দ্রোণাচার্যের হাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ভাইদের মৃত্যু এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের পরাজয়
কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে সাত্যকির ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পেয়ে দ্রোণাচার্য তার রথের সারথিকে রথটি সাত্যকির দিকে চালিত করার নির্দেশ দেন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের সারথি তাকে বলে যে, একদিকে সাত্যকি কৌরব বাহিনীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন, অন্যদিকে পাণ্ডব সৈন্যরা কৌরব ব্যূহ ভেদ করার জন্য ব্যূহের প্রবেশমুখের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় সে দ্রোণাচার্যকে পরামর্শ দেয় যে, দ্রোণাচার্যের উচিত এই দুইটি হুমকির মধ্যে যেটি কৌরব বাহিনীর জন্য বেশি বিপজ্জনক প্রথমে সেটির মোকাবিলা করা। দ্রোণাচার্য যখন তার পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করছিলেন, এসময় কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক যোদ্ধা (যারা সাত্যকির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন) পশ্চাৎপসরণ করে আত্মরক্ষার জন্য দ্রোণাচার্যের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হন। উক্ত যোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন দুঃশাসন।
দ্রোণাচার্য দুঃশাসনকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, তিনি একজন রাজপুত্র ও বীর যোদ্ধা এবং এজন্য তার এভাবে পশ্চাৎপসরণ করা মোটেই শোভনীয় নয়। দুঃশাসন এর জবাবে কিছু না বলে এমন ভাব করেন যেন তিনি দ্রোণাচার্যের কোনো কথাই শুনতে পাননি। তিনি চুপচাপ পুনরায় সাত্যকির বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দ্রোণাচার্য অগ্রসরমান পাণ্ডব বাহিনীকে আক্রমণ করেন। দ্রোণাচার্যের তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় পাঞ্চালের রাজপুত্র (ও ধৃষ্টদ্যুম্নের ভাই) বীরকেতু দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন। পাঞ্চালের সৈন্যরা এতে উৎসাহিত হয়ে দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করে। কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে বীরকেতু নিহত হন।
দ্রোণাচার্যের হাতে বীরকেতু নিহত হওয়ার পর তার ভাই চিত্রকেতু, সুধনবান, চিত্রবর্মা ও চিত্ররথ একযোগে দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে আক্রমণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে তাদের রথগুলোর সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথগুলোর সারথিরা নিহত হয় এবং এরপর তারা নিজেরাও দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে নিহত হন। দ্রোণাচার্যের হাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের পাঁচ ভাই নিহত হওয়ার ফলে ধৃষ্টদ্যুম্ন অত্যন্ত শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ক্রুদ্ধ অবস্থায় দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্য তীরের সাহায্যে উক্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন।
এরপর ক্ষিপ্ত ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্য সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। এটি দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন তার ধনুক নামিয়ে একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন এবং লাফিয়ে নিজের রথ থেকে নেমে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে দ্রোণাচার্যের রথে আরোহণ করেন। কিন্তু ঠিক তখনই দ্রোণাচার্য সংজ্ঞা ফিরে পান এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে এত কাছে দেখতে পেয়ে তার দিকে বহুসংখ্যক বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির তীর নিক্ষেপ করেন। ক্ষতবিক্ষত ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গিয়ে নিজের রথে আরোহণ করেন। এরপর তিনি আবার ধনুক উঠিয়ে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং দ্রোণাচার্য ও ধৃষ্টদ্যুম্ন একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যুদ্ধ চলার পর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের সারথি নিহত হয় এবং এর ফলে রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সেটিকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। সেসময় ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে উক্ত দ্বৈরথ সমাপ্ত করার জন্য আর ফিরে আসেননি, এজন্য এই দ্বৈরথে দ্রোণাচার্যের নিকট ধৃষ্টদ্যুম্ন পরাজিত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়। ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরাজিত করার পর দ্রোণাচার্য বিপুল উদ্যমে পাণ্ডব বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়।
