পুরাণগুলো রচিত হয়েছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। সে যুগে সাহিত্যের মুখ্যধারা বলতে যা ছিল, তা এই পুরাণই। তাই, তখনকার সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপারে জানতে হলে পুরাণে মুখ গুঁজতেই হবে। পুরাণ রচয়িতাগণ ঠিক যে পুরাণ রচনা করেছিলেন, আজকের পুরাণগুলো একদম সে অবস্থায় নেই। যুগান্তরে সেগুলো পরিবর্তিত, পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়ে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে। অনুবাদের খাতিরেও পুরাণের বিভিন্ন সংস্করণ ভূ তথা ভারতের একেক অঞ্চলে একেক ভাষায় প্রচারিত হয়েছে। সেজন্যে একই প্রসঙ্গে একাধিক পৌরাণিক ঘটনা বা প্রেক্ষাপট বা চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা প্রকৃত রসবোদ্ধা, তারা এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েই পুরাণ থেকে রসাহরণ করেন।
শিব-পার্বতীর বিয়ের পর দেবতারা আবার আশায় বুক বাঁধতে থাকেন। কারণ তখন তারা ছিলেন বিতাড়িত। ভয়ংকর অসুর তারক ত্রিভুবন জয় করে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তারকের জন্ম এবং অজেয় হওয়ার গল্পটি দিয়ে এ লেখা শুরু করা যাক।
তারকের জন্মের আগে শুনতে হবে তার বাবা বজ্রাঙ্গের জন্মের গল্পটি। বজ্রাঙ্গের মা ছিলেন দিতি, বাবা ছিলেন কাশ্যপ। দেবতাদের হাতে একের পর এক দিতির সন্তান নিহত হওয়ার পর দেবতাদের প্রতি দিতির ক্রোধ সপ্তমে গিয়ে পৌঁছোয়। তিনি কাশ্যপের কাছে গিয়ে আবার শক্তিশালী পুত্রকামনা করেন, যে তার ভাইদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে এবং দিতির অপমানের শোধ তুলবে। কাশ্যপ তাকে দশ বছর বনে গিয়ে তপস্যা করতে বলেন। তপস্যার ফলস্বরূপ এমন পুত্রের বর দেন, যার অঙ্গ হবে বজ্রের ন্যায়।
কাশ্যপের বরে দিতি এক শক্তিশালী পুত্রের জন্ম দেন। পুত্র পরিণত বয়সে উপনীত হলে দিতি তাকে তার জন্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন। তখন বজ্রাঙ্গ দৈত্যবাহিনী নিয়ে স্বর্গ আক্রমণ করে ইন্দ্রকে পরাস্ত করেন। পরাজিত ইন্দ্রকে তিনি নানাভাবে অপমানিত করেন। শেষে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিতির সামনে এনে হাজির করা হয়। বজ্রাঙ্গ ইন্দ্রকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলে ব্রহ্মা ও কাশ্যপ এসে তাকে আটকান। তারা বলেন,
“পুত্র বজ্রাঙ্গ, ইন্দ্র দেবকুলের রাজা। তুমি তাকে পরাস্ত করেছ। বহুজনের সামনে বিভিন্নভাবে তাকে অপমান করেছ। তোমার মায়ের অপমানের প্রতিশোধও সম্পন্ন হয়েছে। তোমার তাকে মারা উচিত হবে না। মানী লোককে অপমান করলে সেটা তার কাছে হত্যার চেয়েও বড় শাস্তি। তুমি ইন্দ্রকে ছেড়ে দাও। এতে তোমার মহিমা প্রকাশ পাবে।”
