দুর্যোধন–অর্জুন যুদ্ধ: অর্জুনের বুদ্ধিমত্তার নিকট দৈব বর্মের পরাজয়
বিন্দ ও অনুবিন্দের নেতৃত্বাধীন অবন্তীর সৈন্যদলকে পরাজিত করে এবং নিজের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম প্রদান করে অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে কৌরব ব্যূহকে ভেদ করে জয়দ্রথের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তার পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে দুর্যোধন অর্জুনের কাছাকাছি উপস্থিত হন এবং দুর্যোধনের রথ অর্জুনের রথকে অতিক্রম করে অর্জুনকে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে অবস্থান গ্রহণ করে। কৃষ্ণ দুর্যোধনকে হত্যা করার জন্য অর্জুনকে বলেন এবং এসময় দুর্যোধন অর্জুনকে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানান। দুর্যোধনের আহ্বান শুনে অর্জুন ও কৃষ্ণ শঙ্খধ্বনি করেন এবং এরপর দুর্যোধন ও অর্জুনের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
দুর্যোধন অর্জুন, কৃষ্ণ ও অর্জুনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে কৃষ্ণের হাতে থাকা চাবুক (রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে চালনা করতে যেটিকে ব্যবহার করা হতো) কাটা পড়ে। প্রত্যুত্তরে অর্জুন দুর্যোধনের দিকে তীরবর্ষণ করেন, কিন্তু দুর্যোধন দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রদত্ত দৈব বর্ম পরিহিত অবস্থায় ছিলেন এবং উক্ত বর্মটি অর্জুন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করে। এরপর অর্জুন আবার দুর্যোধনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু আবারো উক্ত বর্মটি অর্জুন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করে। অর্জুন দুর্যোধনের বর্ম দেখেই সেটিকে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি আগে থেকেই এই বর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং এই বর্মকে ভেদ করার একটি অস্ত্র তার কাছে ছিল। দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনকে এই অস্ত্র দিয়েছিলেন।
অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে দুর্যোধনের বর্ম ভেদ করার উদ্দেশ্যে উক্ত দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু এটি দেখে অশ্বত্থামা দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করে উক্ত দিব্যাস্ত্রটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেন। অর্জুনের পক্ষে উক্ত দিব্যাস্ত্রটি দ্বিতীয় বারের মতো ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না, কারণ এই দিব্যাস্ত্র ব্যবহারের নিয়ম অনুযায়ী, সেটিকে কেবল একবারই ব্যবহার করা যেত এবং কেউ এটি দ্বিতীয় বার ব্যবহারের চেষ্টা করলে দিব্যাস্ত্রটি ব্যবহারকারীকেই হত্যা করতো। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের শরীরের ঊর্ধ্বাংশের কোনো অংশ উক্ত বর্ম দ্বারা অনাবৃত আছে কিনা, অর্জুন সেটি লক্ষ্য করেন। কিন্তু তিনি দেখতে পান যে, দুর্যোধনের শরীরের ঊর্ধ্বাংশের পুরোটাই উক্ত বর্ম দ্বারা আবৃত। এদিকে অর্জুনের দিব্যাস্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর দুর্যোধন অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং উভয়ের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন।
এরপর ক্রুদ্ধ অর্জুনের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির দুই পার্শ্বনী সারথি নিহত হয়। অর্জুনের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক ও তার দুই হাতের আঙুলগুলোকে সুরক্ষিত রাখা চামড়ার বেষ্টনী কাটা পড়ে। দুর্যোধন তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং অর্জুন তীর নিক্ষেপ করে দুর্যোধনের বিকল রথটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন। এরপর অর্জুনের তীরে দুর্যোধনের দুই হাতের তালু বিদ্ধ হয়। এমতাবস্থায় কৌরব সৈন্যরা দুর্যোধনকে সহায়তা করার জন্য চতুর্দিক থেকে অর্জুনের ওপর আক্রমণ চালায় এবং দুর্যোধনকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে দুর্যোধন দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রদত্ত দৈব বর্মের দ্বারা সুরক্ষিত হওয়ার পরেও অর্জুনের নিকট পরাজিত হন।
কৌরব ব্যূহের শেষ প্রান্তে অর্জুন: শীর্ষ কৌরব যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই
অর্জুনের নিকট দুর্যোধনের পরাজয়ের পর অর্জুন তার ওপর আক্রমণকারী কৌরব সৈন্যদের ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। কৌরব বাহিনীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতে অর্জুন কৌরব ব্যূহের শেষ প্রান্তের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হন, যেখান জয়দ্রথ অবস্থান করছিলেন। অর্জুনকে দেখতে পেয়ে কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, কৃপাচার্য, শল্য, বৃষসেন, শাল ও জয়দ্রথ দূর থেকে একযোগে অর্জুনের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অশ্বত্থামা কৃষ্ণ, অর্জুন ও অর্জুনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে অর্জুন অশ্বত্থামাকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর অর্জুন কর্ণ ও বৃষসেনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে শল্যের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু শল্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, জয়দ্রথ, কৃপাচার্য, শল্য ও বৃষসেন একযোগে অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অশ্বত্থামা আবার অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন।
এরপর অর্জুন কর্ণ ও বৃষসেনকে তীরবিদ্ধ করেন, তার তীরের আঘাতে শল্যের ধনুক কাটা পড়ে এবং তিনি ভুরিশ্রবা, শল্য, কৃপাচার্য, জয়দ্রথ ও অশ্বত্থামাকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর ভুরিশ্রবার তীরের আঘাতে কৃষ্ণের হাতে থাকা চাবুক কাটা পড়ে এবং ভুরিশ্রবা অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর অর্জুন উক্ত আট কৌরব রথীকে তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন এবং তারাও তীরের আঘাতে অর্জুনকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। উক্ত আট কৌরব রথীর মধ্যে জয়দ্রথ ছিলেন বটে, কিন্তু অর্জুনের পক্ষে তাকে হত্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ অর্জুন দূর থেকে উক্ত কৌরব রথীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন এবং বাকি কৌরব রথীরা পূর্ণ শক্তি দিয়ে জয়দ্রথকে রক্ষা করছিলেন। শীঘ্রই কৌরব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে অর্জুনের ওপর আক্রমণ চালায় এবং জয়দ্রথকে আক্রমণ করার পরিবর্তে অর্জুনকে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়।
দ্রোণাচার্য–যুধিষ্ঠির যুদ্ধ: দ্রোণাচার্যের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি
এদিকে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের কাছে দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বাধীন কৌরব সৈন্যদের সঙ্গে পাণ্ডব বাহিনীর তীব্র যুদ্ধ চলছিল এবং উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধারা একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। দ্রোণাচার্য ও যুধিষ্ঠির পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে ও দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির তীরের সাহায্যে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু যুধিষ্ঠির আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। দ্রোণাচার্য আবার যুধিষ্ঠিরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির তীরের সাহায্যে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন।
দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রয়োগকৃত ব্রহ্মাস্ত্র যুধিষ্ঠির কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বিশেষ তীরটিকে ভস্ম করে দিয়ে যুধিষ্ঠিরের রথের দিকে ধাবিত হয়, কিন্তু যুধিষ্ঠির মন্ত্র উচ্চারণ করে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য পাল্টা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে উক্ত ব্রহ্মাস্ত্র দুইটি একে অপরের প্রভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এরপর যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে। দ্রোণাচার্য একটি গদা হাতে নিয়ে সেটিকে ক্ষিপ্রগতিতে যুধিষ্ঠিরের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু এটি দেখে যুধিষ্ঠিরও একটি গদা উঠিয়ে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদার দিকে নিক্ষেপ করেন এবং গদা দুইটি মাঝ আকাশে একে অপরকে তীব্র বেগে আঘাত করে মাটিতে পড়ে যায়।
এরপর দ্রোণাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং যুধিষ্ঠিরের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে তীরবিদ্ধ করেন এবং যুধিষ্ঠির তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে তাকে বন্দি করার উদ্দেশ্যে তার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু যুধিষ্ঠির ক্ষিপ্রগতিতে সেখান থেকে সরে গিয়ে সহদেবের রথে আরোহণ করেন এবং পশ্চাৎপসরণ করেন। এভাবে দ্রোণাচার্যের নিকট যুধিষ্ঠির পরাজিত হন, কিন্তু দ্রোণাচার্য তাকে আবারো বন্দি করতে ব্যর্থ হন।
কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখে শীর্ষ কৌরব ও পাণ্ডব যোদ্ধাদের লড়াই
