কাকাবাবু যেবার খোঁড়া পা নিয়ে হিমালয়ে যাবেন বলেছিলেন, তখন খোদ সন্তুই বিশ্বাস করতে পারেনি। শেষতক তো তারা হিমালয়ে গিয়ে জেঁকে বসলেন, কিন্তু সন্তু তখনও ঠাওর করে উঠতে পারছিল না, আসলে কাকাবাবু কী করতে হিমালয়ে এসেছেন। অবশ্যই এভারেস্টে চড়তে নয়- এ ধারণা সন্তুর মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল।
শেষে কাকাবাবুর কাছে এক বিকটদর্শন দাঁত আর শেরপাদের কাছে বিশালকায় ইয়েতির গল্প শুনে সন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছুল, কাকাবাবু এবার নিশ্চিত একটা ইয়েতি ধরে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেবেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, শেষ অব্দি কাকাবাবু হিমালয়ে কী খুঁজে পেয়েছেন! সেবার ইয়েতি ধরতে গিয়ে তাদের এক ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা হলো, সে গল্প নাহয় আরেকদিন বলা যাবে। আজকে বরং হিমালয়ের জনমানবহীন তুষারঢাকা অঞ্চলে বাস করা কথিত এই ইয়েতি জীবটির খোঁজ করা যাক।
তুষারমানব কেমন ‘মানব’?
ব্যুৎপত্তিগতভাবে ইয়েতি মূলত তিব্বতি শব্দ। ইংরেজিতে যাকে দেওয়া হয়েছে গালভরা একটি প্রতিনাম- অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান।
এই ইয়েতি হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার দুর্গম অঞ্চলে বাস করা এক শ্রেণীর দ্বিপদী প্রাণী। স্নোম্যান বা তুষারমানব নাম হওয়ার কারণ ইয়েতি ‘দেখতে’ অনেকটা মানুষের মতোই। রহস্যময় এই প্রাণীটির দেহ ধূসর-কালো বা লালচে-বাদামী পশমে ঢাকা, দৈহিক গঠন বলিষ্ঠ।
এখন পর্যন্ত অনেক মানুষই ইয়েতিকে দেখেছেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে ইয়েতির কোনো সন্ধান আজ অবধি কেউ পায়নি। সেদিক থেকে বলতে গেলে ইয়েতির ধারণাটি একটি মিথ।
তবে হিমালয় অঞ্চলে অনেক সময় বিশালাকৃতির পায়ের ছাপ, শরীরের পশম ইত্যাদি পাওয়া গেলেও সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল তুষার ভাল্লুকের। কিন্তু একই রকম কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বলে ইয়েতির অস্তিত্ব একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
হিমালয়ের বিশালতার কোনো এক অংশে হয়তো প্রাণীটি মনুষ্য সমাজের চোখ ফাঁকি দিয়ে বহাল তবিয়তে এখনো টিকে আছে, আবার হয়তো বাস্তবিক অর্থেই ইয়েতি বলে কোনোকালেই কিছু ছিল না, বরং এটি হিমালয়ে বাস করা শেরপাদের একান্ত নিজস্ব ড্রাকুলার গল্প।
ইতিহাসে ইয়েতির ইতিউতি
ইয়েতির আদিউৎস তিব্বত ও নেপালের হিমালয় অঞ্চলে বাস করা শেরপাদের লোকগাঁথা। মূলত তিব্বত অঞ্চলেই ইয়েতি মিথের প্রথম উৎপত্তি। পরে শেরপাদের মাধ্যমে তা নেপালে ছড়িয়ে পড়ে। শেরপাদের এসব লোকগল্প সংগ্রহ করেছেন শিব ধাকাল নামের একজন লেখক। ১২টি গল্পের এই সংগ্রহটির নাম ফোক টেইলস অভ শেরপা অ্যান্ড ইয়েতি।
শেরপাদের এই গল্পগুলোতে ইয়েতিকে সবসময় ভয়ঙ্কর প্রাণী হিসেবে দেখা হয়েছে। কখনও ইয়েতিকে অনিষ্টকারী হিসেবে, কখনও দুর্ভোগের উৎস হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এমনকি একটি গল্পে তো ইয়েতিকে ধর্ষণকারী হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে!