ব্রহ্মা ও কাশ্যপের কথায় বজ্রাঙ্গ ইন্দ্রকে ছেড়ে দেন। দৈত্য হয়েও এমন দয়ার উদাহরণ স্থাপন করায় বজ্রাঙ্গকে ব্রহ্মদেব বর দিলে বজ্রাঙ্গ সতত ধর্মে মতি থাকার এবং তপস্বী হওয়ার বর চাইলেন। ব্রহ্মদেব খুশি হয়ে তাকে সেই বর দান করেন এবং বরাঙ্গী নামক এক অপরূপ, তপস্বীমনা কন্যা সৃষ্টি করে তার সাথে বজ্রাঙ্গের বিয়ে দেন। রাজপাট ছেড়ে বনে কুটির বানিয়ে তারা বসবাস করা শুরু করেন। বজ্রাঙ্গ সবসময় ঘরের বাইরে গিয়ে সাধনা করতেন। বরাঙ্গী ঘরে থেকে ঘর সামলাতেন আর ধর্ম-কর্ম নিয়ে পড়ে থাকতেন।
একদিন ইন্দ্র সেই বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বরাঙ্গীকে দেখে ভাবলেন, বজ্রাঙ্গ তার প্রতি যে অন্যায় করেছে সেটার প্রতিশোধ নেওয়া যাক। ইন্দ্র বানর হয়ে কুটিরের আশেপাশের সব গাছ উপড়ে ফেললেন। তারপর ভেড়া হয়ে গাছের সব পাতা, ভূমির তৃণ-ঘাস সব খেয়ে ফেলে সেখানে বিরানভূমির সৃষ্টি করলেন। তারপর কখনো সাপ হয়ে, কখনো শিয়াল হয়ে বরাঙ্গীকে ভয় দেখাতে লাগলেন। মেঘ হয়ে আশ্রমের উপর দিন-রাত বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলেন। বিভিন্নভাবে আশ্রমকে কলুষিত করার চেষ্টা করলেন ইন্দ্রদেব।
বরাঙ্গী তপস্যা করছিলেন। ইন্দ্রের উৎপাতে তার তপস্যার বিঘ্ন ঘটা শুরু হয়। তিনি তপস্যা পূর্ণ করতে পারলেন না। যখন বুঝলেন, এগুলো ইন্দ্রের কাজ, তখন ইন্দ্রকে শাপ দিতে উদ্যত হওয়া মাত্র ইন্দ্র নিজরূপে এসে বরাঙ্গীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। ইন্দ্র চলে যাওয়ার পরে ক্ষোভ ও দুঃখে বরাঙ্গী বনের এক প্রান্তে বসে কাঁদতে লাগলেন। বজ্রাঙ্গ তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করে পুনরায় ব্রহ্মদেবের দেখা পেলেন। এবারও একই বর চাইলেন, “প্রভু আমার সকল অসুরভাব দূর করে সর্বদা ধর্মে মতি রাখুন।” ব্রহ্মা সে বরই দিলেন। এতদিনের তপস্যার পরে বজ্রাঙ্গ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যখন কুটিরে ফিরলেন, তখন দেখলেন কুটিরে বরাঙ্গী নেই। খোঁজাখুঁজির পরে বরাঙ্গীর দেখা পেলেন। কাছে এসে দেখেন, তার পত্নী কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞাসা করার পর বরাঙ্গী বললেন,
“আপনি চলে যাওয়ার পর ইন্দ্র এসে এমন উৎপাত শুরু করে যে আমি আমার তপস্যা পূর্ণ করতে পারিনি। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গেছি আমি। স্বামী, আপনি আমাকে এমন পুত্রের বর দিন, যে আমাকে সকল উৎপাত থেকে বাঁচাবে।’
বজ্রাঙ্গ আবার মনে মনে ব্রহ্মদেবকে স্মরণ করলেন। ব্রহ্মদেব এসে বললেন, “আবার ঘোর তপস্যায় বসার দরকার নেই তোমার। আমি তোমার প্রতি সতত প্রসন্ন। বলো পুত্র, কী বর চাও?” বজ্রাঙ্গ বললেন, “হে প্রপিতামহ, আমায় এমন পুত্রের বর দিন যে দীর্ঘকাল দেবতাদের নানাভাবে উৎপীড়ন করে তাদের অহংকারের শাস্তি দেবে।” ব্রহ্মদেব মুচকি হেসে বললেন, “তুমি অতি ধার্মিক বজ্রাঙ্গ। তোমার মনের আশা পূর্ণ হোক।”
