বিখ্যাত পরিচালক ডেভিড ফিঞ্চারের সিনেমা ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অফ বেঞ্জামিন বাটন’ যারা দেখেছেন, তাদের জন্য এই অদ্ভুত ন্যাকেড মোল র্যাটের অদ্ভুত মামলা বোঝা একটু সহজতর হবে। তারপরেও যাদের সিনেমাটি দেখা হয়নি, তাদের জন্য শুরুতে সিনেমার কাহিনী খানিকটা বলে নিচ্ছি।
সিনেমার নায়ক বেঞ্জামিন বাটনের ব্যাপারটা একটু আলাদা। অন্যান্যদের আট-দশটি শিশু থেকে তার জীবনচক্র আলাদা। আলাদা বলতে একদম উল্টো। সবার জীবন যেখানে শিশু থেকে কিশোর, যৌবন এরপর আসে বার্ধক্য, সেখানে বেঞ্জামিনের জীবন শুরুই হয়েছে বার্ধক্য দিয়ে। সদ্য জন্ম নেয়া বেঞ্জামিনের দেহে অশীতিপর বৃদ্ধদের ন্যায় জীর্ণ চামড়া দেখে যে কেউ আঁতকে উঠলো। সবাই ভাবলো আর কয়দিন বাঁচবে এই শিশু? কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বুড়ো শিশু বেঞ্জামিনের জীবনের চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে বেঞ্জামিন বুড়ো হয়ে গেলো তরুণ বেঞ্জামিন। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় আর বেঞ্জামিনের যায় বয়স।
আমাদের আজকের প্রবন্ধের নায়ক ন্যাকেড মোল র্যাট নামক এক ধরনের নেংটি ইঁদুর, যাদের ব্যাপারটা বেঞ্জামিনের ন্যায় কিঞ্চিত অদ্ভুত। বেঞ্জামিনের গড়মিল যেখানে বয়সে হিসেবে, সেখানে এই ইঁদুরদের বয়স, ব্যথা পাওয়া, রোগ অসুখ হওয়া থেকে শুরু করে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তাসহ আরো বহু হিসাব অন্যান্য ইঁদুরদের থেকে আলাদা। কমিক বইয়ের রঙিন পাতায় বর্ণিত সুপারম্যানের ন্যায় এরাও অনেক প্রতিকূল পরিবেশে দিব্যি মানিয়ে নিতে পারে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- ‘সব সুপারহিরো মুখোশ পরে না’। আমাদের নেংটি ইঁদুরেরও কোনো মুখোশ বা পোশাক নেই। এদের আছে দু’জোড়া ধারালো দাঁত আর বুড়োদের মতো শীর্ণ চামড়া।
পরিচিতি পর্ব
অদ্ভুত ইঁদুরদের নিয়ে কথা বলার আগে এদের সাথে হালকা পরিচিতি পর্ব সেরে নেওয়া যাক। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতে, সাধারণ চায়ের কাপের সমান আকারের এই নেংটি ইঁদুরগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম Heterocephalus glaber।এরা স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পূর্ণবয়স্ক ইঁদুররা সাধারণত তৃণভোজী হয়ে থাকে। এই প্রাণীর দেহে কোনো চুল বা পশম থাকে না। এর জীর্ণ চামড়া দেখলে বৃদ্ধ মানুষের চামড়ার কথা মনে পড়ে।
এদের মুখের অগ্রভাগে কাঠবিড়ালের ন্যায় ধারালো দাঁত রয়েছে। এদের দাঁতের একটি মজার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন স্বাধীনভাবে সঞ্চালিত হতে পারে, তেমনি এদের সামনের দাঁতজোড়া প্রয়োজন পড়লে আলাদা আলাদাভাবে নাড়ানো যায়। এই অদ্ভুত দাঁতজোড়া ইঁদুরগুলোর অন্যতম হাতিয়ার। এর সাহায্যে এরা মাটি খুঁড়ে বেশ বিস্তৃত সুড়ঙ্গ গড়ে তোলে। এই সুরঙ্গপথের সাহায্যে মাটির নিচে গড়ে ওঠে নেংটি ইঁদুরদের বিশাল কলোনি। দু’জোড়া দাঁতের সাহায্যে এই ইঁদুরের দল মাটির নিচে সর্বোচ্চ আড়াই মাইল লম্বা সুড়ঙ্গ খনন করতে পারে!
