[৩য় পর্ব পড়ুন]
কর্ণ–ভীম মহাযুদ্ধ: ভীমের পরাক্রম, কর্ণের দৃঢ়তা এবং ২০ কৌরব রাজপুত্রের মৃত্যু
ভীম দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করে এবং দুর্যোধনের ১১ ভাইকে হত্যা করে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতে অর্জুনের সন্ধানে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ভীমকে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে কর্ণ তার দিকে অগ্রসর হন এবং কর্ণ ও ভীমের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ আরম্ভ হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে কর্ণ ও ভীমের মধ্যে সংঘটিত দ্বৈরথ যুদ্ধ ছিল মহাভারতে বর্ণিত সবচেয়ে প্রলম্বিত ও তীব্র দ্বৈরথ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। কর্ণকে মহাভারতে বর্ণিত শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজদের মধ্যে একজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং রণকুশলতার দিক থেকে তাকে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, অর্জুন প্রমুখের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বিপরীতে ভীমকে মহাভারতে বর্ণিত শ্রেষ্ঠ গদাধারী ও মল্লযোদ্ধাদের মধ্যে একজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, কিন্তু ধনুক চালনার ক্ষেত্রেও ভীমের দক্ষতা নেহায়েত কম ছিল না।
কর্ণের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় ভীম দেবতাদের কাছ থেকে পাওয়া বায়ব্য ধনুক ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কর্ণ সাধারণ ধনুক ব্যবহার করেছিলেন। উল্লেখ্য, কর্ণকে তার গুরু মহর্ষি পরশুরাম বিজয়া নামক একটি দৈব ধনুক প্রদান করেছিলেন এবং সেটি অর্জুনের গাণ্ডীব ধনুকের সমকক্ষ ছিল, কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সপ্তদশ দিন বাদে জীবনের অন্য কোনো দিন কর্ণ এই ধনুকটি ব্যবহার করেননি (কর্ণ কেন এই ধনুকটি ব্যবহার করতেন না, সেই কারণটি মহাভারতে বর্ণিত হয়নি)। তদুপরি, কর্ণ যে প্রকৃতপক্ষে পঞ্চপাণ্ডবের বড় ভাই, সেসময় পঞ্চপাণ্ডব সেটি জানতেন না। দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের বন্ধুত্ব ও দুর্যোধনের বিভিন্ন পাণ্ডববিরোধী ষড়যন্ত্রে কর্ণের সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে পঞ্চপাণ্ডব কর্ণকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন। এজন্য কর্ণের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধ চলাকালে ভীম তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং কর্ণকে হত্যা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে, কর্ণ জানতেন যে, পঞ্চপাণ্ডব প্রকৃতপক্ষে তার ভাই এবং তিনি তাদের মা কুন্তীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি অর্জুন ব্যতীত অন্য চার পাণ্ডবকে হত্যা করবেন না। এজন্য ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধ চলাকালে কর্ণকে লক্ষ রাখতে হয় যে, ভীম যেন কোনোভাবেই নিহত না হন। অর্থাৎ, কর্ণ ও ভীমের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ চলাকালে ভীম দুইটি দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন — কর্ণের সাধারণ ধনুকের বিপরীতে তিনি একটি দৈব ধনুক ব্যবহার করছিলেন এবং কর্ণ তার বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে পারছিলেন না।
কর্ণের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধের শুরুতে ভীম এমন জোরে গর্জন করে ওঠেন যে, এটি শুনে কর্ণ ছাড়া আশেপাশে অবস্থানরত সকল রথীর হাত থেকে তাদের ধনুক পড়ে যায়। কর্ণ ভীম ও তার রথের সারথিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে ভীম কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ হালকাভাবে ভীমের দিকে তীর নিক্ষেপ করছিলেন, যাতে ভীম গুরুতরভাবে আহত না হন। কিন্তু ভীম পূর্ণশক্তি দিয়ে কর্ণের দিকে তীর নিক্ষেপ করছিলেন এবং তার উদ্দেশ্য ছিল কর্ণকে হত্যা করা। কর্ণ ভীমের দিকে ৪টি তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে সেগুলোকে কেটে ফেলেন। এরপর কর্ণ ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর ভীম কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে ভীম কর্ণকে তীব্র শক্তিতে তীরবিদ্ধ করেন এবং কর্ণের শরীরের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।
এরপর কর্ণ ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন, কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং কর্ণের রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। কর্ণ তার বিকল রথ থেকে ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে নেমে বৃষসেনের রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। কর্ণ ও ভীম একে অপরকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু তখনো কর্ণ হালকাভাবে তীর নিক্ষেপ করছিলেন, আর ভীম তীর নিক্ষেপ করছিলেন তার সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে। এসময় ভীম অর্জুনকে দেখতে পান এবং কর্ণকে এড়িয়ে অর্জুনের কাছাকাছি যাওয়ার প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু কর্ণ বৃষসেনের রথ থেকে নেমে আরেকটি রথে আরোহণ করেন এবং ভীমের গতিরোধ করেন।