এসব গল্পে ইয়েতিকে প্রতিকূল চরিত্র হিসেবে বিচার করার কিছু কারণ রয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীরই এরকম কিছু কাল্পনিক চরিত্র থাকে, যা ভয়ের উদ্রেক করে, মানুষের চোখে সেগুলো জুজুর মতো কাজ করে। ইয়েতি হচ্ছে শেরপাদের সেই জুজু।
শেরপারা হিমালয়ের দুর্গম তুষারাবৃত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় তাদের জীবিকার জন্য। এসব অঞ্চলে রয়েছে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। তুষারধ্বস, বরফের চোরা গর্ত এসব তো আছেই, পাশাপাশি রয়েছে জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণের ভয়। এই আক্রমণকারী জানোয়ারদের কাছ থেকে সাবধান থাকার জন্য শেরপাদের যে জুজুর ভয় দেখানো হয়, তা হচ্ছে ইয়েতি।
ধাকালের মতে, এই জুজুর সৃষ্টির পেছনে হয়তো এমন উদ্দেশ্য ছিল যে, শেরপাদের বাচ্চাকাচ্চারা যেন তাদের আবাসস্থল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে না যায়। কারণ বরফের বিশাল প্রান্তরে একবার হারিয়ে গেলে তার আর ঘরে ফেরার কোনো উপায় নেই। সুতরাং শেরপা বাচ্চাদের যদি ইয়েতির ভয় দেখানো যায়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই ঘর থেকে দূরে পা ফেলতে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করবে।
দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও ইয়েতির খোঁজ করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে তিনি সিন্ধু উপত্যকা জয়ের সময় ইয়েতির গল্প শুনে ইয়েতি দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয়রা তাকে জানিয়েছিল, ইয়েতি কম উচ্চতায় বেঁচে থাকতে পারে না, তাই তাদের পক্ষে ইয়েতি ধরে সম্রাটের সামনে হাজির করা সম্ভব নয়।
ইয়েতিবাবা’র দর্শন
গবেষক মিরা শ্যাকলি তার স্টিল লিভিং? ইয়েতি, সাসকোয়াচ, অ্যান্ড দ্য নিয়ান্ডারথাল এনিগমা (১৯৮৩) বইতে দুজন হাইকারের ইয়েতি দর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন।
১৯৪২ সালের কোনো একদিন ওই দুই হাইকার তাদের থেকে ‘সিকিমাইল দূরে বরফের ওপর দুটো কালো বিন্দু চলাচল করতে’ দেখেছেন। এত দূর থেকে দেখার পরেও তারা খুব স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছিলেন: উচ্চতা একেবারে আট ফুটের কম ছিল না। চৌকো মতন মাথা। … লালচে বাদামী অধোমুখী পশম।
আরেকজন ব্যক্তির দর্শনলাভের অভিজ্ঞতা মোতাবেক, ইয়েতির আকার গড়পড়তা মানুষের মতোই। মাথাভর্তি লম্বা চুল থাকলেও মুখমণ্ডল আর বুকে রোমের বালাই নেই বললেই চলে। লালচে-বাদামি দু’পেয়ে প্রাণীটি মনোযোগ দিয়ে শেকড় তুলছিল আর সময়ে সময়ে চড়া ও তীক্ষ্ণ গলায় কান্না করছিল।
পর্বতারোহী রাইনহোল্ড মেসনারের ইয়েতি দর্শনের গল্প শোনা যাক। ১৯৮৬ সালের সেদিন মেসনার একটা বিশেষ রুট ধরে চলছিলেন। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। জঙ্গুলে খাড়াই বেয়ে ওঠার সময় হঠাৎ তার সামনে বিশাল ও কালো রংয়ের কিছু একটা উদয় হলো।
