জাপানি লোককথায় প্রেত পরিচিতি (পর্ব || ১)

হাজার বছর ধরে জাপানি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে ওনি এবং ইউরেই। ওনি হলো মানবসদৃশ অতিকায় আকৃতির শিংওয়ালা দানব। মিথে তাদের হাজির হতে দেখা যায় অনিষ্টকারী হিসেবে। পাপী ব্যক্তি মৃত্যুর পরে নির্দিষ্ট নরকে পতিত হলে ওনিতে পরিণত হয়। হয়ে ওঠে নরকের দেবতার মতোই হিংস্র আর নিষ্ঠুর। নরকে তাদের সংখ্যা বেশুমার। তবে দুনিয়ায় থাকতেই যারা পাপের ভারে সকল প্রকার ক্ষমার অযোগ্য হয়ে উঠেছে, তারা জীবিত অবস্থাতেই ওনিতে পরিণত হয়।

ইউরেইকে মোটাদাগে ভূত বলা যায়। জাপানি বিশ্বাসে মৃত্যুর পরে আত্মার প্রত্যাশিত গন্তব্য ইয়োমিনোকুনি। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথটা দুর্গম এবং যাত্রাটা কষ্টসাধ্য। তাই নিকটাত্মীয়দের কেউ মারা গেলে জীবিতদের নির্ধারিত আচার পালন করতে হয়। সাহায্য করতে হয় মৃতের আত্মার পরকালীন অভিযাত্রায়। সফল হলে মুক্তিপ্রাপ্ত আত্মা জীবিতদের জন্য সাহায্য ও সৌভাগ্য নিয়ে আসে। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করা কিংবা সঠিকভাবে শেষকৃত্য না পাওয়া আত্মাগুলোর দুনিয়াবি হিসেবে বাকি। তারা তাই ইহকাল ও পরকালের মধ্যে আটকে থাকে। সেই অতৃপ্ত আত্মাগুলোই পরিচিত ইউরেই নামে। বিভিন্ন সময়ে ওনি আর ইউরেই নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গল্প। এখন অব্দি সেই ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। 

কিয়োহিমে

সম্রাট তাইকো তখন শাসন করছেন। কি প্রদেশে আগমন করলেন এক সুদর্শন যাজক, আনচিন। প্রাদেশিক গভর্নরের কন্যা কিয়োহিমে তরুণ যাজকের প্রেমে পড়ে যায়। নারী হয়েও রাতের অন্ধকারে গোপনে দেখা করতে যেত সে। কিন্তু শীঘ্রই প্রতারণা করলো আনচিন। প্রেমার্ত কিয়োহিমেকে ফেলে রেখে চলে যাবার পথ ধরলো গোপনে। বেদনার্ত হয়ে পিছু নেয় কিয়োহিমে। দেরিতে হলেও ধরতে পারে প্রেমিককে।

প্রতারণার যন্ত্রণায় কিয়োহিমে পরিণত হয় ভয়াল সাপে; Image Source: yokaistreet.com

কিন্তু আনচিন তাকে ফিরে পেয়ে আনন্দিত না হয়ে মিথ্যা বলতে থাকে অবিরাম। প্রেমিকাকে স্থবির রেখে পালিয়ে যায়। আর সহ্য করতে পারে না কিয়োহিমে। প্রতারণার যন্ত্রণায় ক্রোধে দানবীয় সাপে রূপান্তরিত করে শরীর। মুখ দিয়ে বের হয় আগুন। ধাওয়া করে আনচিনকে। তরুণ যাজক নৌকায় নদী পার হয়ে যায়। মাঝিকে নিষেধ করে তার পিছু ধাওয়াকারিণীকে যেন নদী পার না করিয়ে দেয়। তাতে ফায়দা হয় না! কিয়োহিমে সাপের রূপেই নদী পার হয়। আনচিন সেই দানবমূর্তি প্রত্যক্ষ করে পাশের মন্দিরে অতিকায় ঘন্টার নিচে আত্মগোপন করে। দেখতে না পেলেও গায়ের গন্ধে ঠিক খুঁজে পায় কিয়োহিমে। ঘন্টাটা পেঁচিয়ে ধরে লেজ দিয়ে আঘাত করতে থাকে একের পরে এক। মুখ থেকে নিংড়ে দেয় আগুন। মৃত্যুবরণ করে আনচিন।

