পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। সেই সাথে বদলে যাচ্ছে আমাদের পরিবেশ, আমাদের আবহাওয়া। মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। গড়ে উঠছে নতুন কলকারখানা, তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি। আর এসবের ফলে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করা হচ্ছে বন, হত্যা করা হচ্ছে বহু বন্যপ্রাণীকে। যার ফলে ইতিমধ্যে পৃথিবীতে বহু প্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে। বহু প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। হয়তো আর কয়েক দশক পরেই তাদের শেষ বংশধরটিও হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে।
ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার টিম ফ্লাচ দু’বছর আগে নেমেছিলেন এক মিশনে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন এসব বিপন্ন প্রাণীর যতটা সম্ভব ছবি তোলার। তার এই মিশনের ফলাফল ছিল খুবই চমকপ্রদ। এই দুই বছরে তিনি বিশ্বজুড়ে বিপন্ন সব প্রাণীর অসাধারণ কিছু ছবি তুলেছেন। এসব ছবি আমাদেরকে কিছুটা হলেও সেই বিপন্ন ও চমৎকার প্রাণীগুলোর জীবন সম্পর্কে ধারণা দেবে। চলুন আজকে দেখে নিই টিম ফ্লাচের ক্যামেরায় উঠে আসা বিপন্ন প্রাণীদের সেই অসাধারণ ছবিগুলো আর জেনে নিই সেই প্রাণীগুলো সম্পর্কে।
১. ফিলিপাইনি ঈগল
ঈগলের অসাধারণ সুন্দর একটি প্রজাতি এই ফিলিপাইনি ঈগল। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আর মাত্র ৬০০টির মতো রাজকীয় এই ঈগল বেঁচে রয়েছে গোটা পৃথিবীতে। ফিলিপাইনের জাতীয় পাখি এটি।
২. আইবেরিয়ান লিংক্স
লিংক্স বাঁকানো কান বিশিষ্ট একধরনের বন বিড়াল। গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টা ও সংরক্ষণের ফলে এই বিপন্ন প্রজাতির বন বিড়ালগুলোকে কিছুটা সুরক্ষিত করা গেছে। বর্তমানে বন্য পরিবেশে মোট ১০০-৩২৬টি আইবেরিয়ান লিংক্স রয়েছে।
৩. রিং-টেইলড লেমুর
সুন্দর এই প্রাণীটির সংখ্যা গত কয়েক বছরে চোরাশিকারি ও বাসস্থান ধ্বংসের ফলে একে বারেই কমে এসেছে। বর্তমানে বন্য পরিবেশে মাত্র ২,০০০ এর মতো রিং-টেইলড লেমুর রয়েছে।
৪. লাল পান্ডা
চমৎকার সুন্দর এই প্রাণীটির লাজুক স্বভাবের কারণে এদের খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিন। আনুমানিক ১০,০০০ এর মতো লাল পান্ডা বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে রয়েছে। প্রতি বছরই এদের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে।
৫. জোনাকি
জোনাকি একসময় প্রচুর পরিমাণে দেখা গেলেও এরা বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রচুর কমে গিয়েছে। রাতের আধারে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা এই পোকার সংখ্যা আবাস ধ্বংস ও নানা কীটনাশকের কারণে কমে গিয়ে শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে কোথাও কোথাও।
৬. সাইগা