পূর্ব আফ্রিকা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন আফ্রিকান অঞ্চলে এই ইঁদুরদের উপদ্রব লক্ষ্য করা যায়। এরা মূলত তৃণভূমি অঞ্চলে বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
সামাজিক জীবনযাপন
ন্যাকেড মোল র্যাট ইঁদুর শ্রেণীর প্রাণী হলেও এদের জীবনযাপনের ধরন অনেকটা পতঙ্গদের সাথে মিলে যায়। মৌমাছি, বোলতা, পিঁপড়ার ন্যায় এরাও কলোনির মাঝে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করে। মৌমাছির ন্যায় এদের কলোনির সভাপতির দায়িত্বে থাকে এক রানী ইঁদুর। রানী ইঁদুরের তত্ত্বাবধানে শ্রমিক ইঁদুররা কাজ ভাগাভাগির মাধ্যমে নিজের কলোনির নিরাপত্তা এবং বর্ধনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। আর রানীর কাজ হচ্ছে বংশবৃদ্ধি করা। রানীর পছন্দমতো কয়েকটি পুরুষ ইঁদুর ও রানীর মাধ্যমে জন্ম নেয় ইঁদুরের পরবর্তী প্রজন্ম।
এরা বাদে বাকি ইঁদুররা শ্রমিক হিসেবে পরিচিত। শ্রমিকরা শুধু সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ করে না। এরা খাদ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সদ্য জন্ম নেয়া ইঁদুরের লালন পালন করার কাজও করে থাকে। ন্যাকেড মোল র্যাটরা সাধারণত চোখে কম দেখতে পায়, তাই এদের ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি প্রখর হয়। এরা বিভিন্ন শব্দ উৎপাদনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে থাকে।
তবে রানীর মৃত্যু ঘটা মাত্র এদের সংহতির বারোটা বেজে যায়। রানীর ফাঁকা আসন পূরণ করার জন্য এদের মাঝে তখন মার-মার কাট-কাট যুদ্ধ বেঁধে যায়। আবার দুটো কলোনির প্রবেশমুখ যদি কাছাকাছি পড়ে যায়, তখন দুই গ্রুপের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বেঁধে যায়। এরা নিজেদের কলোনির অধিকার রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে পারে।
এদের বয়স বাড়ে না
বেঞ্জামিন বাটনের মতো এই ইঁদুরের বয়স আক্ষরিক অর্থে না কমলেও এদের বয়স বেড়ে বুড়ো হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এই চির তরুণ ইঁদুরের দলের গড় আয়ু প্রায় ৩০ বছর, যেখানে আকারভেদে অন্যান্য ইঁদুরের গড় আয়ু মাত্র ৪ বছর হয়ে থাকে। সাধারণ ইঁদুরের সাথে আকার বিবেচনা করলে ন্যাকেড মোল র্যাটদের বাঁচার কথা মাত্র ৬ বছর। এদের দেহে বার্ধক্যের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। সময়ের হিসাবে বয়স বাড়তে থাকলে অন্য যেকোনো প্রাণীর মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে গেলেও এদের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায় না। জীববিজ্ঞানী রচেল বুফেনস্টেইন দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই ইঁদুরদের তারুণ্যের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে তিনি এদের সম্পর্কে শত শত মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে তিনি দেখতে পান, ন্যাকেড মোল র্যাটের কোষে ডিএনএ সংশোধন প্রক্রিয়া অত্যন্ত সক্রিয়। এই সক্রিয় সংশোধন প্রক্রিয়া বদৌলতে এরা হিসাবের চেয়েও ৫ গুণ সময় ধরে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়।
আবার বাচ্চা জন্ম দেয়া ইঁদুররা শ্রমিক ইঁদুরের তুলনায় বেশি বছর বেঁচে থাকে। এর পেছনে কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা জানান, শ্রমিক ইঁদুরের তুলনায় বাচ্চা জন্মদাতাদের দেহে পেশি পুনর্গঠনের সাথে জড়িত জিনের অভিব্যক্তি অধিক মাত্রায় ঘটে থাকে। এরা ইঁদুরের দেহে পেশি ক্ষয়রোধ করে এবং আজীবন তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে ৩০ বছরের কাছাকাছি রানী ইঁদুরের দেহেও কমবয়সী ইঁদুরের সমান প্রজনন ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে।