উকি-ওনা

অপূর্ব সুন্দরী উকি-ওনা বাস করে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ি অঞ্চলে। চোখের ইশারায় পথিককে বিভ্রান্ত করে দিতে পারে। শীতের ঝড় কিংবা তুষারপাতের সময় মানুষের হারিয়ে যাওয়ার কারণ তার দৃষ্টি। অবশ্য কখনো কখনো কোলে একটা শিশু নিয়ে হাজির হয়। হতভাগা পথিক তার কোল থেকে শিশুটাকে নেয়া মাত্রই বরফে পরিণত হয়ে যায়। হিংস্রতা যে নেই তা না। কখনো সরাসরি হামলে পড়ে জনপদে। ভেঙে চুড়ে দিয়ে যায় বাড়িঘর। হত্যা করে যায় ঘুমন্ত অধিবাসীকে। কখনো কেবল মেরেই তৃপ্ত। কখনো ভ্যাম্পায়ারের মতো বের করে নেয় শিকারের রক্ত। 

বরফ ও পাহাড়ি অঞ্চলে শিকারের অপেক্ষা করে উকি-ওনা; Image Source: youreperfect.studio

 

প্রাচীনকালে মিনোকিচি এবং মোসাকু নামের দুই কাঠুরে বসবাস করত। মিনোকিচি ছিল তরুণ আর মোসাকু খুবই বৃদ্ধ। এক শীতের দিনে তারা ঝড়ের কারণে ঘরে ফিরতে পারল না। জঙ্গলেই খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেলে পতিত কুড়েঘর। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেও দেরি হয় না। সন্ধ্যার দিকে মিনোকিচি চোখ খুলেই দেখে ভয়ানক কাণ্ড। সাদা পোশাক পরিহিত এক সুন্দরী তরুণী মোসাকুর উপর নিঃশ্বাস ফেলল। সাথে সাথে বরফে জমে মৃত্যুবরণ করল বৃদ্ধ। তরুণী এবার মিনোকিচির দিকে এগিয়ে আসে। কী ভেবে নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও থেমে যায়। বলে ওঠে, “বৃদ্ধের মতো তোমাকেও হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু তুমি তরুণ এবং সুদর্শন। বেঁচে থাকো। কিন্তু যদি কখনো আমার কথা কাউকে বলো, কেউ রক্ষা করতে পারবে না সেদিন।”  কয়েক বছর পরে মিনোকিচি ওয়ুকি নামের এক তরুণীকে বিয়ে করে। কয়েকটি সন্তান নিয়ে সুখেই কাটে দিনগুলো। কিন্তু দিন গড়ালেও তরুণীর বয়স বাড়ে না।

একদিন সন্তানেরা ঘুমিয়ে গেলে মিনোকিচি স্ত্রীকে ডাকে। বহু বছর আগে দেখা আজব ঘটনার কথা বলে। নেহায়েত স্বপ্ন ছিলো নাকি কোনো দানবী, সে জানে না। তবুও বলে সেই বরফে দেখা তরুণীর সাথে নিজের স্ত্রীর মিলের কথা। আর ওয়ুকি শুনেই দাঁড়িয়ে যায়। “আমিই সেই তরুণী। কিন্তু আমি তোমাকে সেই ঘটনা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও আমি তোমাকে খুন করলাম না। কেবল সন্তানগুলোর জন্য। তাদের দেখে রেখো।” এই বলে উধাও হয়ে যায় উকি-ওনা। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি।

শুতেন-তোজি

জাপানি লোককথায় শ্রেষ্ঠ তিনজন দানবের একজন শুতেন-তোজি। লাল শরীরটা তার পঞ্চাশ ‍ফুট লম্বা। পাঁচটা শিং এবং পনেরোটা চোখ নিয়ে এক ভয়াল মূর্তি। অবশ্য জন্ম থেকেই ওনি না। হাজার বছর আগে সে ছিল তোয়ামা অঞ্চলের শিশু। মা মানুষ আর বাবা ড্রাগন। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তার অস্বাভাবিক শক্তি আর অসম্ভব বুদ্ধিতে। মানুষ তাকে দেখে ক্রমশ দানবসন্তান বলে এড়িয়ে চলতে থাকে। বয়স ছয় বছর হলে নিজের মা অব্দি ত্যাগ করে তাকে। ইয়াতিম অবস্থা নিয়ে এক যাজকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বালক। সেখানেও তার অস্বাভাবিকতা সমবয়সীদের মাথাব্যথার কারণ হয়। ক্রমে মদে আসক্ত হয়ে পড়ে সে, সাধুদের জন্য যা নিষিদ্ধ। এই প্রবল আসক্তির কারণেই নাম হয়ে উঠে শুতেন-তোজি।