কৌরব রথী ক্ষেমাধুর্তি কৈকেয়া রাজ্যের রাজা বৃহৎক্ষত্রের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং একে অপরকে তীরবিদ্ধ করেন। ক্ষেমাধুর্তির তীরের আঘাতে বৃহৎক্ষত্রের ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর ক্ষেমাধুর্তি বৃহৎক্ষত্রকে তীরবিদ্ধ করেন। কিন্তু বৃহৎক্ষত্র আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ক্ষেমাধুর্তির ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। বৃহৎক্ষত্রের তীরের আঘাতে ক্ষেমাধুর্তির রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং এরপর ক্ষেমাধুর্তি নিজেও নিহত হন। বৃহৎক্ষত্রের হাতে ক্ষেমাধুর্তি নিহত হওয়ার পর বৃহৎক্ষত্র বিপুল উদ্যমে কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
ত্রিগার্তা রাজ্যের রথী বীরধনবান চেদি রাজ্যের রাজা দৃষ্টকেতুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর বীরধনবানের তীরের আঘাতে দৃষ্টকেতুর ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু দৃষ্টকেতু একটি বিশেষ তীর উঠিয়ে সেটিকে বীরধনবানের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে বীরধনবান নিহত হন। দৃষ্টকেতুর হাতে বীরধনবান নিহত হওয়ার পর বীরধনবানের অধীনস্থ সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।
দুর্যোধনের ভাই দুর্মুখ সহদেবের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং উভয়ে একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। শীঘ্রই সহদেবের তীরের আঘাতে দুর্মুখের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে, রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং দুর্মুখের ধনুক কাটা পড়ে। এরপর সহদেব দুর্মুখকে তীরবিদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় দুর্মুখ তার বিকল রথ থেকে ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে নেমে ত্রিগার্তা রাজ্যের রাজপুত্র নীরমিত্রের রথে আরোহণ করেন, কিন্তু সহদেবের তীরের আঘাতে নীরমিত্র নিহত হন। এদিকে দুর্যোধনের আরেক ভাই বিকর্ণ নকুলের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু অতি শীঘ্রই তিনি নকুলের নিকট পরাজিত হন এবং সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। মগধ রাজ্যের রাজপুত্র ব্যাঘ্রদত্ত সাত্যকির বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই তিনি সাত্যকির হাতে নিহত হন। বাহ্লিক রাজ্যের রাজপুত্র শাল উপপাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু তীব্র যুদ্ধের পর তিনি উপপাণ্ডবদের হাতে নিহত হন।
রাক্ষস অলম্বুশের বিরুদ্ধে ভীম, ঘটোৎকচ ও অন্যান্য পাণ্ডব যোদ্ধাদের লড়াই
রাক্ষস অলম্বুশ ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অলম্বুশ ও ভীম একে অপরকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অলম্বুশের তীরের আঘাতে ভীমের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদলের ৪৩০ জন রথী নিহত হয়। এরপর অলম্বুশের তীরের আঘাতে ভীম সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তার রথের ওপর বসে পড়েন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি সংজ্ঞা ফিরে পান এবং তার তীরের আঘাতে অলম্বুশ ক্ষতবিক্ষত হন। এরপর অলম্বুশ ইন্দ্রজালের সাহায্যে অদৃশ্য হয়ে যান এবং সেই অবস্থায় ভীমের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কিন্তু ভীম চতুর্দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং তার নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টির তোড়ে অলম্বুশ শীঘ্রই নিজের রূপে ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু অলম্বুশ আবারো ইন্দ্রজালের সাহায্যে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে শুরু করেন।
কখনো তিনি বিরাট আকৃতি ধারণ করেন, আবার কখনো ভূগর্ভে প্রবেশ করেন, আবার কখনো অতি ক্ষুদ্র আকৃতি ধারণ করে আকাশে উড়তে শুরু করেন। এসময় তার সৃষ্ট ইন্দ্রজালের ফলে বিভিন্ন ধরনের বিপুল সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র আকাশ থেকে পাণ্ডব সৈন্যদের ওপর পতিত হতে শুরু করে এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় ভীম মন্ত্র উচ্চারণ করে অলম্বুশের ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে ৎভাশত্রাস্ত্র প্রয়োগ করেন। উক্ত দিব্যাস্ত্রের প্রভাবে অলম্বুশের সৃষ্ট ইন্দ্রজাল ধ্বংস হয়ে যায় এবং অলম্বুশের শরীরের প্রতিটি অংশ তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এরপর অলম্বুশ সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে ভীমের নিকট রাক্ষস অলম্বুশের পরাজয় ঘটে।
