পুরাণগুলো রচিত হয়েছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। সে যুগে সাহিত্যের মুখ্যধারা বলতে যা ছিল, তা এই পুরাণই। তাই, তখনকার সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপারে জানতে হলে পুরাণে মুখ গুঁজতেই হবে। পুরাণ রচয়িতাগণ ঠিক যে পুরাণ রচনা করেছিলেন, আজকের পুরাণগুলো একদম সে অবস্থায় নেই। যুগান্তরে সেগুলো পরিবর্তিত, পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়ে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
অনুবাদের খাতিরেও পুরাণের বিভিন্ন সংস্করণ ভূ তথা ভারতের একেক অঞ্চলে একেক ভাষায় প্রচারিত হয়েছে। সেজন্যে একই প্রসঙ্গে একাধিক পৌরাণিক ঘটনা বা প্রেক্ষাপট বা চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা প্রকৃত রসবোদ্ধা, তারা এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েই পুরাণ থেকে রসাহরণ করেন।
পুরাণের দেবতাদের হাতে অনেকরকম অস্ত্র-শস্ত্র শোভা পেতে দেখা যায়। অস্ত্র ও শস্ত্র একসাথে বলা হলেও দুটো কিন্তু আলাদা। অস্ত্র হলো, যেগুলো শত্রুর দিকে ছুঁড়ে মারা হয়। আর শস্ত্র হলো, যা হাতে রেখে যুদ্ধ করা হয়। তীর, শূল- এগুলো অস্ত্র। তলোয়ার, গদা হচ্ছে শস্ত্র। একেকজন দেব-দেবী একেক ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র ধারণ করেন। এগুলো তাদের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। কেউ কেউ সেগুলো দিয়ে কোনো অশুভ শক্তির নাশ করেছেন। আবার, ভক্তদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বর হিসেবে অনেকসময় দেবতারা তাদের সেগুলো প্রদান করেন।
অসুরেরা ত্রিমূর্তির কাছ থেকে অনেকরকম অস্ত্র-শস্ত্রের বর প্রাপ্ত হয়ে দেবতাদের পরাজিত করেছে। আবার, দেবতারা অসুরদের উপদ্রব থেকে বাঁচতে অস্ত্র-শস্ত্র উৎপাদন করে প্রতি-আক্রমণ করেছেন। পুরাণে মোটামুটি তিন হাজারের বেশি অস্ত্র-শস্ত্রের কথা উল্লেখ আছে। সব তো বলা সম্ভব নয়। সর্বাধিক চর্চিত কয়েকটির কথা বলি।
ব্রহ্মদেবের তিন অস্ত্র
ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা। তিনি চারহাতে পুঁথি-পুস্তক, কমণ্ডলু, জপমালা, পদ্ম ধারণ করে বসে থাকলেই এমন ভাবা ঠিক হবে না ব্রহ্মদেবের আশীর্বাদজাত কোনো অস্ত্র-শস্ত্র নেই। ব্রহ্মদেবের আশীর্বাদজাত অস্ত্র তিনটি– ব্রহ্মাস্ত্র, ব্রহ্মশিরাস্ত্র ও ব্রহ্মদণ্ডাস্ত্র। ভয়ংকর সেগুলোর বিধ্বংসী ক্ষমতা। তিনটি অস্ত্রই মহারথীরা ব্যবহার করেন। এ তিনটি অস্ত্র লাভ করতে হয় কঠোর তপস্যার দ্বারা। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এ তিনটি অস্ত্র প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, একজন গুরু, তিনি স্বয়ং ব্রহ্মদেবও হতে পারেন, তার শিষ্যকে শুধু এগুলো দান করতে পারবেন।
কঠিন ও কঠোর তপস্যার পরে এগুলো লাভ হয়। বলা হয়, দিনে একবারই কেউ এগুলো নিক্ষেপ করতে পারবেন এবং একবার এগুলো আহ্বায়িত হলে নিক্ষেপ না করে উপায় নেই। ব্রহ্মাস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতা যে কারো হাড় কাঁপিয়ে দেবে। এটি অনেকটা পারমাণবিক বোমার মতো। যেখানে নিক্ষেপিত হবে, পুরো এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, চৌদ্দ বছর সেখানে কোনো ফসল ফলবে না, সেখানকার জীবেরা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেবে। ব্রহ্মশিরাস্ত্র ব্রহ্মাস্ত্রের তুলনায় চারগুণ শক্তিশালী। এ অস্ত্রগুলোর সম্মুখভাগে স্বয়ং ব্রহ্মা গিয়ে অধিষ্ঠিত হন বলে এগুলো অমোঘ ও অব্যর্থ। ব্রহ্মার চার মাথা ব্রহ্মশিরাস্ত্রের চারটি মাত্রা প্রকাশ করে।
