প্রাচীন পুরাণগুলো সবসময়ই অদৃষ্ট এবং ভবিষ্যদ্বাণীকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। অদৃষ্ট যে অলঙ্ঘনীয় তা প্রাচীন গ্রীক, মিসরীয় এমনকি আমাদের এই অঞ্চলের প্রাচীন পুরাণগুলোতে (বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য) পাওয়া যায় বিভিন্ন উপকথা বা মিথের মাধ্যমে। এমনই একটি গ্রীক ট্র্যাজেডি নিয়ে আজকের এই লেখা।
গ্রীক পুরাণ নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই আসে ডেলফির মন্দিরের কথা। অ্যাপোলোর এই মন্দিরের বিশেষত্ব এই যে, এই মন্দিরে ভবিষ্যতের খবর জানা যেত। ডেলফির অরাকল সব কিছুই জানে, মূলত প্রশ্নকর্তা ডেলফির অরাকলকে যে প্রশ্ন করবেন, তার উত্তর পাওয়া যেত মন্দিরের পুরোহিতদের মাধ্যমে। আজ থেকে হাজার বছর আগেও ডেলফির অরাকলের কাছে মানুষ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে যেত। এর ভগ্নাবশেষ আপনি আজও দেখতে পাবেন গ্রীসের পারনাসাস (Parnassus) নামক পর্বতে ।
গ্রীক পুরাণে কথিত আছে, এককালে দেবরাজ জিউস এই মন্দির স্থাপন করতে চাইলেন। গ্রীক পুরাণ অনুসারে, ধরিত্রী মাতা একজন দেবী, যার নাম গয়া (Gaia)। জিউস চাইলেন, তিনি মন্দির করবেন গয়ার নাভির ওপর। গয়ার নাভি খুঁজে বের করার জন্য তিনি একটি ঈগল পাঠালেন পূর্বে এবং একটি পশ্চিমে। ঈগল দুটির মিলনস্থল যেখানে সেখানেই ওম্ফালোশ বা গয়ার নাভি রয়েছে। ডেলফির এই মন্দিরের এই জায়গাটির নাম ছিল ক্রিসা, পরে এর নাম হয় পাঈথিয়া (আবার অনেকে বলেন পাইথো)। এই নামকরণের পেছনেও কিন্তু একটি মিথ আছে। পাইথন নামে এক বিশাল ড্রাগন নাকি পাহারা দিত এই মন্দিরের জায়গা অর্থাৎ গয়ার নাভিকে।
কিন্তু বিপদ বাধাল দানব পাইথন। সে কোনোভাবেই গয়ার নাভি ছেড়ে নড়বে না, শেষ পর্যন্ত জিউসের ছেলে সূর্য, সুর, সত্য এবং ভাগ্যের দেবতা অ্যাপোলো সরীসৃপটি হত্যা করেন ।
দানব পাইথনের নামানুসারে এর নাম হয়তো পাইথিয়া, আবার অনেকে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, পাইথস নামে সন্ন্যাসিনীদের নামানুসারে এর নাম পাইথিয়া। নামকরণ যেভাবেই হোক না কেন, গ্রীসের মানুষের কাছে এই মন্দিরের আলাদা একটা কদর সবসময় ছিল। আজ থেকে হাজার দুয়েক বছর আগেও গ্রীসের অধিবাসীরা নানা সমস্যা, ভবিষ্যত এবং প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে এই অরাকলের কাছে ছুটে যেত। সুতরাং এই ডেলফির মন্দির আর অরাকল নিয়ে নানাবিধ গল্পগাঁথা প্রচলিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
নিয়তি বিষয়ক সবচেয়ে করুণ কাহিনি বোধহয় রাজা লাইয়াস আর তার পুত্র ইডিপাসের। এই কাহিনীকে উপজীব্য করে নাটক লিখেছেন হোমার আর হিডিয়াসের মতো সাহিত্যিকেরা।
