জানুয়ারির ১ তারিখ, একটি পুরনো বছরের শেষ, একটি নতুন বছরের শুরু। এদিন একইসাথে পুরনো বছরের কাজের জন্য অনুতাপ সৃষ্টি করে, আবার নতুন বছরের সামনের দিনগুলো ভালো কাটানোর আশাবাদ তৈরি করে। যেমন হতে পারে গত বছর পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না করার আফসোস, আবার সামনের পরীক্ষাগুলোয় ভালো করার প্রত্যয় ও আশা নিয়ে নতুন বছর শুরু করা। ‘শুরু’ ও ‘শেষ’ এর রোমান দেবতা জেনাসের (Janus) নাম থেকেই যে মাসের উৎপত্তি, তার বৈশিষ্ট্য এমন হওয়াই স্বাভাবিক। প্রাচীন রোমে অবশ্য সে ‘ইয়েনাস (ianus)’ নামেই পরিচিত ছিল, কেননা প্রাচীন ল্যাটিন ভাষায় J অক্ষরটি ছিল না।
জেনাসকে নিয়ে রোমান পুরাণে বেশ কিছু ঘটনা আছে। সবগুলো একরকম না হলেও মূল বিষয় মোটামুটি এক। জেনাস শুধুমাত্র শুরু এবং শেষের দেবতাই নন, তার ক্ষেত্র বেশ বিস্তৃত। তাকে রূপান্তরের দেবতাও ধরা হয়, যিনি তত্ত্বাবধান করেন দরজা, পথ, গতি, এমনকি সময়েরও। রোমানরা বিশ্বাস করে, সৃষ্টির একদম শুরুতে ছিলেন জেনাস, পাহারা দিচ্ছিলেন স্বর্গের দ্বার।
ধারণা করা হয়, তার তত্ত্বাবধানে ধর্ম, জীবন, এমনকি অন্যান্য দেবতাদের সৃষ্টির ব্যাপারও ছিল। তাই অন্য সব দেবতার মধ্যে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। যে দেবতারই উপাসনা করা হোক না কেন, জেনাসের নাম প্রথমে নিয়েই উপাসনা শুরু হয়। জেনাসের কল্পিত প্রতিমূর্তিও তার বৈশিষ্ট্য বহন করে। জেনাসকে কল্পনা করা হয় দুই মুখমণ্ডলের সাথে, যার এক মুখ অতীতের দিকে, আরেক মুখ ভবিষ্যতের দিকে।
অতীত ও ভবিষ্যতের এই সংমিশ্রণের কারণেই মূলত জেনাসকে সময়ের দেবতাও বলা হয়। জেনাসকে নিয়ে প্রচলিত আছে কয়েক ধরনের মিথ। তার কিছু প্রাচীন ও আদি ল্যাটিন থেকে আগত, আর কিছু পরবর্তীতে গ্রিক পুরাণ-লেখকদের দ্বারা সৃষ্ট। এক মিথে বলা হয়, বনদেবী ক্রেনের সাথে জেনাসের সম্পর্কের কথা। ক্রেন বা কার্ডিয়া নামে পরিচিত এই দেবী তার প্রেমিকদের সাথে ছলনা করে পাহাড়ের গুহায় নিয়ে যেতেন, এরপর সেখানে বন্দী করেই পালিয়ে যেতেন। জেনাসের সাথেও একই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েন, জেনাসের দু’মুখো মাথার কারণে। পেছন দিকের চোখ দিয়ে দেখে ফেলেন জেনাস, আটকে ফেলেন কার্ডিয়াকে। পরবর্তীতে কার্ডিয়াকে বানান কবজার দেবী, তারও ছিল দুয়ার রক্ষার যাদুকরী ক্ষমতা।
আরেক গল্পে বলা হয়, জেনাস তার রাজ্য ল্যাটিয়াম (যার উপর পরে রোম গঠিত হয়) ক্যামিসের সাথে একসাথে শাসন করতেন। ক্যামিস ছিলেন দেবী ও তার অর্ধাঙ্গিনী। গ্রিক পৌরাণিকদের মতে, ক্যামিস ছিলেন জেনাসের বোন এবং একইসাথে তার স্ত্রী। তাদের পুত্র টাইবারিনাস। বলা হয়ে থাকে, টাইবারিনাস আলবুলা নদীতে বা তার কাছেই মৃত্যুবরণ করেন বলে তার নামানুসারে নদীর নাম হয় টাইবার।
