যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে অর্জুনের হাতে ভগদত্ত নিহত হওয়ার পর শকুনির ভাই বৃষক ও অচলের নেতৃত্বে গান্ধারের সৈন্যরা অর্জুনকে আক্রমণ করেন এবং বৃষক অর্জুনের রথের সামনে ও অচল অর্জুনের রথের পিছনে অবস্থান নিয়ে অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে বৃষকের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয় এবং তার ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর অর্জুনের তীরে গান্ধারের ৫০০ সৈন্য নিহত হয়। ইতোমধ্যে বৃষক তার বিকল রথ থেকে নেমে তার ভাই অচলের রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে বৃষক ও অচল উভয়ে অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু শীঘ্রই অর্জুনের তীরের আঘাতে বৃষক ও অচল উভয়েই নিহত হন।
অর্জুনের হাতে বৃষক ও অচল নিহত হওয়ার পর দুর্যোধনের ভাইয়েরা অর্জুনের দিকে নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করেন। শকুনি অর্জুন ও কৃষ্ণকে বিভ্রান্তিতে ফেলার উদ্দেশ্যে ইন্দ্রজালের সাহায্য নেন এবং তার ইন্দ্রজালের ফলে নানা ধরনের প্রচুর সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র অর্জুনের ওপর পতিত হয়। কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে তার দিকে নিক্ষিপ্ত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রকে প্রতিহত করেন। এরপর শকুনির ইন্দ্রজালের ফলে সৃষ্ট বিপুল সংখ্যক হিংস্র প্রাণি অর্জুনকে আক্রমণ করার জন্য চতুর্দিক থেকে তার দিকে ছুটে আসে, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে সেগুলো নিহত হয়। এরপর শকুনির ইন্দ্রজালের ফলে চতুর্দিক ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে অর্জুনের রথকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং সেই অন্ধকারের ভিতর থেকে বিভিন্ন কর্কশ কণ্ঠস্বর অর্জুনের নিন্দা করতে থাকে। অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে এই ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে জ্যোতিষ্কাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং সেটির প্রভাবে শকুনির ইন্দ্রজালের ফলে সৃষ্ট অন্ধকার কেটে যায়।
এরপর শকুনির ইন্দ্রজালের ফলে ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় এবং সেটি অর্জুনের রথের দিকে অগ্রসর হয়। অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে এই ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে আদিত্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং সেটির প্রভাবে শকুনির ইন্দ্রজালের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস অদৃশ্য হয়ে যায়। এভাবে শকুনির সৃষ্ট নানাবিধ ইন্দ্রজাল ব্যর্থ করে দিয়ে অর্জুন শকুনির ওপর তীরবর্ষণ করেন এবং তার তীরে শকুনি আহত হন। এসময় শকুনি আতঙ্কিত হয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে অর্জুনের নিকট শকুনির পরাজয় ঘটে।
শকুনিকে পরাজিত করার পর অর্জুন কৌরব বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, যাদের একাংশ দ্রোণাচার্য যেদিকে অবস্থান করছিলেন সেদিকে এবং অপর অংশ দুর্যোধন যেদিকে অবস্থান করছিলেন সেদিকে পশ্চাৎপসরণ করে। অর্জুন কৌরব সৈন্যদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন এবং তার হাতে কৌরবদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সেসময় যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য এক অংশে দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যরা যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার চেষ্টা চালাচ্ছিল এবং যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। এসময় ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যূহ রক্ষার ক্ষেত্রে একটি ভুল করেন (তাদের এই ভুলের বিবরণ মহাভারতে দেয়া হয়নি) এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কৌরব সৈন্যরা পাণ্ডব ব্যূহে প্রবেশ করে রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ আরম্ভ করে। এসময় পাণ্ডব সৈন্যরা দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালায় এবং বিপরীতক্রমে কৌরব সৈন্যরা তাকে রক্ষা করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। দ্রোণাচার্যের তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং পাণ্ডব বাহিনী স্থানে স্থানে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যকে প্রতিহত করার জন্য তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
