গ্রেট হোয়াইট হাঙর বা সাদা হাঙর সাগরের সবচেয়ে বড় শিকারি মাছ, যারা ৩০০০ পাউন্ডেরও (২২৬৮ কিলোগ্রাম) বেশি ওজনের হয়ে থাকে এবং এই হাঙরগুলো ১৫ থেকে ২০ ফুট বা এরও বেশি দৈর্ঘ্যের হতে পারে। যদিও এরাই সবচেয়ে বড় হাঙর নয়। মহাসাগরের এই দৈত্যকে মনে করা হয় পানিতে বাস করা এক সুপারহিরো। কারণ, এরা বিশাল ও বড়, প্রায় মানুষের সমান জীবনকাল এদের, দ্রুত নিজেদের ক্ষত সেরে তুলতে পারে এরা এবং ক্যান্সার এদের খুব একটা আক্রান্ত করতে পারে না!
গবেষকরা অনেক দিন ধরেই হোয়াইট হাঙরের আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন। অবশেষে, এই হাঙরের সম্পূর্ণ জিনোম ডিকোড করার পর উঠে এসেছে বৈশিষ্ট্যগুলোর নিমিত্তে সম্ভাব্য বেশ কিছু উত্তর। হাঙর রিসার্চ সেন্টার ও গাই হার্ভে ফাউন্ডেশনের একদল গবেষক হোয়াইট হাঙরের জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ করেছেন এবং সেগুলো আরও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের সাথে তুলনা করেছেন। ফলাফল হিসেবে উঠে এসেছে সাগরের প্রাচীন এই দৈত্য সম্বন্ধে দারুণ সব অজানা ও অসাধারণ সব তথ্য।
গ্রেট হোয়াইট হাঙরের জিনোমে ৪.৬৩ বিলিয়ন বেস পেয়ার (Base Pair) রয়েছে, যা মানুষের জিনোমের তুলনায় ১.৫ গুন বেশি! সহজেই অনুমেয়, বিশাল এই প্রাণীর জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ করা কোনো সহজ ব্যাপার ছিল না। মানুষের জিনোমের সাথে এই হাঙরের জিনোমের আরও একটি মিল রয়েছে। তা হলো, মানুষের জিনোমের মতোই এদের জিনোমও গঠিত হয়েছে পুনরাবৃত্ত জেনেটিক বিন্যাসের মাধ্যমে। এই পুনরাবৃত্ত জেনেটিক বিন্যাস দ্বারা গঠিত জিনোমের বিভিন্ন অংশে আবার LINEs নামের একটি বিশেষ জিন রয়েছে, যা এই হাঙরগুলোকে বিশেষ সক্ষমতা দিয়েছে। এগুলো প্রায়ই নিজেদের অনুলিপি তৈরি করতে থাকে এবং জিনোমের বিভিন্ন অংশে নিজেদের জন্য জায়গা করে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় LINEs জিনগুলো ডিএনএ’তে ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড (Double-stranded) ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি করে এবং এই কারণে ডিএনএগুলোর মেরামতেরও প্রয়োজন হয়। ডিএনএ’তে ক্রমাগত এই ভাঙনের ফলেই জিনোম অস্থিতিশীল অবস্থায় থাকে এবং এখান থেকে জেনেটিক মিউটেশনের মতো মারাত্মক ঝুঁকির সাথে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে।
কিন্তু, হোয়াইট হাঙরের মধ্যে এ ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যায় না। বিবর্তনের ধারায় কোনোভাবে এরা জিনোমের এই অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে।
জিনোমের অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী জিন রয়েছে, তেমনি আরও কয়েকটি জিন রয়েছে এই হাঙরদের জিনোমে। এই জিনগুলো আবার কাজ করে জেনেটিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিএনএ মেরামত করার জিন এবং টিউমার হতে বাধা দেয় এমন জিন। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জিনোম স্থিতিশীলতার সাথে এই হাঙরের জিনোম স্থিতিশীলতার পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এই ধরনের নির্দিষ্ট কিছু নমুনা বা জিন, যেগুলো বিবর্তনের ধারায় এই হাঙরগুলোকে দিয়েছে অসাধারণ সক্ষমতা। অন্য যেকোনো প্রাণীর চেয়ে এই হাঙরগুলোর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকার অন্যতম কারণ সম্ভবত এই বিশেষ জিনগুলো। গবেষকদের মতে, ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে আপনার জিনোমে এই ধরনের স্থিতিশীলতা জরুরি, অর্থাৎ যেকোনো ধরনের জেনেটিক মিউটেশন এড়িয়ে চলার সক্ষমতা। অতিরিক্ত জেনেটিক মিউটেশনই ক্যান্সারের মুখে ঠেলে দেয়, যেহেতু এই হাঙরগুলো তা প্রতিরোধ করতে পারে, তাই তারা সহজেই এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও রাখে। ভবিষ্যৎ ক্যান্সার গবেষণায় যে এই আবিষ্কার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে, তা বলা বাহুল্য। গবেষকদের দাবি, মানুষের ক্যান্সার প্রতিরোধে অবশ্যই এই হাঙরগুলো থেকে তৈরি কিছু খেলেই কাজ হবে এমন নয়, তবে বিকল্প ঔষধ তৈরিতে তা ভূমিকা রাখতে পারে।
