শহরবাসীদের অনেকেই পোষা প্রাণী হিসেবে বিড়াল পালেন। এটি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গৃহপালিত প্রাণী। বিড়াল খুবই আরামপ্রিয় একটি প্রাণী। বাংলাদেশে একে ‘বাঘের মাসি‘ বলে ডাকা হয়। অনেকে বিড়াল পোষেন ইঁদুর মারার জন্য। তাছাড়া দুধ, মাছ, মাংস বিড়ালের প্রিয় খাবার। এরা খুবই নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে। কারণ এদের পায়ের নীচে খুব নরম মাংসপিণ্ড থাকে।
উৎপত্তি
প্রায় ৯,০০০ বছর পূর্বে প্রাচ্যের কৃষকেরা সর্বপ্রথম বন্য বিড়ালকে পোষ মানাতে সক্ষম হন। তারই কয়েক শত বছর পর মিশর ছাড়িয়ে সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বিড়াল ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে শুধুমাত্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ব্যতীত সর্বত্রই বিড়াল দেখা যায়। চীনে প্রায় ৫,৩০০ বছর পূর্বের কিছু মৃৎশিল্পে চমৎকারভাবে বিড়ালের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়, যেগুলো আকারে বর্তমানের সাধারণ বিড়ালের মতই। যদিও খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬৫-২১৫০ অব্দে বিড়ালকে একটি পবিত্র প্রাণী হিসেবে মানা হতো, তবুও ঐ সময়ে তেমন কেউ বিড়াল পালতো না। বিভিন্ন মন্দিরে বিড়ালের পূজা করা হতো। ইঁদুর ধরে বলে বিড়ালকে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী পশু বলে বিবেচনা করা হতো।
বিড়াল সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য
ঘরোয়া বিড়ালগুলো বন্য বিড়ালের চেয়েও আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে। মিশর এবং তার পূর্ববর্তী এলাকার বৃহত্তর গবেষণার মাধ্যমে এই আশ্চর্য তথ্য পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করে থাকেন বন্য বিড়ালেরা শস্যখাদক ইঁদুর ধরবার তাগিদে বিভিন্ন ক্ষেতে ঘুরে বেড়াতো এবং তখন থেকেই কৃষকেরা এদেরকে বন্ধু ভাবা শুরু করেন। গবেষক ইভা মারিয়া গেইগল বলেন, বিড়াল দুই ধাপে পোষা শুরু হয়। প্রথমে পূর্বাঞ্চলীয় কোনো দেশে এবং তারও অনেক পরে মিশরে। এরপর বিড়ালগুলো জাহাজে জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে কারণ তখন জাহাজে মজুদ করা শস্য এবং পণ্য ইঁদুরের কবল থেকে বাঁচাতে একমাত্র কার্যকরী পন্থা ছিল বিড়াল।
ইঁদুর ধরা থেকে যেভাবে পোষা প্রাণীতে পরিণত হলো এই বিড়াল
বিড়াল শুরু থেকে এত আদুরে বা অলস ধরণের প্রাণী ছিল না। প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে কৃষক এবং নাবিকদের হয়ে তারা ইঁদুর ধরেছে এবং অনেক অনেক উপকার করে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে বিড়ালই মানুষের সঙ্গ বেছে নিয়েছিল। এতে দুই পক্ষেরই লাভ হলো। গবেষণায় আরো জানা যায় যে, প্রায় ২০০ রকম প্রাচীন বিড়ালের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলো মূলত পাথুরে যুগ, মিশরের মমি যুগ কিংবা ভাইকিং গ্রেভসের সময়কার।
বিড়াল পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে রোমান যুগে। মজার ব্যাপার হলো টবি বিড়ালগুলোর উৎপত্তি হয়েছে মধ্যযুগে। এই বিড়ালগুলোর ডিএনএ-তে এমন কিছু জিন পাওয়া গেছে যার কারণে এদের শরীরে নিখুঁত পশমের ডিজাইন থাকে। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পূর্ব তুরষ্কে এই গবেষণা করা হয়। বেশ কয়েক শত বছরের মাঝেই এই বিড়ালগুলো সারা বিশ্বে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বুদ্ধির দিক থেকে টবি বিড়াল অন্যান্য প্রজাতি থেকে পিছিয়েই আছে বলা যায়। ড. গেইগল আরো বলেন, বিড়াল আসলে প্রথম দিকে খুব কমই সংকরিত হতো যা কুকুরের বৈশিষ্টের সম্পূর্ণ বিপরীত। এছাড়া বিড়াল অনেক বেশি উপকারীও ছিল। কিন্তু বর্তমানে অনেক রকমের সংকর বিড়াল দেখা যায়। যেমন: ব্যাম্বিনো, কর্নিশ রেক্স, পার্সিয়ান ইত্যাদি। বর্তমানে সারা বিশ্বে বিভিন্ন জাতের গৃহপালিত বিড়াল দেখা যায়। এর একটি ছোট্ট তালিকা নিচে দেয়া হলো।