দুঃশাসন–সাত্যকি যুদ্ধ: দুঃশাসনের পরাজয় এবং দুঃশাসনকে সাত্যকির ‘জীবনদান’
এদিকে দ্রোণাচার্যের ভর্ৎসনা শুনে দুঃশাসন সাত্যকির বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুঃশাসন সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু সাত্যকি দুঃশাসনের দিকে ব্যাপক তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার তীরবৃষ্টির তোড়ে দুঃশাসনের সঙ্গে থাকা সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করে। দুঃশাসন সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন এবং পুনরায় সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু সাত্যকি দুঃশাসনের দিকে এমন তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন যে, দুঃশাসন ও তার রথের চারদিক তীরে ছেয়ে যায়। এটি দেখে দুর্যোধন সাত্যকিকে আক্রমণ করার জন্য ত্রিগার্তার রথীদের নির্দেশ দেন এবং ত্রিগার্তার ৩,০০০ রথী (যারা কৌরবদের ‘সংশপ্তক’ সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত ছিল) সাত্যকিকে আক্রমণ করে। কিন্তু সাত্যকির তীরে তাদের মধ্যে ৫০০ জন নিহত হয় এবং অবশিষ্টরা সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়।
এরপর দুঃশাসন আবার সাত্যকিকে আক্রমণ করেন এবং দুঃশাসন ও সাত্যকি একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। সাত্যকির তীরের আঘাতে দুঃশাসনের ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর সাত্যকি দুঃশাসনকে এড়িয়ে অর্জুনের সন্ধান করার জন্য রওনা হওয়ার উপক্রম করেন। কিন্তু দুঃশাসন সাত্যকির গতিরোধ করেন এবং সাত্যকির দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন। সাত্যকির তীরের আঘাতে উক্ত বিশেষ তীরটি কাটা পড়ে। এরপর দুঃশাসন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং তারা একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। এরপর সাত্যকির তীরের আঘাতে দুঃশাসনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো, রথটির সারথি ও পার্শ্বনী সারথিরা নিহত হয় এবং দুঃশাসনের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে।
সেসময় সাত্যকি চাইলে পরাজিত দুঃশাসনকে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু ইতিপূর্বে ভীম দুর্যোধন ও তার ভাইদেরকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং সাত্যকি দুঃশাসনকে হত্যা করলে ভীমের প্রতিজ্ঞা অপূর্ণ থেকে যেত। এজন্য তিনি দুঃশাসনকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন এবং সেখান থেকে সরে গিয়ে কৌরব ব্যূহের আরো গভীরে অগ্রসর হন।
দ্রোণাচার্যের হাতে বহুসংখ্যক শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধার পরাজয়/মৃত্যু
এসময় যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক অংশে দুর্যোধন পাণ্ডব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলেন এবং তার তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে ভীমের নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা একযোগে দুর্যোধনকে আক্রমণ করেন। দুর্যোধন ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, উপপাণ্ডবগণ, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও বিরাটকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর তার তীরে শত শত পাণ্ডব রথী ও হাতি নিহত হয়। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে এবং যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন। কিন্তু দুর্যোধন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। দ্রোণাচার্য দুর্যোধনকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হন এবং দ্রোণাচার্য ও পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।