ব্রহ্মদণ্ডাস্ত্র এগুলোর চেয়েও শক্তিশালী। কথিত আছে, ব্রহ্মাস্ত্র ও ব্রহ্মশিরাস্ত্রকে ঠেকানোর ক্ষমতা আছে একমাত্র ব্রহ্মদণ্ডাস্ত্রের। তবে, ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এটি নিক্ষেপিত হলে চোখের পলকে এটি পুরো সংসারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের যুদ্ধগুলোতে এ তিনটি অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। ব্রহ্মদেবের তপস্যা করে অসুরেরা এ অস্ত্রগুলো লাভ করে দেবতাদের পরাজিত করত।
বৈষ্ণবাস্ত্র
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এর সাথে বিষ্ণুর সম্পর্ক রয়েছে। বৈষ্ণবাস্ত্র ব্রহ্মাস্ত্রের ন্যায়ই ভয়ংকর। এটিও অনেক তপস্যার ফলে লাভ হয়। এটি নিক্ষেপিত হলে আকাশে একটি গহ্বরের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে শত্রুর উপর তীর, গদা, চক্র ইত্যাদি নিক্ষেপিত হয়। এর তীব্রতা বাড়ানো বা কমানো যায়। এটিও ব্রহ্মদেবের অস্ত্রগুলোর ন্যায় দিনে একবারই ব্যবহার করা যায়। দ্বিতীয়বার ব্যবহার করলে এটি নিক্ষেপণকারীকে বা তার পক্ষকেই গ্রাস করে। এ অস্ত্র থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, এর সামনে নিজেকে সমর্পণ করা। কেউ নিজেকে সমর্পণ না করলে বা কিঞ্চিত করলে সে সেভাবেই এর দ্বারা আক্রান্ত হবে।
মহাভারতে অশ্বত্থামা একবার পাণ্ডব বাহিনীর উপরে এটি প্রয়োগ করলে কৃষ্ণ সবাইকে বৈষ্ণবাস্ত্রের সামনে নিজেদের সঁপে দিতে বলেন। সবাই নিজেকে সঁপে মুক্তি পেলেও ভীম তা করেন না। এতে অস্ত্রের পুরো প্রভাব তার উপরে গিয়ে পড়ে। শেষে, কৃষ্ণ বৈষ্ণবাস্ত্রকে নিজের গলায় মালা বানিয়ে ধারণ করলে ভীম সেটির প্রকোপ থেকে রক্ষা পান।
পাশুপতাস্ত্র
শিবের আরেক নাম পশুপতি। সেখান থেকেই এ অস্ত্রের নামকরণ। এ অস্ত্রের এমন গুণ যে, কেউ একে হাত দিয়ে ছুঁড়ে বা চোখ দিয়ে ইশারা করে বা মুখ দিয়ে নির্দেশ দিয়ে বা মন থেকে চিন্তা করে নিক্ষেপ করতে পারেন। ধনুকের জ্যা থেকে মোটা দড়ি, সূক্ষ্ম তন্তু থেকে দুর্বল ঘাস যেকোনো মাধ্যমেই এটি ছোঁড়া যায়। অনেক সাধনার পরে এটি লভিত হয়। পাশুপতাস্ত্রের মন্ত্র বা শিক্ষা শিব একমাত্র নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন। এ অস্ত্র সাধারণত ব্যবহৃত হয় ধর্মের পথে অটল কোনো ধার্মিক যোদ্ধার পতন ঘটাতে। মহাভারতে অর্জুন শিবের তপস্যা করে শিবের কাছ থেকে এটি লাভ করেছিলেন। পাশুপতাস্ত্র দিয়ে তিনি সিন্ধুরাজ জয়দ্রথকে বধ করেন। শিবের আরেকটি অস্ত্র আছে- রুদ্রাস্ত্র। বলা হয়, এটি তার তৃতীয় নয়নের তেজ।
দেবরাজ ইন্দ্রের অস্ত্র
ইন্দ্রের নাম উঠলেই প্রথমে আসবে তার বজ্রের কথা। একে বজ্রাস্ত্র বলা হয়। দধীচির হাড় থেকে তিনি এটি লাভ করেছিলেন। এটি ঠিক বজ্রের মতোই। নিক্ষেপিত হলে উচ্চমাত্রায় বৈদ্যুতিক আবেশ তৈরি করে সবকিছু জ্বালিয়ে দেয়। ইন্দ্রের আরেকটি অস্ত্র হলো, বাসব শক্তি। এটি শুধু একবারই ব্যবহার করা যায়। এজন্য একে ‘একাঘ্নী অস্ত্র’ বলা হয়। এর এমন গুণ যে, যাকে উদ্দেশ করে এটি নিক্ষেপিত হবে, তার নাশ না করা পর্যন্ত এটি থামবে না। ছল করে কর্ণের কবচ ও কুণ্ডল চুরি করার পরে ইন্দ্র কর্ণকে এই অস্ত্র প্রদান করেছিলেন। কর্ণ এটি অর্জুনকে বধ করার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। পরে, পরিস্থিতির চাপে কর্ণ ভীমের পুত্র ঘটোৎকচকে বধ করতে সেটি ব্যবহার করতে বাধ্য হন।
আগ্নেয়াস্ত্র ও বরুণাস্ত্র
আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপিত হলে শত্রুর উপর অগ্নির স্ফুলিঙ্গ, অগ্নিগোলক ইত্যাদি নিক্ষেপিত হয়। এটি অগ্নিদেবের আশীর্বাদজাত অস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্রের ঠিক বিপরীত বরুণাস্ত্র। এটি নিক্ষেপিত হলে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। বরুণ জল বা সমুদ্রের দেবতা। তার সাথে সম্পর্কিত অস্ত্রে পানির প্রকোপ থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। মূলত আগ্নেয়াস্ত্রকে প্রশমিত করতে বরুণাস্ত্র নিক্ষেপিত হয়।
নাগাস্ত্র ও গরুড়াস্ত্র
নাগ মানে সাপ। নামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এর প্রকোপ। এটি নিক্ষেপিত হলে শত্রুর শিবিরে ভয়ানক বিষধর সাপের আগমন ঘটত। সাপের ছোবলেই তারা প্রাণ হারাত। এক্ষেত্রে আরেকটি অস্ত্রের প্রচলন আছে। নাগপাশ। সাপ দিয়ে তৈরি পাশ। এটির প্রভাবে শত্রু বীভৎস, বিষধর ও শক্তিশালী কোনো সাপের পাশবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ত। এতে শত্রুর আর নড়বার উপায় থাকত না। রামায়ণে মেঘনাদ এটি প্রয়োগ করে রাম-লক্ষ্মণকে আবদ্ধ করেছিলেন। নাগাস্ত্রের প্রতিকার গরুড়াস্ত্র। গরুড় নাগদের শত্রু। নাগেরা গরুড়ের খাদ্য। নাগাস্ত্রের প্রভাব হ্রাস করতে ও উদ্ভূত সাপগুলোকে সরাতে পুরাণের যোদ্ধাগণ গরুড়াস্ত্র প্রয়োগ করতেন।
বায়ু অস্ত্র ও সূর্যাস্ত্র
বায়ু অস্ত্র বায়ুদেবতার ন্যায় প্রকোপশালী অস্ত্র। এটি নিক্ষেপিত হলে প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝা সৃষ্টি হতো। মহাভারতে অর্জুন কর্ণের উপর এটি প্রয়োগ করেছিলেন। সূর্যাস্ত্র যেখান প্রয়োগ করা হতো, সেখানে সূর্যের ন্যায় তেজস্বী জ্যোতির্গোলকের আবির্ভাব ঘটত। মূলত অন্ধকার ও মায়া কাটাতে এটি নিক্ষেপিত হতো। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন শকুনির উপর এ অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন।
মোহিনী অস্ত্র ও ত্বষ্ট্রাস্ত্র
মোহিনী বিষ্ণুর একটি রূপ। বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধরে অসুরদের মন ভুলিয়েছিলেন। মোহিনী নামের সাথে তাই মায়া জুড়ে আছে। মোহিনী অস্ত্র প্রয়োগ হয় মায়া সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। এটি নিক্ষেপিত হলে শত্রু শিবিরে মায়া সৃষ্টি হতো। ত্বষ্ট্রাস্ত্র আরেক অদ্ভুত অস্ত্র। এটি শত্রুপক্ষে নিক্ষেপিত হলে শত্রু সেনারা নিজেরা নিজেদের শত্রু ভেবে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু করে দিত।
পুরাণের দেবতাদের হাতে অনেকরকম অস্ত্র বা শস্ত্র শোভা পেতে দেখা যায়। শিবের হাতে ত্রিশূল, বিষ্ণুর হাতে সুদর্শন চক্র, কার্তিকের হাতে ভেল, কালীর হাতে খড়গ ইত্যাদি। সেগুলো নিয়ে আরেকটি লেখায় বলা যাবে। আজকের অস্ত্রগুলোর সবগুলোই গুরু তার শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। পুরাণে বর্ণিত এ অস্ত্রগুলো একেকটি একেক তাৎপর্য বহন করে। একেক দেব-দেবীর মাহাত্ম্য বা শক্তি প্রকাশ করে। সেগুলো নিয়েও পরে কোনো লেখায় বলা যাবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম, চরিত্র, প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবিস্তর মতভেদ থাকতে পারে। তবে, গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীটিই অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, বর্ণ এবং মতবাদকে কোনোরূপ কটূক্তি বা কটাক্ষ বা অপমান করার অভিপ্রায়ে এ লেখাটি রচিত হয়নি।