অতীতে ফড়িংকে একসময় শয়তানের সুঁই হিসেবে ডাকা হত এবং ফড়িং দুষ্ট, অবাধ্য শিশুদের মুখ সেলাই করে দেবে বলে এই ভয় দেখানো হত। তবুও, গ্রামের অনেকের শৈশবের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাটে ছোট ফড়িংের পেছনে ছুটে। আমাদের এই পরিচিত পতঙ্গটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন হওয়ায়, এদের ঘিরে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত। ফড়িং সম্বন্ধে আরেকটি বেশ প্রচলিত কিংবদন্তি হলো, এই পতঙ্গগুলো মৃত সাপকে জীবিত করতে পারে! কিংবদন্তিগুলো শুনতে বেশ আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর হলেও কোনোটিই বিন্দুমাত্র সত্য নয়। তবে পতঙ্গটির ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক ও মজার অনেক তথ্য রয়েছে, যা আমাদের অনেকেরই অজানা। সেসব নিয়েই সাজানো হয়েছে এই আয়োজন।
প্রাগৈতিহাসিক পতঙ্গ
ফড়িং নামের ছোট পতঙ্গটির রয়েছে অতি প্রাচীন ইতিহাস। পৃথিবীর বুকে ডাইনোসরদের পদচারণার অনেক আগে থেকেই আকাশে উড়ে বেড়িয়েছে ফড়িংরা। প্রায় ৩০০ মিলিয়নের বেশি বছর ধরে পৃথিবীতে ফড়িংদের বসবাস। সময়ের সাথে পরিবেশের পরিবর্তনে, বিবর্তনের ধারায় একসময়ের সুবিশাল পতঙ্গ ফড়িং আজকে পরিণত হয়েছে ছোট পতঙ্গে। কার্বনিফেরাস যুগে ফিরে গেলে দেখা যাবে, ফড়িংদের পূর্বপুরুষেরা ছিল পতঙ্গদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতঙ্গ।
এই যুগে পাওয়া যেত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পতঙ্গগুলো। সুপ্রাচীন গ্রিফেনফ্লাই হলো পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পতঙ্গ, যাদের বিবেচনা করা হয় ফড়িংের পূর্বপুরুষ হিসেবে। Meganeuropsis permiana, গ্রিফেনফ্লাইগুলোর পাখার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দূরত্ব ছিল ৭১ সেন্টিমিটার ও উইং স্প্যান ছিলো ২৮ ইঞ্চি। কার্বনিফেরাস যুগে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ৩০% এরও বেশি, ক্ষেত্র বিশেষে এই পরিমাণ প্রায় ৫০% পর্যন্তও ছিল। মনে করা হয়, বাতাসে অক্সিজেনের এই উপস্থিতি পতঙ্গগুলোর সুবিশাল আকারের অন্যতম কারণ ছিল।
অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি
বড় দুটি চোখের সুবাদে ফড়িংের দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। এদের দর্শনশক্তি প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি এবং মানুষের চেয়ে অধিক সংখ্যক রঙ দেখতে পারে ফড়িংরা। একটি ফড়িংের চোখে প্রায় ৩০,০০০ এর মতো লেন্স বা ওমাটিডিয়া রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এরা অর্জন করেছে অসাধারণ দর্শন ক্ষমতা।
একটি ফড়িং তার মস্তিষ্কের প্রায় ৮০ ভাগ ব্যবহার করে দৃষ্টিলব্ধ তথ্য বিশ্লেষণে, ফলে অন্যান্য পোকার চলাচল সহজেই নির্ণয় করতে পারে এরা। তাছাড়া, ওড়ার সময়ে অন্য পতঙ্গ বা কোনো কিছুর সাথে সংঘর্ষের হাত থেকেও রক্ষা পেতে ও খাবার শিকার করতে তাদের এই দৃষ্টি শক্তি দারুণ কাজে দেয়।
বাচ্চা ফড়িং পানিতে বাস করে
সাধারণত পুকুর, লেক বা জলাশয়ের ধারেই ফড়িংের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। কারণ নারী ফড়িংগুলো পানির উপরে, জলজ উদ্ভিদ বা শৈবালের উপর ডিম দেয়। এখানেই ডিম ফুটে বের হয় ফড়িংের বাচ্চা বা নিম্ফ।
প্রায় ৯-১৭ বার নিম্ফাল ত্বক বা খোসা পরিবর্তনের পর যৌবনে পা দেয় এরা। বড় হওয়ার আগপর্যন্ত অন্যান্য অতিক্ষুদ্র জলজ অমেরুদণ্ডী দিয়েই খাবারের পর্ব সেরে নেয় নিম্ফ। পানির জীবনের সমাপ্তি ঘটে শেষবারের জন্য ত্বক পরিবর্তন করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মাধ্যমে।
নিম্ফ শ্বাসকার্য সম্পাদন করে পায়ুপথ দিয়ে
অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগের জন্য ফড়িংের নিম্ফ ব্যবহার করে তাদের পায়ুপথ। কারণ, তাদের ফুলকা তখন থাকে মলদ্বারের ভেতরে। পায়ুপথ দিয়ে সরাসরি পানি টেনে নেয় ভেতরে এবং এরপর আবার তা বের করে দেয় একই পথ দিয়ে। এই পদ্ধতিতে সম্পাদন হয় গ্যাস আদান-প্রদানের কাজটি। এই পদ্ধতির আরেকটি অতিরিক্ত সুবিধা হলো, গতিশক্তির ফলে সামনে এগিয়ে চলে পতঙ্গগুলো।
নতুন প্রাপ্তবয়স্ক বেশিরভাগ ফড়িং পরিণত হয় শিকারে
নিম্ফ অবস্থা থেকে পরিবর্তনের জন্য পানি থেকে আশেপাশের পাথর কিংবা গাছে আশ্রয় নেয় এগুলো এবং এরপর শারীরিক পরিবর্তনের জন্য প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
নিম্ফ দশা থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ফড়িং হিসেবে নতুন জীবন শুরু করার মুহূর্তে এরা খুবই দুর্বল এবং অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। শরীরের গঠন আরও মজবুত ও ওড়ার জন্য পর্যাপ্ত শক্তির জন্য সময় লাগে আরও বেশ কয়েকদিন। এই সময়ে বেশিরভাগ ফড়িংই পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয়।
উড়বার দুর্দান্ত ক্ষমতা
ফড়িং সামনেও যেমন উড়তে পারে, তেমনি পেছনের দিকেও উড়তে সক্ষম। সম্পূর্ণ গতিতে বা ধীরে, ঠিক সোজা উপরে বা নিচের দিকে ওড়ার দারুণ সক্ষমতা রয়েছে এদের। তাছাড়া, সামনে-পেছনে না এগিয়ে বাতাসে এমনি ভেসে থাকার দারুণ দক্ষতার ফড়িংের রয়েছে চারটি পাখা। প্রতিটি পাখা স্বাধীনভাবে চালনা করতে পারে এই পতঙ্গগুলো এবং একটি অক্ষ বরাবর সামনে-পেছনে ঘোরাতেও পারে এগুলো।
প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ফড়িং। গবেষণায় দেখা গেছে, অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি ও উড়তে পারার দক্ষতার দরুণ শিকার ধরতে ও আগের জায়গায় ফিরে আসতে একটি ফড়িংের মাত্র ১-১.৫ সেকেন্ড সময় লাগে।
পুরুষ ফড়িং নিজ এলাকার জন্য লড়াই করে
কিছু প্রজাতির ফড়িং তার এলাকায় অন্য ফড়িংের প্রবেশ একেবারেই পছন্দ করে না। কোনো ফড়িং এই অনধিকার চর্চা করলে, তার বিরুদ্ধে ঐ এলাকার পুরুষ ফড়িং একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করে। স্কিমার, ক্লাবটেইলস এবং পেটটেইলস ফড়িং ডিম পাড়ার জন্য পুকুরের আশেপাশের জায়গা বেঁছে নেয়। এই সময় অন্য কোনো ফড়িং যদি এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, তাহলে দায়িত্বে থাকা পুরুষ ফড়িং তাকে তাড়া করে ভাগিয়ে দিবে।
অন্যান্য কিছু প্রজাতি যদিও নিজের সুনির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে মাথা ঘামায় না, তবুও ওড়ার পথে অন্য পুরুষ ফড়িং পথ মারিয়ে গেলে, তাদের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে থাকে। তাছাড়া, কিছু পুরুষ ফড়িং অবশ্য পছন্দের মেয়ে ফড়িংের জন্য প্রতিপক্ষের সাথে সহিংস আচরণ প্রদর্শন করে।
কিছু ফড়িং অভিবাসী স্বভাবের
অন্য অনেক প্রাণীর মতো, কিছু ফড়িং প্রয়োজনের তাগিদে বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে নিজেদের সাধারণ বাসস্থান ছেড়ে পাড়ি জমায় অনুকূল পরিবেশে। কিছু প্রজাতি দল বেঁধে, আবার কিছু প্রজাতি একাকী শুরু করে এই যাত্রা। উত্তর আমেরিকার গ্রিন ডার্নার্স নামের ফড়িং শীতকালে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ পরিবেশের দিকে চলে যায় এবং বসন্তকালে আবার ফিরে আসে নিজের চিরচেনা ভুবনে।
বংশবৃদ্ধির জন্য গ্লোব স্কিমার ফড়িং খুঁজে বেরায় অস্থায়ী জলাধার, তাই প্রজননের জন্য এরা অনুসরণ করে বৃষ্টিস্নাত এলাকা। এমনকি ভারত ও আফ্রিকার মধ্যবর্তী রেকর্ড ১১,০০০ মাইল দূরত্ব ভ্রমণের রেকর্ড রয়েছে এই গ্লোব স্কিমারদের।
তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ
কিছু ফড়িং সামনে-পেছনে উড়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আবার কিছু কোনো কিছুর অবলম্বন করে চুপটি মেরে বসে থাকে। শরীর উষ্ণ রাখতে পাখা দ্রুত চালনা করে তাপ উৎপন্ন করে ফড়িং। বসে থেকে অলস সময় কাটাতে পছন্দ করা ফড়িং অবশ্য শরীর উষ্ণ রাখতে ব্যবহার করে সূর্যের আলো। পর্যাপ্ত আলো পেতে যথাযথ অবস্থান নিতে এদের জুড়ি নেই। অতিরিক্ত গরমের সময় কিছু ফড়িং আবার তাদের পাখা ব্যবহার করে অত্যধিক সূর্যের আলো প্রতিফলিত করতে এবং যেখানে সূর্যের আলো কম সেখানে সাধারণত অবস্থান নেয়।