সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগোরে
ঘুম ঘুম থাকে না ঘুমেরই ঘোরে।
একটি পারুল বোন আমি তোমার
আমি সকাল সাঝে শত কাজের মাঝে
তোমায় ডেকে ডেকে সারা
দাও সাড়া গো সাড়া।
সাত ভাই চম্পার কাহিনী বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বাংলায় প্রচলিত ১০টি সেরা উপকথাকে যদি তালিকা করা হয় তাহলে সাত ভাই চম্পার উপকথা অবশ্যই থাকবে। শীতের রাতে গোল হয়ে বসে দাদীমা কিংবা নানীরা তাদের নাতি-নাতনীদের কাছে সাত ভাই চম্পার কাহিনী বলেন। একজনের বলা কাহিনীর সাথে অন্য জনের বলা কাহিনীর মাঝে কিছু পার্থক্য থাকে। একেকজনের মুখে এই গল্পের সাথে একেকরকম রস মিশ্রিত হয়। তবে কিছু কিছু কাহিনী আছে যাদের জন্মই হয় এই মুখ থেকে ঐ মুখে ভিন্নতা তৈরি হবার জন্য। এসব গল্প একজন থেকে আরেকজনের মুখে মুখে রংচং মেখে রঞ্জিত হলে কাহিনীর কোনো ক্ষতি হয় না, বরং আরো প্রাণ পেয়ে উঠে। এরকমই একটি লোককাহিনী হলো সাত ভাই চম্পার কাহিনী।
শত শত বছর ধরে এটি মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকলেও প্রথম গ্রন্থিত আকারে প্রকাশ করেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার। তার কালজয়ী রচনা ঠাকুরমার ঝুলিতে এই গল্পটি সংকলিত হয়েছিল। ঠাকুরমার ঝুলিতে তিনি লোকগাথাগুলোকে শুধু সংগ্রহ করেই সন্তুষ্ট হননি, রূপকথার কাল্পনিক চিত্রগুলোও এঁকেছিলেন নিজের হাতে। বর্তমানে বাজারে প্রচুর রূপকথার বই কিনতে পাওয়া যায়। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে সেসব কিনে দেন। এসব রূপকথার গল্পের বইয়ের বেশিরভাগেই গ্রন্থিত থাকে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প। আর নির্বাচিত সেসব গল্পের মাঝে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে সাত ভাই চম্পার গল্প।
এর কাহিনী অনেকটা এরকম- এক দেশে থাকে এক রাজা। রাজার ৬ বউ। পরপর ৬টি বিয়ে করেছেন কিন্তু কোনো বিবির ঘরেই কোনো সন্তান হয় না। এ নিয়ে রাজার মনে বেজায় দুঃখ। শুধু রাজাই নয়, রাজ্যের সকল প্রজাদের মাঝেও অসন্তোষ। এ কেমন অপয়া রাজা যার ঘরে ছয়টি বউ থাকা সত্ত্বেও একটি সন্তানের জন্ম হয় না? প্রজাদের এমন অসন্তোষ দেখে রাজা আরো দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে গেলেন। একদিন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে জানতে পারলেন, আরো একটি বিয়ে করলে সপ্তম বিবির ঘরে আসবে কাঙ্ক্ষিত সন্তান।
সন্তানের আশায় তিনি বিয়ে করলেন আবার। নতুন বিবি ঘরে এনেছে দেখে আগের ছয় বিবির গায়ে জ্বলুনি উঠে যায়। আগের রানীদের ছয় জনই খুব অহংকারী, দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। ছোট রানী খুব শান্ত ও নম্র। এজন্য রাজা ছোট রানীকে বেশি ভালোবাসতেন। ফলে ছয় রানীর চোখের বিষ হয়ে যায় ছোট রানী। একদিন খবর আসে ছোট রানী সন্তানসম্ভবা। এই খুশিতে প্রজাদের জন্য রাজকোষ এবং রাজভাণ্ডার খুলে দেন রাজা। সেখান থেকে প্রয়োজন মতো অর্থ ও সম্পদ নিতে পারবে প্রজারা। দেখতে দেখতে জন্মের সময় চলে এলো। আতুর ঘরে রইলেন ছয় রানী এবং একজন গৃহপরিচারিকা। বাইরে সন্তানের মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন রাজা।