ব্রহ্মার বরে বজ্রাঙ্গ-বরাঙ্গী মহাতেজস্বী এক পুত্রের জন্ম দিলেন। পুত্রের নাম রাখা হলো তারক। তারকের পরে সুরপদ্ম ও সিংহমুখ নামক আরো দুই পুত্রের মা হলেন বরাঙ্গী। তারকের বাহুর বল, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেখে বরাঙ্গী তাকে ব্রহ্মদেবের তপস্যা করতে নির্দেশ দিলেন। হাজার বছরের তপস্যার পরে ব্রহ্মদেব তারককে দেখা দিয়ে বর দিলে তারক বর চাইলেন যে জগতের সবরকম প্রাণী কর্তৃক নিক্ষেপিত বা সৃজিত সবধরনের অস্ত্র যেন তার কাছে এসে ব্যর্থ হয়। ব্রহ্মা অপারগতা প্রকাশ করলে তারক বললেন, “তবে এমন বর দিন যে মহাযোগী মহাদেবের বালকপুত্রের হাতেই যেন আমার মৃত্যু হয়।” ব্রহ্মা বললেন, “তথাস্তু”।
ব্রহ্মার বরে অজেয় বীরে পরিণত হলেন তারক। তিনি কুটিরে ফিরে মা-বাবার আশীর্বাদ নিলেন। তারপর ভাইদের সাথে নিয়ে অসুরদের সংগঠিত করলেন। বিরাট বাহিনী তৈরি করলেন। দশজন সেনাপতির হাতে পুরো বাহিনীর ভার দেওয়া হলো। তারা হলেন জম্ভ, কুজম্ভ, মহিষ, কুঞ্জওর, মেমস, কালা নেমি, নিমি, মথন, জম্ভক আর শুম্ভ। একেকজন মহারথীর রথ, অস্ত্রাদি একেক রকম। কেউ গরুটানা রথে, কেউ বাঘেটানা রথে, কেউ হাতিটানা রথে, কেউ কুকুরটানা রথে যুদ্ধ করতে বের হলেন।
একেক সেনাপতি একেকজন দেবতার সমান শক্তিশালী। অসুরবাহিনী দেবলোক আক্রমণ করল। ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হলো। দেবতারা পরাজিত হলেন। স্বয়ং বিষ্ণু এলেন দেবতাদের সাহায্য করতে, তবুও তারা তারককে হারাতে পারলেন না। অসুরেরা সকল দেবতাকে বন্দী করল। তারক ইন্দ্রের আসনে বসে দেবতাদের অপমান করলেন। তাদের হত্যা না করে ছেড়ে দিলেন। ত্রিভুবনের অধিপতি বনে গেলেন তারকাসুর।
অসুরদের অপমান ও অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। সবাই ফন্দি আঁটতে লাগলেন কীভাবে শিবের বিয়ে দেওয়া যায়। শিবের সাথে পার্বতীর বিয়ে হয়ে গেলে সকল দেবতা ভাবলেন, এবার নিশ্চয়ই শিবপুত্র এসে আমাদের বাঁচাবে। হাজার বছর চলে গেল তবুও শিবের পুত্র হওয়ার নাম নেই। সকল দেবতা মেরু পর্বতে এক সভায় মিলিত হলেন। আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য, কীভাবে শিব পুত্রলাভ করবেন। দেবতারা সভা শেষ করে কৈলাসে এসে মহাদেবকে সব কথা খুলে বললে, মহাদেব তাদের নিজের স্খলিত বীর্য এনে দিলেন।
উল্লেখ্য, কার্তিকের জন্মপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু কিছু মতভেদ দেখা যায়। কেউ কেউ বলেন, এখানে কোনো রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গ আনা যাবে না। যোগবলে হর-পার্বতী কার্তিকের জন্ম দিয়েছিলেন। মহাদেবের বীর্য বা হর-পার্বতীর যোগশক্তি থেকে একটি প্রচণ্ড তেজস্বী জ্যোতির্গোলকের জন্ম হয়। অগ্নিদেব সেই গোলক নিজের ভেতর ধারণ করেন। তার তাপ সইতে না পেরে তিনি সপ্তর্ষির পত্নীগণকে (বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতী ব্যতীত) সে গোলক দান করলেন। তারা তাদের দেহাভ্যন্তরে কিছুদিন রাখার পরে ভ্রূণাকারে সে জ্যোতির্গোলক হিমালয়ে গিয়ে স্থাপন করলেন।