বিস্মিত মেসনার দেখলেন প্রাণীটি দৌড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। তার দৌড়ানোর ভঙ্গি মানুষের মতোই, কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত। গাছের শাখা-প্রশাখা বা বরফের ওপর থাকা গর্ত কিছুকেই পরোয়া করছে না। দশ গজের মতো গিয়ে প্রাণীটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং তারপরই মেসনারের চোখের সামনে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল।
সেদিন রাতে চাঁদের আলোয় সেটিকে আবারও দৌঁড়াতে দেখেন মেসনার। সাত ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা, বলিষ্ঠ ও চটপটে শরীর। ছোট ছোট পা, পশমে ঢাকা দেহ আর লম্বা, শক্তিশালী হাতওয়ালা প্রাণীটি রাগত স্বরে শব্দ করছিল। সেই রাতে আবারও গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যায় প্রাণীটি।
১৯৮৬ সালে অ্যান্থনি উলরিজ নামক আরেকজন হাইকার ইয়েতি দেখেন বলে দাবি করেন। তিনি দেড়শ মিটার দূর থেকে একটি ইয়েতিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। তিনি দুটো ছবিও তুলে নেন।
সেই ছবি পরখ করে দেখা গেল, সেগুলো কোনো মেকি ছবি নয়। ইয়েতির অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে ছবিজোড়া ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। পরের বছর গবেষকেরা উলরিজের ইয়েতি দর্শনের স্থানে গিয়ে বুঝতে পারেন, উলরিজ আসলে একটি পাথুরে-পৃষ্ঠের ওপরের অংশ দেখতে পেয়েছিলেন।
সন্ধানে ধন্দে সবাই
ইয়েতিকে নিয়ে গল্পগাঁথা শেরপাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল একটা সময় পর্যন্ত। তারপর পশ্চিমা অভিযাত্রীরা হিমালয়ে পা ফেলল, তাদের হাত ধরে ইয়েতির গল্প ছড়িয়ে পড়লো ইউরোপ, আমেরিকাজুড়ে, আরও ভয়ংকর, আরও চাঞ্চল্যকর উপায়ে। উপমহাদেশের এই অঞ্চল থেকে ইয়েতির পশ্চিমযাত্রা বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে।
১৯২১ সালে চার্লস হাওয়ার্ড-বারি মাউন্ট এভারেস্টে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেবার বরফের ওপর তিনি কিছু বিশাল পায়ের ছাপ খুঁজে পান। তিনি জানলেন, সেগুলো ছিল ‘মিথো-কাংমি’র। এই শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করলে হয় ‘মনুষ্য-ভল্লুক তুষারমানব’।
দেশে ফেরার পর অভিযাত্রী-দলটির কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাৎকার নেন হেনরি নিউম্যান নামক একজন সাংবাদিক। তিনি ‘মিথো’ শব্দটির ভুল অনুবাদ করেন ‘কুৎসিত’ (filthy) হিসেবে। পরে তিনি ‘কুৎসিত’-এর স্থলে ‘জঘন্য’ (abominable) শব্দটি প্রয়োগ করেন।
নিউম্যানের হাত ধরে এই কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় শেরপাদের ইয়েতি-দর্শনের গল্পগুলো অভিযাত্রীদের মাধ্যমে অনূদিত হতে থাকে। সেই সাথে এই গল্পের নতুন ডালপালা ছড়ায় পশ্চিমা দুনিয়ায়।
১৯৫০-এর দশকে ইয়েতি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। ইয়েতির সন্ধানে অভিযাত্রী ও পর্বতারোহীরা অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেন হিমালয় অঞ্চলে। এমনকি হলিউড অভিনেতা জেমস স্টুয়ার্টও ইয়েতির সাথে জড়িয়ে যান। তিনি সেসময় তার লাগেজে ‘ইয়েতির’ একটি আঙুল বয়ে বেড়াতেন।