কৈকেয়ার রাজা বৃহৎক্ষত্র দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্য তার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তিনি তীরের সাহায্যে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে বৃহৎক্ষত্রের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু বৃহৎক্ষত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রয়োগকৃত ব্রহ্মাস্ত্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে উভয় ব্রহ্মাস্ত্রের প্রভাব নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এরপর বৃহৎক্ষত্র দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্য বৃহৎক্ষত্রকে এমনভাবে তীরবিদ্ধ করেন যে উক্ত তীরটি বৃহৎক্ষত্রের শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। দ্রোণাচার্য ও বৃহৎক্ষত্র এভাবে একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন এবং বৃহৎক্ষত্রের তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের রথের সারথি আহত হয়।
এরপর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে বৃহৎক্ষত্রের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং রথটির ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। সর্বশেষ দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে বৃহৎক্ষত্র নিজেও নিহত হন। দ্রোণাচার্যের হাতে বৃহৎক্ষত্র নিহত হওয়ার পর দ্রোণাচার্যের তীরে পাঞ্চাল ও কৈকেয়ার বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় চেদির রাজা দৃষ্টকেতু দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দৃষ্টকেতু দ্রোণাচার্যকে এবং দ্রোণাচার্যের রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে দৃষ্টকেতুর ধনুক কাটা পড়ে। দৃষ্টকেতু আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে দৃষ্টকেতুর রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং এরপর দ্রোণাচার্য দৃষ্টকেতুকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন।
দৃষ্টকেতু একটি গদা উঠিয়ে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং গদাটিকে দ্রোণাচার্যের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে গদাটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এরপর দৃষ্টকেতু একটি বর্শা ও একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেগুলোকে দ্রোণাচার্যের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে সেগুলো কাটা পড়ে। এরপর দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত একটি তীরের আঘাতে দৃষ্টকেতু নিহত হন। দ্রোণাচার্যের হাতে দৃষ্টকেতু নিহত হওয়ার পর দৃষ্টকেতুর ছেলে দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে তিনিও নিহত হন।
এরপর মগধের প্রাক্তন রাজা জরাসন্ধের ছেলে দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য ও জরাসন্ধের ছেলে পরস্পরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে জরাসন্ধের ছেলে নিহত হন। বস্তুত এসময় দ্রোণাচার্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন এবং সেসময় পাণ্ডব বাহিনীর যেসব যোদ্ধা দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছিল, তাদের কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি। এসময় দ্রোণাচার্যের তীরে পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল সংখ্যক রথী, হাতি, অশ্বারোহী এবং পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। এই পরিস্থিতিতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ছেলে ক্ষত্রধর্ম দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তার তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে। কিন্তু দ্রোণাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ক্ষত্রধর্ম নিহত হন।
এরপর চেকিতন দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। চেকিতন দ্রোণাচার্যকে এবং দ্রোণাচার্যের রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্য চেকিতনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে চেকিতনের রথের সারথি নিহত হয়। এর ফলে চেকিতনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সেটিকে সেখান থেকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। দ্রোণাচার্যের নিকট চেকিতনের পরাজয়ের পর পাণ্ডব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করে, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরে তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব বাহিনী কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখ থেকে কিছুটা দূরে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়।