তবে সবচেয়ে প্রচলিত মিথটির সাথে জড়িয়ে আছে রোম সৃষ্টির ঘটনা। যদিও রোম কীভাবে তৈরি হয়েছিল সে ব্যাপারে পুরাতত্ত্ববিদদের মত ভিন্নই হবে, কিন্তু প্রাচীন রোমানদের কাছে তাদের শহর সৃষ্টির ঘটনাগুলো উপকথা ও পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর। সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনী হলো রোমুলাস ও রেমাস নামে দুই যমজ ভাইয়ের। কথিত আছে, তাদের মা ছিল মধ্য ইতালির এক প্রাচীন শহর অ্যালবা লংগার রাজা নিউমিটরের কন্যা রিয়া সিলভিয়া আর পিতা ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের রোমান দেবতা মার্স, যিনি গ্রিকদের কাছে এরিস নামে পরিচিত।
কিন্তু জন্মের পরপরই নিউমিটরের ভাই আমুলিউস তাদেরকে হত্যা করার জন্য টাইবার নদীতে ফেলে দেয়। আমুলিউস তার ভাই নিউমিটরকে উৎখাত করে অ্যালবা লংগার সিংহাসন জোরপূর্বক দখল করে নেয়। পরবর্তীতে এক দৈববাণীতে আমুলিউস জানতে পারেন যে রোমুলাস-রেমাস দু’ভাই হবে তার পতনের কারণ। তাই পথের কাঁটা দূর করতে নবজাতকদের হত্যার আদেশ দেন আমুলিউস, যারা পরে বেঁচে যায় ভৃত্যদের দয়ায়। মায়া হয়েছিলো বলে এতটুকু বাচ্চাদের খুন করতে পারেনি ভৃত্যরা, ফেলে যায় টাইবারের ধারে। কথিত আছে, সেখান থেকে এক মাদী নেকড়ে দু’ভাইকে নিয়ে যায় এবং নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করতে থাকে।
তারা সেই নেকড়ের দুধ খেয়ে বড় হতে থাকে ‘লুপারকাল’ নামক গুহায়, যতদিন না ফস্টুলাস নামক এক মেষপালক খুঁজে পায় তাদের। বড় হয়ে রোমুলাস ও রেমাস, আমুলিউসকে উৎখাত করে এবং একটি নতুন শহর স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এই বিষয়ক কিছু মনোমালিন্য ও বিবাদের মধ্যে রোমুলাস হত্যা করে রেমাসকে এবং নিজের নামানুসারে নতুন শহরের নামকরণ করে ‘রোম’।
বলা হয়ে থাকে, রোমুলাসের আদেশে তার অনুচররা স্যাবিন নামক এক আদিবাসী গোষ্ঠীর এক নারীকে অপহরণ করতে গেলে জেনাস আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার এক ঝর্ণা সৃষ্টি করে তাদের বাধা দেয় এবং অপহরণকারীদের জ্বলন্ত লাভায় ডুবিয়ে হত্যা করে। আবার আরেক গল্পে বলা হয় স্যাবিন জাতিগোষ্ঠী রোম আক্রমণ করলে রোমের প্রবেশদ্বারে জ্বলন্ত লাভার ঝর্ণা সৃষ্টি করে জেনাস আক্রমণকারীদের রোমে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। রোমের দ্বিতীয় রাজা নুমা যিনি তার ধর্মানুরাগের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিল, কথিত সেই স্থানে একটি মন্দির তৈরি করে জেনাসকে উৎসর্গ করে।
