পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণী কোনো না কোনোভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। খাদ্যচক্রের সব প্রাণী তৃণভোজী না হলেও তৃণভোজী প্রাণীদের উপর নির্ভর করে সকল মাংসাশী প্রাণী। খাবারের জন্য মানুষ প্রায় সম্পূর্ণরূপেই উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। খাবার ছাড়াও মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম উপাদান বাসস্থান ও চিকিৎসাও সরাসরিভাবে উদ্ভিদের সাথে নির্ভরশীল। গাছের ছায়া গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে পথিককে সামান্য জিরিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই নির্ভর করে গাছের উপর। আগেকার দিনে গ্রামে প্রাচীন বটগাছের নিচে বসতো মেলা, প্রাচীন গাছ নিয়ে শোনা যেতো নানারকম কিংবদন্তী। কখনো কি মনে হয়েছে একটি গাছ কতদিন বাঁচে কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী গাছ কোনগুলো? এর আগে বলেছিলাম সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের কথা, এবার বলব সবচেয়ে দীর্ঘজীবী গাছেদের কথা। স্বাভাবিকভাবেই, শুধুমাত্র বহুকোষী গাছের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এই তালিকা।
পান্ডো, উতাহ (যুক্তরাষ্ট্র)
গাছের বয়স নির্ধারণ করা হয় মূলত কান্ডের বয়সরেখা থেকে। তবে কিছু গাছ রয়েছে যারা ক্লোনের মাধ্যমে একটি কলোনির মতো তৈরি করে নেয়। কিন্তু মাটির উপরে নতুন কান্ড হলেও মাটির নিচে সেই গাছটির মূল থাকে একই, একটি নেটওয়ার্কের মতো ছড়িয়ে। প্রতিটি গাছই জেনেটিকালি একইরকম হয়। ফলে এই গাছগুলোর কান্ড নতুন হলেও বয়স নির্ধারণ করা হয় মূলের মাধ্যমে। এটি সেরকমই একটি গাছ।
পান্ডোর কান্ড ১৫০ বছরের মতো বাঁচলেও এর মূলের বয়স চমকে দেবার মতো! বিজ্ঞানীদের ধারণা এর মূলের বয়স অন্তত ৮০ হাজার বছর। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ৮০ হাজার বছর আগে, যখন পৃথিবী ছিল পুরোই আলাদা এক জগত। দক্ষিণ-মধ্য উতাহর ফিসলেক ন্যাশনাল পার্কে রয়েছে পান্ডোর একটি উপবন। প্রায় ১০০ একর জায়গায় রয়েছে ৪৭ হাজারের মতো কান্ড, সবগুলোই একই মূল থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং সবগুলোর জেনেটিক সিকোয়েন্স একই। বলা চলে, পুরো এলাকা জুড়ে একটিই গাছ!
ওল্ড জিক্কো, সুইডেন
পান্ডোর মতো এটিও একটি ক্লোনাল গাছ, তবে পান্ডোর সাথে এর পার্থক্য এটি একা। ওল্ড জিক্কো আবিষ্কার হয় ২০০৮ সালে, ধারণা করা হয় এটি এর প্রাচীন মূলের একমাত্র জীবিত কান্ড। বিরূপ পরিবেশের কারণে অন্যগুলো মারা গিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মূলের কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে এর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৯,৫৫০ বছর।
সুইডেনের ফুলুফজ্যালেট পর্বতে রয়েছে এই সুপ্রাচীন গাছটি। উমেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এর আশেপাশে চার প্রজন্ম পুরনো কাঠের ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন যেগুলোর কোনো কোনোটি প্রায় ৮,০০০ বছর পুরনো। এই গাছের মূলের যখন জন্ম, তখন চলছিল বরফ যুগ। অর্থাৎ পুরো পৃথিবী তখন ঢেকে গিয়েছিল বরফে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জও বরফের কারণে ইউরোপের মূল ভূমির সাথে যুক্ত ছিল। সেই ভয়াবহ আবহাওয়া পেরিয়ে আসা এই গাছের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত, আর এই চিন্তার কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ।
Pinus longaeva, ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র)
নন ক্লোনাল গাছগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো গাছের বেশিরভাগই Pinus longaeva প্রজাতির। এর মধ্যে মেথুসেলাহ নামের একটি গাছ সবচেয়ে পুরনো গাছ হিসেবে টিকে ছিল ২০১২ সাল পর্যন্ত, যার বর্তমান বয়স প্রায় ৪,৮৪৯ বছর। অর্থাৎ এর মূল এবং কান্ড দুটোই প্রায় পাঁচ হাজার বছর পুরনো! এটি মূলত এক ধরণের পাইন গাছ। ক্যালিফোর্নিয়ার ইনয়ো জাতীয় বনে এ গাছের অবস্থান যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার মিটার উপরে হোয়াইট মাউন্টেনে অবস্থিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Pinus longaeva, যা এখনো জীবিত।
১৯৫৭ সালে এডমন্ড স্কুলম্যান এবং টম হারলান প্রথম এ গাছের বয়স নির্ধারণ করেন ৪,৭৮৯ বছর, সে হিসেবে এর জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ২,৮৩৩ সালে। গিজার গ্রেট পিরামিড তৈরি শেষ হয় খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৬০ সালে। এর মানে গ্রেট পিরামিডেরও প্রায় দু’শ বছর আগে জন্ম এই গাছের!