একজন মার্কিন অভিযাত্রী আঙুলটি নেপালের কোনো এক গুম্ফা থেকে সংগ্রহ করেন। পরে স্টুয়ার্টের সহযোগিতায় আঙুলটি ভারতের বাইরে পাচার করা হয়। এডিনবার্গ চিড়িয়াখানার বিশেষজ্ঞরা ২০১১ সালে এক ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত করেন আঙুলটি আসলে মানুষের ছিল।
ক্রমশ হিমালয়ে ইয়েতির পায়ের ছাপ, খুলি, পশম, হাড় বা দাঁতের টুকরা ইত্যাদি পাওয়ার দাবি করেন পর্বতারোহীরা। কিন্তু অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়- এগুলো ছিল মূলত অন্যান্য পর্বতচারী জন্তু যেমন ভাল্লুক, অ্যান্টিলোপ, বানর ইত্যাদির অংশ।
মেসনারের ইয়েতি অভিযান
পর্বতারোহী রাইনহোল্ড মেসনার সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ‘ইয়েতি শিকারি‘। ১৯৮৬ সালে ইয়েতি দেখার পর তিনি অনেকবার সেই ইয়েতির খোঁজে ছুটে বেড়িয়েছেন হিমালয় পর্বতমালা, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ভারত, মঙ্গোলিয়া, ও কাজাখাস্তানের আনাচেকানাচে।
বারো বছরের খোঁজ শেষে মেসনার সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, ইয়েতি আসলে একপ্রকার ভাল্লুক বৈ আর কিচ্ছু নয়! মেসনারের হিসেবমতে, ইয়েতির এই কিংবদন্তি মূলত একপ্রজাতির ভাল্লুক আর শেরপাদের হিমালয়ী বুনোজন্তুর গালগল্পের সমন্বিত রূপ।
“এখন পর্যন্ত ইয়েতির যতগুলো পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছে সেগুলো সবই একই প্রজাতির ভাল্লুক।” সুতরাং, ইয়েতির ব্যাপারটি একদিক থেকে বাস্তবতাই। মেসনার ইয়েতিকে দুপেয়ে জন্তু হিসেবে দেখতে নারাজ। তার মতে, মানুষ বাস্তবতার চেয়ে গাঁজাখুরি গল্প বেশি পছন্দ করে।
সাইকসের তথৈবচ গবেষণা
মেসনারের ভাল্লুক তত্ত্বের আপাত সমর্থন মিলেছে ২০১৪ সালে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক অধ্যাপক, ব্রায়ান সাইকস ইয়েতির কিছু কথিত নমুনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ও তার দল ইয়েতির পশমের ডিনএনএ পরীক্ষা করেন। এসব নমুনার মধ্যে মেসনারের প্রদত্ত নমুনাও ছিল।
এরপর তারা এসব নমুনা ডিএনএ অন্যান্য প্রাণীর জিনোম সিকোয়েন্সের সাথে মিলিয়ে দেখেন। তারা দেখতে পান, লাদাখ ও ভুটানে পাওয়া ইয়েতির দুটো নমুনার সাথে একধরনের মেরুভাল্লুকের প্রায় শতভাগ জিনগত মিল রয়েছে। তবে এই ভাল্লুক প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে।
গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, হিমালয় অঞ্চলে হয়তো এমন একধরনের ভাল্লুকের বাস রয়েছে যেগুলো মূলত বিলুপ্ত মেরুভাল্লুক (Ursus maritimus) ও বাদামী ভাল্লুকের (Ursus arctos) সংকর। আর এই সংকর জাতটিই হয়তো কোনোভাবে ইয়েতি মিথ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে।
বারনেট-এডওয়ার্ডসের চ্যালেঞ্জ