গৃহপালিত বিড়ালের জাত তালিকা
আমেরিকান কার্ল (American Curl); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকান ববটেইল (American Bobtail); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাষ্ট্র
বারমিল্লা (Burmilla); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাজ্য
হাইল্যান্ডার (Highlander); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাষ্ট্র
জাপানিজ ববটেইল (Japanese Bobtail); প্রাপ্তিস্থান: জাপান
কোরিয়ান ববটেইল (Korean Bobtail); প্রাপ্তিস্থান: কোরিয়া
কুরিলিয়ান ববটেইল বা কুরিল দ্বীপের ববটেইল (Kurilian Bobtail, or Kuril Islands Bobtail); প্রাপ্তিস্থান: পূর্ব রাশিয়া ও জাপান
ম্যাঙ্কক্স (Manx); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাজ্য (আইল্যাণ্ড অব ম্যান)
স্কটিশ ফোল্ড (Scottish Fold); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাজ্য (স্কটল্যাণ্ড)
মিনস্কিন (Minskin); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাষ্ট্র
এ্যাবিসিনিয়ান (Abyssinian); প্রাপ্তিস্থান: ইথিওপিয়া
আমেরিকান শর্টহেয়ার (American Shorthair); প্রাপ্তিস্থান: যুক্তরাষ্ট্র
এ্যারাবিয়ান মাউ (Arabian Mau); প্রাপ্তিস্থান: আরব্য দ্বীপসমূহ
অস্ট্রেলিয়ান মিষ্ট (Australian Mist); প্রাপ্তিস্থান: অস্ট্রেলিয়া
এশিয়ান (Asian) মূল নেয়া হয়েছে এশিয়া থেকে
বেঙ্গল (Bengal); গড়ে তোলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে
বোম্বে (Bombay); প্রাপ্তিস্থান: এশিয়া; গড়ে তোলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে
বিড়ালের বৈশিষ্ট্য
বিড়াল নিশাচর প্রাণী। বিড়ালের চোখের রেটিনা কুইনাইন নামক একটি পদার্থ দ্বারা আবৃত, যার কারণে এদের চোখ আলোক সংবেদনশীল হয়। এ কারণে রাতের বেলায় আমরা বিড়ালের চোখ জ্বলতে দেখি। বিড়ালের চোখের পর্দা তিনস্তর বিশিষ্ট। এদের ঘ্রাণশক্তি খুবই উন্নত। এরা শুধুমাত্র ঘ্রাণ নিয়ে তারপর খাবার খায়। কোনো বিড়ালের নাকের ভেতরে যদি মাংস বেড়ে যায় অথবা কোন কারণে নাক বন্ধ হয়ে যায়, সেই কয়দিন তারা খাওয়ায় রুচি হারিয়ে ফেলে এবং আস্তে আস্তে রোগা হয়ে যায়। বিড়ালের শ্রবণশক্তি মানুষের তুলনায় ৬ গুণ বেশি। এজন্য এরা কোনো শব্দ শুনলে খুব দ্রুতই ঘাড় মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে এবং খুব সামান্য শব্দেই চমকে যায়।
বিড়াল খুবই আকর্ষণপ্রিয়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোনো বাড়িতে যদি একই সাথে একটি ছোট বাচ্চা এবং একটি বিড়াল থাকে, তাহলে বিড়ালটি ওই বাচ্চাটিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। কারণ স্বভাবতই বাচ্চাটির প্রতি সকলের আদর-যত্ন একটু বেশিই থাকে। আরো একটি মজার বৈশিষ্ট্য হলো, বিড়াল মানুষের কাছে গেলেই বুঝতে পারে সে বিড়াল পছন্দ করে কিনা। বিড়াল পছন্দ করে না এমন মানুষের কাছে এরা খুব একটা ঘেঁষে না।
বিড়ালের আরো কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য
১. বিড়াল যদি মেঝেতে খুব গড়াগড়ি খায় তখন আপনাকে বুঝতে হবে সে এই মুহূর্তে কিছুটা সময় চাচ্ছে এবং খেলতে চাচ্ছে। অনেক বিড়াল তার মনিবের বাইরে যাবার সময় এমনটি করে থাকে যাতে তাকেও সাথে নেয়া হয়। এটা দৃষ্টি আকর্ষণ করার এক সুন্দর পদ্ধতি। সত্যিই তো! এভাবে যদি পোষা বিড়ালটি কাছে এসে গড়াগড়ি দেয়, তাহলে তাকে রেখে কি কোথাও যাওয়া সম্ভব?