মদে প্রবল আসক্তির কারণে তার নাম শুতেন তোজি: Image Source: rabbitholemag.com

এক রাতে মন্দিরে উৎসব হচ্ছিল। শুতেন-তোজি প্রবেশ করে মদ্যপ অবস্থায়। ওনির মুখোশ পরে সমবয়সীদের ভয় দেখিয়ে মজা নিতে থাকে। কিন্তু রাত শেষে ভয়টা নিজের উপরেই চেপে বসে। হাজার টানাটানি করেও মুখোশটা খুলতে পারে না। লজ্জা, ভয় আর গুরু কর্তৃক অপমানিত হয়ে চলে যায় পাহাড়ে। সবার থেকে দূরে। লোকালয় থেকে মাঝে মাঝেই নিয়ে আসে খাবার আর মদ। ক্রমে একটা অপরাধী চক্র গড়ে ওঠে তাকে কেন্দ্র করে। শুতেন-তোজি নিজে রপ্ত করে কালজাদু এবং অলৌকিক বিদ্যা। শেখায় তার শিষ্যদের। আস্তে করে গোটা শিবিরটা পরিণত হয় ওনিতে। সুযোগ পেলেই হামলে পরে পথিক ও জনপদে। কুমারি নারীদের ধরে নিয়ে রক্ত পান করে। তার বহুদিন পরে মিনামোতোর নেতৃত্বে একদল নায়ক শুতেন-তোজির আস্তানা দখল করে এবং কালো যুগের অবসান ঘটায়।

ইয়ামায়ুবা

জাপানের পার্বত্য অঞ্চল এবং বনে থাকে বৃদ্ধা ডাইনি ইয়ামায়ুবা। আগে মানুষ থাকলেও পাপের ভারে দানবে পরিণত হয়। ইয়ামায়ুবা কিন্তু একজন ব্যক্তিকে বোঝায় না, বোঝায় বৃদ্ধাদের একটা শ্রেণিকে। মাথায় শিং ও লম্বা দাঁত থাকলেও সাধারণত তা প্রকাশ করে না। ইয়ামায়ুবা একা কোনো রাস্তার ধারে বসবাস করে। রাতের ব্যস্ত পথিকদের খাবার বা ঘুমের জন্য আশ্রয় দিতে চায়। গভীর রাতে অতিথি যখন ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে, তখনই সে সত্যিকার রূপে ফিরে আসে। তারপর মজা করে খায়। ইয়ামায়ুবার গল্পগুলো বেশিরভাগই বলা হতো অবাধ্য বাচ্চাদের রাতে ঘুম পাড়ানোর সময়। প্রচার করতো তারা, যারা কোনো কৌশলে তার হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে।

মানুষ সেজেই পথিকদের ফাঁদে ফেলে ইয়ামায়ুবা; Image Source: commons.wikimedia.org

যখন কোনো নারী বাজে কাজ করে জনপদ থেকে পালিয়ে যায়, বহু বছরের ব্যবধানে সে ইয়ামায়ুবায় পরিণত হয়। দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের সময় সাধারণত জীবনই টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বড় পরিবারের খাদ্য সমস্যা তখন প্রকট। বাধ্য হয়ে অনেকেই তাদের কনিষ্ঠ শিশুটি কিংবা বৃদ্ধজনকে জঙ্গলে ফেলে আসে, যেন বাকিরা বাঁচতে পারে। ফেলে আসা নারীরা ক্রোধে-ক্ষোভে পরিণত হয় দানবীতে। শরীর কুকড়ে যেতে থাকে, চুল সাদা আর মুখটা সরু হয়ে যায়। চর্চা করে জাদুবিদ্যা, খায় মানুষ।