ভীম কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং কর্ণকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। ভীমের তীরে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং এরপর ভীম কর্ণের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। ভীম কর্ণকে বারবার তীরবিদ্ধ করতে থাকেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে কর্ণ ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং কর্ণের তীর ভীমের বর্ম ভেদ করে তাকে আঘাত করে। এভাবে কর্ণ ও ভীম একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন, কিন্তু তখনো কর্ণ হালকাভাবে এবং ভীম পূর্ণশক্তি ব্যবহার করে তীর নিক্ষেপ করছিলেন। ভীম বুঝতে পারছিলেন যে, কর্ণ তার দিকে হালকাভাবে তীর নিক্ষেপ করছেন এবং এতে ভীম অপমানিত বোধ করেন, কারণ তার মনে হচ্ছিল কর্ণ তাকে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করছেন না। ক্ষিপ্ত ভীম কর্ণের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং কর্ণের শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশ ভীমের তীরে বিদ্ধ হয়।
প্রত্যুত্তরে কর্ণ ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। কর্ণ আবার ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এবার ভীমের শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশ কর্ণের তীরে বিদ্ধ হয়। ভীমের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে এবং ক্রুদ্ধ ভীম কর্ণকে বারবার তীরবিদ্ধ করেন। এরপর ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। ভীম আবার ক্ষিপ্রগতিতে কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং সেই তীরগুলো কর্ণের শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। আহত কর্ণ তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে আরেকটি রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এরপর কর্ণ ও ভীম একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। ভীম কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন।
এরপর কর্ণ ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীমের সঙ্গে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে যে বৃহৎ পাণ্ডব সৈন্যদলটি প্রবেশ করেছিল সেটিকে আক্রমণ করেন। কর্ণের তীরে উক্ত পাণ্ডব সৈন্যদলের বহুসংখ্যক রথী, হাতি, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে ভীম ক্ষিপ্ত হয়ে কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার রথটিকে কর্ণের রথের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য রথটির সারথিকে নির্দেশ দেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কর্ণের বিরুদ্ধে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। ভীমের রথটিকে অগ্রসর হতে দেখে কর্ণও তার রথের সারথিকে ভীমের রথের কাছাকাছি অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন এবং এর ফলে কর্ণ ও ভীমের রথদ্বয় একেবারে কাছাকাছি চলে আসে। কর্ণ ও ভীম রথে থাকা অবস্থাতেই একে অপরকে গদার সাহায্যে আক্রমণ করেন এবং উভয়ের মধ্যে একটি তীব্র গদাযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
কর্ণ যেমন তীরচালনায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন, ভীম তেমনিভাবে গদাযুদ্ধে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। কিন্তু ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কর্ণ যেমন তীরচালনায় ভীমের দক্ষতার প্রমাণ পেয়েছিলেন, তেমনিভাবে কর্ণের বিরুদ্ধে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ভীম গদাযুদ্ধে কর্ণের দক্ষতার প্রমাণ পান। কর্ণ ও ভীম গদার সাহায্যে একে অপরকে তীব্র শক্তিতে আক্রমণ করেন, কিন্তু তাদের কেউই একে অপরকে পরাজিত করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত কর্ণ ও ভীমের রথদ্বয়ের সারথিরা রথ দুইটিকে একে অপরের থেকে দূরে টেনে নিয়ে যায় এবং উভয়ে ধনুক উঠিয়ে আবার একে অপরের ওপর তীরবর্ষণ করতে শুরু করেন। এসময় কর্ণের তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং অনুরূপভাবে ভীমের তীরে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।
এরপর কর্ণ ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সারথি নিহত হয়। কর্ণ ক্ষিপ্রগতিতে তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং এরপর ভীমের দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর কর্ণ ও ভীম একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যুদ্ধ চলার পর ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর ভীম কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং কর্ণকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন।
এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে তার ভাই দুর্জয় কর্ণকে সহায়তা করার জন্য ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভীমের তীরের আঘাতে দুর্জয় নিহত হন এবং দুর্জয়ের রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোও নিহত হয়। এরপর ভীম কর্ণকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন, কিন্তু কর্ণ ভীমের তীরবৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং নিহত দুর্জয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তার মৃতদেহকে প্রদক্ষিণ করেন। ভীম তখনো কর্ণকে তীরবিদ্ধ করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কর্ণ সেটি উপেক্ষা করে আরেকটি রথে আরোহণ করেন এবং ধনুক উঠিয়ে আবার ভীমকে তীরবিদ্ধ করতে শুরু করেন। বেশ কিছুক্ষণ কর্ণ ও ভীম একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। এরপর কর্ণ সজোরে ভীমের দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেটি ভীমের শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়।
ক্রুদ্ধ ভীম একটি বৃহদাকৃতির গদা উঠিয়ে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং রথটির সারথি নিহত হয়। কর্ণ ধনুক হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং মাটিতে দাঁড়িয়েই ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। কর্ণ ও ভীম একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং কর্ণকে মাটিতে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেয়ে দুর্যোধন কর্ণকে সহায়তা করার জন্য তার ভাই দুর্মুখকে প্রেরণ করেন। কিন্তু ভীমের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে দুর্মুখ ভীমের তীরের আঘাতে নিহত হন। এমতাবস্থায় কর্ণ যুদ্ধ বন্ধ রেখে ও ভীমের তীরবৃষ্টিকে উপেক্ষা করে নিহত দুর্মুখের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তার মৃতদেহকে প্রদক্ষিণ করেন এবং এরপর দুর্মুখের রথে আরোহণ করে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন।
ভীম কর্তৃক সজোরে নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কর্ণের বর্ম ও শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। প্রত্যুত্তরে কর্ণ ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার নিক্ষিপ্ত তীরগুলো ভীমের ডান বাহু ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। এর ফলে ভীমের শরীর থেকে ব্যাপকভাবে রক্ত ঝরতে শুরু করে। প্রত্যুত্তরে ভীম কর্ণকে ও কর্ণের রথের সারথিকে তীরবিদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের ভাই দুর্মর্ষণ, দুঃসহ, দুর্মদ, দুর্ধর ও জয় কর্ণকে সহায়তা করার জন্য ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তাদেরকে ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে দেখে কর্ণ তাদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দুর্যোধনের পাঁচ ভাইকে তীরের সাহায্যে হত্যা করেন এবং এরপর কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন।
কর্ণ ও ভীম বারবার একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। এরপর ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে। কর্ণ একটি গদা উঠিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং গদাটিকে ভীমের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে উক্ত গদাটিকে প্রতিহত করেন। কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন এবং মাটিতে দাঁড়িয়ে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। ভীম কর্ণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে ১,০০০টি তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেগুলোর সবই কাটা পড়ে। এরপর কর্ণের তীরের আঘাতে ভীমের বর্ম কাটা পড়ে। ভীম আবার কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কর্ণের শরীর ও ডান বাহু ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়।
এমতাবস্থায় রক্তাক্ত কর্ণ আরেকটি রথে আরোহণ করে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। দুর্যোধনের নির্দেশে তার ভাই চিত্র, উপচিত্র, চারুচিত্র, শরাসন, চিত্রায়ুধ ও চিত্রবর্মা একযোগে কর্ণকে সহায়তা করার জন্য ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু তারা ভীমের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ভীম কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রেখে তীরের সাহায্যে তাদেরকে হত্যা করেন। এরপর কর্ণ ও ভীম একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের বর্ম কাটা পড়ে। প্রত্যুত্তরে কর্ণ ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তারা একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। ভীম কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং ভীমের ওপর তীরবর্ষণ করেন। ভীমের শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশ কর্ণের তীরে বিদ্ধ হয়।