এদিকে ভীমের কাছে পরাজিত হওয়ার পর অলম্বুশ যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক অংশে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তার হাতে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে রাক্ষস ঘটোৎকচ অলম্বুশের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং উভয়ের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়। ঘটোৎকচ ও অলম্বুশ পরস্পরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং এরপর ইন্দ্রজাল ব্যবহার করে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। অলম্বুশের সৃষ্ট ইন্দ্রজালের ফলে ঘটোৎকচের সৃষ্ট সমস্ত ইন্দ্রজাল ধ্বংস হয়ে যায়। এটি দেখে ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব ও উপপাণ্ডবগণ ঘটোৎকচকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং ঘটোৎকচের সঙ্গে মিলে একযোগে অলম্বুশের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। অলম্বুশ তাদের সকলের ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন, কিন্তু তাদের তীরের আঘাতে তিনি ক্ষতবিক্ষত হন এবং হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ঘটোৎকচ তার রথ থেকে উড়ে গিয়ে অলম্বুশের রথে আরোহণ করেন এবং অলম্বুশের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করেন।
উল্লেখ্য, মহাভারতের বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অলম্বুশ নামের দুইজন রাক্ষস কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে এক অলম্বুশ অর্জুনের ছেলে ইরাবানকে পরাজিত ও নিহত করেন, কিন্তু অর্জুন, সাত্যকি ও অভিমন্যুর কাছে পরাজিত হন এবং অবশেষে যুদ্ধের চতুর্দশ রাতে ঘটোৎকচের হাতে নিহত হন। অন্য অলম্বুশ ছিলেন ইতিপূর্বে ভীমের হাতে নিহত রাক্ষস বকের ভাই। যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে তিনি ভীমের নিকট পরাজিত হন এবং এরপর ঘটোৎকচ ও পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে নিহত হন। এই দুইজনের বাইরে কৌরব বাহিনীতে অলম্বুশ নামে আরো একজন রথী ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন মানুষ। তিনি যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে সাত্যকির হাতে নিহত হন।
কৌরব ব্যূহে সাত্যকির অনুপ্রবেশ: দ্রোণাচার্য ও কৃতবর্মার বিরুদ্ধে সাত্যকির লড়াই
এসময় সাত্যকি দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তারা আবার পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য ও সাত্যকি একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন, কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীব্র তীরবৃষ্টির ফলে সাত্যকি ক্ষতবিক্ষত হন এবং হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের নেতৃত্বে পাণ্ডব সৈন্যরা একযোগে দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করে এবং সাত্যকিকে দ্রোণাচার্যের হাত থেকে রক্ষা করে। সাত্যকি সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন এবং দ্রোণাচার্যের নিকট সাত্যকির পরাজয়ের পর দ্রোণাচার্য অগ্রসরমান পাণ্ডব বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। দ্রোণাচার্যের তীরে পাঞ্চালের ২৫ জন ও কৈকেয়ার ১০০ জন শীর্ষ রথী নিহত হয় এবং এরপর পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য দ্রোণাচার্যের হাতে নিহত হয়।
এদিকে অর্জুন সেদিন ভোরে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন এবং এরপর থেকে পাণ্ডবরা তার আর কোনো খবর পাননি। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং অর্জুনের খোঁজ নেয়ার জন্য সাত্যকিকে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশের নির্দেশ দেন। অর্জুন কৌরব ব্যূহে প্রবেশের আগে যুধিষ্ঠির যাতে কৌরবদের হাতে বন্দি না হন সেটি নিশ্চিত করার জন্য সাত্যকিকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ উপেক্ষা করা সাত্যকির পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য সাত্যকি ভীমের ওপর যুধিষ্ঠিরকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের নেতৃত্বে পাণ্ডব সৈন্যরা কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখে থাকা সৈন্যদলের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, যাতে সাত্যকির পক্ষে কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করা সহজ হয়।
সাত্যকি কৌরব সৈন্যদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে বাধা প্রদানের জন্য দ্রোণাচার্য তার দিকে অগ্রসর হন। সাত্যকি দ্রোণাচার্যকে উপেক্ষা করে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্য তাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এর ফলে উভয়ের মধ্যে আবারো দ্বৈরথ যুদ্ধ আরম্ভ হয়। দ্রোণাচার্য ও সাত্যকি একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। দ্রোণাচার্য সাত্যকির উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমার গুরু (অর্জুন) ভীরুর মতো আমার সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে চলে গেছে। তুমিও যদি তোমার গুরুর মতো আমার সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে না যাও, তাহলে তুমি আজকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না!” প্রত্যুত্তরে সাত্যকি বলেন, “শিষ্যের সবসময় উচিত গুরুর দেখানো পথ অনুসরণ করা। আমি সেই পথই অনুসরণ করব যেটি আমার গুরু অনুসরণ করেছেন!”