২০১২ সালে মেথুসেলাহকে হারিয়ে ৫,০৬২ বছরের (২০১২ সালে) আরেকটি Pinus longaeva পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী নন ক্লোনাল গাছ হিসেবে রেকর্ড বুকে জায়গা করে নেয়। এ গাছটিও ক্যালিফোর্নিয়ার হোয়াইট মাউন্টেনে অবস্থিত। নিরাপত্তা এবং অযাচিত দর্শনার্থীদের এড়াতে এ দুটি গাছের সম্পূর্ণ অবস্থান বিজ্ঞানীরা ছাড়া আর কেউ জানে না।
তবে এদের ছাড়িয়ে একই জায়গার একই প্রজাতির আরেকটি গাছ হতে পারতো সবচেয়ে দীর্ঘজীবী গাছ। ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞানীরা বয়স নির্ধারণের জন্য গাছটি কেটে ফেলেন, এরপর দেখা যায় গাছটির বয়স ৪,৮৪৪ বছর। পরে গাছটির নাম দেয়া হয় ‘প্রমিথিউস’।
ল্যানগারনিউ ইউ, ওয়েলস
উত্তর ওয়েলসের ল্যানগারনিউ গ্রামের একটি ইউ গাছ এটি। গ্রামের সেইন্ট ডিজিয়ান্স চার্চের উঠোনে রয়েছে গাছটি। গাছটির মূল অংশ বর্তমানে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেও গাছটি টিকে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। গাছটির বয়স ঠিক কত সে ব্যাপারে বেশ বিতর্ক রয়েছে, তবে ধারণা করা হয় গাছটির বয়স চার থেকে পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে। সে হিসেবে ব্রিটেনের ব্রোঞ্জ যুগে এ গাছের জন্ম।
২০০২ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ট্রি কাউন্সিল এই গাছটিকে ব্রিটেনের সেরা ৫০ গাছের তালিকায় স্থান দেয়। সেইন্ট ডিজিয়ান্স চার্চ তের শতকের দিতে তৈরি হলেও সে স্থানে আগে প্যাগান মন্দির ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন।
মাটির কাছে এর কান্ডের পরিধি প্রায় ১১ মিটার! এতো বিশাল গাছ হবার পরেও ১৯৯৫ সালের আগে এ গাছটি গবেষকদের চোখেই পড়েনি।
সার্ভ-এ-আবার্কুহ, ইরান
মধ্য ইরানের আবার্কুহ শহরে অবস্থিত এ গাছটি একটি সাইপ্রেস গাছ যার বয়স প্রায় চার হাজার বছর। এটি ‘জরাথ্রুস্ট সার্ভ’ নামেও পরিচিত। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, হযরত নূহ (আ)-এর ছেলে এই গাছটি রোপণ করেছিলেন, তবে ঐতিহাসিক সময়সীমা আর গাছের বয়সের সাথে তুলনা করলে এ কিংবদন্তী ধোপে টেকে না। আবার অনেকেই বলে থাকেন জরাথ্রুস্ট ধর্মের প্রবর্তক নিজে এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এ তথ্যেরও কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই।
পারস্য সাম্রাজ্যের সময় গাছটি একটি বাগানের অংশ ছিল বলে ধারণা করা হয়। আবার্কুহ শহরের প্রায় ২১ হাজার মানুষের বাস, এর মাঝেও মাথা উঁচু করে টিকে আছে এই প্রাচীন গাছটি। এটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী গাছ। গাছটি প্রায় ২৫ মিটার লম্বা এবং এর কান্ডের পরিধি প্রায় ১১.৫ মিটার। বেশ কয়েকবার এই গাছটিকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হলেও সেগুলো সফল হয়নি।
Fitzroya cupressoides, চিলি/আর্জেন্টিনা
দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে এই প্রজাতির গাছগুলো দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকা গাছের অসাধারণ উদাহরণ। এরা যে শুধু দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে তা-ই নয়, বরং এরা একইসাথে উচ্চতম গাছগুলোর মধ্যেও অন্যতম হয়ে আছে। এদের উচ্চতা ৪০-৬০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, আর্জেন্টিনার কিছু গাছ ৭০ মিটার পর্যন্ত লম্বাও আছে ।
১৯৯৩ সালে চিলিতে এ প্রজাতির একটি গাছ পাওয়া যায় যার বয়স ৩৬২২ বছর। এ গাছের নামকরণ করেছিলেন চার্লস ডারউইন, তার জাহাজের ক্যাপ্টেনের নামানুসারে। এ গাছটিকে স্থানীয়ভাবে ‘অ্যালেরক’ নামে ডাকা হয়। চিরসবুজ এই গাছগুলো গত দু’শতাব্দী ধরে ব্যাপকহারে কাটা হচ্ছে কাঠের জন্য। ১৯৭৬ সালের পর চিলি সরকার এ প্রজাতির গাছ কাটা নিষিদ্ধ করলেও আইনের ফাঁক গলে অনেকেই এখনো গাছ কেটেই যাচ্ছে।