একপর্যায়ে ভেতর থেকে খবর এলো দেখার জন্য। কিন্তু রাজা গিয়ে দেখেন সেখানে পড়ে আছে কতগুলো কুকুরের ছানা। রাজার ঘরে জন্মেছে কুকুর ছানা? এ যেন পরিবারের অপয়া দূর করার চেয়ে আরো বাড়িয়ে দিলো। দুঃখে-ক্ষোভে ছোট রানীকে বনবাসে পাঠিয়ে দিলেন রাজা।
কিন্তু রানী আসলে সাতটি ছেলে এবং একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। হিংসুটে ছয় রানী চক্রান্ত করে জন্মের পরপরই ছেলেগুলোকে সরিয়ে ফেলে। কাঁচা মাটির পাত্রে ভরে তাদেরকে পুতে দেয় প্রাসাদের পেছনের বাগানে। তারাই চক্রান্ত করে আতুর ঘরে এনে রাখে কতগুলো কুকুরের ছানা। যেন রাজা দেখেই অপমানিত হয় এবং ছোট রানীকে প্রাসাদের বাইরে তাড়িয়ে দেয়। তাদের চক্রান্ত সফল হয় এবং দাসী হয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকে ছোট রানী।
এভাবে চলতে থাকে, দিন দিন খাঁ খাঁ করতে থাকে রাজবাড়ি। একদিন বাগানের মালী এসে জানায় পূজা দেবার জন্য বাগানে যথেষ্ট ফুল নেই। একটি গাছে শুধু সাতটি চম্পা আর একটি পারুল ফুল আছে। রাজা বললেন, এগুলোকেই নিয়ে আসো। মালী ফুল আনতে গেলে তারা হাতের নাগালের বাইরে উপরে উঠে যায়। মালী আবারো ধরতে গেলে বলে, রাজা না আসলে এই ফুল ছিঁড়তে দেবে না। এমন অদ্ভুত ঘটনা শুনে রাজা সাথে সাথে চলে আসলেন। আসার পর তারা আবার জানায়, বড় রানী না আসলে ফুল দেবে না। বড় রানী আসার পর জানায়, মেজ রানী না আসলে দেবে না। মেজ রানী আসলে আবার জানায় সেজ রানীর দাবী। এভাবে সকল রানী আসার পর সাতটি চম্পা ফুল বলে বনবাসে যাওয়া দুঃখী ছোট রানী না আসলে কাউকে ফুল ছিঁড়তে দেয়া হবে না। ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে বন থেকে খুঁজে বের করে আনা হলো ছোট রানীকে।
ছোট রানীর গায়ের কাপড় ছেড়া। এই বেশেই ফুল তোলার জন্য হাত বাড়ালেন, আর অমনিই কোলে নেমে আসে সাতটি রাজপুত্র আর একটি রাজকন্যা। মানবরূপ ধারণ করার সাথে সাথেই তারা মা মা বলে ডাকা শুরু করলো ছোট রানীকে। পুতে দেবার ফলে তারা মরে যায়নি, বাগানের ফুল হয়ে বেঁচে ছিল এতদিন। এরপর তারা ছয় রানীর কর্মের কথা বললেন রাজাকে। এমন অমানবিক কাজের কথা শুনে ছয় রানীকে কাটা দিয়ে পুতে ফেলার আদেশ দিলেন রাজা। এরপর রাজা সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলেন এবং রাজ্যেও অপয়া কেটে গিয়ে বিরাজ করতে লাগলো সুখ আর সুখ।