সাদা এই হাঙরের আরেকটি সুপার পাওয়ার বা অসাধারণ ক্ষমতা হলো, দ্রুত ক্ষত সারিয়ে তোলার দুর্দান্ত সক্ষমতা। এই ক্ষমতার পেছনেও অবশ্যই বিশেষ জিনের ভূমিকা রয়েছে, যা একইসাথে ক্ষত সারিয়ে তুলতে এবং এদের জিনোমে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জিনোমে থাকা এই ধরনের জিনের চেয়ে, এই হাঙরগুলোর জিনোমে বিশেষ এই জিনগুলোর পরিমাণ অনেক বেশি। বিবর্তনের ধারায় পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই হাঙরগুলোর জিনোমে এ ধরনের জিনের আধিক্য লক্ষণীয়, যা অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে তুলনামূলক কম।
হাঙরের অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্যের পেছনের কারিগর হিসেবে গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন জিনোমের বিশেষ কিছু জিনের ভূমিকা। কিন্তু, একটি বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার জন্য এখনও জিনোম সিকোয়েন্সে যথেষ্ট তথ্য খুঁজ পায়নি গবেষক দলটি।
হাঙরের ঘ্রাণশক্তি দুর্দান্ত। প্রচলিত রয়েছে, এরা প্রায় এক মাইল দূর থেকেও এক ফোঁটা রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে থাকে! যদিও পুরোটাই লোকমুখে প্রচলিত এবং একবারেই সত্যি নয়। গবেষকরা আশা করেছিলেন যে, ঘ্রাণ শক্তির ব্যাখ্যা করার জন্য এদের জিনোমে অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টর বা OR জিন পাওয়া যাবে। তবে এই হাঙরগুলোর জিনোমে এই ধরনের জিনের সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে খুব একটা বেশি নয়। তবে গবেষকরা ভমেরনাসাল (Vomeronasal) নামের এক ধরনের জিন খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলো তাদের অসাধারণ ঘ্রাণনেওয়ার শক্তির পিছনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এই গবেষণায় উঠে আসা তথ্যগুলো শুধু এই সাদা দৈত্যের জিনোম গবেষণা নয়, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আরও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও। তবে গবেষকরা স্বীকার করছেন যে, আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে এবং এই জিনোম সিকোয়েন্স এই হাঙরগুলোর অসাধারণ ক্ষমতার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া শুরু করেছে মাত্র।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বিবর্তনের পরিক্রমায় এই হোয়াইট হাঙরগুলো দুর্দান্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেও, সংখ্যায় এরা কমে যাচ্ছে প্রতি বছর। প্রায় প্রতি বছর ১০০ মিলিয়নের মতো হাঙর শিকার করা হয়, এগুলোর মধ্যে সাগরের এই বিশাল দৈত্যও রয়েছে। হাঙর শিকারের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এদের স্যুপ তৈরির জন্য এদের পাখা সংগ্রহ, ভুয়া মেডিকেল সংক্রান্ত গবেষণাসহ আরও অন্যান্য নানা কারণে। অনেক সময় দেখা যায়, শুধু পাখা সংগ্রহ করার পর হাঙর ছেড়ে দেওয়া হয় মৃত্যুর মুখে, যা খুবই অমানবিক।
বিভিন্ন সিনেমা ও টিভি সিরিজে এই হাঙ্গরদের দেখানো হয় অত্যন্ত হিংস্র ও মানুষের জন্য মারাত্মক বিপদজনক হিসেবে। সত্যি হল, বছরে মানুষ যত হাঙর হত্যা করে, হাঙর সেই সংখ্যার ধারেকাছেও মানুষ হত্যা করে না। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে সক্ষম হলেও, এই পৃথিবীর মানুষের হিংস্রতার বিপরীতে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। যদি না মানুষ নিজে থেকে বুঝতে সক্ষম না হয় যে, পরিবেশের জন্য এই প্রাণীগুলো অতটা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরাও এমনটাই আশা করছেন, তাদের গবেষণার ফলাফল হয়ত মানুষকে বুঝতে সাহায্য করবে এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি। আশা করা যেতেই পারে, খুব বেশি দেরি হওয়ায় পূর্বেই মানুষ খুব দ্রুত বুঝতে পারবে এই অমোঘ সত্য।