মন্দিরের দুই পাশে দুটি ধনুকাকৃতি গেটের মধ্যে পরিবেষ্টিত চলাচলের একটি স্থান, যার মাঝ বরাবর জেনাসের একটি ব্রোঞ্জ-মূর্তি, যার দুই মুখ দুই দরজার দিকে ফেরানো। মন্দিরের দরজা দুটো যুদ্ধের সময় খুলে দেওয়া হতো, আর শান্তি ফিরে আসার পর বন্ধ করা হতো। যদিও দ্বিতীয় ঘটনা খুব কমই ঘটতো কেননা সেই সময়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। বলা হয়ে থাকে, নুমার রাজত্বে এই দরজা বেশ অনেক বছর ধরে বন্ধই ছিল, অর্থাৎ রাজ্যে শান্তি বিরাজ করছিল।
নুমার পর রাজা টুলুস হস্টিলিয়াস জেনাস মন্দিরের দ্বার খুলে দেন যখন তিনি অ্যালবা লংগার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যান। সেই দ্বার পরবর্তী ৪০০ বছর পর্যন্ত খোলা থাকে। সম্রাট অগাসটাস দাবি করেন তার সময়ে এ দ্বার তিনবার বন্ধ করা হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এমনটাই প্রতীয়মান করতে চেয়েছেন। এর পর সম্রাট নিরোর সময়ে শান্তির প্রতীক হিসেবে কিছু মুদ্রা তৈরি করা হয় যার উপর জেনাসের মন্দিরের বন্ধ দরজার ছাপ আঁকা ছিল। অর্থাৎ রাজ্যে কতটা শান্তি বিরাজ করছে, ঐ প্রতীক দিয়ে নিরো তাই বোঝাতে চেয়েছিলেন।
রোমানরা বিশ্বাস করে, জানুয়ারি মাসটা দেয়াল-পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন নুমা। জেনাসের মন্দিরে ১২টি বেদী তৈরির মাধ্যমে দিন-পঞ্জিকার সাথে জেনাসের সম্পর্ক আরও পোক্ত করেন নুমা, যার প্রতিটি বেদী বছরের এক একটি মাস নির্দেশ করে। কবি মার্শাল তাই জেনাসকে ‘বছরের আদি পিতা ও জনক’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
১৫৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে জানুয়ারির প্রথম দিনে প্রধান বিচারপতিরা তাদের কার্যালয়ের কাজ শুরু করতেন এবং সেই দিনটি শুরু হতো জেনাসের প্রতি প্রার্থনার মাধ্যমে। গমের সাথে লবণ ও বার্লি মিশিয়ে তৈরি ‘ইয়েনুয়াল’ নামক পিঠা জেনাসকে ভোগ দিত পূজারীরা। যেকোনো শুভকাজের শুরুতে, যেমন ফসল কাটা, শিশুর জন্ম, বিয়ে বা যেকোনো কাজ শুরু করার আগে রোমানরা জেনাসকেই স্মরণ করতো ও তার পূজা করতো।
সাধারণ বলিগুলোতেও জেনাস মুখ্য ভূমিকা পালন করতো। অন্য সব দেবদেবীর আগে জেনাসকে ধূপ-ধুনো ও মদ্য অর্পণ করা হতো। কারণ স্বর্গদ্বারের রক্ষক হবার দরুন জেনাসের মাধ্যমেই অন্য দেবতাদের কাছে পৌঁছাতে হবে, এমনটা মনে করা হতো। রোম সৃষ্টির শুরু থেকে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের উত্থান পর্যন্ত জেনাসের বেশ সরব উপস্থিতি ছিল রোমান ধর্ম ও সংস্কৃতিতে। শহরের দরজা থেকে শুরু করে রোমান মুদ্রা এমন অনেক জায়গাতেই জেনাসের দু’দিকে ফেরানো মুখের প্রতিকৃতির উপস্থিতিই প্রমাণ করে রোমান ধর্ম ও পুরাণে দেবতা হিসেবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তিনি।
ফিচার ইমেজ: greekmythology.com