প্রাচীন আমেরিকান উপকথায় থরে থরে সাজানো আছে হাজারও রহস্যময় লোককাহিনী। আছে গল্পের ডালি ভরা বিচিত্র সব রূপকথা। এসব রূপকথা কখনো অশ্রুপাত ঘটিয়েছে পাঠকের চক্ষুযুগলে, কখনো আবার নিয়ে গেছে রোমাঞ্চকর পৌরাণিক কাহিনীর পানে। আজকের এ কাহিনী তেমনই। একজন রানী, যিনি কিনা রহস্যেমোড়া স্থান ডেথ ভ্যালির কিংবদন্তী।
হাজার বছর পূর্বে, সিয়েরা নেভাদার উঁচু পাহাড়সারির দক্ষিণ-পূর্ব পাদদেশ ঘিরে ছিল তিমবাশা শোশোনে নামক এক উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা ও উটাহ প্রদেশের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এ স্থান ছিল বৈচিত্র্যময়। ছিল নীল জলরাশির স্বচ্ছ সরোবর আর রংধনু রংয়ের সুরভিত ফুল-ফলের বাগান। মৌমাছির গুঞ্জনে এ অঞ্চলের কুঞ্জবনও মাতোয়ারা ছিল সেসময়।
উর্বর বেলে-দোয়াশ মাটিতে আশির্বাদপুষ্ট এ মানুষগুলোর হাতে বোনা ফসলের প্রতিটি বীজ তারকারাজির মতো আলো ছড়াতো। গোলা ভরে উঠতো গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী ও মটরশুঁটির দানায়। বন্য মিষ্টি বাদাম সংগ্রহে দুঃসাহসী এ মানুষগুলো বেয়ে উঠতো পাহাড়ের গা। সুউচ্চ চূড়া থেকে পেড়ে আনতো থোকা থোকা সুমিষ্ট জাদুকরী ফল। মাটির সাথে মানবের এমন সম্পর্ক প্রকৃতির আশির্বাদ ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে!
নির্মল এ রাজ্য পরিচালনার গুরুভার ছিল এক রূপসী রানীর হাতে। নিজের জ্ঞান, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও মোহনীয় রূপ-লাবণ্য দ্বারা তিনি জয় করে নেন শোশোনে রাজ্যবাসীর মন। আর তাই সহজ-সরল এ মানুষগুলোও তাকে রানী হিসেবে মেনে নেয় সাদরে। তার চরণতলে নিজেদের সঁপে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। রানীও নিজের মমতাময়ী ছায়াতলে আপণ করে নেন প্রজাদের। সুজলা-সুফলা এ ভূমি চাষাবাদ হতে থাকে রানীর নামে। ফুলে-ফসলে ভরে ওঠে চারিধার। ঘ্রাণে মৌ মৌ করে মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর।
কিছুদিন পর, দূর-পূবের রাজ্যে ভ্রমণে বের হন রানী। সেখানে অ্যাজটেকের সুশোভিত অট্টালিকার দর্শনে মুগ্ধ হন তিনি। নিজের এমন একটি প্রাসাদে বসে রাজ্য পরিচালনা করবেন, এটা তার বহুদিনের ইচ্ছে। আর তাই ফিরে এসেই জনগণকে আদেশ দিলেন, সরোবরের পাশে একটি জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ নির্মাণের। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়সওয়ারের দল ছুটে গেল দূরদেশ পানে। শস্যের বিনিময়ে নিয়ে আসা হলো কারুকার্যখচিত মারবেল পাথর ও প্রাসাদ নির্মাণের প্রয়োজনীয় রসদ। রানীর স্বপ্ন পূরণে প্রজারাও গায়েগতরে খেটে শুরু করলো নির্মাণকাজ।
বছর পেরিয়ে যায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। নির্মিতব্য প্রাসাদে আসীন হতে রানীরও যেন আর তর সইছে না। হৃদয়ের মনিকোঠায় খেলে যায় কত সুখ-কথা; আনন্দেও তাই আটখানা তিনি। এমনই একদিনে, আনন্দের রেশ কেটে রানীর মনে উদিত হয় নতুন এক ভয়, উঁকি দেয় উৎকণ্ঠা। যেভাবে কাজ আগাচ্ছে তাতে হয়তো মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত প্রাসাদ নির্মাণকাজ থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। ফলে, রাজপ্রাসাদে বসে রাজ্য পরিচালনার সৌভাগ্য বুঝি আর হবে না!