২. বিড়াল সবটুকু খাবার শেষ করে না। অনেক সময় ধরে খেয়ে খাবারের কিছু অংশ বাঁচিয়ে রাখে। মজার ব্যাপার হলো এমনটি সে তার মনিব থেকেই শিখে। যে সকল বাড়িতে মনিব তার বেঁচে যাওয়া খাবার থেকে বিড়ালকে খেতে দেয়, সেই সকল বাড়িতেই বিড়ালগুলো নিজের খাবার মনিবের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে শেখে।
৩. বিড়াল সাধারণত মাংসাশী প্রাণী। কিন্তু যখন ঘাস পাতা খেতে শুরু করে তখন খুব অদ্ভুত লাগে তাই না? আসলে বিড়ালের ঘাস খাবার পেছনে কারণ হলো এরা ঘাস থেকে এক ধরণের ভিটামিন পায়। কখনো কখনো নিজের গা চুলকাতে গিয়ে মুখে জড়িয়ে যাওয়া পশম ছাড়াতেও এরা ঘাসের সাহায্য নেয়।
৪. অনেক সময় দেখা যায় বিড়াল তার পা আরেক বিড়ালের গায়ে অথবা মেঝেতে পিষছে। এর কারণ হলো তারা অন্য বিড়ালের প্রতি যত্ন বা মমতা দেখায় অথবা নিজের পায়ের রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখতে এরা এমন করে থাকে। অনেক সময় বাচ্চা বিড়াল তার মায়ের বুকের দুধ ঠিকমত না পেলে তখন মায়ের গায়ে এভাবে পা ঘষতে থাকে।
৫. বিড়ালেরা ফোনের প্রতি আসক্ত। যারা বিড়াল পালেন, তারা লক্ষ্য করে থাকবেন ফোনটি বেজে উঠলেই বাড়ির বিড়ালটি সবার আগে দৌড়ে ফোনের কাছে চলে যায়। এর কারণ হলো কৌতুহল। এরা বোঝার চেষ্টা করে আসলে ফোনে কীভাবে কথা বলা যায় অথবা কার সাথে কথা বলা যায় কিংবা কাউকে দেখা যাচ্ছে না তবুও মনিব কার সাথে কথা বলছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিড়াল সাধারণত ফোনের কাছে সবার আগে দৌড়ে যায়। তাছাড়া এরা আরও লক্ষ্য করে যে ফোনে কথা বলার সময় তাদের প্রতি মনিবের মনোযোগ কিছুটা কমে যায়। তাই মনোযোগ কেড়ে নেয়া উৎসটি তারা নিজেরাই এত আগ্রহ নিয়ে দেখে।
বিড়াল নিয়ে যত গবেষণা করা হবে ততই এর সম্পর্কে আরও নতুন নতুন তথ্য বেরোবে। মানুষের চেয়েও বিড়াল যেন বেশিই রহস্যময় প্রাণী।
ফিচার ছবিসূত্র- readersdigest.cat