এসময় অশ্বত্থামা রাজা নীলের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। মহাভারতে প্রদত্ত বিবরণ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, অশ্বত্থামা ও নীলের মধ্যে তীব্র শত্রুতা ছিল এবং ইতিপূর্বে কুরুক্ষেত্রে সংঘটিত একটি দ্বৈরথে অশ্বত্থামা নীলকে পরাজিত করেছিলেন, কিন্তু এই শত্রুতার কারণ মহাভারতে উল্লেখ করা হয়নি। নীলের তীরের আঘাতে অশ্বত্থামা বিদ্ধ হন, কিন্তু শীঘ্রই অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে নীলের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। নীল একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং অশ্বত্থামার রথের দিকে ছুটে যান, কিন্তু তিনি অশ্বত্থামার রথ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। অশ্বত্থামার হাতে নীল নিহত হওয়ার পর পাণ্ডব সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
পাণ্ডব বাহিনীর দুরবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ভীম কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং রাজা বাহ্লিক ও কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা ও দুর্যোধন ভীমের ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং ভীম তাদের ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে সাত্যকি, নকুল ও সহদেবের নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা ভীমকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত শীর্ষ কৌরব যোদ্ধাদের আক্রমণ করেন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় এবং লড়াইয়ে উভয় পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দ্রোণাচার্যের তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়।
কর্ণ–অর্জুন দ্বৈরথ যুদ্ধ: ফলাফলবিহীন পরিসমাপ্তি
ইতোমধ্যে অর্জুন সংশপ্তকদের পরাজিত করে সেদিকে অগ্রসর হন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এসময় কৌরব সৈন্যরা তাদেরকে রক্ষা করার জন্য কর্ণকে আহ্বান জানাতে থাকে এবং কর্ণ তাদেরকে আশ্বস্ত করে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি মন্ত্র উচ্চারণ করে অর্জুনের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে সেটির বিরুদ্ধে বরুণাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাব নিঃশেষ হয়ে যায়। কর্ণ অর্জুনের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে কর্ণের তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং কর্ণের ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কর্ণ তীরের সাহায্যে অর্জুনের তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরে অর্জুন বিদ্ধ হন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে এটি ছিল কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যেকার প্রথম দ্বৈরথ যুদ্ধ। কিন্তু এটি পূর্ণ হয়নি। কারণ কর্ণের তীরে অর্জুন বিদ্ধ হওয়ার পরপরই ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং তাদের তীরে কর্ণ বিদ্ধ হন। এরপর অর্জুন, ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন একযোগে কর্ণের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে অর্জুনের তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরের আঘাতে ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে। ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রত্যেকেই কর্ণের দিকে একটি করে বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেগুলো কাটা পড়ে এবং এরপর কর্ণের তীরে অর্জুন বিদ্ধ হন।
এসময় কর্ণের তিন ভাই (কর্ণের পালকপিতা অধিরথের ছেলেরা) কর্ণকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে তারা সকলেই নিহত হন। একই সময়ে ভীম একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে কর্ণের রথের আশেপাশে থাকা ১৫ জন সৈন্যকে হত্যা করেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে চর্মবর্মা ও নিষাদ রাজ্যের রাজা বৃহৎক্ষত্রকে হত্যা করেন। এরপর ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষিপ্রগতিতে তাদের নিজ নিজ রথে আরোহণ করেন এবং ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলেই নতুন ধনুক উঠিয়ে কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। সাত্যকির তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং কর্ণ নিজেও বিদ্ধ হন।
এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য, দুর্যোধন ও জয়দ্রথের নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যরা কর্ণকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়। এসময় কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকির ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং সাত্যকিকে সহায়তা করার জন্য অর্জুন, অভিমন্যু, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল ও সহদেব সেদিকে অগ্রসর হন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং উভয় পক্ষেরই প্রচুর সৈন্য নিহত হয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু কোনো পক্ষই একে অপরের ওপর আধিপত্য লাভ করতে পারেনি। অবশেষে সূর্যাস্তের পর উভয় পক্ষ ধীরে ধীরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে।
কার্যত যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে কৌরব ও পাণ্ডবরা উভয়েই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সুতরাং ক্ষয়ক্ষতির ভিত্তিতে সেদিনের যুদ্ধের জয়–পরাজয় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সেদিনের যুদ্ধে কৌরবদের মূল লক্ষ্য ছিল যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা, কিন্তু দ্রোণাচার্য এই লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হন। এজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে কৌরবদের কৌশলগত পরাজয় ঘটে বলে ধরে নেয়া হয়।
যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিন: চক্রব্যূহে অভিমন্যুর প্রবেশ, জয়দ্রথের প্রতিরোধ এবং অভিমন্যুর বীরত্ব
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিন ভোরে দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার ক্ষেত্রে দ্রোণাচার্যের ব্যর্থতার জন্য তাকে দোষারোপ করেন। দ্রোণাচার্য এতে লজ্জিত হন এবং দুর্যোধনকে বলেন যে, তার এভাবে কথা বলা উচিত নয়। তিনি মন্তব্য করেন যে, অর্জুন যে বাহিনীকে রক্ষা করছেন সেটিকে পরাজিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অবশ্য তিনি দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সেদিনের যুদ্ধে তিনি পাণ্ডব বাহিনীর একজন শীর্ষ যোদ্ধাকে হত্যা করবেন এবং একটি সম্পূর্ণ অভেদ্য ব্যূহ গঠন করবেন। কিন্তু তিনি এটিও যোগ করেন যে, অর্জুনকে যেন বিগত দিনের মতো আবারো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
সেই মোতাবেক সংশপ্তকরা সেদিন আবারো যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ প্রান্তে সমবেত হয় এবং অর্জুনকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানায়। অর্জুন যথারীতি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সেদিকে যাত্রা করেন। অর্জুন ও সংশপ্তকদের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর দ্রোণাচার্য কৌরব সৈন্যদের নিয়ে ‘চক্রব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে একটি জটিল চক্রের আকারে সজ্জিত করেন। ভীমের নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনী কৌরব ব্যূহের দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু ব্যূহের ভিতর থেকে দ্রোণাচার্য পাণ্ডব বাহিনীর ওপর তীরবর্ষণ করেন এবং তার নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টির তোড়ে সমগ্র পাণ্ডব বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়।
এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে ডেকে জানান যে, অর্জুন ছাড়া তাদের মধ্যে আর কেউই চক্রব্যূহ ভেদ করার কৌশল জানেন না। তিনি অভিমন্যুকে কৌরব ব্যূহ ভাঙার জন্য বলেন। অভিমন্যু প্রত্যুত্তরে জানান যে, তিনি অর্জুনের কাছে চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল শিখেছেন, কিন্তু ব্যূহে প্রবেশের পর যদি তিনি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন, সেক্ষেত্রে তিনি ব্যূহ থেকে বের হতে পারবেন না, কারণ চক্রব্যূহ থেকে বের হওয়ার কৌশল তিনি শেখেননি। যুধিষ্ঠির ও ভীম অভিমন্যুকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তারা সকলেই ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবেন।