এরপর কর্ণ আবার ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তিনি কর্ণের দিকে এমন তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন যে, কর্ণের রথ পুরোপুরি ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরে ছেয়ে যায়। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে তার ভাই শত্রুঞ্জয়, শত্রুসহ, চিত্র, চিত্রায়ুধ, দৃধা, চিত্রসেন ও বিকর্ণ কর্ণকে সহায়তা করার জন্য ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু কর্ণের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত রেখেই ভীম তীরের সাহায্যে দুর্যোধনের উক্ত সাত ভাইকে হত্যা করেন। এই পর্যায়ে এসে কর্ণ ভীমের ওপর মারাত্মক ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং ভীমের বিরুদ্ধে তার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করেন। তিনি ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করে ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এসময় কর্ণের তীরে ভীমের সঙ্গে থাকা পাণ্ডব সৈন্যদলটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অনুরূপভাবে, ভীমের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।
ভীম কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং ভীমের তীর কর্ণের কান, বুক ও কপালে বিদ্ধ হয়। ক্রুদ্ধ কর্ণ ভীমের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন এবং অনুরূপভাবে ভীমও কর্ণের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ভীম তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। কর্ণ বেশ কয়েকবার ভীমের দিকে অনুরূপ তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু প্রতিবারই ভীম তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর ভীম কর্ণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। ভীম কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন।
এরপর কর্ণের তীরের আঘাতে ভীমের সঙ্গে থাকা সবগুলো তূণীর ও ভীমের বায়ব্য ধনুক কাটা পড়ে এবং ভীমের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। কর্ণ ভীমের রথের সারথিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং সে ক্ষিপ্রগতিতে ভীমের রথ থেকে নেমে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করে। কর্ণের তীরের আঘাতে ভীমের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। ক্রুদ্ধ ভীম একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেটিকে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। এরপর ভীম একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে ভীমের হাতে থাকা ঢালটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত ভীম তার হাতে থাকা তলোয়ারটিকে কর্ণের রথের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে। কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমকে তীরবিদ্ধ করতে শুরু করেন।
এবার ভীম প্রকাণ্ড এক লাফ দিয়ে তার বিকল রথ থেকে কর্ণের রথের ওপর লাফিয়ে পড়েন এবং কর্ণকে রথের ওপর থেকে মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্ণ বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাকৃতির তীরের (একেবারে স্বল্পপাল্লার যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত) সাহায্যে ভীমকে ক্ষতবিক্ষত করেন এবং ভীম কর্ণের রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পশ্চাৎপসরণ করেন। কর্ণ তার রথে চড়ে ভীমের পশ্চাদ্ধাবন করেন। আশেপাশে বহুসংখ্যক হাতির মৃতদেহ স্তূপাকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল (চতুর্দশ দিন সকালে কৌরব ব্যূহে প্রবেশের পর অর্জুন এই হাতিগুলোকে হত্যা করেছিলেন)। ভীম কর্ণের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এগুলোর মধ্যে এমন একটি স্থানে আত্মগোপন করেন, যেখানে কর্ণের রথের পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। কর্ণের তীর থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য ভীম একটি অতিকায় হাতির মৃতদেহ তুলে ধরে সেটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে সেটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।
এরপর ভীম উক্ত হাতির মৃতদেহের বিভিন্ন টুকরো এবং আশেপাশ্ব পড়ে থাকা রথের চাকা, হাতি ও ঘোড়ার মৃতদেহ প্রভৃতি উঠিয়ে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে সেগুলোর প্রতিটিকেই কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে থাকেন। কর্ণের তীরের আঘাতে ভীম ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন এবং প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় কর্ণ কুন্তীকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে ভীমকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন। এর পরিবর্তে তিনি তার রথ থেকে নেমে তার ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে ভীমকে স্পর্শ করেন। তিনি ভীমকে ব্যঙ্গ করে লম্বা একটি বক্তব্য দেন, যার অংশবিশেষ ছিল এরকম: “নপুংসক! মূর্খ! পেটুক! তোমার অস্ত্র সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, অথচ তুমি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও! তুমি কেবলই একটি শিশু! তোমার থাকা উচিত এমন কোথাও যেখানে প্রচুর খাদ্য ও পানীয় আছে।… আমার মনে হয় না যে তুমি অস্ত্র উঠানোর যোগ্য।… তোমার যুদ্ধে থাকা উচিত নয়, তোমার উচিত জঙ্গলে নির্বাসিত হওয়া!”