অর্জুন ও সাত্যকির পথে ভীমের অনুগমন
এদিকে সেসময় যুধিষ্ঠির অর্জুন ও সাত্যকির কোনো সংবাদ পাচ্ছিলেন না এবং এজন্য তিনি বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। অর্জুন ও সাত্যকি সেসময় নাগাদ কৌরব ব্যূহের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন এবং কৌরব ব্যূহের বাইরে থেকে তাদের সংবাদ জানা সম্ভব ছিল না। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির ভীমকে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অর্জুন ও সাত্যকির খোঁজ নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। সাত্যকি কৌরব ব্যূহে প্রবেশের আগে ভীমের ওপর যুধিষ্ঠিরকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব অর্পণ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ অমান্য করা ভীমের পক্ষে সম্ভব ছিল না, সুতরাং ভীম যুধিষ্ঠিরকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব ধৃষ্টদ্যুম্নের ওপর অর্পণ করেন এবং কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি তার রথটিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেন এবং ‘বায়ব্য’ নামক দৈব ধনুক উঠিয়ে একটি বৃহৎ সৈন্যদল সমেত কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখ বরাবর যাত্রা করেন।
উল্লেখ্য, পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেককেই দেবতারা একটি করে বিশেষ ধনুক উপহার দিয়েছিলেন। এই ধনুকগুলোকে সাধারণ ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত সাধারণ তীরের সাহায্যে কেটে ফেলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু অর্জুন যেমন তার গাণ্ডীব ধনুক সবসময় ব্যবহার করতেন, অন্য চার পাণ্ডব তাদের দৈব ধনুকগুলো সবসময় ব্যবহার করতেন না। মহাভারতের বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কেবল বিশেষ কোনো যুদ্ধের সময়ই বাকি চার পাণ্ডব উক্ত ধনুকগুলো ব্যবহার করতেন। যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে ভীম তার বায়ব্য ধনুকটি ব্যবহার করেছিলেন এবং যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে কৌরব ব্যূহে প্রবেশের আগে তিনি আবার উক্ত দৈব ধনুক উঠিয়ে নেন।
কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে ভীম: দুর্যোধনের ১১ ভাইয়ের মৃত্যু এবং দ্রোণাচার্যের পরাজয়
ভীমকে সসৈন্যে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের দিকে অগ্রসর হতে দেখে দুঃশাসন, দুর্মুখ, দুঃসহ, দুর্বিমোচন, চিত্রসেন, বিবিংশতি, কুণ্ডভেদী, শাল, বিন্দ, অনুবিন্দ, সুমুখ, দীর্ঘবাহু, সুদর্শন, সুহাস্ত, সুসেন, দীর্ঘলোচন, অভয়, রুদ্রকর্মা, রৌদ্রকর্মা ও সুবর্মা ভীমের ওপর নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করেন। কিন্তু ভীম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে ক্ষিপ্রগতিতে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের সামনে এসে উপস্থিত হন। সেখানে দ্রোণাচার্য অবস্থান করছিলেন এবং তিনি ভীমের গতিরোধ করে তাকে তীরবিদ্ধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন, অর্জুন যেভাবে কৌরব ব্যূহে প্রবেশের সময় তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন, ভীমও তেমনিভাবে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন। তিনি ভীমের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন, “ভীম, তোমার শত্রু অর্থাৎ আমাকে পরাজিত না করে এই শত্রব্যূহে প্রবেশ করা তোমার সামর্থ্যের বাইরে। কৃষ্ণ ও তোমার ছোট ভাই (অর্জুন) আমার অনুমতি নিয়ে এই ব্যূহে প্রবেশ করেছে, কিন্তু তুমি কখনোই এক্ষেত্রে সফল হতে পারবে না।”
দ্রোণাচার্যের বক্তব্য শুনে ভীম ক্রুদ্ধ হন। তিনি দ্রোণাচার্যের উদ্দেশ্যে বলেন, “হতভাগা ব্রাহ্মণ! অর্জুন আপনার অনুমতি নিয়ে এই ব্যূহে প্রবেশ করেছে এরকম হতেই পারে না। সে অপরাজেয়। সে ইন্দ্র কর্তৃক সুরক্ষিত ব্যূহেও অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম। সে যদি আপনাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে থাকে, তাহলে সেটা কেবল আপনাকে সম্মান দেখানোর জন্য করেছে। কিন্তু জেনে রাখুন, আমি অর্জুনের মতো সহানুভূতিশীল নই। আমি ভীম, আপনার শত্রু।… আপনি যেহেতু নিজেকে আমাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে তাই হোক!” এই বলে ভীম একটি গদা উঠিয়ে সেটিকে দ্রোণাচার্যের দিকে নিক্ষেপ করেন। দ্রোণাচার্য ক্ষিপ্রগতিতে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং এর ফলে তার প্রাণ রক্ষা পায়। ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদার তীব্র আঘাতে দ্রোণাচার্যের রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং রথটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
