দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট: যে আজগুবি ঘটনা সত্য বলে মানে অনেকেই!

ঘুম আমাদের শরীরের সুস্থতার জন্য কতটা প্রয়োজনীয়, তা আমরা সকলেই জানি। স্কুলে থাকতে ঘুমের মাহাত্ম্য বোঝাতে ‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা‘ শীর্ষক ভাবসম্প্রসারণ আমাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু কী হবে যদি কেউ টানা এক মাস না ঘুমায়? 

যেকোনো সুস্থ মস্তিষ্কের লোক বলবে- টানা এক মাস না ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব নয়। যখন ঘুম পায়, তখন আমরা অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। যতভাবে চেষ্টা করা হোক, এ প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব না। এমনকি, যারা তীব্র নিদ্রাহীনতায় ভোগেন, তারাও একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তাই এতটা লম্বা সময় ধরে না ঘুমানোর ফলাফল কী হতে পারে সেটি মানুষের আগ্রহের বিষয়।

ইন্টারনেটে নানা সময়ে নানাজন নিদ্রাহীনতার দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল কী হতে পারে তা নির্ণয়ের লক্ষ্যে পরীক্ষা হয়েছে বলে দাবী করেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট’। এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মডিফাই করা বিভিন্ন ছবিও। এ ধরনের ভৌতিক গল্প আর ছবিকে বলা হয় ক্রিপিপাস্তা। মানুষকে ভয় দেখানোই এগুলোর মূল উদ্দেশ্য। আকারে সংক্ষিপ্ত এবং নেটিজেনদের দ্বারা সৃষ্ট এসব ক্রিপিপাস্তা বা আরবান লেজেন্ডের বিষয়বস্তু সাধারণত মৃত্যু, আধিভৌতিক এবং পারলৌকিক ঘটনাবলী। দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্টও একটি ক্রিপিপাস্তা, যেটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে পড়ে যে অনেক মানুষ একে সত্য বলে ধরে নেয়। কিন্তু রাশিয়া বা বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের কোনো পরীক্ষা সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

নেটের দুনিয়ায় দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি; Image Credit : bloody-disgusting.com

এতক্ষণ যে পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছিল, তার কাহিনীই চলুন এবার জানানো যাক আপনাদের।

কেউ যদি টানা ত্রিশ দিন নিদ্রাহীনভাবে কাটায়, তাহলে কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আগ্রহী হন একদল সোভিয়েত গবেষক। চল্লিশের দশকে সংঘটিত এই পরীক্ষা ছিল সেনাবাহিনী-অনুমোদিত। এক্ষেত্রে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহৃত হয় পাঁচজন রাজবন্দী। গোপন স্থানে এনে তাদের একটি বদ্ধ গ্যাস চেম্বারে রাখা হয় ১৫ দিনের জন্য। টেস্ট সাবজেক্টদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। এবং গ্যাস চেম্বারে ছড়িয়ে দেয়া হয় একটি বায়ুবাহী স্টিমুলেন্ট, যা তাদের জেগে থাকতে সহায়তা করবে। রাজবন্দীদের বলা হয়েছিল- তারা যদি সফলতার সাথে পরীক্ষায় উতরে যেতে পারে, তাহলে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। 

প্রথম কয়েকদিন কেটে যায় নির্বিঘ্নে। সাবজেক্টরা নিজেদের সাথে কথাবার্তা বলছিল, চেম্বারে রাখা মাইক্রোফোন দিয়ে বাইরে থাকা গবেষকদের সাথেও তারা যোগাযোগ রাখছিল। তাদের কথোপকথনের ভিডিও এবং অডিও উভয়ই সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। তাদের আচার-আচরণের ওপর নজর রাখতে চেম্বারটি নির্মিত হয়েছিল টু-ওয়ে মিরর দ্বারা। গন্ডগোলের সূত্রপাত ঘটে পঞ্চম দিনে। বন্দীদের মাঝে পীড়ন এবং মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ দেখা দেয়। তারা নিজেদের মাঝে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কেবল মাঝে মাঝে মাইক্রোফোনে ফিসফিস করে দুই-এক শব্দ বলতে শোনা যায়। নবম দিন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। দুজন বন্দী চেম্বারময় দৌড়াতে শুরু করে, এবং তারস্বরে চেঁচাতে আরম্ভ করে। চিৎকার শুনে মনে হয়- স্বরতন্ত্রী ছিড়ে গেলেও তাদের কিছু যায়-আসে না।

ডেভিড রোমেরোর কল্পনায় ৫ গিনিপিগ; Image Credit : twitter.com

 

চিৎকার-চেঁচামেচি যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবেই হঠাৎ থেমে যায়। চেম্বারে নেমে আসে ভীতিজাগানিয়া নীরবতা। সাবজেক্টদের জীবনের শংকায় গবেষকগণ চেম্বারের দরজা খুলবেন বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু ভেতর থেকে ভেসে আসে বিরোধিতার সুর। তারা বলে- এখন আর তারা মুক্তি চায় না। পনেরতম দিনে যখন চেম্বার খোলা হয়, তখন ভেতরের অবস্থা দেখে সকলের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। একজন বন্দী ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছে। বাকিদের শরীরে ভয়াবহ কাটাছেড়ার দাগ। কারো শরীরের মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে, কারো তলপেট চিরে ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হয়, তারা নিজেরা নিজেদের মাংসও খেয়েছে। যখন চেম্বার ছাড়ার কথা বলা হয়, তখন তারা অমানবিক শক্তি আর নৃশংসতা প্রদর্শন করে প্রতিবাদ করে, যা আগে তাদের মাঝে ছিল না। জোর করে চেম্বারের বাইরে নিতে গেলে তাদের নৃশংসতা আরো বেড়ে যায়। কেন নিজেদের সাথে নিজেরা এমন করেছে- পৃথকভাবে করা এ প্রশ্নের জবাবে তারা প্রত্যেকে বলে- যেকোনো মূল্যে তাকে জেগে থাকতে হবে! 