হিমবান কিছুদিন ধারণ করার পরে তার তেজ সইতে না পেরে গঙ্গায় বিসর্জন করলেন সে ভ্রূণ। গঙ্গা অনেক কষ্টে সেটি বয়ে চললেন। কিছুকাল পরে এক বনের ধারে সেটি রাখলেন। অল্পসময়ের ব্যবধানে সেখান থেকে একটি ফুটফুটে শিশু জন্মাল। শিশুটিকে স্তন্যদান করলেন ছয়জন কৃত্তিকা, যারা আকাশে তারা হয়ে থাকেন। কৃত্তিকাগণ কর্তৃক পালিত বিধায় তার নাম কার্তিক। কার্তিকের মাথা ছিল ছয়টি। শিবদূতগণ অনেক খোঁজাখুঁজি করে কার্তিককে কৈলাসে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। কার্তিক কৈলাসে এসে শিবকে ‘বাবা’ আর পার্বতীকে ‘মা’ বলে ডাকা শুরু করলেন।
দেবতারা খবর পেয়ে সবাই কৈলাসে ছুটে গেল শিবের পুত্রকে দেখতে। এমন তেজস্বী পুত্রই পারবে তারকাসুরকে বধ করতে। দেবতারা পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করলেন। তারকাসুর দেবতাদের স্পর্ধা দেখে হাসতে লাগলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার পরে দৈববাণী হলো, “ইন্দ্র, এই বালককে তোমরা দেববাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করো। জয় তোমাদেরই হবে।” দৈববাণী শুনে সব দেবতারা তাকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলেন। আবার, ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হলো দেবাসুরদের মধ্যে। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি ছোট্ট বালককে দেখে তারকাসুর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। বালকের তেজ পরীক্ষা করতে তিনি একটি মুদগর ছুঁড়ে মারলেন তার দিকে। কার্তিক সেটি বজ্র দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেন।
এবার তারক কার্তিকের দিকে একটি ভিন্দিপাল তুলে মারতে গেলে কার্তিক সেটি হাত দিয়ে ধরে তারককে মুগুর দিয়ে মারলেন। বালকের শৌর্য দেখে তারক মনে মনে ভাবলেন, এ হয়তো সেই বালক, যে তার কালরূপে আসার কথা। সর্বশক্তি দিয়ে তারকাসুর তখন কার্তিককে আক্রমণ করলেন। তারকের মায়াবী অস্ত্রশস্ত্র ব্যর্থ করে দিলেন শিশু কার্তিক। তারক একপর্যায়ে কার্তিকের বাহন ময়ূরকে আক্রমণ করলে ময়ূরের পিঠ থেকে কার্তিক পড়ে যান। ময়ূর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। পরে তারকের গদার আঘাতে কার্তিক আহত হলে দেবতারা তাকে উদ্ধার করে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে নিয়ে যান।
কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে শক্তি ফিরে পেলে কার্তিক তার শেলরূপী শক্তি অস্ত্র প্রয়োগ করে তারকাসুরের হৃদয়কে বিদ্ধ করেন। অসুরের ভয়ানক চিৎকারে যুদ্ধক্ষেত্র কেঁপে ওঠে। তারকাসুর কার্তিকের হাতে নিহত হয়। দেবলোকে পুনরায় দেবতাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম, চরিত্র, প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবিস্তর মতভেদ থাকতে পারে। তবে, গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীটিই অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, বর্ণ এবং মতবাদকে কোনোরূপ কটূক্তি বা কটাক্ষ বা অপমান করার অভিপ্রায়ে এ লেখাটি রচিত হয়নি।