Sequoiadendron giganteum, ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র)
এ প্রজাতির গাছগুলো ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাডা পর্বতে বৃদ্ধি লাভ করেছে। বর্তমানে এ প্রজাতির অনেক গাছ থাকলেও সবচেয়ে পুরনোগুলো মারা গিয়েছে কিংবা গবেষণার জন্য কেটে ফেলা হয়েছে। এ প্রজাতির সবচেয়ে পুরাতন গাছগুলোকে বিভিন্ন কোড নাম দিয়ে ডাকা হয়। যেমন: ‘CBR 26’ কোড নামের গাছটি যখন মারা যায়, তখন এর বয়স ছিল ৩,২৬৬ বছর। ‘D-21’-এর বয়স ছিল ৩,২২০ বছর ‘D-23’-এর বয়স ছিল ৩,০৭৫ বছর। এ গাছগুলোকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই ১৯৩০ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ট্রি রিং রিসার্চ প্রোগ্রামের, যা বর্তমানে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী গাছ শনাক্ত এবং পরিচর্যার কাজ করে চলছে।
জমন সুগি, জাপান
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এ গাছটি জাপানের ইয়াকুশিমায় অবস্থিত। মজার ব্যাপার হলো, গাছটির বয়স নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, গাছটির বয়স দু’হাজার বছরের পক্ষেও যেমন মত আছে, তেমনি আবার পাঁচ হাজার বছরের পক্ষেও অনেক গবেষক সম্মতি দিয়ে থাকেন। এখন পর্যন্ত গাছটির সঠিক বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। কারণ এর জন্য গাছের প্রধান কান্ড কেটে দেখতে হবে, যা করতে গেলে গাছটি মারা যাবে। তাই বিভিন্ন উপায়ে গবেষকরা এর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করলেও কোনো সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি। তবে এর বয়স যে অন্তত দু’হাজার বছর এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকা এক প্রাণের উদাহরণ হিসেবে এই গাছটির কথা বলাই যায়।
লম্বায় প্রায় ২৫ মিটার গাছটির কান্ডের পরিধি প্রায় ১৬ মিটার। এ প্রজাতির গাছগুলো এদের বাকলের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে রেজিন তৈরি করে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। আশেপাশের প্রকৃতির বৈরিতা রক্ষার এ উপায় আবার তাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের জন্য। কাটতে এবং আকৃতি দিতে সহজ হওয়ায় বিভিন্ন আসবাবপত্র এবং ঘরবাড়ি বানানোর জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে এ প্রজাতির গাছগুলো। তবে গবেষকরা এই একটি গাছকে আগলে রেখেছেন।
একশত ঘোড়ার কাঠবাদাম গাছ, সিসিলি (ইটালি)
সিসিলির মাউন্ট এটনা আগ্নেয়গিরি থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে এ গাছের অবস্থান। প্রচলিত আছে আরাগনের রাজকুমারী জিওভান্না মাউন্ট এটনায় যাচ্ছিলেন, তার দেহরক্ষী হিসেবে ছিল একশ জন নাইট। বিদ্যুতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা এ গাছের নিচে অবস্থান নিয়েছিলো, সে থেকেই গাছটির এমন নাম। গাছটির ঘের প্রায় ১৯০ ফুটের কাছাকাছি, সুতরাং খুব স্বাভাবিক যে ১০০ জন নাইট এ গাছের নিচে সহজেই আশ্রয় নিতে পারবে।
গাছটির বয়স দুই থেকে চার হাজার বছর পর্যন্ত হতে পারে। বয়স নিয়ে অনেকেই গবেষণা করছেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট বয়স বের করা সম্ভব হয়নি। পর্যটকদের কারণে যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে কারণে গাছটি বর্তমানে ঘিরে রাখা হয়েছে, তবে দূর থেকে পর্যটকরা গাছটি দেখতে পারে।
এ তালিকার বাইরেও অনেক গাছ রয়েছে যেগুলোর বয়স হাজার বছরেরও বেশি। ২,০০০ বছরের কম যেগুলোর বয়স সেগুলোকে এ তালিকায় স্থান দেয়া হয়নি। মানুষের নানারকম চাহিদা মেটাতে আজ অনেক প্রজাতির গাছ বিপন্ন প্রায়। এরপরও এসব গাছ টিকে রয়েছে সদর্পে, স্বমহিমায়।