একসময় থিবেস নগরীতে বসবাস করতেন সেই অঞ্চলের রাজা লাইয়াস, তার রানী ছিল জোকাস্তা। দেবতাদের কৃপায় তাদের সুখের সীমা ছিল না। কিন্তু প্রত্যেক রূপকথার গল্পের মতো শুধু একটা সমস্যাই ছিল তাদের। কোনো সন্তান ছিল না লাইয়াসের। একসময় অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি এবং রানী ধরনা দেন ডেলফির অরাকলের কাছে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। ডেলফির অরাকলের বেশিরভাগ কথাই হেঁয়ালিপূর্ণ থাকত। মন্দিরের পুরোহিতরা এর বোধগম্য কোনো সমাধান দিয়ে দিতেন। দেলফির অরাকল রাজা লাইয়াসকে যা বলেছিল তার সারমর্ম হচ্ছে, রাজার অচিরেই এক পুত্রসন্তান জন্ম নেবে, কিন্তু রাজার উচিত হবে শিশুটিকে হত্যা করা। অন্যথায়, এই শিশু বড় হয়ে তার আপন বাবাকে হত্যা করে আপন মাকে বিবাহ করবে। ডেলফির ভবিষ্যদ্বাবাণী শুনে রাজা দুঃখে মুষড়ে পড়েন।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের কোল জুড়ে একটি পুত্র সন্তান এলো। ভবিষ্যৎবাণী সত্য হওয়ার আশঙ্কায় রাজা লাইয়াসের নির্দেশে তার পুত্রের গোড়ালিতে ছিদ্র করে একটি আংটা লাগানো হয়, যাতে শিশুটি হামাগুড়ি দিতে না পারে। পুত্রশোকে রানী জোকাস্তা পুত্রকে তুলে দিলেন পরিচারিকার হাতে পাহাড়ের উপত্যকার বনভূমিতে ফেলে আসার জন্য ।
পরিচারিকা শিশুটিকে দিয়ে দেয় ঐ পাহাড়ের এক মেষপালকের হাতে যেন সে বাচ্চাটিকে জঙ্গলে ফেলে আসে। পাহাড়টি ছিল থিবেস আর করিন্থ নামে দুই রাজ্যের সীমারেখায়, পাহাড়ের একপাশে থিবেস, অপরপাশে করিন্থ। মেষপালক ছেলেটির শিশুটির জন্য মায়া হয়। তিনি শেয়াল-শকুনের ছিঁড়ে খাবার জন্য না ফেলে পাহাড়ের অপরদিকের আরেক পরিচিত মেষপালকের কাছে শিশুটিকে দিয়ে দেন। মেষপালকের ধারণা ছিল, শিশুটি হয়তো করিন্থেই থেকে যাবে, কখনোই জানাজানি হবে না যে ছেলেটি থিবেসের রাজপুত্র।
এদিকে করিন্থের রাজা পলিবাস এবং রানী মেরপের কোনো সন্তান ছিল না। সৌভাগ্যজনকভাবে এই শিশুটিকে তারা দত্তক নেন এবং নাম দেন ইডিপাস। এবং আপন সন্তানের মতো লালন পালন করতে থাকেন। ইডিপাস শৌর্য-বীর্যে বলীয়ান হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে পার হয়ে যায় অনেকগুলো বছর। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। তারপর একদিন হঠাৎ করেই শুরু হয় গোলযোগ।
এক মদ্যপ ব্যক্তি কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ইডিপাসকে বলে ফেলে যে, সে রাজার আসল পুত্র নয়, বরং কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান। ইডিপাসের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তৎক্ষণাৎ সে তার পিতা-মাতাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে এবং আসল সত্য জানতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই তার পালক পিতা-মাতা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে মাতালের কথায় কান দিতে নেই, ইডিপাস তাদের আপন পুত্র। সেই সময়ে ইডিপাস আর কিছু না করলেও তার মনে একটা খটকা থেকেই যায় ।
ইডিপাসের মন কোনোভাবেই আর শান্ত হলো না। সে মনে করল, একমাত্র ডেলফির অরাকলের কাছেই সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে এবং উত্তর যা-ই হোক তার মানসিক অশান্তি দূর হবে। পিতা-মাতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডেলফির অরাকল তাকে সাবধান করে দিল যে, সে যেন কোনোভাবেই তার পিতা-মাতার মুখোমুখি না হয়, অন্যথায় তার হাতেই তার পিতার মৃত্যু লেখা, আর আপন মায়ের সাথে বিবাহবন্ধন।