দ্রোণাচার্যের রথ ধ্বংস হওয়ার ফলে দ্রোণাচার্যকে একটি নতুন রথে আরোহণ করতে হয় এবং এর ফলে কয়েক মুহূর্তের জন্য কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখ অরক্ষিত ছিল। সেই সুযোগে ভীম সসৈন্যে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং কৌরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এদিকে দ্রোণাচার্যকে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখ সুরক্ষিত রাখার জন্য সেখানে অবস্থান করতে হয় এবং এই কারণে তিনি ভীমের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারেননি। এদিকে ভীম কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অগ্রসর হয়ে দুর্যোধনের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুঃশাসন ভীমের দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। ভীমের তীরের আঘাতে একে একে দুর্যোধনের ভাই কুণ্ডভেদী, সুসেন, দীর্ঘনেত্র, বৃন্দারক, অভয়, রৌদ্রকর্মা ও দুর্বিমোচন নিহত হন। দুর্যোধনের অন্য ভাইয়েরা ভীমকে ঘিরে ফেলেন এবং তার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ভাই বিন্দ, অনুবিন্দ, সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হন। এরপর দুর্যোধনের বাকি ভাইয়েরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পশ্চাৎপসরণ করেন।
ভীমের হাতে দুর্যোধনের ১১ ভাই নিহত হওয়ার পর কৌরব পক্ষের বহু রাজারাজড়া সৈন্যসামন্ত নিয়ে ভীমের ওপর আক্রমণ চালান। ভীম একটি গদা উঠিয়ে সেটিকে সজোরে আক্রমণকারী সৈন্যদলের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এদিকে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে ভীমের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তাকে প্রতিরোধ করার জন্য দ্রোণাচার্য ভীমের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং তাদের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়। দ্রোণাচার্য ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার গতিরোধ করেন। দ্রোণাচার্যের তীরে ভীমের অধীনস্থ সৈন্যদলটির বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় ভীম তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং ক্ষিপ্রগতিতে দ্রোণাচার্যের রথের দিকে ছুটে যান। দ্রোণাচার্য ভীমের ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন, কিন্তু দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টি ভীমের গতিরোধ করতে ব্যর্থ হয় এবং ভীম দ্রোণাচার্যের রথের কাছে পৌঁছে রথটিকে শূণ্যে উঠিয়ে সেটিকে সজোরে দূরে নিক্ষেপ করেন।
দ্রোণাচার্য কোনোক্রমে সেই রথ থেকে নেমে পড়ে আরেকটি রথে আরোহণ করেন এবং ক্ষিপ্রগতিতে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করে ব্যূহের প্রবেশমুখের দিকে ছুটে যান। এভাবে ভীমের নিকট দ্রোণাচার্যের পরাজয় ঘটে। অর্থাৎ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে অল্প সময়ের ব্যবধানে ভীম পরপর দুই বার দ্রোণাচার্যকে দ্বৈরথ যুদ্ধে পরাজিত করেন। তাছাড়া, ইতিপূর্বে যুদ্ধের ষষ্ঠ ও অষ্টম দিনে দ্রোণাচার্য ভীমের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, দ্রোণাচার্যের কাছেই ভীম (ও অন্যান্য পাণ্ডবরা এবং কৌরবরা) সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। সুতরাং ভীমের নিকট দ্বৈরথ যুদ্ধে অন্তত চার বার দ্রোণাচার্যের পরাজয় ভীমের রণনৈপুণ্যের পরিচায়ক।