তবে সকল বর্ণনায় উপকথাটির রূপ এমন থাকে না। কিছু কিছু বর্ণনায় ভিন্নতা পাওয়া যায়। যেমন একটি বর্ণনা বলছে, সাত ভাই চম্পাকে আসলে আগের ছয় রানীরা মারে না। মারে ছোট রানীর দুই বোন। বোন কেন বোনের সন্তানকে মারতে যাবে তার বর্ণনাও চমৎকার। এখানেও রাজা থাকেন প্রজাদের প্রতি দরদী। রাতে ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘুরে বেড়াতেন রাজ্যের মাঝে এবং গোপনে জানার চেষ্টা করতেন রাজ্যের সুবিধা অসুবিধার কথা।
একদিন রাতে ছদ্মবেশে বেড়িয়ে এক বাড়িতে কান পেতে শুনতে পান তিন বোন খোশগল্প করছে। এক বোন আক্ষেপ করে বলছে, “রাজবাড়ির ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো তাহলে মনের সুখে ঘুরতে পারতাম।” এ কথা শুনে আরেক বোন বলে উঠে, “রাজবাড়ির বাবুর্চির সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো তাহলে মজার মজার খাবার এমনি এমনিই খেতে পারতাম।” ছোট বোনের ছিল দুঃসাহস। দুই বোনের ইচ্ছের কথা শুনে বলে উঠলো “রাজার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো, তাহলে আমি রানী হতে পারতাম!” গরীব কাঠুরের মেয়ের মুখে এমন অদ্ভুত ইচ্ছের কথা শুনে দুই বোন হেঁসে উঠলো। রাজা ঘরটিকে চিহ্নিত করে আজকের মতো চলে গেলেন।
পরের দিন তাদেরকে রাজ দরবারে ডাকলেন এবং তাদের ইচ্ছের কথা জানতে চাইলেন। বললেন, সত্য কথা বললে রাজা তাদের বাসনা পূরণ করে দেবেন। তারা সকলে সত্য কথা বললো এবং সে অনুসারে এক বোনকে রাজবাড়ির ঘোড়সওয়ারের সাথে আর এক বোনকে রাজবাড়ির বাবুর্চির সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। ছোট বোনকে রাজা নিজে বিয়ে করলেন। রাতে ইচ্ছে করাতে স্বয়ং রাজা বিয়ে করে ফেলেছে ওকে, এমনটা দেখে হিংসায় মরে যেতে লাগলো বড় দুই বোন। শুধুমাত্র ইচ্ছে করার সময় ভালো কিছু করলে তারাও পেয়ে যেত ভালো পুরষ্কার।
একসময় নতুন রানীর ঘরে সন্তান আসার খবর আসে। দুই বোন রাজাকে গিয়ে বলে- আমরা তো পরস্পর বোন, আমরাই থাকি আতুর ঘরে। তা-ই হলো। কিন্তু যতগুলো সন্তানের জন্ম দিলো রানী তার সবগুলোকেই মাটির পাত্রে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিলো হিংসুটে দুই বোন।
গল্পের আরেক ভার্সনে দেখা যায় ছয় রানী শুধু ছেলেগুলোকে পুতে দেয়। তারা যখন ছেলেগুলোকে পুতে দেয়ায় ব্যস্ত, তখন তাদের অগোচরে জন্ম নেয় একটি কন্যা সন্তান। আর কন্যার জন্মের সময় উপস্থিত থাকে একজন গৃহ পরিচারিকা। এই কন্যাটিকেও তারা পুতে ফেলবে এই ভয়ে সে চুপি চুপি চুরি করে নিজের ঘরে নিয়ে যায় একে। কন্যা সন্তানটি এই পরিচারিকাকেই মা হিসেবে জেনে বড় হয়। পরবর্তীতে এই কন্যা সন্তানের ভূমিকাতেই সাত ভাইয়ের রহস্য উন্মোচিত হয়।