ইডিপাসের মনে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, যেহেতু তার হাতে পিতার মৃত্যু লেখা, সুতরাং কোনোভাবেই করিন্থে ফেরা উচিৎ হবে না। সে ঠিক করল ডেলফির মন্দিরের কাছাকাছি শহর থিবেসে যাবে।
থিবেস যাবার পথে দাভিলা নামক স্থানে তিন রাস্তার একটি মোড় অতিক্রম করতে হয়। ইডিপাস এই রাস্তা অতিক্রম করার সময় একটি ঘোড়ার গাড়ির সাথে অসাবধানতাবশত ছোট একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ইডিপাসের সাথে চালকের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ইডিপাস রাজকুমার এবং করিন্থের সেরা যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম। অপরদিকে ঘোড়ার গাড়িটি চালাচ্ছিল আর কেউ না, স্বয়ং লাইয়াস, অত্র অঞ্চলের রাজা! ইডিপাসের স্পর্ধা দেখে তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। মামুলি দুর্ঘটনা থেকে এই ঝগড়া এমন একপর্যায়ে যায় যে, তারা একে অপরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান করে বসে। তারা কি আর জানতো যে পিতা-পুত্র মুখোমুখি হতে যাচ্ছে!
সে যা-ই হোক, ফলাফল তো আন্দাজ করেই ফেলেছেন! ইডিপাস রাজা লাইয়াসকে হত্যা করে। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সদ্য পালানো এক ক্রীতদাস।
রাজার মৃত্যুতে রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। কেউ জানে না রাজার হত্যাকারীর পরিচয়, আর কেনই বা সে রাজাকে হত্যা করল। তারা খুব আড়ম্বর করে রাজার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করল। রাজার অবর্তমানে শাসনকাজ পরিচালনা করছিল রানী এবং তার ভাই ক্রেওন। ক্রেওন ঘোষণা করে, স্ফিংক্সের মুখোমুখি হয়ে যে তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে সে হবে থিবেসের রাজা, এবং সেই সাথে রানী জোকাস্তার স্বামী।
স্ফিংক্স হচ্ছে সিংহের শরীর আর মানুষের মাথাওয়ালা এক দানব, যে থিবেসের প্রবেশপথ পাহারা দেয়। কোনো লোক ঐ পথে নগরে প্রবেশ করতে গেলেই মুখোমুখি হতে হয় স্ফিংক্সের। যে স্ফিংক্সের প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারে সে-ই ঢুকতে পারে নগরে, অন্যথায় তাকে মুখোমুখি হতে হয় মৃত্যুর। স্ফিংক্সের প্রশ্নগুলো ছিল অনেকটা ধাঁধার মতো। তার ধাঁধার ফাঁদে এর আগে অনেক জ্ঞানী, গুণী, যোদ্ধা, ক্রীতদাস আটকা পড়েছিল ।
ইডিপাস থিবেসে ঢোকার পথে মুখোমুখি হয় স্ফিংক্সের। স্ফিংক্স তাকে জিজ্ঞেস করে, “কোন সেই প্রাণী যা প্রত্যুষে চার পায়ে, মধ্যাহ্নে দু’পায়ে এবং অপরাহ্ণে তিন পায়ে হাঁটে?“
ইডিপাস উত্তরটা বুঝতে পেরেছিল, উত্তর দিয়েছিল- মানুষ। মানুষ শৈশবে চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে, যৌবনে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে, আর জীবন সায়াহ্নে তাকে লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হয়। উত্তর সঠিক হওয়ায় স্ফিংক্স তাকে থিবেসে প্রবেশ করতে দিল আর থিবেসের লোকদের কাছে ইডিপাস রাতারাতি নায়ক বনে গেল।