এই বলে সাত্যকি দ্রোণাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে তার রথকে ক্ষিপ্রগতিতে পাশ কাটিয়ে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। দ্রোণাচার্য সাত্যকির পশ্চাদ্ধাবনের চেষ্টা করেন, কিন্তু কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাকে সেখানে ফিরে আসতে হয়। এদিকে সাত্যকি কৌরব সৈন্যদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে ক্ষিপ্রগতিতে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অগ্রসর হন। এমতাবস্থায় সাত্যকিকে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে কৃতবর্মা তার দিকে অগ্রসর হন এবং সাত্যকির বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন।
সাত্যকি কৃতবর্মাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে কৃতবর্মার রথের সঙ্গে যুক্ত চারটি ঘোড়া নিহত হয়। এরপর সাত্যকি বারবার কৃতবর্মাকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। কৃতবর্মা সাত্যকির দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন এবং উক্ত তীরটি সাত্যকির বর্ম ও শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। কৃতবর্মার তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর কৃতবর্মা সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। সাত্যকি কৃতবর্মার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কৃতবর্মার তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। সাত্যকি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে কৃতবর্মার দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার তীরের আঘাতে কৃতবর্মার রথের সারথি নিহত হয়। এর ফলে কৃতবর্মার রথের সঙ্গে যুক্ত অবশিষ্ট দুইটি ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং রথটিকে ক্ষিপ্রগতিতে দূরে টেনে নিয়ে যায়। এমতাবস্থায় কৃতবর্মা নিজেই ঘোড়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং পুনরায় সাত্যকির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন, কিন্তু ততক্ষণে সাত্যকি কৃতবর্মাকে পাশ কাটিয়ে কৌরব ব্যূহের আরো ভিতরের দিকে অগ্রসর হন।
কৃতবর্মার বীরত্ব এবং শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধাদের পরাজয়
সাত্যকির কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশের পরপরই ভীমের নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা সসৈন্যে কৌরব ব্যূহে ভাঙন ধরানোর প্রচেষ্টা চালানোর উদ্দেশ্যে কৌরব বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এমতাবস্থায় কৃতবর্মা সাত্যকির পশ্চাদ্ধাবন না করে একাকী উক্ত পাণ্ডব সৈন্যদলকে বাধা প্রদানের জন্য অগ্রসর হন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, উপপাণ্ডবগণ, ঘটোৎকচ, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও বিরাট একযোগে কৃতবর্মাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে কৃতবর্মা তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। কৃতবর্মার তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং ভীম নিজেও কৃতবর্মার তীরের আঘাতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। বাকি ১৩ জন পাণ্ডব যোদ্ধা কৃতবর্মাকে তীরবিদ্ধ করেন, এবং ভীম শীঘ্রই সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে কৃতবর্মার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কৃতবর্মার তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে।
ভীম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে কৃতবর্মাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে কৃতবর্মা ভীমসহ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সকল পাণ্ডব যোদ্ধাকে তীরবিদ্ধ করেন। এভাবে কৃতবর্মা ও শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারা একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। এরপর কৃতবর্মার তীরের আঘাতে শিখণ্ডী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন এবং তার রথের ওপর বসে পড়েন। এমতাবস্থায় পাণ্ডব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে কৃতবর্মার ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু কৃতবর্মার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় ভীমের নেতৃত্বাধীন শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারা সসৈন্যে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ, কৃতবর্মা একাকী ভীমের নেতৃত্বাধীন শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধাদের পরাজিত করেন।
কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে সাত্যকির বীরত্ব: সাত্যকির নিকট দ্রোণাচার্য, কৃতবর্মা ও দুর্যোধনের পরাজয়