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে ভীম প্রথমে গদা নিক্ষেপের মাধ্যমে দ্রোণাচার্যের রথ ধ্বংস করে এবং পরবর্তীতে তার বিপুল শারীরিক শক্তির সাহায্যে দ্রোণাচার্যের রথকে দূরে নিক্ষেপ করে দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করেন। অন্যদিকে, যুদ্ধের ষষ্ঠ ও অষ্টম দিনে তিনি তীর–ধনুক ব্যবহার করে দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু এর ভিত্তিতে ভীমকে দ্রোণাচার্যের চেয়ে অধিকতর দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় কিনা, সেটি অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় দ্রোণাচার্য কখনো কোনো দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেননি। মহাভারতের বিবরণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, দ্রোণাচার্য বিপুল সংখ্যক দিব্যাস্ত্রের অধিকারী ছিলেন এবং সেই তুলনায় ভীমের দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান ছিল বহুলাংশে সীমিত। সুতরাং এটি বলা যেতে পারে যে, দ্রোণাচার্য ভীমের বিরুদ্ধে তার পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করেননি এবং এটি ভীমের নিকট তার পরাজয়ের মূল কারণ।
দুর্যোধনের নিকট যুধমন্যু ও উত্তমৌজের পরাজয়
এদিকে দ্রোণাচার্যকে অতিক্রম করে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে ক্রমান্বয়ে অর্জুন, সাত্যকি ও ভীমের প্রবেশ দুর্যোধনকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। তিনি দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, অর্জুন, সাত্যকি ও ভীমের (যারা ছিলেন দ্রোণাচার্যের শিষ্য) নিকট দ্রোণাচার্যের পরাজয় খুবই আশ্চর্যজনক। তিনি দ্রোণাচার্যকে প্রশ্ন করেন যে, জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য তাদের কী করা উচিত? প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্য মন্তব্য করেন যে, কৌরবরা দ্যূতসভায় প্রকৃতপক্ষে বিজয় বা পরাজয় কোনোটিই অর্জন করেননি, কিন্তু এখন তারা যে খেলায় নেমেছেন সেটিতে জয়দ্রথকে বাজি রাখা হয়েছে এবং এই খেলায় জয়–পরাজয়ও রয়েছে। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের উচিত ফিরে গিয়ে জয়দ্রথকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে শীর্ষ কৌরব যোদ্ধাদেরকে সহায়তা করা।
দ্রোণাচার্যের এই বক্তব্য শুনে দুর্যোধন জয়দ্রথের অবস্থানের দিকে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পথিমধ্যে তিনি পাঞ্চালের রাজপুত্র যুধমন্যু আর উত্তমৌজকে দেখতে পান। যুধমন্যু ও উত্তমৌজ অর্জুনের সঙ্গে কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু কৃতবর্মার কাছে পরাজিত হওয়ার ফলে তারা ব্যূহের গভীরে প্রবেশ করতে পারেননি। এমতাবস্থায় তারা ব্যূহের প্রথম ভাগে কৌরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং কৌরবদের প্রতিরোধ ভেঙে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। দুর্যোধন তাদের গতিরোধ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুধমন্যু দুর্যোধনকে ও দুর্যোধনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু দুর্যোধনের তীরের আঘাতে যুধমন্যুর রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে এবং রথটির সারথি নিহত হয়। এরপর দুর্যোধন যুধমন্যুর রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন। যুধমন্যু দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং উত্তমৌজের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের রথের সারথি নিহত হয়।
এরপর দুর্যোধনের তীরের আঘাতে উত্তমৌজের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির দুই পার্শ্বনী সারথি নিহত হয় এবং উত্তমৌজ তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে যুধমন্যুর রথে আরোহণ করে সেখান থেকে যুদ্ধ করতে থাকেন। উত্তমৌজের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং যুধমন্যুর তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে। এমতাবস্থায় দুর্যোধন একটি গদা উঠিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং যুধমন্যুর রথের দিকে ছুটে যান। যুধমন্যু ও উত্তমৌজ দুর্যোধনকে এভাবে গদা হাতে ছুটে আসতে দেখে উক্ত রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। দুর্যোধন গদার আঘাতে উক্ত রথটিকে ধ্বংস করে ফেলেন। এরপর তিনি শল্যের রথে আরোহণ করে কৌরব ব্যূহের শেষ প্রান্তের দিকে যাত্রা করেন। এদিকে দুর্যোধনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর যুধমন্যু ও উত্তমৌজ নতুন দুইটি রথে চড়ে অর্জুনের অবস্থানের দিকে যাত্রা করেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় সংঘটিত দ্বৈরথ যুদ্ধসমূহ সংক্রান্ত কিছু তথ্য