আর তাই শ্রমিকদের কাজের সাহায্যে নিজের পরিবারের সদস্যদেরও হাত লাগাতে বললেন তিনি। কমিয়ে আনা হলো রাজ্যবাসীর আড্ডা, কোলাহল, অবসর-বিনোদনের সময়। এমনকি, গাত্রবর্ণ পুড়ে যাওয়া গরমেও পিপাসার্ত মানুষগুলো একটু ছায়ায় বসলেই পিঠে পড়া শুরু হলো চাবুকের ঘাঁ। প্রজারা ভাবলেন- হায়, এ কী হলো! আভিজাত্যের মোহে মোদের গুণবান রানী যে পরিণত হয়েছেন নিষ্ঠুর এক মানবীতে।
প্রজাদের এ ভাবনার সত্যতা প্রকাশ পায় একদিনের ঘটনায়। রানী তার ছোট্ট রাজকন্যাকে দেখতে পেলেন অতি সন্তর্পণে পাথর উত্তোলন করছে। কাজে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে ভেবে তখনই রাগে ফুঁসে উঠলেন তিনি। গর্জে উঠলো তার চাবুক। শপাং শপাং করে কয়েক ঘাঁ পড়লো রাজকন্যার শুভ্র পা ও কোমল পিঠে। মায়ের এমন রুঢ় আচরণে খুবই মর্মাহত হলো সে। তৎক্ষণাৎ রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় মায়ের রাজ্য ও সদ্যনির্মিত প্রাসাদের প্রতি অভিসম্পাত করে বসে। তারপর? তারপর তলিয়ে যায় গরম বালুকাময় সেই প্রান্তরে।
ভয়ানক এ ঘটনা রানী ও সকল প্রজার মনে গভীর ছাপ ফেলে। ভয়ের সঞ্চার করে রাজ্যজুড়ে। মাত্রাতিরিক্ত লোভে যে একজন অশুভ মানবীতে পরিণত হয়েছেন তিনি, তা বুঝতে বাকি রইলো না রানীরও। ততক্ষণে এ-ও বুঝতে পেরেছেন, স্বপ্নময় স্বর্গপুরী রাজ্য, প্রিয় প্রজা ও তাদের সুখী-প্রাণবন্ত জীবনধারাকে সে পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে সরলতায় পরিপূর্ণ অনাবিল শান্তির জীবনকে। এখন আর কারও মনে উল্লাস নেই। নেই সেই আগের স্বাচ্ছন্দ্যময় মুহূর্তগুলো।
নিজের এ ভুলের কারণে মুষড়ে পড়লেন রানী। হায় আফসোস! ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে প্রতিনিয়ত ফুঁসে ওঠছে। সূর্যের প্রখর তাপে ঝলসে যেতে শুরু করেছে সবুজ মাঠ, পুড়ে ছাইবর্ণ ধারণ করছে ফল-ফসলের বাগান। অদূরে স্বচ্ছ নীল সরোবরটি পানির অভাবে করছে খাঁ খাঁ। অবশেষে, উর্বর প্রান্তরটিও পরিণত হয়েছে শুষ্ক মরুভূমিতে।
দিন যায়, রাজ্যের প্রজারাও খাবার ও পানীয় জলের অভাবে একে একে অসুস্থ হতে থাকে, হারিয়ে যেতে থাকে মৃত্যুপুরীতে। তা দেখে বাকিরা পালিয়ে যায় দূরের কোনো রাজ্যে। রয়ে যায় শুধু সেই নিষ্ঠুর রানী আর তার অর্ধসমাপ্ত লোভের প্রাসাদ। সেবাশুশ্রূষার অভাবে, রোগ-শোকে একদিন মারা গেলেন তিনিও। অতঃপর, শূন্য এ প্রান্তর মনুষ্যবিহীন অবস্থায় পার করেছে আরও হাজারও বছর।
বহুকাল পর হঠাৎ একদিন একদল রত্নসন্ধানী মানুষের আগমন ঘটে এখানে। হীরা-জহরত, মূল্যবান মনি মুক্তার আশায় এখানে এসেছে তারা। কিছুদিন এখানে থাকার পর হয়ে আসে ফেরার সময়। আর তখনই বাধে বিপত্তি। হারিয়ে ফেলে ফিরে যাওয়ার রাস্তা। ধু ধু মরুর বুকে আটকা পড়ে তারা। অতঃপর, তীব্র পিপাসা ও মরণ যন্ত্রণায় কুপোকাত হয়ে কোনো একদিন সেখান থেকে বেঁচে ফিরে তারা। মৃত্যুর মুখ থেকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে ফিরে আসা এ মানুষগুলো এই স্থানের নাম দেয় ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা।
তখন থেকে বহুবছর পর্যন্ত এ স্থান সম্পর্কে মানুষজন বিশ্বাস করতো, পথিকের দল অভিশপ্ত এ জায়গা অতিক্রমের সময় বেঁচে ফিরে না। তাই, ভুল করেও কেউ এ পথে পা বাড়ানোর সাহস করতো না। কেননা, দিক হারানোর ভয়ের পাশাপাশি মরুবাহন উট ও শক্তিশালী ঘোড়ারাও আটকে যেত এর ভয়ংকর চোরাবালিতে। অতঃপর, তাদেরও পরিণতি হতো ছোট্ট রাজকন্যার মতো। তলিয়ে যেত চিকচিক করা বালির অতল গহ্বরে। ধারণা করা হয়, এখনও অনেক মৃত মানুষ ও প্রাণীর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে অভিশপ্ত এই জনমানবহীন স্থানে।
আজ বহুকাল পর, মার্কিন এই মুলুকের আশেপাশে পুনরায় গড়ে উঠেছে বসতি। তৈরি হয়েছে আড়ম্বরপূর্ণ অট্টালিকা। তবে, লোকমুখে এখনও শোনা যায় সেই স্বপ্নপুরী রাজ্যের হৃদয়বিদারক কাহিনী। বর্ণনা মেলে শোশোনে উপজাতির কিংবদন্তী রূপসী রানীর অর্ধনির্মিত প্রাসাদেরও, যা নাকি আজও ঝলমলে পূর্ণিমার রাতে ভেসে ওঠে ডেথ ভ্যালির রহস্যঘেরা বেলাভূমিতে!