মাকড়সারা সাধারণত গরমকালে নিজেদের গোপন আস্তানা থেকে আলো-বাতাসে বেরিয়ে আসে। আবার শীত আসতেই লুকিয়ে যায়। আটপেয়ে এই প্রাণীরা বেশিরভাগ সময়েই নিরীহ। খাবার ধরতে সে ধ্যানী তাঁতির মতো জাল বুনে চলে। দেওয়ালে এতগুলো পা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নিতান্ত ভদ্রগোছের মাকড়সাটির দিকে তাকিয়ে কখনো ভেবেছেন তাকে নিয়েও কতশত গল্প আছে? আমাদের পূর্বপুরুষেরা হাজার বছর আগে এই প্রাণীকে নিয়ে বিভিন্ন কল্পকথার জন্ম দিয়েছিলেন। বেশিরভাগ সভ্যতার রূপকথা বা পুরাণে তাই মাকড়সা নিয়ে গল্প থাকবেই।
হোপি জাতিগোষ্ঠী
হোপি জাতিগোষ্ঠীর পুরাণে মাকড়সার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। পৃথিবীর সৃষ্টিতে তারা মাকড়সার অবদান দেখতে পায়। মাকড়সা নারীরূপে তাদের কাছে পৃথিবীর অধিষ্ঠাতা দেবী। সূর্যদেবের নাম ‘তাওয়া’। তাওয়ার সাথে মিলে মাকড়সা দেবী পৃথিবীর সৃষ্টি করেন। গাছপালা, প্রাণী তৈরি শেষে তিনি মানুষ তৈরিতে মন দেন। বিভিন্ন রঙের মাটির দলা নিয়ে নিজের লালা মিশিয়ে তিনি মানুষ আকৃতি বানান, তাওয়া তাদের জ্ঞান দেয়। মাকড়সা দেবী চারজন পুরুষ আর চারজন নারী বানিয়েছিলেন। তাদের দম্পতি করে পৃথিবীর চার অংশে পাঠানো হয়। হোপিরা এখনো মাকড়সা দেবীর সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাস করেন।
গ্রিক পুরাণ
গ্রিক কিংবদন্তী অনুযায়ী, আরাকনি নামের এক নারী বয়নবিদ্যায় চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। মানুষজন কাজ ফেলে তার বোনা দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিত। দিনের পর দিন তার গর্বও বাড়ছিল। একদিন গর্বের সাথে সে নিজেকে জ্ঞানের দেবী এথেনার থেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করে বসে।
এথেনা আরাকনিকে উপদেশ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আরাকনির অহমিকা তাকে অন্ধ করে ফেলেছিল। অবশেষে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এথেনা দেবতাদের স্তুতির ছবি তুলে ধরেন। অপরদিকে আরাকনি দেবতাদের খারাপ কাজকে ফুটিয়ে তোলে নিজের ক্যানভাসে। যদিও আরাকনির কাজ এথেনার থেকে সুন্দর ছিল, দেবতাদের অপমান এথেনা সহ্য করতে পারেনি। হাতের মাকু দিয়ে সে আরাকনিকে আঘাত করে। নিজের ভুল বুঝে অনুতপ্ত আরাকনি আত্মহত্যা করে। এথেনার দয়া হয়। আরাকনিকে সে বাঁচিয়ে তোলে ঠিকই, কিন্তু এই শিক্ষা যেন আরাকনির মনে থাকে, তাই এথেনার অভিশাপে সে মাকড়সায় পরিণত হয়। যে দড়িতে আরাকনি ঝুলছিল সেটা হয়ে যায় সুতো। আর আরাকনি আজও তার গুণের নিদর্শন নিয়ে জাল বুনে বেড়ায়। গ্রিক পুরাণে আরাকনিই প্রথম মাকড়সা।
আফ্রিকা