অদ্ভুত দেখতে এই প্রাণীটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সংকটময় বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে কাজাকিস্তানে হঠাৎ প্রায় ১২,০০০ এর মতো সাইগার মৃত্যু হয়, যার ফলে গোটা বিশ্বে এদের পরিমাণ কমে গিয়েছে একেবারেই।
৭. সোনালি বোঁচা-নাক বাঁদর
সুন্দর এই বানরগুলোর বাস চীনের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে। বিপন্ন এই প্রজাতিটির মাত্র ৮,০০০-১৫,০০০ এর মতো বানর বর্তমানে বন্য পরিবেশে বেঁচে আছে।
৮. শুবিল
ভয়ঙ্কর দেখতে এই পাখিগুলোকে দেখতে পাওয়া যায় পূর্ব আফ্রিকায়। ধারনা করা হয় বর্তমানে মাত্র ৫,০০০ থেকে ৮,০০০টির মতো শুবিল বেঁচে রয়েছে গোটা বিশ্বে।
৯. পশ্চিমা নিম্নভূমির গরিলা
পশ্চিমা নিম্নভূমির এই গরিলারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি এলাকাজুড়ে থাকলেও বর্তমানে এদের বাসস্থান ও শিকারের কারণে এদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। প্রায় ১,০০,০০০ এর মতো এই প্রজাতির গরিলা রয়েছে গোটা বিশ্বে।
১০. প্রবোসিস বানর
লম্বা নাকের মজার দেখতে এই বানরের সংখ্যা গত ৩৬-৪০ বছরে প্রায় ৫০% কমে এসেছে। আবাস ধ্বংস ও জ্বালানী কাঠের জন্য গাছ নিধনের ফলেই হয়েছে এমনটি।
১১. ভারতীয় ঘড়িয়াল
মাছের সংকট ও আবাস ধ্বংসের ফলে চমৎকার এই প্রজাতির প্রাণিটির সংখ্যা কমে যাচ্ছে দিন দিন। বর্তমানে এদের মোট সংখ্যা ২৩৫টির মতো।
১২. সামুদ্রিক ইগুয়ানা
সৌভাগ্যক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকার এই টিকটিকি জাতীয় প্রাণীর সংখ্যা অন্য বিপন্ন প্রাণির থেকে কিছুটা বেশি। বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় দুই থেকে তিন লাখ। তবে পর্যটন শিল্পের প্রসারের সাথে সাথে কমছে এদের সংখ্যা।
১৩. সাদা পেটের প্যাঙ্গোলিন
চমৎকার এই প্রাণীগুলো চোরাশিকারিদের দ্বারা ক্রমাগত শিকার হচ্ছে। এদেরকে এদের মাংশ ও মাংস থেকে প্রস্তুতকৃত ঔষধের জন্যই মূলত শিকার করা হয়। বর্তমানে এদের সঠিক সংখ্যা অজানা।
১৪. গুহাবাসী স্যালাম্যান্ডার
ডেনালী পর্বতমালার গুহায় বাসকরা এই স্যালাম্যান্ডারগুলো কিন্তু সম্পূর্ণরূপে অন্ধ। বলতে গেলে এদের আসলে চোখই নেই। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে ১৯৮২ সাল থেকে এদেরকে বিপন্ন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
১৫. বেলুগা স্টারজিওন
এই সামুদ্রিক মাছেরা ১০০ বছরেরও বেশি বাঁচে। তবে এরা এদের মূল্যবান ডিমের জন্য ক্রমাগত শিকার হচ্ছে। এদের এক কেজি পরিমাণ ডিমের দাম ১০,০০০ ডলারেরও বেশি।
১৬. হুডেড শকুন
বন্য এই শকুনের প্রজাতিটিও বর্তমানে বিপন্নের তালিকায় চলে এসেছে। দিন দিন কমছে এদের সংখ্যা।
১৭. উত্তরের সাদা গণ্ডার
চমৎকার এই গন্ডারের প্রজাতিটি আজ বিলুপ্তির পথে। গোটা বিশ্বে এদের মাত্র ৩টি আজ বেঁচে রয়েছে। কেনিয়ার ওল পেজেটা সংরক্ষণ কেন্দ্রে রয়েছে এই ৩টি গন্ডার। এদের মধ্যে শুধুমাত্র একটি পুরুষ।
১৮. মিশরীয় শকুন
চমৎকার এই মিশরীয় শকুন গত কয়েক বছরে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান নিয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ভারতে এই পাখিটির সংখ্যা প্রায় ৩৫% কমে গিয়েছে।
১৯. কাইসারের নিউট
প্রচণ্ড রকম বিপন্ন এই প্রাণীটি আবাস ধ্বংস ও অবৈধ বেচা কেনার ফলে বর্তমানে একেবারেই বিপন্নের পথে। গোটা পৃথিবীতে এখন মাত্র ৯,০০০টির মতো এই নিউট রয়েছে।
২০. দাগযুক্ত তামারিন
তামারিন হলো কাঠবিড়ালির আকারের একধরনের বাঁদর। ব্রাজিলের ম্যানুস শহরে বর্তমানে এই বিপন্ন প্রাণীটির বাস। এদের সঠিক সংখ্যাটি অজানা। তবে বর্তমানে গোটা বিশ্বে আনুমানিক ১৭০টির মতো তামারিন রয়েছে।
২১. সি এঞ্জেলস
সমুদ্রের পানিতে সাঁতরে বেড়ানো এই অদ্ভুত প্রাণীগুলোকে সাধারণত জমাটবাধা সমুদ্রের বরফের নিচে দেখতে পাওয়া যায়। তবে বর্তমান বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এদের পরিমাণ দিন দিন কমছে।
২২. শ্বেত ভাল্লুক
সুন্দর এই প্রাণিটির সংখ্যা বর্তমানে এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে এখন এদের খুঁজে পাওয়াই মুস্কিল। জীববিজ্ঞানীদের মতে গোটা বিশ্বে এদের সংখ্যা বর্তমানে ২৫,০০০ এর মতো।
২৩. আফ্রিকান হাতি
গত এক দশকে চোরাশিকারিদের হাতে প্রায় ১,৪৪,০০০ এর মতো আফ্রিকান হাতি নিহত হয়েছে, যা এদের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ। বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় ৩,৫২,০০০ এর মতো।
২৪. চিতাবাঘ
১৯০০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে চিতাবাঘের সংখ্যা ১,০০,০০০ থেকে নেমে এসেছে ৯-১২,০০০ এ। এছাড়া ইরানের এক বিচ্ছিন্ন স্থানে বর্তমানে ২০০টির মতো চিতাবাঘের আবাস রয়েছে।
২৫. রেড ক্রাউড সারস
একসময়ের বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সারস প্রজাতিতে বর্রমানে মাত্র ১,৭০০-২,০০০ এর মতো এই সারস গোটা বিশ্বে রয়েছে।
২৬. ইউরোপীয় মৌমাছি
ইউরোপীয় এই মৌমাছি গত কয়েক দশকে বিলুপ্তপ্রায় পর্যায়ে চলে এসেছে। তবে সৌভাগ্যবশত এদের পরিমাণ ২০১৬ সাল থেকে বর্তমানে প্রায় ৩% বেড়েছে।
২৭. জলহস্তী
গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে বাস করা এই জলহস্তীদের বর্তমানে অসুরক্ষিত প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দিন দিন এদের পরিমাণ কমছে। বর্তমানে এদের সংখ্যা ১,২৫,০০০-১,৫০,০০০।
২৮. জায়ান্ট পান্ডা
বিপন্ন এই সুন্দর প্রাণীটিকে বর্তমানে বিশেষভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০০৩ সালের হিসাব অনুসারে গোটা বিশ্বে মাত্র ১,৮৬৪ থেকে ১,৫৯৬টির মতো জায়ান্ট পান্ডা রয়েছে।
২৯. মিলিটারি ম্যাকাও
অদ্ভুত সুন্দর এই পাখিটির সংখ্যা বর্তমানে বন ধ্বংসের ফলে অনেক কমে গিয়েছে। গোটা বিশ্বে মাত্র ১০,০০০ এর মতো এই পাখি রয়েছে।
৩০. আরবদেশীয় অরিক্স
প্রচণ্ড রকম বিপন্ন এই প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা বর্তমানে কিছুটা বেড়েছে। তবুও গোটা বিশ্বে মাত্র ১,০০০টির মতো এই প্রাণী বর্তমানে বেঁচে রয়েছে, যা সত্যিই দুঃখজনক।
ফিচার ইমেজ – Tawfiqur Rahman