কিন্তু মেরুভাল্লুক হিমালয় অঞ্চলে বাস করে না। সুতরাং প্রশ্নের মুখে পড়ল সাইকসদের গবেষণা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর দুই অধ্যাপক রস বারনেট ও সিরিডোয়েন এডওয়ার্ডস সাইকস-এর গবেষণালব্ধ ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করেন। এবারের গবেষণায় একটি বড় রকমের ভুল ধরা পড়ে।
সাইকস তার গবেষণায় ইয়েতির নমুনার সাথে প্লাইস্টোসিন কালের মেরুভাল্লুকের যে মিল খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন, তা পুরোপুরি সত্য নয়। বরং বারনেটদের গবেষণা মোতাবেক এই মিলটি মূলত আধুনিক মেরুভাল্লুকের। তা-ও মিলের মাত্রাটা যৎসামান্য।
বারনেট ও এওয়ার্ডসের দাবী অনুযায়ী তাহলে কি হিমালয়ে মানুষের অজান্তে মেরুভাল্লুক বাস করছে? কিন্তু এ দুজন দাবি করলেন, ব্যাপারটা আদৌ ওরকম কিছু নয়, বরং যে নমুনা পশমগুলো পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেগুলোর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত (Damaged DNA) ছিল।
লিন্ডক্ভিস্টের গবেষণা
নিউ ইয়র্কের বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শারলট লিন্ডক্ভিস্ট ২০০৪ সালে আর্কটিক নরওয়ে অঞ্চলে মেরুভাল্লুকের এক লক্ষ বিশ হাজার বছর পুরোনো একটি চোয়ালের হাড় আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ করেন। এর প্রায় এক দশক পরে তিনি অক্সফোর্ডে সাইকসের গবেষণার খবরটি জানতে পারেন।
সাইকসের দলের দাবি ছিল, হিমালয়ের কোনো সুউচ্চ অবস্থানে হয়তো কোনো সংকর জাতের ভাল্লুক এখনো বাস করে আসছে। কিন্তু লিন্ডক্ভিস্ট এ দাবি মেনে নিতে পারেননি। এছাড়া সাইকসদের গবেষণা পদ্ধতি নিয়েও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি, কারণ ওই দলটি ডিএনএ’র তুলনামূলক ক্ষুদ্র ও সীমিত অংশ নিয়ে গবেষণা করেছিল।লিন্ডক্ভিস্ট পুনর্নিরীক্ষণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
নতুন গবেষণায় ২৪টি কথিত ইয়েতির নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এগুলোর মধ্যে ছিল ইয়েতির দাঁত, ত্বকের অংশবিশেষ, চুল, পশম ইত্যাদি। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, দাঁতটি ছিল একটি গৃহপালিত কুকুরের। বাকি নমুনাগুলোর উৎস মূলত হিমালয়ী ও তিব্বতি বাদামী ভাল্লুকের একটি উপ-প্রজাতি, এবং একটি এশিয়ান কালো ভাল্লুক।
এই গবেষণাটির ফলে ইয়েতি রহস্যের সমাধানের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছেন গবেষকেরা। তারা বিপন্ন এশিয়ান ভাল্লুকের একটি নতুন ফ্যামিলি-ট্রি তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন, যা এই প্রাণীটিকে রক্ষায় যথেষ্ট সহায়ক হবে।
আরও একটু গবেষণা
সন্ধানের শেষ এখানেই নয়। এবার বিষয়টি নিয়ে পুনরায় গবেষণা করলেন স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের এলিসার গুতেরেজ ও কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের রোনাল্ড পাইন। এ গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, নমুনা দুটোর উৎস বাদামী ভাল্লুক ছাড়া আর কিছু নয়।