এই উপকথাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত সব অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। পূর্ব-পাকিস্তান আমলে ১৯৬৮ সালে দীলিপ সোমের পরিচালনায় সাত ভাই চম্পা নির্মিত হয়েছিল। এখানে অভিনয় করেছিলেন কবরী, খান আতাউর রহমান সহ অনেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য ধারণকারী কয়েকটি চলচ্চিত্র যদি তালিকা করা হয় তাহলে এটি নিঃসন্দেহে একটি। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত হয় আরেকটি সাত ভাই চম্পা। দুটি চলচ্চিত্র তুলনা করলে দেখা যাবে দুটি চলচ্চিত্রের কাহিনী মূলত একই, শুধু সংস্কৃতিগত কিছু পার্থক্য আছে কিছু। যেমন বাংলাদেশী সাত ভাই চম্পা ছিল মুসলমান কেন্দ্রিক, আর পশ্চিমবঙ্গের সাত ভাই চম্পা ছিল সনাতন ধর্ম কেন্দ্রিক। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আরো একটি সাত ভাই চম্পা নির্মিত হয়। এটি মূলত সব দিক থেকেই ১৯৬৮ সালের চলচ্চিত্রটির রিমেক। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে রাজার মেয়ে পারুল নামে কলকাতা কেন্দ্রিক আরো একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এটিও মূলত সাত ভাই চম্পারই কাহিনী। সাত ভাইয়ের রূপ হলো চম্পা (চাঁপা ফুল) আর বোনের নাম হলো পারুল। সম্প্রতি ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি-বাংলায় বড় কলেবরে প্রচার করা হচ্ছে সাত ভাই চম্পা। কিছু কিছু কাহিনী আছে বারবার বললেও, বারবার প্রচার করলেও পুরনো হয় না। সাত ভাই চম্পার কাহিনীও তেমন।
এই বেলায় প্রশ্ন হতে পারে একসাথে সাতটি বা আটটি সন্তান কেন হবে মানুষের ঘরে? কাহিনীর এক ভার্সন অনুসারে রাজার বউ হয়ে আসার পর ছোট রানী চিন্তিত হয়ে পড়েন। আগের ছয় রানী কোনো সন্তান দিতে পারেননি, এখন তিনিও যদি সন্তান দিতে না পারেন তাহলে রাজার দুঃখ রাখার আর জায়গা থাকবে না। এই শংকায় তিনি প্রার্থনা করলেন যেন তার সন্তান জন্ম হয়। প্রার্থনা মঞ্জুর হয় এবং অলৌকিকভাবে এক দরবেশ এসে একটি লাঠি দিয়ে জানায়, সকালে উঠে এই লাঠিটি ছুড়ে মারবি কূল (বড়ই) গাছের দিকে। এক চেষ্টায় যতগুলো কূল ঝড়ে পড়বে ততগুলো কূল খেয়ে নিবি। যতগুলো কূল খাবি তত সন্তান জন্ম নেবে তোর পেটে। রানী সে অনুসারে কাজ করেন এবং আটটি কূল পড়ে। আটটির মাঝে আটটিই খেয়ে নেন তিনি। ফলে এক পর্যায়ে জন্ম নেয় আটটি সন্তান।
এই কাহিনীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একটি ছড়া লিখেছিলেন।
সাত ভাই চম্পা
সাতটি চাঁপা সাতটি গাছে,
সাতটি চাঁপা ভাই;
রাঙা-বসন পারুল দিদি,
তুলনা তার নাই।
সাতটি সোনা চাঁপার মধ্যে
সাতটি সোনার মুখ,
পারুল দিদির কচি মুখটি
করতেছে টুকটুক।
ঘুমটি ভাঙে পাখির ডাকে
রাতটি-যে পোহালো,
ভোরের বেলা চাঁপায় পড়ে
চাঁপার মতো আলো।
শিশির দিয়ে মুখটি মেজে
মুখখানি বের ক’রে
কী দেখছে সাত ভায়েতে
সারা সকাল ধরে।
দেখছে চেয়ে ফুলের বনে
গোলাপ ফোটে-ফোটে,
পাতায় পাতায় রোদ পড়েছে,
চিকচিকিয়ে ওঠে।
সবশেষে ইতিহাস বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সাত ভাই চম্পা গানটি তুলে ধরছি।
ফিচার ছবি- উইকিমিডিয়া কমন্স