কৃতবর্মার নিকট শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধাদের পরাজয়ের দৃশ্য দেখে সাত্যকি রথ ঘুরিয়ে কৃতবর্মার দিকে অগ্রসর হন এবং পুনরায় তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কৃতবর্মা সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকির তীরের আঘাতে কৃতবর্মার ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর সাত্যকির তীরে কৃতবর্মার অধীনস্থ বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। কৃতবর্মাকে পরাজিত করার পর সাত্যকির আবার রথ ঘুরিয়ে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরভাগের দিকে অগ্রসর হন। এসময় একটি কৌরব হস্তীবাহিনী সাত্যকিকে আক্রমণ করে, কিন্তু সাত্যকির তীরে কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক হাতি নিহত হয়।
এমতাবস্থায় মগধের রাজা জলাসন্ধ একটি হাতির পিঠে চেপে সাত্যকির দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। জলাসন্ধ সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং তার তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে। সাত্যকি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে জলাসন্ধকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং তার তীরের আঘাতে জলাসন্ধের ধনুক কাটা পড়ে। জলাসন্ধ একটি বর্শা উঠিয়ে সাত্যকির দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটি সাত্যকির বাম বাহু ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। এরপর সাত্যকি আবার জলাসন্ধকে তীরবিদ্ধ করেন। জলাসন্ধ একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে তলোয়ারটি সাত্যকির দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে। সাত্যকি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে জলাসন্ধকে তীরবিদ্ধ করেন এবং শীঘ্রই তার তীরের আঘাতে জলাসন্ধ নিহত হন।
সাত্যকির হাতে জলাসন্ধ নিহত হওয়ার পর আতঙ্কিত কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং এমতাবস্থায় দুর্যোধন, দুঃশাসন, দুর্মর্ষণ, দুর্মুখ, বিকর্ণ, চিত্রসেন, বিবিংশতি, সত্যব্রত ও বিজয় একযোগে সাত্যকিকে আক্রমণ করেন। তারা সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে সাত্যকি তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর দুর্যোধন ও সাত্যকি পরস্পরকে তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেন (প্রতীয়মান হয় যে, সেসময় নাগাদ দুর্যোধন দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রদত্ত দৈব বর্ম খুলে ফেলেছিলেন)। সাত্যকির তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর সাত্যকি দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন। দুর্যোধন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে সাত্যকি দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের ভাইয়েরা সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং প্রত্যুত্তরে সাত্যকি তাদেরকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর সাত্যকি আবার দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন।
সাত্যকির তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। এরপর সাত্যকি আবারো দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় দুর্যোধন তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে চিত্রসেনের রথে আরোহণ করেন। সাত্যকির নিকট দুর্যোধনের পরাজয়ের পর কৃতবর্মা ক্ষিপ্রগতিতে সাত্যকির দিকে অগ্রসর হন এবং এটি দেখে সাত্যকিও কৃতবর্মার দিকে অগ্রসর হন। পরস্পরের নিকটবর্তী হয়ে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে আবারো দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর সাত্যকির তীরের আঘাতে কৃতবর্মা সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। কৃতবর্মাকে পরাজিত করার পর সাত্যকি অর্জুনের সন্ধান করার জন্য কৌরব ব্যূহের আরো গভীরে অগ্রসর হন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।
এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখ সুরক্ষিত রাখার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সাত্যকির পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং তাকে অতিক্রম করে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য ও সাত্যকি তীরের সাহায্যে একে অপরকে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করেন। দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে সাত্যকির রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে। সাত্যকি একটি গদা উঠিয়ে দ্রোণাচার্যের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্য তীরের সাহায্যে সেটিকে প্রতিহত করেন। এরপর সাত্যকি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। দ্রোণাচার্য একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সাত্যকির দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সেটি সাত্যকিকে আঘাত না করে সাত্যকির রথকে ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়।
