেশ করে কাদা নিয়ে ফিরে এলা চিচিং বারচিং। সেই মাটির সাহায্যে সৃষ্টি করা হলো পৃথিবী। নন্তু-নপান্তু পৃথিবীর নাম রাখলেন মনোপিল্টে।
আংশিক পরিবর্তিতভাবেও পাওয়া যায় আখ্যানটি। সে মতে, পৃথিবী সৃষ্টির আগে নন্তু-নপান্তু কাঁকড়াকে গভীর পানিতে কাদা আনতে পাঠায়। কাঁকড়া যখন মাটি তুলে আনতে যাবে; ঠিক তখনই মাটির নিচের অধিবাসীরা মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলে তাকে। শেষ অব্দি পানির নিচেই মৃত্যু ঘটে বেচারার। এদিকে বিলম্ব দেখে নন্তু-নপান্তু ব্যাকুল ও শংকিত হয়ে পড়লেন। রহস্য উদ্ধারের জন্য প্রেরণ করলেন ‘নচি’-কে। সেইসাথে দায়িত্ব দিলেন কাদামাটি আনার। পানির নিচে গিয়ে মৃত কাঁকড়াকে দেখতে পেলো নচি। পায়ে তার তখনো লেগে আছে মাটি।
নিজের লেজে করে মাটি নিয়ে ফিরলেও ‘ডুমারু চাংমারু’-এর স্ত্রী ‘চিরিমিট’-এর রূপে সম্মোহিত হয়ে পড়ে নচি। ভুলে বসে নিজের দায়িত্ব এবং নন্তু-নপান্তুর কথা। স্বামী ডুমারু চাংমারু এসব দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো শীঘ্রই। পরিণামে চোখ আর মাথা ব্যতীত নচির সারা শরীর আক্রান্ত হলো মারাত্মক রোগে। নচির দুরবস্থা দেখে ‘মিসি’ হন্তদন্ত হয়ে খবরটা পৌছে দেয় নন্তু-নপান্তুর কাছে। আগাগোড়া শোনার পর নন্তু-নপান্তু মাটি আনার জন্য নিযুক্ত করলেন নারেংসিকে। এবার আর ভুল হলো না। দিন-তারিখ পূর্ণ হলে সৃষ্টি করা হলো পৃথিবী।
অনন্য আয়োজন
ততক্ষণে মাত্র দুই কিসিমের পাথর পৃথিবীর বুক জুড়ে। বড় আকৃতির পাথর ‘মজার’ এবং ছোট আকৃতির পাথর ‘ডিনজার’। এছাড়া তখনো পৃথিবীর উপরিভাগ খুবই নরম। বসবাস দূরের কথা, হাঁটাহাঁটির জন্যও উপযোগী হয়নি। নন্তু-নপান্তু সাহায্য প্রার্থনা করলেন পরম দেবতা তাতারা-রাবুগার কাছে। প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। তাতারা রাবুগা আকাশে সূর্য আর চন্দ্র এবং জমিনে বাতাস দিলেন। আলো আর বাতাসের স্পর্শে পৃথিবীর উপরিভাগ হয়ে উঠতে শুরু করলো শক্ত আর কঠিন। তাতারা-রাবুগা রিংকিং বা পেটিকোট দান করলেন পৃথিবীকে। সাথে দিলেন মেঘের তৈরী পাগড়ি। মাথায় সৌন্দর্যের জন্য দান করলেন আমফাং, রিসিক, প্রাপ ও বললেং গাছের মূলের ন্যায় চুল। প্রকৃতপক্ষে গারো পুরাণে বিশ্বপ্রকৃতিকে গণ্য করা হয় মা হিসাবে।
প্রাণীদের মধ্যে তাতারা রাবুগা প্রথমে সৃষ্টি করেছেন লেজহীন বানর। তার দায়িত্ব ছিল বিকট আওয়াজের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে সজাগ ও সচল রাখা। এরপর জন্ম নেয় হনুমান ও বাদামি রঙের বানর। পরে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের প্রাণী। জলচর প্রাণীদের মধ্যে সবার আগে সৃষ্ট বিশালাকার ব্যাঙ। তার কাজ ছিল বিকট শব্দের মাধ্যমে আকাশে মেঘের আগমন বার্তা ঘোষণা করে দেওয়া। তারপরের দফায় তৈরি হলো মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী।
পৃথিবী সৃষ্টির পর মাটির নিচে অনেক পানি থাকলেও উপরে পানি ছিল না। তাতারা রাবুগা শুষ্ক ধরণীতে আনলেন নদীর প্রবাহ। আকাশ থেকে পানি বর্ষণের জন্য নিয়োজিত হলেন বৃষ্টির দেবী নরে-চিরে-কিমরে-বকরে। সাথে পাঠানো হলো বজ্রের দেবতা গোয়েরাকেও। পৃথিবী এখন বসবাসের জন্য প্রস্তুত।