এরপর অভিমন্যুর নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনী পুনরায় কৌরব ব্যূহের দিকে অগ্রসর হয় এবং অভিমন্যু কৌরব ব্যূহের একটি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে ব্যূহ ভেদ করে একটি সৈন্যদলসহ সেটির ভিতরে ঢুকে পড়েন। পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা অভিমন্যুর পিছনেই ছিলেন, কিন্তু অভিমন্যু তার সৈন্যদল নিয়ে চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেও তারা ব্যূহটিতে প্রবেশ করতে পারেননি। কারণ অভিমন্যু কৌরব ব্যূহের যে স্থানটিতে আক্রমণ চালিয়ে ভাঙন ধরিয়েছিলেন, তিনি সসৈন্যে ব্যূহে প্রবেশের পরপরই জয়দ্রথ সেখানে উপস্থিত হন এবং ব্যূহটি আবার সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হয়। ভীম, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, যুধিষ্ঠির, দ্রুপদ, শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব, বিরাট, দৃষ্টকেতু, উপপাণ্ডবগণ, কৈকেয়ার পাঁচ রাজপুত্র ও অন্যান্য শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধা একযোগে জয়দ্রথকে আক্রমণ করেন, কিন্তু জয়দ্রথ একাকী তাদের সকলকে প্রতিহত করেন।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, পাণ্ডবদের বনবাসের সময় জয়দ্রথ পঞ্চপাণ্ডবের অনুপস্থিতিতে দ্রৌপদীকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি ভীমের নিকট পরাজিত হন এবং ক্ষিপ্ত ভীম শাস্তিস্বরূপ জয়দ্রথের মাথা মুণ্ডন করে দেন। এই অপমানে ক্রুদ্ধ হয়ে জয়দ্রথ দেবতা শিবের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন এবং তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাকে একটি বর প্রদান করেন। এই বরটি ছিল এরকম: অর্জুন ব্যতীত পঞ্চপাণ্ডবের কেউ জয়দ্রথকে পরাজিত করতে পারবেন না। এজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে প্রথম ১২ দিনের মধ্যে ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল বা সহদেব কখনো জয়দ্রথকে পরাজিত করতে পারেননি। অবশ্য অন্য কোনো পাণ্ডব যোদ্ধার বিরুদ্ধে জয়দ্রথের এই বর কার্যকরী ছিল না (যেমন: যুদ্ধের একাদশ দিনে জয়দ্রথ অভিমন্যুর কাছে পরাজিত হন)।
চক্রব্যূহের প্রবেশমুখে জয়দ্রথ একাকী পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাদের সকলেই জয়দ্রথের তীরে বিদ্ধ হন। যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে জয়দ্রথের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু জয়দ্রথ ক্ষিপ্রগতিতে আরেকটি ধনুক উঠিয়ে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদেরকে আবার তীরবিদ্ধ করেন। এরপর ভীমের তীরের আঘাতে জয়দ্রথের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে, কিন্তু জয়দ্রথ ক্ষিপ্রগতিতে আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন। জয়দ্রথের তীরের আঘাতে ভীমের রথের ঝাণ্ডা ও তার ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। ভীম তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সাত্যকির রথে আরোহণ করেন। জয়দ্রথের নিকট ভীমের পরাজয়ের পর অন্যান্য শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারা জয়দ্রথকে পরাজিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের কেউই সফল হতে পারেননি। এর ফলে অভিমন্যু কার্যত তার সৈন্যদলসহ চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে আটকা পড়ে যান।
এদিকে অভিমন্যু ও তার সৈন্যদলের চক্রব্যূহে প্রবেশের পরপরই কৌরব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু অভিমন্যুর তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে। কার্যত চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে অভিমন্যু বিশেষ রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেন এবং যারাই তার সম্মুখীন হচ্ছিল তারাই পরাজিত ও নিহত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই অভিমন্যুর দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু তিনি বিপদগ্রস্ত হতে পারেন এই আশঙ্কায় দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বে কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য, কৃতবর্মা, বৃষসেন, কৃপাচার্য, শকুনি, পৌরব, বৃহদ্বল, শাল ও ভুরি একযোগে অভিমন্যুর ওপর তীরবর্ষণ করেন এবং অভিমন্যু যাতে দুর্যোধনকে আক্রমণ করতে না পারেন সেটি নিশ্চিত করেন।