পশ্চিম আফ্রিকা, বিশেষত ঘানায় আনানসির উপকথার জন্ম। আনানসি মানেই মাকড়সা। আর আনানসি হলো তাদের গল্পের দেবতা। আকাশের দেবতা নিয়ামের ছেলে আনানসি কিভাবে মাকড়সা হয়ে গেল তা নিয়েও গল্প আছে।
রাজার ভেড়াকে মেরে ফেলে আনানসি সব দোষ দেয় এক মাকড়সাকে। রাজা প্রথমে আনানসির কথায় বিশ্বাস করলেও পরে রানী তার ভুল ভাঙিয়ে দেন। এতটুকু একটা মাকড়সা কিভাবে এত বড় ভেড়াকে মারবে? রাজা রেগে গিয়ে আনানসির মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই আনানসি কিন্তু মরেনি, বরং মাকড়সা হয়ে পৃথিবীতে গল্পের যোগান দিয়েছে। পৃথিবীতে কোনো গল্প ছিল না, সব আকাশদেবতা নিয়ামের ভাণ্ডারে জমা থাকত। আনানসির খুব সাধ পৃথিবীতেও গল্প থাকুক। তাই সে নিয়ামের কাছে বায়না ধরে। নিয়াম তার কাছে গল্পের বিনিময়ে তিনটি জিনিস চায়। পাইথন, চিতাবাঘ আর ভীমরুল। বিভিন্ন বুদ্ধি এঁটে ফাদে ফেলে তিনজনকে নিয়ামের কাছে পৌঁছে দেয় আনানসি, নিয়াম তাকে পৃথিবীর জন্য দেয় পর্যাপ্ত পরিমাণ গল্প। আনানসি নিজেই গল্প বলে বেড়াতো। সেসব গল্পে নিজেকেও খারাপ ভূমিকায় ফেলতো সহাস্যে। আনানসির গল্পগুলো আফ্রিকার গন্ডি পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
চেরোকি জাতিগোষ্ঠী
পৃথিবীতে আগে কোনো আলো ছিল না। মানুষেরা হাঁটতো, এ ওর সাথে গিয়ে ধাক্কা খেত। কেউ কাউকে দেখতে পেত না। কারণ তাদের সূর্যই ছিল না। সূর্য ছিল অন্য একটা পৃথিবীতে, আর সেই পৃথিবীর মানুষগুলো এত বেশি কিপটে ছিল যে নিজেদের আলো আর কাউকে দিতে চাইতো না।
মানুষদের ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে এলো প্রাণীরা। নানারকম ফন্দি তারা আঁটলো কিভাবে সূর্য চুরি করে আনা যায়। এক পসামের ভারী সুন্দর ঘন লোমে ঢাকা লেজ ছিল। সে বললো, সূর্যটাকে ওই লেজের ভেতরেই সে লুকিয়ে আনবে। কিন্তু যেই না অন্য পৃথিবীতে গিয়ে সূর্যকে লেজে ঢুকিয়েছে লোম পুড়ে গেল তাপে। সূর্যটাকে আর আনা হলো না। সেই থেকে পসামের লেজে লোম নেই।
বাজপাখি বললো, সে সূর্যকে আনবে মাথায় করে। পসামের মতো দশা হলো তারও। সব দেখে শুনে দাদী মাকড়সা নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিল। সে মাটি দিয়ে পুরু করে একটা পাত্র তৈরি করল। তারপর নিজের সুতো দিয়ে ঐ পৃথিবীর সূর্যটাকে বেঁধে এলো। এদিকে এসে একটান দিয়ে সূর্যকে নিয়ে এসে মাটির পাত্রে ভরে নিজেদের আকাশে বসিয়ে এলো। মাকড়সা ছোট বলে ওই পৃথিবীর মানুষদের কাছে ধরাও পড়েনি। সেই থেকে পৃথিবী আলোকিত। সূর্যের সাথে সাথে সে নিয়ে এলো আগুন। মানুষকে সে শেখালো মাটির পাত্র তৈরি করার বিদ্যা।
কেল্টিক জাতি