ভীমের উদ্দেশ্যে এই বক্তব্য রেখে কর্ণ আবারো তার ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে ভীমকে স্পর্শ করেন এবং বলেন, “অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, কিন্তু যারা আমার মতো তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো না। যারা আমার মতো মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের এরকম এবং আরো অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। কৃষ্ণ আর অর্জুন যেখানে আছে, সেখানে চলে যাও। তারা তোমাকে এই যুদ্ধে রক্ষা করবে। অন্যথায় বাড়ি ফিরে যাও। তুমি তো শিশু, তুমি যুদ্ধ করতে চাও কেন?”
ভীমকে পরাজিত করার পর কর্ণ যখন এভাবে ভীমের উদ্দেশ্যে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছিলেন, সেসময় কৃষ্ণ ও অর্জুন দূর থেকে ভীমের অবস্থা দেখতে পান এবং কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন পিছন থেকে কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। এটি ছিল যুদ্ধের নিয়মের লঙ্ঘন, কিন্তু কার্যত যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই উভয় পক্ষ যুদ্ধের নিয়মাবলি ভঙ্গ করে আসছিল এবং এই পর্যায়ে এসে সেগুলো কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। অর্জুন কুন্তীকে দেয়া কর্ণের প্রতিশ্রুতির কথা জানতেন না এবং তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে, কর্ণ ভীমকে হত্যা করতে পারেন। এজন্য তিনি কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এই আচমকা আক্রমণের শিকার হয়ে কর্ণ ভীমের কাছ থেকে সরে গিয়ে তার রথে আরোহণ করেন। গুরুতরভাবে আহত ও রক্তাক্ত ভীমও কোনোক্রমে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন।
কর্ণ রথে আরোহণ করার পর অর্জুন তাকে লক্ষ্য করে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অর্জুন অশ্বত্থামাকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানান, কিন্তু অশ্বত্থামা সেই আহ্বান স্বীকার না করে কৌরব বাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করেন। অর্জুন অশ্বত্থামার পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং কর্ণ ক্ষিপ্রগতিতে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হন। এই বিচিত্র ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে কর্ণ ও ভীমের মধ্যেকার মহা দ্বৈরথ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
কর্ণ ও ভীমের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ চলাকালে ভীমের তীরের আঘাতে কর্ণের ৯টি ধনুক কাটা পড়ে এবং ভীম কর্ণের ৫টি রথ বিকল করে দেন (অর্থাৎ, কর্ণের ৫ জন সারথি ও তার রথগুলোর সঙ্গে যুক্ত ২০টি ঘোড়া ভীমের হাতে নিহত হয়)। শুধু তাই নয়, দুর্যোধনের ভাইরা পাঁচ বার কর্ণ ও ভীমের মধ্যে চলমান দ্বৈরথ যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে, কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই ভীমের হাতে নিহত হয়। কর্ণ ও ভীমের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে দুর্যোধনের মোট ২০ (১+১+৫+৬+৭) জন ভাই ভীমের হাতে নিহত হয়। সর্বোপরি, কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ভীম তীরচালনায় অত্যন্ত নৈপুণ্যের পরিচয় দেন এবং কর্ণকে গুরুতরভাবে আহত ও রক্তাক্ত করতে সমর্থ হন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সাধারণত কোনো যোদ্ধার প্রতিদ্বন্দ্বী তার রথ বিকল করে দিলে উক্ত যোদ্ধা পশ্চাৎপসরণ করতেন। কিন্তু ভীম বারবার কর্ণের রথ বিকল করে দেয়ার পরেও কর্ণ ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত ভীমকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে সক্ষম হন। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে কর্ণ কুন্তীকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কারণে ভীমের বিরুদ্ধে তার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেননি। কিন্তু কর্ণকে সহায়তা করতে এসে বারবার দুর্যোধনের ভাইদের নিহত হতে দেখে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং ভীমের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে তাকে পরাজিত করেন। বস্তুত ভীম অত্যন্ত সুদক্ষ ও শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন, এবং কর্ণ একজন শীর্ষ যোদ্ধা হলেও তার পক্ষে হালকাভাবে যুদ্ধ করে ভীমের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না।