চেম্বারের বাইরে নিয়ে আসা হলেও বন্দীরা আগের মতোই অতিমানবীয় শক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। ঘুমের ঔষধসহ অন্যান্য ঔষধে তাদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। অমানুষিক আঘাত সহ্য করেও বেঁচে থাকার সক্ষমতা তাদের মাঝে দেখা যায়। নেশাগ্রস্তের মতো তারা জেগে থাকে, আর চেম্বারে গ্রহণ করা স্টিমুলেন্ট খোঁজে। গবেষকরা আরো দেখেন, বন্দীদের একজন ঘুমানোর সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাকি তিন বন্দীর সেবা-শুশ্রূষা এবং আবার চেম্বারে নেওয়ার উপযুক্ত করে তোলা হয়। গবেষণা পুনরায় শুরুর পূর্বে বন্দীদেরকে যেতে হয় Electroencephalogram (EEG) টেস্টের মধ্য দিয়ে। টেস্টের ফলাফলে দেখা যায়- বন্দীদের সকলেই বেঁচে আছে ব্রেইন-ডেড অবস্থায়। 

এক্সপেরিমেন্টের সেই চেম্বার; Image Credit : twitter.com

 

তাদেরকে ভেতরে রেখে পুনরায় চেম্বার বন্ধের পূর্বে আরো একজন মারা যায়। পরীক্ষার এমন হাল দেখে গবেষকরা তাতে সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নেন। আরো একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ টেস্ট সাবজেক্টকে হত্যার পূর্বে গবেষকগণ তার কাছে একটি প্রশ্ন রাখেন। তারা জানতে চান- সে কীসে পরিণত হয়েছে? উত্তরে সে বলে, “আমি সেই অশুভ কালো সত্তা, যা সকল মানুষের মাঝে বিরাজমান। এই সত্তার আগমন ঠেকিয়ে রাখে ঘুম।” খানিক বাদে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়, এবং পরীক্ষার সকল প্রমাণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। 

দুনিয়ার বাকিসব উপকথা, আরবান লেজেন্ড বা ক্রিপিপাস্তার মতো এর ক্ষেত্রেও ভাষ্যভেদে টুকটাক পার্থক্য দেখা যায়। ইন্টারনেটের জগতে দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্টের অভিষেক ঘটে ২০১০ সালে উইকিপিডিয়ার একটি পেজের মাধ্যমে। মূল লেখকের নাম জানা না গেলেও যে বা যারা এটি সৃষ্টি করে, তাদের ইউজারনেইম ছিল অরেঞ্জ সোডা। আগমনের পর থেকেই এটি নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়, এবং ভাইরাল হয়ে যায়। বেশিরভাগ নেটিজেন একে কেবল হরর গল্প হিসেবে দেখলেও অনেক এই এক্সপেরিমেন্ট বাস্তবে ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে। এ সংক্রান্ত যত তথ্য বা ছবি পাওয়া যায়, তার সবই নেটিজেনরা তৈরি করেছে।

যখন শুরু হয় বাতুলতা; Image Credit : twitter.com

 

একে সত্য বলে ভাবার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। এ ধরনের নানা গোপন বৈজ্ঞানিক গবেষণার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের জড়িত থাকার খবর বিভিন্ন সময়ে চাউর হয়েছে। এমনকি, তারা নাকি মানুষকেও এসব গবেষণায় গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করেছে। এসব গবেষণার দায়িত্বে ছিল সোভিয়েত সিক্রেট সার্ভিস। ১৯০০ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিম তথা আমেরিকা এবং তার মিত্রদের পরাজিত করার টোটকা খুঁজতে তারা এসব পরীক্ষা চালায়। যদিও এ ধরনের গবেষণার সাথে আমেরিকা নাম জড়িয়েও খবর শোনা গেছে। এছাড়া, পশ্চিমা মিডিয়ায় রাশিয়াকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে রাশিয়া এ ধরনের কাজ করতে পারে এমন একটা ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার গোপনীয়তা নীতি এসব গুজবকে ডালপালা মেলতে সহায়তা করেছে। 

ক্রিপিপাস্তাটির জনপ্রিয়তার পালে আরো হাওয়া দিয়েছে পপুলার কালচার। এর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে বেশ কিছু উপন্যাস ও ছোটগল্প। নির্মিত হয়েছে কিছু শর্ট ফিল্ম এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাও। তাই দিনশেষে কেবল একটি হরর গল্প হলেও দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে অতীতে যেমন নেটিজেনরা উৎসাহী ছিলেন, তেমনিতে ভবিষ্যতেও এটি তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিতে পারে যেকোনো সময়।

Related Articles

Exit mobile version