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিবরণে বহুসংখ্যক দ্বৈরথ যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় সংঘটিত দ্বৈরথ যুদ্ধগুলোর ফলাফল নির্ধারণের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। সাধারণভাবে, একজন যোদ্ধা অপর একজন যোদ্ধাকে দুইভাবে দ্বৈরথ যুদ্ধে পরাজিত করতে পারতো:
(১) প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করার মাধ্যমে এবং
(২) প্রতিদ্বন্দ্বীকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করার মাধ্যমে।
দ্বৈরথ যুদ্ধে কোনো যোদ্ধা যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করতে পারতো, সেটি হতো তার চূড়ান্ত বিজয়। অন্যদিকে, দ্বৈরথ যুদ্ধে কোনো যোদ্ধা যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করতে পারতো, সেক্ষেত্রেও তাকে বিজয়ী হিসেবে ধরে নেয়া হতো। সাধারণত একজন যোদ্ধা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর রথ বিকল করে দিয়ে (অর্থাৎ, রথের সারথি এবং/অথবা রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করে) কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুরুতরভাবে আহত করার মাধ্যমে তাকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য করতে পারতো। উল্লেখ্য, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে উভয় পক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, রথের সারথি বা রথের সঙ্গে যুক্ত পশুগুলোর ওপর আক্রমণ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই এই নিয়মটির ব্যাপক লঙ্ঘন শুরু হয় এবং কার্যত যুদ্ধের চতুর্দশ দিন নাগাদ যুদ্ধের কোনো নিয়মের লঙ্ঘনই বাকি ছিল না।
আরো উল্লেখ্য, কোনো যোদ্ধা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর রথ বিকল করে দিলেই যে তাকে বিজয়ী হিসেবে ধরে নেয়া যেতো, এমন নয়। কারণ বহু দ্বৈরথ যুদ্ধের ক্ষেত্রে যোদ্ধারা একটি রথ বিকল হওয়ার পর আরেকটি রথে চড়ে কিংবা রথ ছাড়াই দ্বৈরথ যুদ্ধ চালিয়ে যেতো। এজন্য দ্বৈরথ যুদ্ধে কোনো এক প্রতিদ্বন্দ্বী নিহত না হলে সেক্ষেত্রে জয়–পরাজয় নির্ধারণের মূল মাপকাঠি ছিল দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত যোদ্ধাদের কোনো একজনের পশ্চাৎপসরণ বা হার স্বীকার। যেমন: ভীম দ্রোণাচার্যের রথটিকে উঠিয়ে দূরে নিক্ষেপ করার পর দ্রোণাচার্য যদি ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, সেক্ষেত্রে এটিকে দ্রোণাচার্যের পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু ভীম দ্রোণাচার্যের রথটিকে দূরে নিক্ষেপ করার পর দ্রোণাচার্য সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন এবং সেজন্য এই দ্বৈরথ যুদ্ধে ভীম বিজয়ী হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়।
দ্বৈরথ যুদ্ধ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রথীদের মধ্যে সংঘটিত দ্বৈরথ যুদ্ধগুলোর সিংহভাগের ক্ষেত্রে তীর–ধনুক ব্যবহৃত হতো। অল্প কিছু ক্ষেত্রে গদাযুদ্ধ ও তলোয়ারযুদ্ধ সংঘটিত হতো এবং সেগুলোও সাধারণত হতো এক বা উভয় পক্ষের তীর ও ধনুক নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর। বর্শা, বল্লম প্রভৃতি (এবং ক্ষেত্রবিশেষে গদা) দূরপাল্লার যুদ্ধে ব্যবহৃত হতো, অন্যদিকে গদা, তলোয়ার, কুঠার প্রভৃতি স্বল্পপাল্লার যুদ্ধে (close combat) ব্যবহৃত হতো। তীর–ধনুক প্রধানত দূরপাল্লার যুদ্ধে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু কিছু বিশেষ ক্ষুদ্রাকৃতির তীর ছিল, যেগুলোকে একেবারে স্বল্পপাল্লার যুদ্ধেও ব্যবহার করা যেতো।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রধান অস্ত্র ছিল বর্শা, ভীমের গদা, অর্জুনের তীর–ধনুক এবং নকুল ও সহদেবের তলোয়ার (ক্ষেত্রবিশেষে সহদেবের ক্ষেত্রে কুঠার)। কার্যত মহাভারতের বিবরণে এরকম কোনো চিত্র পাওয়া যায় না। মহাভারতের বিবরণ অনুসারে, পঞ্চপাণ্ডবের সকলেরই প্রাথমিক অস্ত্র ছিল তীর–ধনুক। যুধিষ্ঠির ক্ষেত্রবিশেষে বর্শা ব্যবহার করতেন, কিন্তু সিংহভাগ সময়ে তিনি তীর–ধনুক ব্যবহার করেছেন। ভীম ছিলেন প্রধানত একজন গদাধারী, কিন্তু তিনিও তার সিংহভাগ যুদ্ধে তীর–ধনুক ব্যবহার করেছেন। নকুল ক্ষেত্রবিশেষে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, কিন্তু সিংহভাগ সময়ে তিনিও তীর–ধনুক ব্যবহার করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিবরণে সহদেবকে কখনো কুঠার ব্যবহার করতে দেখা যায় না এবং তিনিও সিংহভাগ সময়ে তীর–ধনুক ব্যবহার করেছেন।