মাকড়সা তাদের উপকথায় এক পবিত্র প্রাণী, ক্ষততে মাকড়সার জাল ব্যবহার ও মাকড়সা না মারার প্রথা অনেকদিন ধরে চলে আসছে। মাকড়সা বিষয়ে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি হলো দুই ভাইয়ের গল্প। দুই ভাই একদিন দূরদেশে যাত্রা করে। পথিমধ্যে ছোট ভাই এক বৃদ্ধা, শিশু ও প্রতিবন্ধীকে সাহায্য করে নিজের টাকা, গায়ের কাপড় আর ঘোড়া দিয়ে। বিনিময়ে তারা ছোট ভাইকে যথাক্রমে ভিমরুল, মাকড়সা আর ফড়িং উপহার দেয়।
বড় ভাই ছোট ভাইয়ের বোকামিতে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ফেলে চলে যাচ্ছিলো। তখন দুই ঈগল এসে বড় ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ছোট ভাইয়ের পকেট থেকে সাহায্য করার আওয়াজ আসে। মাকড়সা আকাশ পর্যন্ত মই তৈরি করে, ফড়িংয়ের সাহায্যে। ঈগলদের আস্তানায় পৌঁছে মাকড়সা তার জাল দিয়ে ঈগল আর তার মালিক দৈত্যকে আটকে ফেলে। ভিমরুল তাদের চোখ নষ্ট করে দেয়। আবার মই বেয়ে তারা ফিরে আসে পৃথিবীতে। দুই ভাইকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে তারা নিজেদের আসল রূপে ফিরে আসে। তারা আসলে স্বর্গের দেবতা ছিল। দুই ভাই তাদের প্রণাম করে। ছোট ভাইয়ের গায়ে তখন হীরকখচিত পোশাক, পকেট উপচে পড়ছে মোহরে। মাকড়সাকে কেল্টিকরা উপকারের, আশীর্বাদের প্রাণী ভাবে।
শুধু রূপকথাতেই নয়, মাকড়সা জড়িয়ে আছে অনেক ধর্মের সাথে। তাওরাতে ডেভিডের কথা বলা আছে, তিনি পরে ইজরাইলের রাজা হন। শত্রুসৈন্য তাকে যখন ঘিরে ফেলেছিল, নিরুপায় হয়ে তিনি ঢুকে পড়েন এক গুহায়। এক মাকড়সা জাল বুনে গুহার মুখ ঢেকে দেয়। ফলে বেঁচে যান ডেভিড। একই ঘটনা ঘটেছিল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাথেও। গুহার সামনে মাকড়সা জাল বেঁধে ফেলে। শত্রুসৈন্য ভেবেছিল, মাকড়সার জাল যেহেতু ঠিকঠাকই আছে, এর মাঝে কেউ ঢুকতে পারে না।
মাকড়সাকে সবখানেই ধোয়া তুলসীপাতা ভাবা হয়, তা কিন্তু নয়। সপ্তদশ শতকের ইতালিতে এক নাচের মড়ক দেখা যায়। মানুষ পাগলের মতো দিনের পর দিন নাচতে থাকে। যদিও এটা কোনোরকম মানসিক ব্যাধি ছিল, মানুষজন ধরে নেয়, মাকড়সার কামড়ে এমনটা হচ্ছে।
জাদুবিদ্যায় মাকড়সা
মাকড়সাকে ঘুরতে দেখে বিরক্ত হয়ে মেরে ফেলবেন না, দুর্ভাগ্য নেমে আসতে পারে আপনার উপর- এমনটাই বিশ্বাস করেন অনেকে। তাছাড়া তন্ত্রচর্চায় মাকড়সাকে ব্যবহার করা হতো পশ্চিমা বিশ্বে। সিল্কের কাপড়ের ব্যাগে ভরে ঘাড় থেকে কেউ কেউ মাকড়সা ঝুলিয়ে রাখতেন নিজেদের কপাল ফেরাতে। প্যাগানদের বিশ্বাস ছিল, মাকড়সার বা তার জাল সৃষ্টির দেবীর চিহ্ন।
পুরনো দিনের ইংরেজী লোককথায় বলা হতো, কাপড়ে মাকড়সা পাওয়া গেলে দিনটা ভালো যাবে বা টাকা আসবে। সে যা-ই হোক, এর সবই গল্প। নিজের কপাল ফেরাতে কুসংস্কার মেনে নিরীহ কোনো মাকড়সার ক্ষতি না-ই বা করলাম আমরা!
ফিচার ইমেজ সূত্র: Jeremy Varner