প্রতিজ্ঞা মোতাবেক রানী জোকাস্তার সাথে মহা ধুমধামের সাথে বিয়ে হয়ে গেল ইডিপাসের। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রানীর কোল জুড়ে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান জন্ম নিল। তার নাম রাখা হলো ইতিওক্লেস। আর কয়েক বছরের মাঝেই তাদের ঘর আলো করে আরও তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। এক পুত্র আর দুই কন্যা, পুত্রের নাম রাখা হলো পলিনিসেস আর কন্যাদের নাম যথাক্রমে ইস্মিন আর অ্যানটিগণ। ইডিপাস আর জোকাস্তা ছিল সুখী দম্পতি। ইডিপাসের দক্ষ পরিচালনায় রাজ্যের মানুষ সুখে ছিল । আর ইডিপাস সুখে ছিল এই ভেবে যে, সে তার পিতা করিন্থের রাজা পলিবাসকে হত্যা করেনি। যাক, ডেলফির ভবিষ্যদ্বাণী তাহলে এড়ানো গেল! কিন্তু সুখ চিরকাল স্থায়ী হয় না।
এসমস্ত অনাচার দেখে দেবতারা খুবই অসন্তুষ্ট ছিল। দেবতাদের অভিশাপে রাজ্যে নেমে এলো প্লেগ আর দুর্ভিক্ষ। কোনো ফসলই ফলাতে পারছিল না কৃষকেরা। শুধু মানুষ নয়, গৃহপালিত পশুগুলোও আক্রান্ত হচ্ছিল রোগে। এই দুঃখজনক ঘটনার সমাপ্তি ঘটাতে সব রকম পদক্ষেপই নেয়া হলো। যখন সব প্রচেষ্টাই বিফলে গেল, তখন ইডিপাসের আদেশে অরাকলের কাছে যাওয়া হলো পরিত্রাণের উপায় জানতে। অরাকল বলল, এই সমস্যার সমাধান নিহিত আছে রাজা লাইয়াসের মৃত্যুতে, রাজার মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত করা হলে দেবতাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ।
ইডিপাসের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অনুসন্ধান সম্পন্ন হতে থাকল। ইডিপাস তখনও জানত না যে, সে নিজেকেই হন্যে হয়ে খুঁজছে!
তদন্তের একপর্যায়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেই ক্রীতদাস সাক্ষ্য দিল- ঐদিন ইডিপাসই ছিল হত্যাকারী। ইডিপাস তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না সব। রানী জোকাস্তা কিন্তু তখন বুঝে ফেলেছিল যা বোঝার। ইডিপাসের গোড়ালি খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেই বুঝতে পারলো, এই সেই পুত্র যার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল তারা। জোকাস্তা নিজ কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে রইল। ইডিপাস কিন্তু তখনও এতটা নিশ্চিত ছিল না। সে অনুসন্ধান চালিয়েই যেতে থাকল। একপর্যায়ে মেষপালক দুজন এসে যখন সাক্ষ্য দিল তখন ইডিপাসেরও মেনে নেয়া ছাড়া উপায় রইল না।
গ্লানিতে জোকাস্তা আত্মহত্যা করল, আর হতাশায় ইডিপাস নিজের জামার পিন খুলে সেটি দিয়ে তার দুই চোখ কোটর থেকে টেনে বের করে আনল।