অতঃপর মানুষ
তাতারা-রাবুগা তার সকল সহকারীকে সামনে ডাকলেন এবং পরামর্শ করলেন। সৃষ্টির সেরা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল। দেবী সুস্মিকে পৃথিবীতে পাঠানো হলো প্রথম মানব-মানবীর জন্য স্থান নির্বাচন করতে। মানুষের আগমন নিয়ে ধর্মের অনুসন্ধান থেমে থাকেনি। ইসলাম যেখানে আদম এবং হাওয়াকে সামনে আনে প্রথম মানব-মানবী হিসাবে, হিন্দুধর্ম বিশ্বাসীদের মতে, প্রথম মানুষ মনু। নর্স পুরাণ অনুসারে, প্রথম মানব-মানবী আস্ক এবং এমব্লা। সেরকম গারো পুরাণে মানবগোষ্ঠীর আদি পিতা-মাতার নাম শানী এবং মুনি। তাতারা-রাবুগার আদেশে নন্তু-নপান্তুই প্রাচ্যের আমিতিং-আফিলজাং নামক স্থানে আদি মানব-মানবী শানী এবং মনিকে প্রেরণ করেন। এই প্রথম জুটি থেকেই জন্ম নেয় গানচেং এবং দুজং; দু’জনই বর্তমান গারো জাতির পূর্বপুরুষ।
তখনো পৃথিবীতে খাবার বলতে কিছু নেই। গাছের ফল, বনের পশু-পাখির মাংস খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো। নিজেদের প্রয়োজনেই জঙ্গল কেটে ভূমি চাষ করে থিতু হলো তারা। পৃথিবীতে প্রথম ভূমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করেছে বনজাসকো এবং তার স্ত্রী জানেগানদো। শিকারজীবন থেকে তারাই প্রথম কৃষি সভ্যতার সূচনা করে। দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কৃতজ্ঞতা হিসাবে উৎপাদিত ফসলের কিছু অংশ উৎসর্গ করে তাদের নামে। সেই থেকে জন্ম নেয় ধর্মচর্চার নতুন উদাহরণ।
সাংসারেক
গারোদের আদি ধর্মের নাম সাংসারেক। অনেক দেবতার মধ্যে প্রধানতমের নাম তাতারা রাবুগা। অবশ্য তার কমপক্ষে আরো আটটি নাম আছে; স্তুরা পান্তুরা, জিপজিনি জিপজানা, খরাদক-খুরাফিন, চানদাসি-গংগংরিগিপা, আজানজান বুলজানজান, সেফিরা-বলিরা, জামনকগিপা-জাংগিনি বিয়ামবি এবং বুলগিপা-ইমবাংগিপা। দেবদেবীদের সাধারণ অর্থে ডাকা হয় মিদ্দে বলে। মিদ্দেদের সন্তুষ্টির জন্য পূজা বা আমুয়া পালন করতে হয়। পালিত হয় ওয়ানগালার মতো উৎসব। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন একেকজন মিদ্দে। চোরাবুদি শষ্য রক্ষা করেন; সালজং উর্বরতার দেবতা, কালকামে মানুষ ও প্রাণের রক্ষক, সুসিমে ধনদেবী এবং নাওয়াং জীবন হরণকারী দেবতা।
তবে সময়ের ব্যবধানে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। বর্তমান গারোদের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। রোমান ক্যাথলিক, ব্যাপ্টিস্ট, প্রেসবিটারিয়ান প্রভৃতি খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের মিশনারি কর্মকাণ্ডে স্থানীয়রা ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়। লেখাপড়া, চিকিৎসা সেবা, উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গারো সমাজ পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক তাদের ধর্মান্তর। কয়েক হাজার বছর আগের সভ্যতা খোঁড়াখুঁড়ি করে পশ্চিমা বিশ্ব পুরাণ সংগ্রহ করে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়েও গারো পুরাণ যেন আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতোই-
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”