এরপর দ্রোণাচার্য ও সাত্যকি একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন, কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে এবং দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত একটি বিশেষ তীরের আঘাতে সাত্যকির রথের সারথি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সাত্যকি নিজেই তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং এরপর আবার তিনি ও দ্রোণাচার্য পরস্পরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। শীঘ্রই সাত্যকির তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের রথের সারথি নিহত হয় এবং রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সেটিকে দূরে টেনে নিয়ে যায়।
এটি দেখে কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক শীর্ষ যোদ্ধা সাত্যকিকে আক্রমণ করেন, কিন্তু শীঘ্রই সাত্যকির তীরবৃষ্টির তোড়ে তারা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন এবং এর ফলে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে। সাত্যকি পুনরায় কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরভাগের দিকে অগ্রসর হন। এদিকে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার ফলে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখ বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, সুতরাং দ্রোণাচার্যকে সেই অংশটি সুরক্ষিত রাখার জন্য সেদিকে অগ্রসর হতে হয়। এর ফলে দ্রোণাচার্যের পক্ষে আর সাত্যকির পশ্চাদ্ধাবন করা সম্ভব হয়নি। সাত্যকি দ্রোণাচার্যের রথ বিকল করে দেয়ার পর দ্রোণাচার্য যেহেতু আর সাত্যকির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাননি, সেজন্য এটিকে সাত্যকির নিকট দ্রোণাচার্যের পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাত্যকি কৌরব সৈন্যদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে থাকেন। কৌরব সৈন্যরা তার গতিরোধ করার উদ্দেশ্যে চতুর্দিক থেকে তার ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সাত্যকির তীরবৃষ্টির ফলে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং সাত্যকির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। কৌরব রথী সুদর্শন সাত্যকিকে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে তার দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেসময় তারা একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করেন এবং একে অপরের তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। কিন্তু শীঘ্রই সাত্যকির তীরের আঘাতে সুদর্শনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং এরপর সুদর্শন নিজেও নিহত হন।
সাত্যকির হাতে সুদর্শন নিহত হওয়ার পর কম্বোজের সৈন্যরা ও যবন সৈন্যরা (‘যবন’ বলতে সাধারণত বৈদিক সভ্যতার বাইরের জাতিগুলোকে বুঝানো হয়) সাত্যকির ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সাত্যকি তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন এবং তাদেরকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য করেন। বস্তুত ইতিপূর্বে এই পথ অতিক্রম করার সময় অর্জুন কৌরব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছিলেন এবং সাত্যকিও ঠিক একইভাবে কৌরব বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করছিলেন। এমতাবস্থায় দুর্যোধন, দুঃশাসন, চিত্রসেন, দুঃসহ, দুর্মুখ ও শকুনি একযোগে সাত্যকিকে আক্রমণ করেন এবং সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে সাত্যকি তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে শকুনির ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু শকুনি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দুর্যোধন ও তার ভাইদের সঙ্গে মিলে সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন।
এমতাবস্থায় সাত্যকির তীরের আঘাতে দুর্যোধনের রথের সারথি নিহত হয় এবং এর ফলে রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সেটিকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। দুর্যোধনের পরাজয় ও পশ্চাৎপসরণের পর দুর্যোধনের ভাইয়েরা ও শকুনি রণে ভঙ্গ দিয়ে পশ্চাৎপসরণ করেন। এরপর দুর্যোধন ও দুঃশাসনের নির্দেশে ১০০ শীর্ষ রথী, ১,০০০ রথী, ৩,০০০ ধনুর্ধর, ১,০০০ হাতি, ২,০০০ অশ্বারোহী ও বিপুল সংখ্যক পদাতিক সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি সুবৃহৎ সৈন্যদল সাত্যকিকে আক্রমণ করে, কিন্তু সাত্যকির তীরে পুরো বাহিনীটিই ধ্বংস হয়ে যায়। সাত্যকির হাতে উক্ত বাহিনীটি ধ্বংস হওয়ার পর দুঃশাসনের নির্দেশে পার্বত্য অঞ্চলের সৈন্যরা সাত্যকিকে আক্রমণ করে। তারা পাথর নিক্ষেপে বিশেষভাবে দক্ষ ছিল এবং তারা সাত্যকির দিকে বিপুল সংখ্যক বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করে। কিন্তু সাত্যকি তীরের সাহায্যে উক্ত পাথরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরে প্রতিপক্ষের বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। ফলে পার্বত্য অঞ্চলের সৈন্যরাও সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে কৌরব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে করতে সাত্যকি কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অগ্রসর হন।