অন্ধ ইডিপাস জীবনের বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দেয় এথেন্সের অদূরে জনমানবহীন এক বনানীতে। সন্তানদের মধ্যে এ সময় সে পাশে পেয়েছিল শুধু তার কন্যা অ্যান্টিগণকে। এথেন্সের রাজা থিসিয়াস ইডিপাসের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহমর্মিতার হাত। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষটির শেষ সময়টা স্বস্তিতেই কেটেছিল। কিন্তু দুই পুত্রের প্রতি চরম মনঃক্ষুণ্ণ ছিল ইডিপাস। মাঝে মাঝেই তাদের অভিশাপ দিত পিতার প্রতি এমন অবহেলার কারণে। শেষপর্যন্ত সব দুঃখের অবসান ঘটিয়ে মারা যায় ইডিপাস।
এদিকে ইডিপাসের চলে যাবার কারণে ক্ষমতায় কে বসবে তা নিয়ে সমস্যা শুরু হয় দুই ভাই ইতিওক্লেস আর পলিনিসেস এর মধ্যে। শেষ পর্যন্ত রফা হয়- প্রতি বছর একজন করে বসবে সিংহাসনে। প্রথম দফা রাজা হলো ইতিওক্লেস। কিন্তু একবছর পর সে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাল। শুরু হলো দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়ী হলো না কেউই। দুই ভাই একে অপরের হাতে মারা গেল। সুযোগসন্ধানী ক্রেওন এই সুযোগে সিংহাসনে বসে পড়ল, আর পলিনিসেসকে বেইমান ঘোষণা করল। তার মৃতদেহ সৎকার না করে বরং হিংস্র শ্বাপদগুলো যাতে ছিড়ে খেতে পারে এজন্য বনে ফেলে দিতে বলল ক্রেওন। নিজের ভাইয়ের লাশের এই অবস্থা মেনে নিতে পারলো না অ্যান্টিগণ। মামা ক্রেওনের কাছে তার ভাইয়ের মৃতদেহের সৎকারের জন্য আকুল আবেদন জানাল। নিজের ভাগ্নির কান্না শোনা তো দূরে থাক, উল্টো ক্রেওন তাকে জীবন্তাবস্থায় অন্ধকার এক গুহায় আমৃত্যু আটকে রাখার আদেশ দিল, আর সাথে দিল মাত্র একদিন চলার মতো খাবার।
ক্রেওনের পুত্র হেমিওন কিন্তু প্রথম থেকেই তার পিতার অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ করছিলো। সেই ছোটবেলা থেকেই অ্যান্টিগণ ছিল তার বাগদত্তা, হবু বৌয়ের ওপর এহেন অনাচার এবং মৃত্যুদণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না সে।
ওদিকে আবার থিবেসে দেবতা অ্যাপোলোর পূজারি এক অন্ধ সাধু ছিলেন, যার নাম তিরেসিয়াস। তিনি ক্রেওনের দরবারে এসে তাকে তার এই অন্যায় কাজের জন্য দেবতাদের অসন্তুষ্টির কথা জানালেন।
দেবতাদের অসন্তুষ্টির কথা শুনে রাজার বোধোদয় হলো। কিন্তু তার পুত্র আর সে যখন অ্যান্টিগণকে উদ্ধার করতে গেল তখন শেষ হয়ে গেছে সব। এই দুনিয়ার এত অবিচার আর সহ্য করতে পারেনি অ্যান্টিগণ। অন্ধকারে তিলে তিলে মরার চেয়ে আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছে সে। নিজের ভালবাসার এত নির্দয় পরিণতি দেখে আর থাকতে পারল না হেমিওন। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিজ পিতাকে হত্যা করতে পারল না সে, প্রেমিকার মতো স্বেচ্ছামৃত্যুই বেছে নিল। এদিকে মা ইউরিদিস নিজের ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহত্যা করল। শেষপর্যন্ত রাজা ক্রেওন আবিষ্কার করল, তার সমস্ত পরিজন মৃত্যুবরণ করেছে।
আর এভাবেই ডেলফির অরাকল সত্য প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে দুঃখের পরিসমাপ্তি ঘটল। গ্রীকরা তাই বিশ্বাস করত, নিয়তির হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। উদাহরণ হিসেবে তারা রাজা লাইয়াসের ঘটনা বর্ণনা করত, কীভাবে শত চেষ্টা করেও রাজাকে নিয়তির কাছে পরাস্ত হতে হয়েছে।