রহস্যময় প্রাণীজগত: মানুষের বিরুদ্ধে প্রাণীরা যেভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছে।

গোড়ার কথা

একসময় মানুষ বসবাস করতো প্রকৃতির মাঝে, প্রকৃতির সাথে। আস্তে আস্তে মানুষ উন্নত হলো। যে প্রকৃতিকে মানুষ ভয় পেতো, পূজা করতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে; তাকে হাতের মুঠোয় আনতে চাইলো। মানুষ অনেকাংশে সফল হলো বটে, কিন্তু প্রকৃতিতে সৃষ্টি হলো বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন সময়ে মানুষ জলবায়ু বিনষ্ট করেছে; বুঝে কিংবা না বুঝে। কিন্তু যেভাবেই হোক, তার ফলাফল সরাসরি পড়েছে জীবজগতের উপরে। এই পরিবর্তনের সাথে টিকতে না পেরে অনেক প্রাণী হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে, আর অনেক প্রাণী টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে আপ্রাণ। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নিজেদের ভেতরে নানা পরিবর্তন এনেছে তারা। আজ তেমন কয়েকটি প্রাণীর কথাই জানবো আমরা।

বিষপ্রতিরোধী ইঁদুর

সুপারমাউসেরা দিব্যি বেঁচে আছে ওয়ারফেরিনকে কাঁচকলা দেখিয়ে; Source: elegraph.co.uk

ইঁদুর মানুষের বহুদিনের পুরানো সঙ্গী। সম্ভবত যখন মানুষ কৃষিকাজ শুরু করেছে, তখন থেকেই ইঁদুরেরা মানুষের পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। তবে মানুষ যে তার এই সঙ্গীকে খুশিমনে গ্রহণ করেছে তা বলার জো নেই। মানুষের শ্রমসাধ্য ফসলের ক্ষেত তারা যেভাবে নিষ্ঠার সাথে বারোটা বাজিয়ে আসছে, তাতে এহেন সঙ্গীকে কে বা চাইবে? তার উপরে আছে প্রাণঘাতী প্লেগ সহ আরো কয়েক ডজন রোগ। হ্যামিলিন শহরের গল্প মনে আছে তো? ইঁদুরের উৎপাতে কি বেকায়দাতেই না পড়েছিলো শহরবাসী। তাই ইঁদুরকে খুশিমনে নিতে না চাইলে তাতে দোষ দেওয়ারও কিছু নেই।

ইঁদুরকে দমন করার জন্য মানব সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশলের শরণাপন্ন হয়েছে। আমাদের অতি আদরের বিড়াল পোষাও বলতে গেলে ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচার জন্যই। তার উপরে আছে হরেক রকমের ফাঁদ। ইঁদুর দমনে শেষ সংযোজন রাসায়নিক বিষ।তবে ইঁদুরেরা যে হাসিমুখে এসব মেনে নিয়েছে তা নয়, তারাও যথাসাধ্য চেষ্টাচরিত্র করে চলেছে নিজেদের জানমাল টিকিয়ে রাখার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে সুপার মাউস!

মানুষের ব্যবহার করা ইঁদুর প্রতিরোধী বিষকে দিব্যি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলেছে এরা। স্প্যানিশ এবং জার্মান ইঁদুরের দুটি জাতের সংকরায়নের ফলে উদ্ভুত এই সুপার মাউস আসলেই সুপার পাওয়ারের অধিকারী। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা হতো ওয়ারফেরিন নামে একধরনের পদার্থ। এটি রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় এবং ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের দেহে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ করে; অন্তত এই সেদিন পর্যন্ত করতো। কিন্তু নতুন এই সুপার মাউসেরা সেসবকে দিব্যি কাঁচকলা দেখিয়ে তাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।

মথের রং পরিবর্তন

সাদা পিপার্ড মথ সহজেই চোখে পড়বে; Source: icr.org

মানুষের আধুনিকায়নের আরেক শিকার রাত্রিচর পিপার্ড মথ। নরম কোমল এই মথগুলো দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকতো শিকারীর চোখ থেকে। এ কাজে সহায় ছিলো এদের চমৎকার সাদা ফুটকুড়ি মেশানো ডানা। ছত্রাক পড়া বার্চ গাছের কান্ডে এরা এমনভাবে মিশে থাকতো, দূর থেকে তো দূরের কথা, কাছ থেকে অতি সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য না করলে এদের চেনাই দুষ্কর।

কিন্তু ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে আবহাওয়া পরিবর্তিত হতে থাকলো। কালো ধোঁয়ার আবরণে ঢাকা পড়তে লাগলো গাছপালা। এতে কালো বার্চের কান্ডে লুকিয়ে থাকা সাদা ফুটকিওয়ালা মথগুলো শিকারী পাখির চোখের উন্মুক্ত হয়ে পড়তে থাকলো এবং দ্রুত তারা শিকারী পাখিদের পেটে যেতে লাগলো। এই অবস্থায় তাদের হাতে একটিমাত্র উপায় ছিলো। পরিবেশের সাথে মিলিয়ে সাদা থেকে কালো হয়ে যাওয়া। সুতরাং আস্তে আস্তে পরিবেশ থেকে সাদা মথ হারিয়ে গেলো তার জায়গা নিলো কালো মথ

আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, মথেরা কি জাদু জানে যে মন্ত্রবলে সাদা থেকে কালো হবে? এখানে মূল ভূমিকা রাখে প্রকৃতি। স্বাভাবিকভাবেই কিছু মথ সাদা আর কিছু মথ কালো হয় (ঠিক যেমন দুই ছেলের কেউ লম্বা আর কেউ খাটো হতে পারে)। যখন সাদা মথ দ্রুত শিকারে পরিণত হতে থাকলো, তখন স্বভাবতই তারা বংশবিস্তারের সুযোগ কম পেতে থাকলো। অপরদিকে কালো মথেরা ঠিকই তাদের বংশবিস্তার চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে একসময় প্রকৃতিতে শুধুই কালোর আধিক্য দেখা দিলো।

এ থেকে আবার বুদ্ধিমান পাঠকের মনে জিজ্ঞাসা আসতে পারে, তাহলে কি দূষণ কমে গেলে সাদা মথ ফিরে আসবে? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই!আর এমনটিই দেখা গিয়েছিলো ১৯০০ সালে, যখন ইংল্যান্ড প্রকৃতি বিশোধন পরিকল্পনা তুলে নিয়েছিলো কাঁধে।

মেক্সিকোর গুহা মাছেরা

আটলান্টিক মোলি; Source: National Geaographic

মেক্সিকোর দক্ষিণে জকু (Zoque) উপজাতির মানুষেরা এক অদ্ভুত রীতি পালন করে। ফসল ওঠার আগে তারা দলবেঁধে স্থানীয় একটি সালফিউরিক খনিজে নির্মিত গুহাতে যায়। সেখানে ঈশ্বরের কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। তারপর বিচার করে ঈশ্বর তাদের আকুতি শুনেছে কিনা। এজন্য বেছে নেয় সালফিউরিক গুহার ভেতরের একটি হ্রদকে। এখানে বসবাস করে আটলান্টিক মোলি নামে এক প্রজাতির মাছ। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বারবাসকো গাছ থেকে এক ধরনের পেস্ট তৈরি করে নেয় তারা। মৃদু বিষাক্ত এই নির্যাস পানিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। এই বিষ মাছের জন্য প্রাণঘাতী। হাজারে হাজারে মাছ মরে ভেসে ওঠে। যত বেশি মাছ ভেসে উঠবে, তাদের বিশ্বাস, ঈশ্বর  তত বেশি সদয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে ঈশ্বর তাদের প্রতি খুব বেশি সদয় হতে পারেন নি! কেননা আটলান্টিক মোলি এই নিষ্ঠুর কাজের বিরুদ্ধে নিজেদের দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে নিয়েছে। এখন বারবাসকো গাছের নির্যাসে তাদের ক্ষতি হয় না। অবশ্য ওদের এ মুহূর্তে আর এই অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োজন নেই, কারণ আদিবাসীদের এই রীতি এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

 দাঁতবিহীন হাতি

দাঁতবিহীন হাতি; Source: techly.com.au

বিবর্তনের ধারায় হাতিরা একজোড়া দাঁত উপহার পেয়েছিলো প্রকৃতির হাত থেকে। শত্রুকে আক্রমণ করার পাশাপাশি অন্য হাতিকে মিলনের জন্য আকর্ষণ করার জন্য এই দাঁত জোড়া বেশ কাজে দিয়ে এসেছে এতদিন। কিন্তু এগুলোই যে তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে কে জানতো? সৌন্দর্যপিপাসু নির্মম মানুষেরা অন্যের প্রাণ কেড়ে নিয়ে নিজেদের ড্রইং রুম সাজাতে কোনোদিন কার্পণ্য করেনি। আর হাতির দাঁত এ কাজে সবসময়ই চাহিদার তুঙ্গে ছিলো। সেই আদিম রাজাদের থেকে আধুনিক ধনী, হাতির দাঁতের কারুকাজ তাদের আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যম। তাই গত দু’শ বছরে পৃথিবীতে হাতির সংখ্যা কমে গেছে ভয়াবহভাবে।

এখনও অবৈধভাবে শত শত হাতি শিকার হচ্ছে প্রতিবছর। শিকারীদের লক্ষ্য থাকে বড় দাঁতাল হাতি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বড় দাঁতওয়ালা হাতিগুলো তাদের পূর্ণ জীবনকাল অতিবাহিত করতে পারছে না। তার আগেই তাদেরকে কোনো লোভী শিকারীর হাতে জীবন দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে দাঁতবিহীন বা ক্ষুদ্র দাঁতওয়ালা যারা, তারা বেঁচে যাচ্ছে।

সুতরাং প্রজাতি টিকিয়ে রাখার জন্য হাতিদের কাছে তাদের দাঁতগুলো বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমতাবস্থায় কিছু কিছু অঞ্চলে ৯৮ শতাংশ হাতি দাঁত ছাড়াই জন্মগ্রহণ করছে! অথচ পূর্বে সেখানে শতকরা ২ থেকে ৬ শতাংশ হাতি দাঁত ছাড়া জন্মাত। এটাও বলতে গেলে মানুষের অপদান (অপকারী যে দান)! কারণ দেখা যায়, দাঁত ছাড়া হাতিরা তাদের আত্মরক্ষায় বেশ অপারগ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন কন্দ বের করার জন্য মাটি খোঁড়ার মতো কাজগুলোও তারা সাবলীলভাবে করতে পারছে না।

হাডসন নদীর মাছেরা

আটলান্টিক টমকড, যারা নিজেদের দূষিত জলে মানিয়ে নিয়েছে; Source: Molecular Evolution Forum

আমেরিকার একটি কোম্পানী, নাম জেনারেল ইলেকট্রিক, তাদের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের জন্য এক ভয়াবহ পন্থা অবলম্বন করেছিলো। তারা তাদের সমস্ত বর্জ্য পদার্থ হাডসন নদীতে ফেলতো। হিসেব করে দেখা যায়, ১৯৪৭-৭৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে তারা প্রায় ১৩ লক্ষ পাউন্ড বর্জ্য নিক্ষেপ করেছিলো, যার প্রধান উপাদান ছিলো পলিক্লোরিনেটেড বায়ো ফিনাইল, যা সংক্ষেপে পিসিবি নামে পরিচিত।

মারাত্মক এই রাসায়নিকটি এতটাই ভয়াবহ যে, এরা কখনো ভেঙে শেষ হয়ে যায় না। এই বিশাল পরিমাণ পিসিবি হাডসন নদীকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। ৩১৫ মাইল লম্বা হাডসন নদীর ২০০ মাইলের উপরে ছড়িয়ে পড়ে এই রাসায়নিক, যেগুলোর সংস্পর্শে এলে প্রাণীদের হৃৎপিন্ড অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো আটলান্টিক টমকড নামে এক মাছের ক্ষেত্রে। নদীর তলদেশে বসবাসকারী এই মাছেরা তাদের জিনে এমন কিছু মিউটেশন লাভ করলো যে, তারা  পিসিবি দূষিত পানিতে অভিযোজিত হওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাডসনকে পুনরায় দূষণমুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে আটলান্টিক টমকডদের ঝামেলা বাড়লো বইকি কমলো না। দূষিত পানিতে অভিযোজিত টমকডেরা অনাস্বাদিত বিশুদ্ধ পানিতে কীভাবে খাপ খাইয়ে নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Related Articles

Exit mobile version