এবার টনক নড়ল সাইকস ও তার দলের। নিজেদের ভুল স্বীকার করে তারা বিবৃতি দিলেন। সেই সাথে তারা আরও উল্লেখ করলেন যে, তাদের পরীক্ষিত নমুনাদ্বয় কোনো নরবানরের সাথে মেলে না।
রাশিয়ান ইয়েতির খোঁজে
২০১১ সালে রাশিয়ান সরকারের ইয়েতি আবিষ্কারের নেশা চাপে। পশ্চিম সাইবেরিয়ায় তারা ইয়েতি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মিলিত হয়। গবেষক জন বাইন্ডারনাজেল দাবি করেন, ইয়েতি গাছে বাসা বেঁধে থাকে। দলটির কাছে ইয়েতির অস্তিত্বের ‘সন্দেহাতীত প্রমাণ’ থাকার কথা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়।
কিন্তু সব ভণ্ডুল করে দেন আরেক বিজ্ঞানী জেফ মেলড্রাম। তিনি সন্দেহ করেন, ইয়েতির গাছে বাসা বাঁধার ব্যাপারটি আগাগোড়া ভুয়া। পরে প্রমাণিত হয়, যেসব গাছের মোচড়ানো ডালপালাকে ইয়েতির বাসা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল, সেগুলো আসলে মনুষ্যনির্মিত হাতিয়ার দিয়ে কাটা হয়েছে। মেলড্রাম সিদ্ধান্তে পৌঁছান, ওই অঞ্চলে পর্যটকদের আকর্ষণ করার উদ্দেশে রাশিয়ান সরকার এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেছে!
তুষারমানব থেকে তুষারভাল্লুক
এসব গবেষণা থেকে গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ইয়েতি মূলত হিমালয় অঞ্চলে বাস করা ভাল্লুক জাতীয় প্রাণী ও স্থানীয় মিথের একটি সমন্বিত কিংবদন্তি।
সেই হিসেবে এক অর্থে ইয়েতির ধারণা সত্য। কারণ এর মূল উৎস ভাল্লুক জাতীয় প্রাণী থেকে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের মতো দেখতে বিশাল দেহের কোনো রোমশ দুপেয়ে প্রাণী হয়তো হিমালয়ে বাস করে না, বা কখনোই করেনি।
তারপরও মানুষ এখনো ইয়েতির সন্ধানে ছুটছে, পপ-কালচারে স্থান পেয়েছে ইয়েতি। ইয়েতি বর্তমানে ক্রিপটোজুওলজি’র অংশ হয়ে উঠেছে। ক্রিপটোজুওলজি হচ্ছে প্রমাণের অভাবে অস্তিত্বহীন এমন সব কথিত প্রাণী বিষয়ক গবেষণা।
নেপাল সরকার ১৯৫০-এর দশকে ইয়েতি শিকারের জন্য লাইসেন্স বিক্রি করা শুরু করে। ইয়েতিকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। শেরপারা এখনো বিশ্বাস করে ইয়েতি শুধু তাদেরকেই দেখা দেয়, যারা ইয়েতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।
ভুটানের সাক্তেং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ইয়েতি সংরক্ষণ করা। ইয়েতি মিথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল অর্থনৈতিক চক্র। নেপালে ‘ইয়ক অ্যান্ড ইয়েতি’ নামের পাঁচতারা হোটেল রয়েছে, আরও আছে ইয়েতি এয়ারলাইন্স। সুতরাং বলা যায়, একসময়ের রহস্যময় ইয়েতি এখন মানুষের জীবনের সাথে ভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
ফলে নিঃসন্দেহে ইয়েতির আবেদন কখনো কমবে না। হিমালয়ের সাহসী শেরপারা ইয়েতিকে দেখবে আতঙ্ক ও শ্রদ্ধার চোখে, আর দুনিয়ার আধুনিক মানুষ ইয়েতিকে দেখবে তাদের দৈনন্দিন ভোগবাদী জীবনের একটি সুবিধাজনক উপযোগ হিসেবে!