উজি নো হাশিহিমে

রাজদরবারেরই এক সম্ভ্রান্ত রমণী হঠাৎ কিফুনের মন্দিরে ধ্যানে নিমগ্ন হলো। সাত দিনব্যাপী সে কী গভীর ধ্যান! ভেতরটা জ্বলছে হিংসা আর ঈর্ষায়। কেবল একটাই প্রার্থনা, শয়তানি শক্তি দেয়া হোক। প্রতিশোধ নিতে চায়। শত্রুদের উপর শক্ত প্রতিশোধ। কিফুনে মন্দিরের কামি তার উপাসনার একাগ্রতায় মুগ্ধ হলেন। শিখিয়ে দিলেন কিছু পদ্ধতি। উজি নদীতে গিয়ে টানা একুশ দিন ডুব দিতে হবে। মহিলা সেই কামির কথা মতো একটা নির্জন স্থান বেছে নিল। মাথার চুলগুলো বেঁধে পাঁচটা শিং বানাল। শরীরেজুড়ে সিঁদুর মেখে করলো লাল; যেমনটা দানব ওনিরা হয়ে থাকে। মাথায় তিনটা আর দাঁতে দুইটা বাতি বেঁধে অন্ধকারে ছুটে চললো নদীর দিকে। সে রাতে তাকে যে-ই দেখেছে, ওনি ভেবে আতঙ্কে মৃত্যুবরণ করেছে। কিফুনের কামির কথামতো একুশ দিন নদীর পানিতে ডুব দিয়ে থেকে তার আশা পূরণ হলো। পরিণত হলো জীবন্ত দানবীতে, নাম হাশিহিমে।

মূলত শত্রুদের প্রতিশোধ নিতেই ওনিতে পরিণত হন হাশিহিমে; Image Source: totaljapandemonium.com

ক্ষমতা পাবার পর হাশিহিমে প্রথমেই সেই শত্রুদের উপর প্রতিশোধ নিল। নারীদের সামনে হাজির হতো পুরুষ রূপে, আর পুরুষদের সামনে নারী রূপে। তামাম শহর তার ভয়ে তটস্থ। অনেক পরে ইয়োরিমিতসু আসেন চারজন সঙ্গী নিয়ে, তাদের মধ্যে বীর সুনাও ছিলেন। এই সুনাই কৌশলে হাশিহিমের আক্রোশ থেকে মানুষকে মুক্ত করে।    

সবিশেষ

লোকজ ধর্মগুলো অত বেশি যুক্তিনির্ভর হয় না। হতে পারে না। মানব চরিত্রের চিরন্তন দিক হলো আশা আর ভীতি। কিন্তু ভয় দিয়ে তো আর কৌতূহলকে দাবিয়ে রাখা যায় না। ফলে মানুষ অন্ধকার, বরফ ঝড়, পাহাড় কিংবা নদীতে অস্বাভাবিক মৃত্যুকে যেমন ভয় পেয়েছে; একইসাথে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে নিজস্ব জ্ঞানের আলোতে। একইসাথে প্রতিকায়িত হয়েছে তাদের ভীতি, আচার এবং চিন্তা। ফলে এই উপকথাই তাদের ধর্ম এবং বিজ্ঞান। রাতে হাঁটতে গিয়ে কিংবা বরফ ঝড়ে গুম হয়ে যাওয়া স্বজনদের কী হয়েছে, সেই উত্তরটা অন্তত সান্ত্বনা হিসেবে পাওয়া যায়। গুম হওয়ার যন্ত্রণা তো এই সময়েও অজানা না!

নিজেদের মাটিতে শিন্টোধর্মের বীজ। ভারত থেকে গেছে হিন্দু আর বৌদ্ধধর্মের বাতাস। চীনা সংস্কৃতির প্রবাহও থেমে থাকেনি। ফলে জাপান হয়ে উঠেছে অজস্র আর বিচিত্র সব অলৌকিক সত্তার সূতিকাগার। ধর্মীয় বাড়াবাড়িকে পাশ কাটিয়ে এই সহাবস্থানের ঐতিহ্য সত্যিই অবাক করার মতো।

Related Articles

Exit mobile version