কর্ণ ও ভীমের মধ্যেকার যুদ্ধের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল: তাদের কেউই এসময় পরস্পরের বিরুদ্ধে দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করেননি। কর্ণ বিপুল সংখ্যক দিব্যাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, কুন্তীকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে তিনি ভীমকে হত্যার ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন না এবং এজন্য তিনি ভীমের তীরে গুরুতরভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও ভীমের বিরুদ্ধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ থেকে বিরত ছিলেন। অন্যদিকে, ভীমের দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান ছিল তুলনামূলকভাবে সীমিত এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমকে খুব কম সময়েই দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এই দ্বৈরথ যুদ্ধের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল: ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কর্ণ তীরচালনার পাশাপাশি গদাযুদ্ধেও তার নৈপুণ্যের পরিচয় দেন, কারণ ভীম গদাযুদ্ধে অত্যন্ত দক্ষ হওয়া ছিলেন, কিন্তু তিনি কর্ণকে গদাযুদ্ধে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন।
কর্ণ ও ভীমের মধ্যেকার দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় দুর্যোধন বারবার কর্ণকে সহায়তা করার জন্য নিজের ভাইদের ভীমের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি জানতেন যে, ভীমের বিরুদ্ধে তার ভাইদেরকে যুদ্ধে প্রেরণের অর্থ তাদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কর্ণকে সহায়তা করার জন্য তাদেরকে প্রেরণ করতে থাকেন। কার্যত এতে কোনো লাভ হয়নি। রণকুশলতার দিক থেকে ভীম দুর্যোধনের ভাইদের চেয়ে বহুগুণ বেশি দক্ষ ছিলেন এবং দুর্যোধনের ভাইয়েরা ভীমের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ভীম তাদেরকে হত্যা করেন। কর্ণ প্রাণপণ প্রচেষ্টা করেও তাদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। কার্যত কর্ণ ও ভীমের মধ্যে চলমান দ্বৈরথ যুদ্ধে দুর্যোধনের ভাইয়েরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই রাখতে পারেননি (অবশ্য ভীমের হাতে তাদের মৃত্যু কর্ণকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করে এবং ভীমের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাকে প্ররোচিত করে)।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, দুর্যোধন কেন তার ভাইদেরকে জেনেশুনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে প্রেরণ করছিলেন? মহাভারতে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া নেই, কিন্তু এটি সম্পর্কে দুইটি মতামত প্রচলিত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, কর্ণ ও দুর্যোধনের মধ্যেকার বন্ধুত্ব এত ঘনিষ্ঠ ছিল যে কর্ণের জন্য দুর্যোধন নিজের ভাইদেরকে মৃত্যুর মুখে প্রেরণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। অপর মত অনুসারে, কৌরব বাহিনীতে একমাত্র কর্ণই অর্জুনকে পরাজিত করতে সক্ষম বলে দুর্যোধন বিশ্বাস করতেন এবং যেহেতু কেবল অর্জুনকে হত্যা করার মাধ্যমেই এই যুদ্ধে কৌরবদের বিজয় নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল, সেহেতু দুর্যোধনের দৃষ্টিতে নিজের ভাইদের সুরক্ষার চেয়ে কর্ণকে সহায়তা করা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সামগ্রিকভাবে, একটি প্রলম্বিত ও তীব্র দ্বৈরথ যুদ্ধের পর কর্ণ ভীমকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন এবং তাকে হত্যা করার সুযোগ লাভ করেন। বস্তুত কর্ণ যদি ভীমকে হত্যা করতেন, সেটি হতো কৌরবদের জন্য বড় একটি সাফল্য এবং সম্ভবত সেক্ষেত্রে দুর্যোধন ও দুঃশাসনের প্রাণ রক্ষা পেতো। কিন্তু কর্ণ কুন্তীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে ভীমকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে কৌরবরা বড় ধরনের একটি সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য কর্ণ ও ভীমের মধ্যেকার ‘মহাযুদ্ধ’ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটি বিশেষ ঘটনা বটে, কিন্তু যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফলের ক্ষেত্রে কর্ণের বিজয় ও ভীমের পরাজয়ের তাৎপর্য ছিল নগণ্য।