সুপার ‘র্যাট’
ন্যাকেড মোল র্যাটের কেরামতি শুধু বয়স আটকে ফেলার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই ইঁদুরের দেহে মরণব্যাধি ক্যান্সারও বাসা বাঁধতে পারে না। এদের এই অতিপ্রাকৃত ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এখন পর্যন্ত এর সঠিক কারণ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় জার্নাল প্রকাশনা সংস্থা PNAS এ প্রকাশিত একটি জার্নালে আন্দ্রে সেলুয়ানোভ নামক এক গবেষক এর পেছনে কন্টাক্ট ইনহিবিশন নামক এক ক্যান্সার বিরোধী প্রক্রিয়ার উপস্থিতিকে দায়ী করেছেন। ন্যাকেড মোল র্যাটরা এই প্রক্রিয়ার প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। এর ফলে এদের দেহে কোনো ক্যান্সার কোষ জন্ম নিতে পারে না।
শুধু ক্যান্সার নয়, এই ইঁদুররা দেহে যেকোনো ধরনের আঘাতের ফলে ব্যথা অনুভব করে না। এর ফলে বড় ধরনের আঘাতের পরেও এরা দিব্যি ছুটাছুটি করতে পারে। ঠিক যেন কমিক বুকের সুপারম্যানের ন্যায় অবিনশ্বর এই সুপার ইঁদুররা।
অক্সিজেন ছাড়া ১৮ মিনিট
অক্সিজেন প্রাণিজগতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস। শ্বাস গ্রহণের সময় বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে বিভিন্ন বিপাকের মাধ্যমে অধিকাংশ প্রাণী দেহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে থাকে। অক্সিজেন না থাকলে কয়েক মুহূর্তের মাথায় পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু এক্ষেত্রে আফ্রিকার ন্যাকেড মোল র্যাটরা ব্যতিক্রম। বেশ অল্প মাত্রায় অক্সিজেনে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে। এরা অক্সিজেন ছাড়াও দীর্ঘ ১৮ মিনিট ধরে বেঁচে থাকতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা ১৮ মিনিট পর সাময়িকভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও পুনরায় অক্সিজেন পাওয়ামাত্র লাফিয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। তা এদের মাঝে কী এমন জাদু আছে? কী এদের রহস্য?
গবেষণায় দেখা যায়, অক্সিজেন ঘাটতি অনুভূত হওয়া মাত্র এরা শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দেয়। অক্সিজেনের বদলে এরা দেহে জমা থাকা ফ্রুক্টোজ গ্রহণ করা শুরু করে। ফ্রুক্টোজ সাধারণত প্রাণীদের মাঝে দেখা যায় না। অক্সিজেন ঘাটতি থাকলে উদ্ভিদের মাঝে ফ্রুক্টোজ ব্যবহার দেখা দেয়।
ক্ষুদ্র টার্ডিগ্রেড থেকে শুরু করে রঙিন ময়ূর কিংবা ডোরাকাটা চিতাবাঘ- বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে চলা বিবর্তন পৃথিবীকে দু’হাত ভরে দিয়েছে বিচিত্রময় প্রাণিজগৎ। বিবর্তনের পরিক্রমায় বিভিন্ন প্রাণী অদ্ভুত অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে যা যুগে যুগে বিজ্ঞানমহলে বিজ্ঞানীদের আলোচনার খোরাক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। এসব প্রাণীর ভয়ংকর রূপ কিংবা সৌন্দর্য দেখে কৌতূহল হয়েছে হাজার গবেষক। কিন্তু পেট উল্টো করে মরার মতো ঘুমিয়ে থাকা নেংটি ইঁদুরের জাত ‘ন্যাকেড মোল র্যাট’কে দেখে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি এরা কতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। টার্ডিগ্রেডের মতো অবিনশ্বর না হলেও, এদের দেহের বিস্ময়কর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সবসময় বিজ্ঞানীদের অবাক করেছে। এদের নিয়ে গবেষণা অতীতে চলেছিলো, এখন চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে এদের জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা আরো বিশদভাবে জানতে পারবো। তখন আমরা আমাদের পৃথিবীর জীববৈচিত্র সম্পর্কে আরেকটু বেশি জানতে পারবো। উন্মোচন করবো বহু অচেনা জ্ঞান, যা আমাদের অগোচরে কোথাও লুকিয়ে আছে।