অনুরূপভাবে, কৌরব রাজপুত্রদের প্রাথমিক হাতিয়ার ছিল তীর–ধনুক। ভীমের মতো দুর্যোধনও ছিলেন প্রধানত গদাধারী, কিন্তু তিনি তার সিংহভাগ যুদ্ধে তীর–ধনুক ব্যবহার করেছেন। এর বাইরে কৌরব পক্ষের ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, কৃতবর্মা, বৃষসেন, কৃপাচার্য প্রমুখ যোদ্ধার এবং পাণ্ডব পক্ষের সাত্যকি, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, বিরাট, অভিমন্যু, উপপাণ্ডবগণ, চেকিতন প্রমুখ যোদ্ধার প্রধান হাতিয়ার ছিল তীর–ধনুক। শল্য ছিলেন ভীম ও দুর্যোধনের মতোই প্রধানত একজন গদাধারী, কিন্তু সিংহভাগ যুদ্ধে তিনিও তীর–ধনুক ব্যবহার করতেন।
সাধারণভাবে, মহাভারতের যোদ্ধাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যোদ্ধাদের জয়–পরাজয়ের হিসেবকেই সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত মহাভারতের ওপর নির্মিত সিরিয়ালগুলোতে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, অর্জুন প্রমুখ যোদ্ধাকে প্রায় বা সম্পূর্ণ অপরাজেয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু মহাভারতে প্রদত্ত বিবরণে কার্যত কোনো যোদ্ধাকেই অপরাজেয় হিসেবে দেখা যায় না। যেমন: কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের যুদ্ধের প্রথম ১৩ দিনে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, ভীম, সাত্যকি, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ প্রমুখ শীর্ষ যোদ্ধাদের সকলেই কখনো না কখনো পরাজিত হয়েছেন।
ভীষ্ম অর্জুন ও ভীমের কাছে পরাজিত হয়েছেন; দ্রোণাচার্য অর্জুন, ভীম, সাত্যকি ও অভিমন্যুর কাছে পরাজিত হয়েছেন; কর্ণ অভিমন্যুর কাছে পরাজিত হয়েছেন; ভীম ভীষ্ম, ভগদত্ত, জয়দ্রথ ও কৃতবর্মার কাছে পরাজিত হয়েছেন; সাত্যকি ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও ভগদত্তের কাছে পরাজিত হয়েছেন; অভিমন্যু ভীষ্ম ও ভগদত্তের কাছে পরাজিত হয়েছেন এবং ঘটোৎকচ ভগদত্ত ও কৃতবর্মার কাছে পরাজিত হয়েছেন। যুদ্ধের প্রথম ১৩ দিনে অর্জুন সরাসরি পরাজিত হননি বটে, কিন্তু কৃষ্ণ তাকে দুইবার ভগদত্তের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছেন, অর্থাৎ কৃষ্ণ হস্তক্ষেপ না করলে অর্জুন ভগদত্তের হাতে নিহত হতেন।
অর্থাৎ, জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে মহাভারতের শীর্ষ যোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, ভীষ্ম পর্বে ভীম দুইবার ভীষ্মের নিকট পরাজিত হন, কিন্তু বিপরীতক্রমে ভীষ্ম একবার ভীমের নিকট পরাজিত হন। এমতাবস্থায় রণনৈপুণ্যের ক্ষেত্রে ভীষ্ম ও ভীমের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা করে কোনো সুনির্দিষ্ট ফলাফলে পৌঁছানো কঠিন। আবার, যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে কর্ণ অভিমন্যুর নিকট পরাজিত হন, কিন্তু যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে অভিমন্যু ভগদত্তের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এদিকে পাণ্ডবরা বনবাসে থাকাকালে কর্ণ দুর্যোধন কর্তৃক বৈষ্ণব যজ্ঞ আয়োজনের প্রেক্ষাপটে দিগ্বিজয়ে বের হন এবং সেসময় তিনি ভগদত্তকে পরাজিত করে প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য জয় করেছিলেন। এমতাবস্থায় রণনৈপুণ্যের ক্ষেত্রে কর্ণ ও অভিমন্যুর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা করে কোনো সুনির্দিষ্ট ফলাফলে পৌঁছানো কঠিন।
বস্তুত মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধগুলোর বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় না, মহাভারতে বর্ণিত কোনো শীর্ষ যোদ্ধাই পুরোপুরি অপরাজেয় ছিলেন না এবং প্রত্যেক দ্বৈরথ যুদ্ধে তাদের প্রদর্শিত নৈপুণ্য একই মাত্রার ছিল না। কখনো তারা অত্যন্ত নৈপুণ্যের পরিচয় দিতেন, আবার কখনো তাদের প্রদর্শিত নৈপুণ্য হতো প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কম। যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে কর্ণ দুর্যোধনের কাছে মন্তব্য করেন যে, “বিজয় ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল।” অবশ্য কোনো দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের ভাগ্যের পাশাপাশি সেই সময় তাদের মনোবল, তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরন, তাদের অনুসৃত রণকৌশল, প্রতিপক্ষের প্রতি তাদের মনোভাব প্রভৃতিও জয়–পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো।