জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার আমাদের এই পৃথিবী। সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে প্রায় ৮৭ লাখেরও বেশি প্রজাতির জীব। জলে-ডাঙায় বসবাস করা এসব জীবের স্পন্দনে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে পৃথিবীর আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে। প্রজন্মান্তরে বাহিত হচ্ছে প্রাণের আলোকবর্তিকা। এই লাখ লাখ জীবের মধ্যে যদি আকার-উচ্চতাভেদে একটি ক্রম তৈরি করা হয়, তাহলে সবার আগে কাদের নাম আসবে বলে ধারণা করেন?
অনেকেই বলবেন ডাইনোসরদের কথা। খুব একটা ভুল হবে না এই উত্তর। সাউরোপোসাইডন নামক এক প্রজাতির ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া গেছে যারা লম্বায় প্রায় ৫৫ ফুট লম্বা। কিন্তু সাউরোপোসাইডনদের চেয়েও লম্বা প্রাণী রয়েছে। আর সেই প্রাণীর সন্ধান করতে হলে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেতে হবে না। বর্তমান পৃথিবীতেই সেই প্রাণী বেঁচে আছে। আর তা হচ্ছে সাগরের নীল তিমি। এরা প্রায় ৯৮ ফুট লম্বা হয়। প্রাণিজগতের ইতিহাসে এরা প্রথম হলেও সামগ্রিক জীবজগতে সবচেয়ে লম্বা সদস্য নয়। ভুলে গেলে চলবে না, জীবজগতে প্রাণীর পাশাপাশি বহু প্রজাতির উদ্ভিদও রয়েছে। উদ্ভিদকূলে এমন এক সদস্য রয়েছে যাদের উচ্চতা প্রায় ৩০০ ফুটের চেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত হিসাব করা সবচেয়ে উচ্চতম সদস্য প্রায় ৩৮০.১ ফুট উঁচু হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ৬টি সাউরোপোসাইডন বা ৩টি নীল তিমি একে অপরের উপর দাঁড়িয়ে এদের উচ্চতার সমান হতে পারবে। আর এই সবচেয়ে উঁচু সদস্যের নাম হচ্ছে ‘ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড ট্রি’।
ঠিক কতটুকু উঁচু?
পৃথিবীতে বিদ্যমান ৩টি রেডউড প্রজাতির মধ্যে অন্যমত হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড। অন্য দুটি হচ্ছে- সিয়েরা এবং জাপানিজ রেডউড। ক্যালিফোর্নিয়া রেডউডকে অনেকে কোস্ট বা কোস্টাল রেডউড হিসেবেও ডাকে। এটি মূলত মোচাকৃতি ফলদায়ক নগ্নবীজী কাষ্ঠল বৃক্ষ। এদেরকে কোস্টাল নামকরণের পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালোফোর্নিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমের সৈকত ঘেঁষে এদের অবস্থান। তবে এরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার মিটার উচ্চতায় জন্ম নেয়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Sequoia sempervirens. চেরোকি ভাষার আদিপুরুষ সেকুইয়া’র সম্মানার্থে এই বৃক্ষের বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম অংশে সেকুইয়া রাখা হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কমিশন কর্তৃক এই বৃক্ষকে বিপন্ন ঘোষণা করা হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড বৃক্ষ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা জীব হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এদের গড় উচ্চতা প্রায় ৩২০ ফুট। এরা এতই উঁচু হয় যে জমিন থেকে দাঁড়িয়ে এদের শীর্ষবিন্দু দেখতে পারবেন না। একটি ৩০ তলা অট্টালিকার সমান হয়ে থাকে এদের একেকটি। পৃথিবীর উচ্চতম রেডউড হচ্ছে হাইপেরিয়ন। ২০০৬ সালে আবিষ্কৃত এই বৃক্ষটি উচ্চতায় প্রায় ৩৮০.১ ফুট লম্বা। এরপরই আছে হেলিওস (৩৭৪.৩ ফুট), ইকারাস (৩৭১.২ ফুট) এবং দাইদেলাস (৩৬৩.৪ ফুট)। মানুষের হাতে অনিষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে এদের অবস্থান গোপন রাখা হয়েছে। এসব উঁচু বৃক্ষকে মাটিতে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সহায়তা করে এদের প্রশস্ত কাণ্ড। প্রায় ২৭ ফুট চওড়া কাণ্ডের উপর ভর করা এই গাছগুলো শুধু লম্বার দিক দিয়েই প্রথম নয়, বরং জীবজগতের গড় আয়ুর তালিকাতেও এরা প্রথম। সরকারি তথ্যমতে, সবচেয়ে বুড়ো রেডউডের বয়স প্রায় ২,২০০ বছর। অর্থাৎ, এই গাছ যখন চারা ছিল তখন পৃথিবীতে রোমান সাম্রাজ্যের শাসন ছিল!
একসময়ের পৃথিবীজুড়ে
বর্তমানে অতিকায় রেডউড বৃক্ষগুলোর সিংহভাগ উত্তর আমেরিকা মহাদেশে পাওয়া যায়। বলতে গেলে এই গাছগুলো এখন আমেরিকার স্থানীয় বৃক্ষ বলে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু একসময় এই গাছ উত্তর গোলার্ধের সর্বত্র পাওয়া যেত। পৃথিবীর বুকে ক্যালিফোর্নিয়া রেডউডের সবচেয়ে পুরাতন ফসিলের বয়স প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর। জুরাসিক যুগে এদের পথচলা শুরু হয়। ধারণা করা হয়, পৃথিবী থেকে ডাইনোসরের বিলুপ্তির পরপরই এদের আবির্ভাব ঘটে। অর্থাৎ, আবির্ভাবের দিক দিয়ে এরা ফুল, মাকড়সা এবং পাখিদের থেকেও প্রাচীন।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের আগমন ঘটেছে প্রায় ২ লাখ বছর আগে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে রেডউড বৃক্ষ জীবজগতের মুরুব্বি গোছের সদস্য। এরপর আমেরিকা ব্যতীত অন্যান্য মহাদেশ থেকে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৫০ সালে বাণিজ্যিকভাবে রেডউড কর্তনের আগে এখানে প্রায় ২০ লাখ একর জায়গাজুড়ে রেডউড বন ছিল। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্ধেক আয়তনের সমান হবে সেই বন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিস্তৃত বন হঠাৎ করে ধ্বংস হলো কেন?
১৮৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে স্বর্ণখনির সন্ধান পাওয়া যায়। এর ফলে হাজার হাজার কর্মচ্যুত মানুষ এই অঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করে। মানুষের কাঠ এবং জ্বালানীর চাহিদা মেটাতে রেডউড কর্তন শুরু হয়। স্থানীয় আদিবাসী যায়া ছিল, তারা সাধারণত এই গাছ কাটতো না। তবে গাছ ভূপাতিত হয়ে গেলে তার কাঠ ব্যবহারের জন্য কেটে নিয়ে যেত। শত বছর ধরে কমতে কমতে সেই বনের মাত্র ৫ শতাংশ বাকি রয়েছে। বর্তমানে যে বন দেখা যায়, তার অধিকাংশ গাছের বয়স বড়জোর দেড়শ থেকে দুইশত বছর হবে। সহস্রবর্ষী গাছের হিসাবে এরা নিতান্ত শিশু। ক্যালিফোর্নিয়া সৈকতের সন্নিকটে প্রায় সাড়ে চারশ’ মাইল দীর্ঘ জায়গাজুড়ে এই গাছগুলো সগৌরবে দণ্ডায়মান রয়েছে।
আবহাওয়া
সবধরনের আবহাওয়ায় রেডউড গাছ জন্মায় না। প্রজাতিভেদেও এদের অনুকূল আবহাওয়ার রকমফের হতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড সাধারণত ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়াতে ভালো জন্মায়। এজন্য এদের বনগুলো সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে দেখা যায়। খরা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে গাছের এই বিশাল দেহকে সজীব রাখতে এমন আবহাওয়া অত্যন্ত দরকারি। বেঁচে থাকার জন্য এদের প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করতে হয়। এজন্য এরা আকারে বড় হলেও এদের শেকড় মাটির বেশি গভীরে পৌঁছায় না। তবে এদের শেকড় অনেক বিস্তৃত হয়। বেশিরভাগ পানি বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। সারাবছর বৃষ্টিপাত না পেলেও এদের সমস্যা হয় না। কারণ এদের সুউচ্চ এবং ঘন শাখাপ্রশাখায় কুয়াশা জমে পানি হয়ে ঝরে পড়ে। প্রতিবছর এরা গড়ে ২-৩ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
বংশবিস্তার
ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড বৃক্ষ বীজ এবং অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। গাছের আকার বড় হলেও এদের মোচার আকৃতি অত্যন্ত ছোট আকারের হয়ে থাকে। প্রতিটি মোচার ভেতর ৫০-৬০টি বীজ থাকে। তবে বীজ দিয়ে এদের বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে একদম নিচে ভূপৃষ্ঠে জমে থাকা শুকনো পাতা এবং আবর্জনার স্তর। তাছাড়া এদের নতুন বীজের প্রায় ৭০% শুরু থেকেই অকার্যকর হিসেবে গণ্য হয়। তাই বীজ থেকে খুব বেশি রেডউড চারা উৎপন্ন হয় না। তবে ভূপৃষ্ঠে গাছের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে বহু রেডউড চারাগাছ জন্ম নেয়। মূলত, বেশিরভাগ গাছই অঙ্গজ উপায়ে জন্ম নিয়ে থাকে। এরা অনেকসময় রূপকথার পরীর আংটি (Fairy ring) এর মতো চক্রাকারে জন্ম নেয় এবং বেড়ে উঠে। জিনগতভাবে, অঙ্গজ উপায়ে বেড়ে উঠা চারাগুলো তাদের জন্মদাতা গাছের ক্লোন হয়ে থাকে।
ক্ষয়রোধী কাণ্ড
রেডউড বনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই গাছের বেশ কিছু প্রতিরক্ষা পন্থা রয়েছে। সেগুলো মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এদের ক্ষয়রোধী কাণ্ড। এদের কাঠ বেশ টেকসই হয়। সহজে পচন ধরে না এবং পোকামাকড় এবং অন্যান্য ক্ষতিকর জীবের আক্রমণে নষ্ট হয় না। পানির কারণে অনেক গাছের কাঠ নষ্ট হয়ে যায়। রেডউড বৃক্ষের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। এমনকি অনেক কীটের জন্য এর কাণ্ড বিষাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই গাছের বাকল বেশ পুরো। যার ফলে বনে কোনো কারণে আগুন লেগে গেলেও এ গাছের কোনো ক্ষতি হয় না। তবে একদম তরুণ চারাগাছ আগুনে পুড়ে যেতে পারে। এর কাণ্ড বিভিন্ন রাসায়নিক এবং জৈবিক পদার্থের (যেমন, এসিড) আক্রমণ থেকে গাছের কাঠ সুরক্ষিত থাকে। এসব গুণের কারণে ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯ শতকে রেডউড কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা ছিল প্রচুর।
জলবায়ুতে রেডউডের প্রভাব
ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড বৃক্ষের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন। রেডউডের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং ঘন কুয়াশার প্রয়োজন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুষ্ক মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর ফলে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টিপাত এবং পাতলা কুয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিপাত কম হলেও কুয়াশাকে ঘনীভূত করে পানির অভাব পূরণ করতো রেডউড। কিন্তু কুয়াশাও পাতলা হয়ে যাওয়ায় এখন এদের পানির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। যার ফলে গাছগুলো প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের অভাবে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রেডউডদের নিয়ে সম্প্রতি গবেষণায় কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়েছে জলবায়ুর নাটকীয় পরিবর্তন প্রতিরোধে এদের ভূমিকা। আমাদের আবহাওয়া এবং জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত কার্বন এবং কার্বন যৌগ শুষে নিতে পারে এই বৃক্ষ। পুরাতন রেডউড বনাঞ্চলের গাছগুলো এই কার্বন শোষণ করে নিজের দেহে জমা করে রাখে। অন্যান্য বনাঞ্চলের তুলনায় এদের শোষণ মাত্রা প্রায় ৩ গুণ বেশি। প্রতি একরে এরা প্রায় ১,০৮৩.৩৩ মেট্রিক টন কার্বন জমা রাখে। তাছাড়া এই গাছগুলো শতবর্ষী এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহস্রবর্ষী হওয়ার দীর্ঘ সময় ধরে এই কার্বন এদের মাঝে জমা থাকবে। এর ফলে বিষাক্ত কার্বন যৌগ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, রেডউডের পরিত্যক্ত গুঁড়ির মধ্যেও কার্বন সঞ্চিত থাকতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড বৃক্ষকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই এই গাছের সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় প্রাচীন যুগের এই অনন্য নিদর্শন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১৯১৮ সালে এই বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য গঠিত হয় ‘সেভ দ্য রেডউডস লীগ’। এই সংগঠনের কাজ হচ্ছে রেডউড বনাঞ্চলকে মানুষের হাতে ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখা। এছাড়াও রেডউড নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে নানা সম্ভাবনাময় দিক উঠে এসেছে। তাই এই বনাঞ্চল সংরক্ষণ করে গবেষণার কাজ সুগম করার দিকে নজর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।