অভিমন্যু উক্ত যোদ্ধাদের ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এরপর উক্ত যোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে অভিমন্যুকে ঘিরে ফেলেন। দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, কৃতবর্মা, শল্য, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি, বিবিংশতি ও দুঃসহ একযোগে অভিমন্যুকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে অভিমন্যু তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর তিনি আসমকের রাজার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং শীঘ্রই তার তীরের আঘাতে আসমকের রাজা নিহত হন। আসমকের রাজার মৃত্যুর পর তার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এরপর দ্রোণাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, বৃষসেন, শকুনি, সোমদত্ত, বিবিংশতি, শাল, ক্রথ, সুসেন, কুণ্ডভেদী, প্রতর্দন, বৃন্দারক, লালিত্য, প্রবাহু ও দীর্ঘলোচন একযোগে অভিমন্যুর ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, এবং অভিমন্যু তাদের সকলের বিরুদ্ধে পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
অভিমন্যুর তীর কর্ণের বর্ম ও শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায় এবং তার তীরের আঘাতে সুসেন, দীর্ঘলোচন ও কুণ্ডভেদী নিহত হন। এরপর কর্ণ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা অভিমন্যুর ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং অভিমন্যু তীরবিদ্ধ হন। তীরবিদ্ধ হয়ে ক্ষিপ্ত অভিমন্যু শল্যকে আক্রমণ করেন এবং তার তীরের আঘাতে শল্য সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথে বসে পড়েন। শল্যের অবস্থা দেখে কৌরব সৈন্যরা আতঙ্কিত হয় এবং পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় শল্যের ছোট ভাইয়ের নেতৃত্বে মদ্রের সৈন্যরা অভিমন্যুকে আক্রমণ করে, কিন্তু শীঘ্রই অভিমন্যুর তীরের আঘাতে শল্যের ভাই নিহত হন এবং এতে আতঙ্কিত হয়ে মদ্রের সৈন্যদের একাংশ পশ্চাৎপসরণ করে। মদ্রের সৈন্যদের আরেক অংশ ক্ষিপ্ত হয়ে একযোগে অভিমন্যুকে আক্রমণ করে, কিন্তু অভিমন্যুর তীরে তাদের সিংহভাগই নিহত হয়।
অভিমন্যুর রণকুশলতা দেখে দ্রোণাচার্য খুশি হন (যেহেতু অভিমন্যু ছিলেন দ্রোণাচার্যের প্রিয় ছাত্র অর্জুনের ছেলে) এবং কৃপাচার্যের কাছে তার প্রশংসা করেন। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে দুর্যোধন কর্ণ, শল্য, দুঃশাসন, বাহ্লিক ও অন্যান্য শীর্ষ কৌরব যোদ্ধাদের কাছে মন্তব্য করেন যে, দ্রোণাচার্য ইচ্ছাকৃতভাবে অভিমন্যুকে রক্ষা করছেন। তার বক্তব্য শুনে দুঃশাসন অভিমন্যুর দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর অভিমন্যুর তীরের আঘাতে দুঃশাসন সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথে বসে পড়েন এবং রথটির সারথি দুঃশাসনকে সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কর্ণ–অভিমন্যু দ্বৈরথ যুদ্ধ: অভিমন্যুর নিকট কর্ণের পরাজয়
অভিমন্যুর নিকট দুঃশাসনের পরাজয়ের পর কর্ণ অভিমন্যুর দিকে অগ্রসর হন এবং অভিমন্যু ও তার সঙ্গে থাকা সৈন্যদলের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কর্ণের তীরে অভিমন্যুর সৈন্যদল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কর্ণ ও অভিমন্যু একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং উভয়েই ক্ষতবিক্ষত হন। এরপর অভিমন্যুর তীরের আঘাতে কর্ণের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং তার রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। কর্ণের তীরে অভিমন্যু আবার বিদ্ধ হন, কিন্তু তার তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে।
এমতাবস্থায় কর্ণের ভাই (কর্ণের পালকপিতা অধিরথের এক ছেলে) কর্ণকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং অভিমন্যুকে আক্রমণ করেন। তার তীরে অভিমন্যু বিদ্ধ হন, কিন্তু শীঘ্রই অভিমন্যুর তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। এরপর অভিমন্যু নিরস্ত্র কর্ণের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং আহত অবস্থায় কর্ণ সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। অর্থাৎ, অভিমন্যুর নিকট কর্ণ পরাজিত হন। কর্ণকে পরাজিত করার পর অভিমন্যু কৌরব সৈন্যদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এদিকে এসময় পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা জয়দ্রথের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, কিন্তু জয়দ্রথকে পরাজিত করে চক্রব্যূহে প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। অর্থাৎ, অভিমন্যু কার্যত চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে বন্দি হয়ে পড়েন।